সন্ধ্যা, ৬। ৩৯ । ।
বাইরে এখন অঝোরে বৃষ্টি ঝরছে।
হয়তো এবারের মত শ্রাবণকে বিদায় জানানোর সময়টা কড়া নাড়ছে দুয়ারে।
ক্লান্তিকর ক্লাস,চিরচেনা একাকীত্ব আর বৃষ্টিভেজা দিন। সব মিলিয়ে মনটা আজ ভীষণ খারাপ।
গত বর্ষা বর্তমানকে ভুলে অতীতে ফিরে যাওয়ার এক অদ্ভুত স্মৃতি উপহার দিয়েছিলো আমায়। আজ এই বাদল দিনে,ফিরে দেখা কিছু অতীতে তাই ঠাই করে নিয়েছে সেই বৃত্তহীন অতীতটাও।
গত বর্ষার শেষের দিকের কথা।
ক্লাস শেষে একদিন বাড়ি ফিরছিলাম আমি।
তখনি হঠাৎ ফোনের রিংটা বেজে উঠলো। না,মিস্ড কল না। কল।
আমার এক বন্ধু বলতো,মেয়েরা নাকি ফোন করে না, কেবল মিস্ড কল দেয়(কথাটার সত্যতা আমি যাচাই করার সুযোগ পাইনি) কিন্তু আমার ইনি বেশ অন্য রকম।
সে আবার দুটোই সমানে দেয়। সে যাই হোক।
ফোনটা ধরতেই ভেসে আসলো ওর জাদুকরী কণ্ঠ।
''আমার কন্ঠ হতে গান কে নিল ভুলায়ে, সে যে বাসা বাঁধে নীরব মনের কুলায়ে। ''
বলতে দ্বিধা নেই ওর কণ্ঠটা আমার কাছে শোনা পৃথিবীর সুন্দরতম কণ্ঠ।
কোকিল কণ্ঠী বললেও হয়তো বেশী হবেনা।
কেননা ওর সবটুকু প্রশংসাই আমি নিজের মনের কাঁচের ঘরে তুলে রেখে দেই,সযত্নে।
আমারি কাছে।
তাই আমার ইচ্ছেমত আমি ওর প্রশংসা করি। নিজের মত করে।
''আমার একটা পেন ড্রাইভ লাগবে। ঠিক ৩০ মিনিট এর মধ্যে। দিতে পারবে?''
অবাক হলাম আমি। কি বলবো ঠিক বুঝতে পারছিলাম না। একটু ভীত কণ্ঠে তবুও বললাম,
''দেখ,আমি এখন কলাবাগানে ।
রাস্তায় অনেক জ্যাম,৩০ মিনিটের মধ্যে কি করে পারবো? ''
''আমি কিছু জানিনা। পারবে কি না? ''
আমি কিছু বললাম না। আমি জানি, ও ধরে নিয়েছিলো আমি পারবোনা।
তাই একটা নীরব অভিমান কণ্ঠে নিয়ে ফোনটা রেখে দিল ও।
আমি নিজেও সেটাই ভাবলাম।
ধুর এটা কোনোভাবেই সম্ভব না। যেই জ্যাম,এর মাঝে ৩০ মিনিটে হুমায়ন রোড। নট পসিবল।
একে তো আমার কাছে পেন ড্রাইভ নেই। দুই গাড়ি কোন ভাবেই এই জ্যাম থেকে বের হতে পারবেনা।
তাই মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলাম,যাবনা। কিন্তু পরক্ষনেই,ওর ভুবন ভুলানো হাঁসি মাখা মুখে রাজ্যের সব বিষাদ নেমে আসবে,এটা ভেবে কেমন জানি মুষড়ে পড়লাম আমি। ভাবলাম,ওর জন্য এটুকু করতে পারবোনা আমি। কিসের এত ভালোবাসা তাহলে? কিন্তু কিই বা করি, এতো জ্যাম। বিপাকে পড়ে গেলাম আমি।
হঠাৎ একটা আইডিয়া এলো মাথায়। আমার মাথাটা খুব তাড়াতাড়ি রেসপন্স না দিলেও দেরিতে যেটা দেয় সেটা বেশ কাজের হয়। আজকেও তাই। একটা আইডিয়া আসলো অবশেষে।
দেখি এটা ট্রাই করে ।
আইডিয়াটা মন্দ না। (আমার কাছে মনে হল আর কি!)
ড্রাইভার কে বললাম জরুরি একটা কাজ আছে। আপনি আসেন। আমি কিছুটা হেঁটে তারপর রিকশা নিচ্ছি।
কিছুটা পথ হেঁটে,না হেঁটে বললে ভুল হবে।
কিছুটা পথ দৌড়ে কোনোমতে একটা রিকশা নিলাম আমি।
গন্তব্য। তাজমহল রোড,অভিকদের বাসা।
ওকে ফোন দিয়ে একটা পেন ড্রাইভ মেনেজ করতে বললাম ১ দিনের জন্য।
জানতাম কাজটা আহামরি কিছু না।
ও মানাও করলনা।
ভাগ্যটা ভাল ছিল আমার। অস্থিরতায় কাটানো হাজারো সেই মুহূর্ত কাঁটিয়ে ওর বাসার সামনে পৌঁছে দেখি,দুপুর ২ টা ৫২।
আরও ৮ মিনিট বাকি।
এই যাত্রায় বেঁচে গেলাম, বলে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লাম আমি ।
মনে কিছুটা বিজয়ের ধ্বনি বাজিয়ে তখনই ওকে কল দিলাম আমি।
সেকি। ও ফোন ধরেনা।
১,২,৩,৪।
।
ঠিক চারবারের মাথায় ফোনটা ধরলেন উনি।
কি হল? এত কল দিচ্ছ কেন? বাসায় নাকি এখনও রাস্তায় ?
তোমার বাসার সামনে।
কি??? মনোভঙ্গির অদ্ভুত সরলতায়, চরমভাবে অবাক হল ও।
সত্যি?
হুম,সত্যি। বিশ্বাস না হলে বারান্দায় আসো।
আসছি। ঘুম জড়ানো কণ্ঠে বলল ও। আসছি ,তবে বারান্দায় না। বাসার নীচে।
ওর আসতে কিছুটা সময় লাগছিল।
আমি সেই সময়টাতে তাই, বাইরে দাড়িয়ে রইলাম।
বলতে দ্বিধা নেই,ওদের বাসার বাইরে দাঁড়ানোটা আমার জন্য অভ্যাস, না অভ্যাস নয় বরং অনেকটা ভালো লাগায় দাঁড়িয়ে গেছিলো। প্রতিদিন স্কুল বন্ধুদের সাথে আড্ডার বাহানায় ওর সাথে দেখা করতে যাওয়া, আর বাইরে না বের হতে পেরে ৩ তলার জানালা থেকে ওর আমাকে দেখা আর আমার পাগলামো দেখে স্নিগ্ধ একটা হাঁসির ঝলক দেওয়া।
এটা কিভাবে মিস করতাম আমি। ?
ওর সাথে দেখা করা আর ফোনালাপ এই দুই এর চক্করে আমার ছেলেবেলার সবচেয়ে প্রিয় অবসর কাজ, ক্রিকেট খেলা ছাড়া হয় আমার।
স্কুল ফ্রেন্ডরা এই নিয়ে আমাকে অনেক কথা শুনাতো। মাঝের সময়টাতে ওদের নাকি ভুলেই গেছিলাম আমি।
স্পেশাল কারো জন্য।
যাই হোক। ফিরে আসি সেই মুহূর্তটির স্মৃতিচারণে,।
কি আশ্চর্য !তখনই বাইরে হঠাৎ বৃষ্টি শুরু হল ।
এ নিয়ে ৪ বার এ মাসে ওর সাথে দেখা করতে ওর বাসায় এলাম আমি। আশ্চর্য ৪ বারই বৃষ্টি নামলো। (লিখাটাকে কাকতালীয় করার জন্য বলছিনা, সত্যিই)
বর্ষাকালে বৃষ্টি নামবে এটাই স্বাভাবিক। তবে ঠিক তখনি যখন আমি ওর বাসার সামনে এসে পৌঁছলাম।
একটু হলেও অবাক করার মত।
আজো একই ঘটনা। কি আশ্চর্য?
আমার কাছে তখন ছাতা ছিলোনা। আর বৃষ্টিতে ভেজা আমার জন্য তখন মানা। অন্তত গায়ে কিছুটা জ্বর থাকা অবস্থায় তো অবশ্যই।
অনুপায় হয়ে আমি ওদের বাসার পাশের দোকানটায় গিয়ে আশ্রয় নিলাম । দোকানের লোকগুলির সাথে অনেক ক্ষণ ধরে দাড়িয়ে আমি আনমনে বৃষ্টি দেখছিলাম। আর ওর জন্য ক্লান্তিহীন একটা অপেক্ষা করছিলাম,সেটা বোধ হয় না বললেও হয়।
হঠাৎ দেখি ছাতা নিয়ে কে জানি বৃষ্টির মাঝে দূর থেকে ডাকছিল আমায়।
একটা মধুর কণ্ঠে আমার নামটা শুনে বুঝতে দেরি হলনা।
ওটা ও।
দোকানের লোকগুলোও কিছুটা অবাক হল। আমিও কিছুটা লজ্জা পেলাম। এতগুলি লোকের সামনে ও যেভাবে আমাকে ডাকছিল।
অনেকটা লজ্জায় পিছনে ফিরে না তাকিয়ে সোজা দৌড়ে ওর সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম আমি।
আমার বাসায় চল। মাকে বলেছি তুমি পেন ড্রাইভ দিতে এসেছ। তাই, সমস্যা নেই। যাবে না?
না,আজ না। অন্য কোন দিন।
রক্ত চক্ষু করে ও আমার দিকে তাকাল।
রাগলে নাকি সব প্রেয়সী কেই সুন্দর লাগে। ওকে হয়তো আরও সুন্দর লাগছিলো। আমার কাছে সবচেয়ে সুন্দর।
বাইরের সুন্দরী বৃষ্টি কনাগুলির চেয়েও সুন্দর।
আহা কি সুন্দর ঐ দুটি চোখ,ঐ রাঙা দুটি ঠোঁট,চোখের আলোয় দেখেছিলেম চোখের বাহিরে। না,এমন কাব্যিক কোন বর্ণনা আমি ওকে কখনও দেইনি।
কারণ,ওকে কখনও চোখের দৃষ্টি দিয়ে মূল্যায়ন করতাম না আমি। প্রত্যেক মানুষের মনের দৃষ্টি চোখের দৃষ্টি থেকে অনেক সুন্দর।
আর সুন্দর কোন কিছু দিয়ে, যে কোন কিছুর মূল্যায়ন করলে সেটির মূল্যায়ন সার্থক ও সুন্দর হয়, এটা আমার বিশ্বাস ছিল।
তবুও মনে হল,ওর চোখের নিচ হইতে আলোকচ্ছটার মতো অমিয় ভালোবাসার স্নিগ্ধ কিছু আলো অনায়াসে গড়িয়ে নামছিল।
বাসায় যাওয়া লাগবেনা। আমাদের সিঁড়ি ঘরের ওখানটায় চল। তোমাকে এই বৃষ্টিতে বেরোতে দিবনা আমি।
আমি নীরবভাবে ওর কথায় সাঁয় দিলাম।
ওর কথা গুলা মেনে নিতে মাঝে মাঝে এত ভাল লাগে আমার।
জানিনা,হয়তো এটাই ভালোবাসা।
দুজনে মিলে ওদের সিঁড়ি ঘরের ওদিকটায় গেলাম।
বেশ আঁধার। বৃষ্টির ফোঁটা আলতো একটা ছোঁয়া দিয়ে যাচ্ছিলো ওখানে।
ও অনেকটা এলোমেলো। চোখে মুখে ক্লান্তির ছাপ।
তুমি রোজা রেখেছ তাই না? কথা বলার মত কিছু না পেয়ে এটা দিয়েই কথোপকথন শুরু করলাম আমি।
হু,তুমি রেখেছ?
হু। রেখেছি?...আমিও একই জবাব দিলাম।
আমি তোমাকে অনেক পেইন দেই তাই না।
ও আমাকে পেইন দেয় কিনা জানিনা,তবে ও আমাকে অনেক ভাল বুঝে এটা আমি জানি। আজকে আবার নতুন করে জিনিসটা বুঝতে পারলাম।
আমি নির্বাক থেকে কিছুক্ষন পর জবাব দিলাম,হঠাৎ এই প্রশ্ন?
না, এমনি। মনে হল।
-
বৃষ্টি থামছেই না। হয়তো আল্লাহ চাচ্ছিলেন আমরা আরও কিছুক্ষন কাছাকাছি থাকি। চোখের ভাষায় মনের কথাগুলি নিবিড় করে বলে যাই।
আমাদের এতটা কাছাকাছি থেকে কথোপকথন এর আগে কখনও হয়নি। তাই আমরা একে অপরের দিকে একটু লুকোচুরি দৃষ্টিতে দেখছিলাম।
তবুও বারবার ধরা খেয়ে যাচ্ছিলাম নিজেদের কাছেই। দুজনের চোখেই কেমন যেন একটা অজানা তৃষ্ণা।
দুজনাকে মন ভরে দেখার।
প্রায় ১ ঘণ্টা বৃষ্টিটা অমন ভাবেই চলতে লাগলো। আর আমাদের এলোমেলো কথন।
বৃষ্টিটা কমতে শুরু করলো। কিন্তু,কেন জানি আমার যেতে ইচ্ছে করছিলোনা।
বৃষ্টি কমেছে,যাবেনা?
হুম..যাব। তাড়িয়ে দিতে চাঁচ্ছ? আর কিছু ক্ষন থাকলে কি সমস্যা?
না। সমস্যা নেই।
তবে চাচী খারাপ ভাবতে পারে। এভাবে তোমার সাথে সিঁড়ি ঘরে। বুঝোই তো। তবুও থাকতে চাইলে থাকো। কি আর করার।
আমি এখন একটা কাজ করবো। তুমি হাসবেনা তো?
না। হাসবনা। আমি মুচকি হাসলাম। তবে ওর থেকে লুকিয়ে।
বৃষ্টির ধারা তখন কমতে কমতে একদম কমে যাচ্ছিলো। ঠিক যেন, একটা নিষ্পাপ শিশুদের মত করে আকাশ পানে তাকিয়ে নিজের চোখ মুখ ভিজাচ্ছিল ও। আর মুখ দিয়ে বৃষ্টির পবিত্র কণাগুলি আলতো আলতো করে নিজের ঠোঁটে লাগাচ্ছিল।
কত সুন্দর!কোথাও কোনো খুঁত নেই ওর নিস্পাপ শিশুসুলভ আচরণে। আমার স্তিমিত চোখের সামনে আজ আবির্ভূত হলো স্বপ্নের মত ওর দুটি চোখ আর ওর কাক ভেজা শরীর।
আমি জানতাম। ও আমাকে চলে যেতে না বলেও, চলে যেতে বলছে।
আমি একটা মুচকি হাঁসি দিয়ে ওখান থেকে বেড়িয়ে পড়লাম।
আমি জানতাম, ও এই মুহূর্তটা একা থাকতে ভালোবাসে।
এমন মুহূর্তে শুধু বৃষ্টির কণারা আর ও।
আর কেউ নয়। আমিও না।
তখনও জানতাম না। ওটা ছিল ওর সাথে কাটানো আমার শেষ শ্রাবণের দিন।
আমাদের সাথে কি হয়েছে সেটা না হয় অজানাই থাক।
আজ আমার সাথে ও নেই,তবুও বহুকাল পরে ধুলো পরা স্মৃতির ডায়েরিতে সযত্নে রয়ে গেছে মুহূর্তটা।
আজো বৃষ্টি হলে, অঝোরে শ্রাবণের কান্না শুনলে আমার মনে পড়ে ওকে।
কোথায় হয়তো মায়াবী নূপুর পায়ে বৃষ্টিতে ভিজছে ও।
দুষ্টু বৃষ্টি ওর চোখের পাতা ছুঁয়ে দিচ্ছে।
শুধু আমি ওর সাথে নেই।
তবুও স্মৃতির ছেঁড়া পাতায় ও রয়ে যাবে,চিরকাল।
এক হারিয়ে যাওয়া বন্ধু হয়ে। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।