ওই বর্ডারের দিকে কইলে যাইস না। গেলে কইলে হেরা তরে মাইরা লাইবো। চোহের সামনে দেখছস না বড় ডারে মাইরা লাইসে। এই যে চোহের সামনে দেখতাছস না বেড়া। এডা কিন্তু আসলে কোন বেড়া না, মরনফাঁদ।
এই বলে জুলেখা রে তার মা আয়েশা বেগম বকা দিতেছিল। আয়েশা বেগমের বড় ছেলে ইয়ুসুফ এর মৃত্যু হয়েছে এই সীমান্ত বেড়া লাগোয়া তাদের নিজস্ব জমিতে হালচাষ করতে গিয়ে। কি করবে এই সীমান্তবর্তী এলাকার মানুষগুলো। কারন এদেরতো আর জীবিকার অন্য কোন উপাই নেই।
জন্মের পরে পড়ালেখার করে মানুষ রুপি অমানুষ হওয়ার সুযোগ তাদের জীবনে আসে নাই।
আরে পড়ালেখা তো দূরে থাক। ঠিক মতনে যাদের পেটে ভাত জোটে না, তাদের আবার!!! পেটের জ্বালা বড় জ্বালা। কি আর করা। সময়তো আর বসে থাকেনা। দেখতে দেখতে জুলেখা এখন বেশ বড়সড় হয়ে গেছে।
বয়স, বার কি চোদ্দ হবে। ঠিক বলতেও পারেনা আসল বয়সটা। কে রাখবে এই সব দিন কালের হিসাব নিকাষ। যেখানে দিন শেষে রাত আসে। তারপর আবার সকাল হয়।
পেটের তাড়নায় ছোটাছুটি করতে হয়।
প্রয়োজন কোন আইন মানেনা। মানেনা কোন বাঁধা। দিনে দিনে জুলেখা ও হয়ে যায় তার বাবার চোরাকারবারির সহযোগী। এটাকে ঠিক চোরাকারবারি বলা ঠিক হবে কিনা জানিনা।
সে প্রতিবেশী দেশ থেকে গরু কিনে এদেশে এনে বিক্রি করেন। কথা আসে কর ফাঁকির। আমাদের দেশে কর ফাঁকির কথা শোনলে হাসি আসে। যেখানে কর যে একটা জিনিস, দিতে হয় এটা খুব কম মানুষই জানে। আর যারাই বা এটা ভুল ক্রমে জেনে গেছে তারা ও মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছে জীবনে কোন দিন তারা তা পরিশোধ করবেনা।
আর সেখান আমরা জুলেখার বাবাকে চোরাকারবারি বলি, কারন উনি সরকারকে কর দেন না। এই হিসাব করলে আমার সবাই এই চোরাকারবারি গুটি কয়েক মানুষ ছাড়া। একেই বলে যত দোষ নন্দ ঘোষ। কৃষ্ণ করলে লীলা খেলা আর আমি করলেই হয়ে যায় প্রেম।
এবার আসি ঠিক ওই সব সীমান্ত এলাকার মানুষের সাধারণ জীবনে।
আমার একবার সুযোগ হয়েছিল বেনাপোল যাওয়ার। কিছুদিন থেকেছিলাম ও সেখানে। আমার এক পরিচিত BDR এ কাজ করতো সেখানে। নিজের চোখের সামনে যা দেখছি তাই বলছি। বিশ্বাস করুন এসব এলাকার মানুষের আসলে চোরাকারবারি হওয়া ছাড়া আর কোন গতি নাই।
একদিন সন্ধাই বের হয় দেখতে, ঠিক কি হয় সেখানে। মানুষগুলো সবাই ব্যাস্ত কখন উপারে যাবে আর নিয়ে আসবে বস্তা ভর্তি মালামাল। সন্ধ্যা নামলেই যেন পারাপেরর একটা স্বর্গরাজ্য হয়ে যায়। সীমান্তের উপারে যারা কাজ করেন তাদের ভাব খানা এরকম যে ভারত থেকে কিছু এদেশে আসলে উনারা কিছু দেখেন না। কিন্তু মাগার আমাদের দেশ থেকে ওদের উখানে কিছু গেলেই খবর আছে।
কারন ওখান থেকে যখন মালামাল এদেশে আসে তখন এদেশী দালালরা টাকা দিয়ে তা কিনে নিয়ে আসেন। তাতে বরঞ্চৎ ওদের লাভ ই হয় বেশী।
একদিন সন্ধায় জুলেখার বাবা ঠিক করলে আজকে উপারে যাবেন। অবশ্য ব্যাপার টা ঠিক এরকম যে ওপারে যাওয়া আশার জন্য তাদের আসলে কোন সিধান্তের প্রয়োজন হয় । কারন তারাতো যাওয়া আসার মধ্যেই থাকেন।
যাই হোক যেই কথা সেই কাজ। ইদানীং আবার পারাপারের কাজ টা অনেক বেশী জটীল হয়ে যাচ্ছে। কারন ওপারে যেতে এখন বেড়া টপকাতে হয়। পৃথিবীতে সম্ভবত সীমান্তে বেড়া দেওয়ার রেওয়াজ প্রথম চালু করেছিল ইসরাইল। সাম্রাজ্জবাদ যুক্তরাষ্ট্রের ও মেক্সিকোর সীমান্তে বেড়া দেওয়া আছে।
জুলেখার বাবা আগে থেকেই পার্শ্ববর্তী দেশের গরু দালালদের সাথে সব কথাবার্তা পাকা পাকি করে রেখে ছিল। টাকা পয়সার লেনা দেনা সবই পাকাপোক্তা করা ছিল। সে যথারীতি কেনা গরুগুলু আনতে গেলেন। এর মধ্যে পাকে যত সব ঝামেলা। ওখানকার দালালরা আরো বেশী টাকা চাচ্ছে।
গরুগুলো ও মনে হচ্ছে যে রকম দেখানো হয়েছিল সে রকম না। মানে এখানে ও ভেজাল। কিন্তু কি আর করা। কিনতে তো হবেই। নইলে ত সব টাকাই গচ্ছা যাবে।
ক্ষতি মেনে নিয়েই সে তাদের সাথে সব কিছু মিটমাট করে চলে আসতে ছিলেন। তখনই শুরু হয় নতুন সমস্যা। বি এস এফ জওয়ান তার কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা দাবি করে বসল। নইলে কিছুই নিতে দিবেনা। অনেক বুঝনো হল কিন্তু বিধি বাম।
কে শোনে কার কথা। বিবেকের সামান্য কিছু অবশিষ্ট থাকলে তো । আরে বাপ, হইত তোর কর্তব্য পালন কর ভাল ভাব্ নয়ত অন্য কিছু কর। এর মধ্যে কথাকাটির এক পর্যায়ে পরিবেশ একটু না অনেকটাই গরম হয়ে গেল। বি এস এফ রা জুলেখার বাবাকে বলল, যা তোর কিছু দেয়া লাগবেনা, আমারা দেখি কি করা যায়।
জুলেখার বাবা ভয়ে ভয়ে গরু নিয়ে চলে আসতে লাগলো। কারন যে টাকা দাবি করা হয়্লছিল তা দিবার সামর্থ্য তার নাই। সেই দাবি মিটাতে গেলে আসলে কোন লাভ করা সম্ভব হবেনা। কিন্তু এখন সে কি করবে। কোন টাকা পয়সা বি এস এফ নিল না।
এটা আবার কি মতলব। পিছনে আবার গুলি করে বসবে না তো। মনে মনে দুয়া করার চেষ্টা চলছে। কিন্তু কোন দুয়াই তার মনে পরছেনা। ভাবতেছে কোন মতে চলে যেতে পারলেই হয়।
আর কোন দিন একাজ করবেনা। এ যাত্রাই বেঁচে গেলেই হয়।
পিছনে বি এস এফ জওয়ান রা রাগে কটমট করতে ছিলেন। এদের মধ্যে একজন বধ হয় একটু বেশই চোটে গেছেন। শালা টাকা দিবে না, দেখি তুই গরু নিয়ে যাস কিভাবে।
হাতে বন্দুক থাকলে নাকি মানুষের রাগ এম্নেতেই একটু বেশী হয়। নিজেকে অনেক বেশী ক্ষমতাবান মনে হয়। আর বাকি সব মানুষকে মনে হয় bloody civilian । জওয়ান ভাবতেছে কতদূর যাবি। তোর পায়ের চলার শক্তি কি আমার বন্দুকের গুলির চাইতেও বেশী।
না, না । তা হতে পারেনা। শিকারী যেমন শিকার করার সময় ভাবে কতো সহজে শিকার বধ করা যায়। জওয়ান ও তাই ভাবতেছে। আবার এটাও ভাবতেছে বেশী চলে গেল না তো।
নাহ আর মনে হয় দেরী করা ঠিক হবেনা। হাতে বন্দুক একদম তাক করা হয়ে গেছে। তাও মনে মনে ভাবতেছে যে গুলিটা কোথায় করবে মাথায় নাকি পায়ে। পায়ে গুলি করলে কম হয়ে যাবে। শালা একটু বেশী তেরামি করছিল।
আর সহ্য হচ্ছেনা তার।
হঠাৎ করে জোড়ে একটা শব্দ হল। জুলেখার বাবার শীর্ণ দেহটা ছিন্নবিন্ন হয়ে গেল। রক্তে মাটি ভিজে গেল। হাত থেকে খুলে পরল ধরে থাকা গরুর লাগামগুলো।
গরুগুলো কিছু বুঝে উঠার আগেই দৌড়াতে লাগলো। মাটির দেহ মাটিতে পড়ে রইল। রক্তে লালে লাল হয়ে গেল জুলেখার বাবার পড়নে থাকা লুঙ্গি আর শার্ট। আকাশে উড়ে যাওয়া পাখিগুলো থমকে দাঁড়ালো। গাছে থাকা কাক গুলো কাকা করতে লাগলো।
এই অন্ধকার রাতে কেউ শোনতেও পেল না যে, এইমাত্র একজন মানুষ পৃথিবী ছেঁড়ে চলে গেল।
অপর দিকে জওয়ান এবার তার দায়িত্ব পালন করার জন্য ব্যস্ত হয়ে গেল। ক্যাম্পে খবর দেয়া হল একজন বাংলাদেশীকে চোরাকারবারিকে গুলি করা হয়েছে। কারন সে ছিল নিয়মত চোরাকারবারি। একদিন নয়, দুদিন নয় অনেকদিন এ তাকে এই কাজ করতে দেখা গেছে।
বারে বারে চড়াই তুমি খেয়ে যাও ধান এবার চড়াই তোমার জান কতল করিলাম। তড়িঘড়ি করে লাশ উঠিয়ে নিয়ে আসা হল। পরদিন সকালে পতাকা বৈঠক করা হবে বি জি বি এর সঙ্গে।
তারপ দিন এই খবর বাংলাদেশের পত্র পত্রিকায় ফলাও করে প্রচার করা হল। কিছু কিছু TV চ্যানেল যথেষ্ট গুরুত্ত সহকারে এই খবর প্রচার করল।
ভুল বশত আমাদের প্রধানমন্ত্রী খবরটা দেখে ফেলে। উনি ভাবলেন আগামিকাল সকালে উনার উপদেষ্টামণ্ডলীদেরকে নিয়ে একটা বৈঠক করা হবে। এভাবে কেন মানুষ মারবে । এটা কেমন কথা হল। পরদিন উনি উনার অফিসে এলেন।
যথারীতী মিটিং ডাকা হল। উনি তলব করলেন গহর রিজভী সাহেবকে এবং আরো সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গকে। উনারা তো অবাক, কি ব্যাপার কি হলো কোন প্রটোকোল ছাড়া হঠাৎ উনি মিটিং ডাকলেন যে। কি হল আবার হঠাৎ করে। এমনেতেই যে এই দেশের কত কত সমস্যা উনাদের সামলাতে হয়।
সময় মত সবাই এসে উপস্থিত হল মিটিং এ। প্রধানমন্ত্রী রিজভী সাহেব কে বললেন কি ব্যাপার আপনি কি গত কালকের খবরটা দেখেছিলেন। কেন ম্যাডাম কি হয়েছে। পাশ থেকে একজন বলে বললেন ওই যে border killing এর ব্যাপারটা। রিজভী সাহেব এতো ক্ষনে মুখ খুললেন।
ম্যাডাম আমি তো ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম যে কি জানি কি হয়ে গেল। উনি বুঝালেন ম্যাডাম, এসব তো আর নতুন কিছুনা। এসব তো আগে থেকে চলে এসেছে। আপনি গত রাতে যাকে মরতে দেখেছেন কিংবা আগেও যারা এভাবে মরেছে এরা আসলে কেউ ভাল মানুষ না। এরা সবাই চোরাকারবারি।
এরা আসলে নানা ধরনের অপরাধের সাথে জড়িত। আসলে এধরনের কিছু লোক মারা গেলেই স্থানীয় পর্যায়ে শান্তি আসবে। ভাগ্যিস আমাদের দেশের পুলিশ কিংবা র্যাইব দিয়ে ওদের কে মারতে হয়নি। তখন আবার সরকার বিরোধী কতো কথা উঠত। পাশের বন্ধুপ্রতীম দেশের সিমান্তরক্ষীরা যা করেছে ভালই করেছে।
আমাদের বি জি বি সদসসরা বরং কোন প্রতিবাদ না করে বুদ্ধীমানের পরিচয় দিয়েছে। আপনি এইসব সাধারণ বিষয় নিয়ে কখনো ভাব্বেন না। এইসব আসলে আমাদের বিরোধী দলের প্রচারনা। ওরাই দেশ্টার বারোটা বাজিয়ে দিয়ে গেছে। ওরাই তো যত সমস্যার মূল।
ওদের বিচার করতে না পারলে দেশের কোন উন্নতি হবেনা। আর মিডিয়ার লোকজন ও একটু বেশী স্বাধীনতা পেয়ে গেছে, উলটা পালটা যা খুশী তাই প্রচার করা শুরু করে দিয়েছে। দাঁড়ান আমি এদের দেখতেছি। প্রধানমন্ত্রী এবার হাফ ছেঁড়ে বাঁচলেন। ওফফ যা ভেবেছিলাম আর কি।
মিটিং শেষে মাননীয় মন্ত্রী আশরাফ সাহেবকে রিজভী সাহেব বুঝালনে খুব শিগ্রই আপনি একটা প্রেস ব্রিফিং করে সবাইকে বলে দেন যে, সরকার আসলে এসব সীমান্ত নিয়ে ভাবছেনা। এগুলো খুব তুচ্ছ ঘটনা। আরও অনেক অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ করতে হয়। দুই দেশের সাথে খুব বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বিরাজ করতেছে। সীমান্তে খুনাখুনি আগেও ছিল, এখন ও আছে, আশা করি ভবিষ্যতে ও থাকবে।
আপনারা সাধারণ জনগন কেউ এসব নিয়ে ভাববেন না। যেমন টা আমরা কখনো ভাবিনা।
কিছুদিন আগেই সীমান্তের পাশে থাকা একমাত্র জমিতে হাল চাষ করার সময় বি এস এফ গুলি করে মেরেছিল জুলেখার বড় ভাইকে। এবার গেল তার বাবা। বাবার লাশ টাও দেখা হলোনা।
কিন্তু অবাক করার মত ব্যাপার যে তার চোখে কোন পানি নেই। মৃত্যু শোকে কোন বিলাপ নেই। পুরু পরিবার স্তব্ধ। তারা জানেনা এখন তারা কি করবে। কোথায় যাবে।
কি খাবে। এর পরেই বা কার মৃত্যুর পালা গুনতে হবে বি এস এফ এর কাছে।
কিছুদন যাবৎ জুলেখাদের বাড়ীতে বেশ আনাগোনা দেখা যাচ্ছে প্যান্ট পড়া ভদ্র লোকদের। তারা জুলেখার কাছ থেকে অনেকে অনেক কিছু জানতে চায়। অনেক প্রশ্ন করে।
তাদের কারো কারো হাতে ক্যামেরা থাকতে দেখা যায় । জুলেখা খুব সাহস নিয়ে একবার এক সাংবাদিক কে বলেই বসল স্যার আপনার হাতের কাগুজে এসব কি লিখা থাকে। আমাকে প্রথম লিখা টা একটু পড়ে শোনাবেন। আমি তো পড়তে পাড়িনা। জীবনে কোন দিন স্কুলে যায়নি।
সাংবাদিক সাহেব এবার কিছুটা থতমত খেয়ে গেলেন যে কি বলবেন খুঁজে পাচ্ছেন না। । এমন এক সংবাদ ই জুলেখা শোনতে চাইল, যা তাকে পড়ে শোনানো খুব কষ্টের কাজ। সাংবাদিকের চুপ থাকা দেখে জুলেখা বলে উঠল কি ব্যাপার স্যার আপনার অনেক প্রশ্নের উত্তর তো আমি দিয়েছে, তাই না। আপনি আমার এক কথায় এমন করে চুপ করে আছেন কেন।
আমাকে একটু পড়ে শোনান। যা আছে তাই শোনান। হোক ভাল কিংবা মন্দ।
সাংবাদিক সাহেব জুলেখার বাবার মৃত্যু আর তার নিচে আশরাফ সাহেবের প্রেস ব্রিফিং টা পড়ে শোনালেন। পড়া শেষে উনি জুলেখার চোখের পানে তাকিয়ে দেখলেন, তার চোখ থেকে ঝরে পরল এক ফোটা শীতল অশ্রু।
প্রিয় পাঠক আপনারা কি কেউ বুঝতে পারেন এই অশ্রুর অর্থ...
পাদটীকা: লেখাটা নিতান্তই লেখকের নিজস্ব একটা কল্পনা মাত্র। বাস্তবে হয়তবা আপনারা এর মিল খুঁজে পেতে পারেন। এর জন্য দুঃখ প্রকাশ করছি। জুলেখার বাবার মৃত্যুতে লেখক মর্মাহত।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।