গুলিবিদ্ধ হয়ে মৃত্যুর পরও দীর্ঘ সময় সীমান্তের কাঁটাতারের সঙ্গে ঝুলে ছিল কিশোরী ফেলানির লাশ। এ দৃশ্য দেখে স্থানীয় মানুষ ক্ষুব্ধ হয়ে উঠলে লাশটি সরিয়ে নেয় হত্যাকারী ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) সদস্যরা। এই নৃশংস ঘটনায় আবার প্রমাণ হলো, ভারতীয় কর্তৃপক্ষের মুখ এবং মনের কথা এক নয়। প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের জন্য বিন্দুমাত্র অনুশোচনাও নেই তাদের। সীমান্তে বেআইনিভাবে রক্তপাত এবং ধারাবাহিকভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাপ্রবাহ তার চাক্ষুষ প্রমাণ।
বিএসএফের নৃশংসতা এবং গোঁয়ার্তুমির অবসান হবে কবে—তাও আর নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। কারণ বিডিআর-বিএসএফ মহাপরিচালক পর্যায়ে ঢাকা-দিল্লিতে চার-চারবার বৈঠক হওয়ার পরও বিএসএফ হাত গুটিয়ে নেয়নি। তারা সম্পূর্ণ বেআইনিভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘন করে নিরীহ বাংলাদেশীদের গুলি করে মেরেছে। পাখির মতো গুলি করে বালিকা হত্যার ঘটনা তার সর্বশেষ নজির। ফলে সঙ্গত কারণেই দেশবাসী বিশেষত সীমান্তের মানুষ গভীর ক্ষোভ, উত্কণ্ঠা-উদ্বেগের মধ্যে দিনাতিপাত করছে।
এ ব্যাপারে সরকার যে যথেষ্ট উদ্বিগ্ন, তার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। হত্যার প্রতিবাদ করে এবং লাশ চেয়ে বিজিবি (বিডিআর) বরাবরের মতোই চিঠি পাঠিয়েছে।
জানা গেছে, নিহত কিশোরী ফেলানি (১৫) নাগেশ্বরী উপজেলার দক্ষিণ রামখানা বানারভিটা গ্রামের নূরু মিয়ার মেয়ে। মেয়েকে নিয়ে নূরু ফুলবাড়ী সীমান্ত দিয়ে ফিরছিলেন। তিনি প্রথমে মই দিয়ে সীমান্তের কাঁটাতারের বেড়া পার হয়ে দেশে ঢুকে পড়েন।
কিন্তু পার হওয়ার সময় কাঁটাতারে জড়িয়ে যায় ফেলানির জামাকাপড়। এসময় সে ভয়ে চিত্কার শুরু করলে বিএসএফ সদস্যরা তাকে লক্ষ্য করে গুলি চালায়। প্রাপ্ত তথ্য অনুসারে, নূরু ভারতের দিল্লিতে কাজ করেন। বিয়ে ঠিক হওয়ায় মেয়েকে সঙ্গে করে দেশে ফেরার পথে এই নৃশংস হামলায় শিকার হলেন তিনি। ৭ জানুয়ারি এই হত্যাকাণ্ডের পর বিজিবি যথারীতি প্রতিবাদ করে লাশ ফেরত চাইলে ময়নাতদন্তের পর লাশ ফেরত দেবে বলে জানিয়েছে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ।
স্বভাবতই প্রশ্ন আসে, আপাতত লাশ ফেরত দেয়ার কথা বলেছে তারা। যেন বন্ধুত্বের উপহার! কিশোরী ফেলানিকে গুলি করে না মেরে বিএসএফ সদস্যরা তাকে অনায়াসে আটক করতে পারত। কাঁটাতারে জড়িয়ে পড়ায় তার পক্ষে পালিয়ে যাওয়ার কোনো উপায় ছিল না। কিন্তু বিএসএফ সচেতনভাবেই সেই আইনি তথা মানবিক পথটি বেছে না নিয়ে হত্যাকেই বেছে নিয়েছে। উল্লেখ্য, বিশ্বের কোনো সীমান্তেই ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের মতো এভাবে একতরফাভাবে নিরীহ মানুষকে সীমান্তবিধি রক্ষার নামে খুন করার নজির নেই।
অবৈধভাবে সীমান্ত পারাপারের দায়ে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে আটক করে তাকে বিচারের সম্মুখীন করা হয়। এ ব্যাপারে আরেকটি বিষয় মনে রাখা দরকার যে, বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত কোনো ভূপ্রাকৃতিক বিভাজনের মাধ্যমে চিহ্নিত নয়। সীমান্তের বেশি অংশই নদী, সমতল ভূমি, জনপদ বিদীর্ণ করে বিভাজনরেখা দিয়ে নির্ণীত হয়েছে ১৯৪৭ সালে। ফলে স্বভাবতই দু’দলের জনগণের মধ্যে দেশভাগের মতো আত্মীয়তা, বন্ধুত্ব, সামাজিক সম্পর্ক অন্তত মানবিক কারণে হলেও বিলীন হয়ে যায়নি। কাঁটাতারের বেড়া সবসময় সেই মানবিক সংশ্লিষ্টতাকে ভাগ করে দাঁড়াতেও পারে না।
আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে এসব দিকও বিবেচনা করা হয় পৃথিবীর সব সভ্য সমাজে। এতে মানবাধিকার সমুন্নত থাকে, মনুষ্যত্ব উচ্চকিত হয়। প্রতিবেশী বন্ধু দেশের কাছে এমনটি আশা করা অন্যায় আবদার নয়। কিন্তু ভারতীয় কর্তৃপক্ষ সে প্রত্যাশাকে বরাবরই অপদস্থ করেছে। তারই পরিণতি একের পর এক রক্তপাত।
বাংলাদেশের মানবাধিকার সংগঠন ‘অধিকার’-এর পরিসংখ্যান অনুযায়ী ২০১০ সালে বিএসএফ ৭৪ বাংলাদেশীকে হত্যা করে। একই সময় বিএসএফের গুলি ও নির্যাতনে আহত হন ৭২ জন। অপহৃতের সংখ্যা ৪৩। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ গত ডিসেম্বরে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বাংলাদেশী হত্যার প্রতিবাদ জানিয়ে দায়ী সীমান্তরক্ষীদের বিচার করতেও ভারত সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে। আমরাও মনে করি, নিজ দেশের নাগরিক হত্যার প্রতিবাদে সবচেয়ে অগ্রণী ভূমিকা নেয়ার দায় সরকারেরই।
এই কর্মকাণ্ড শুধু কূটনৈতিক পর্যায়ে করলেই চলবে না, দেশবাসীকে প্রতিবাদী হওয়ার জন্য প্রকাশ্য ভূমিকাও নিতে হবে। জনগণের প্রতিবাদ, সরকারের তত্পরতা এবং আন্তর্জাতিক মহলের হস্তক্ষেপ, সর্বোপরি ভারত সরকারের সদিচ্ছা যোগ হলেই এই ধারাবাহিক সীমান্ত অশান্তি নির্বাপিত হতে পারে। ভারতীয় কর্তৃপক্ষ কেন বার বার অঙ্গীকার করেও কথা রাখছে না—বাংলাদেশ সরকার এ প্রশ্নের উত্তর দাবি করতে পারে ন্যায়সঙ্গত কারণেই। অবিশ্বাস, সন্দেহ-সংশয় নিয়ে আর যাই হোক, সৌহার্দ্য বজায় রাখা কঠিন। ভারত দেয় অঙ্গীকার রক্ষা করবে—এখন এ মর্মে যে কোনো উদ্যোগ নিতে হবে সরকারকে।
আর কোনো নিষম্ফল বৈঠক নয়, নতজানু পররাষ্ট্রনীতি নয়, নয় কোনো খুনখারাবি।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।