সেনাবাহিনীতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি ও অভ্যুত্থান পরিকল্পনাকারীদের মধ্যে অন্যতম লে. কর্নেল (অব.) এহসান ইউসুফের ল্যাপটপে ছায়া মন্ত্রীদের নামও ছিল। এই ল্যাপটপে ছিল সরকার উৎখাত চেষ্টার পরিকল্পনার ছক। বিশৃঙ্খলা তৈরি করে বর্তমান গণতান্ত্রিক সরকারকে উৎখাত করার নীলনকশা করেন এহসান। এমনকি সেনাবাহিনীতে অভ্যুত্থান ঘটানোর পর কিছু বিষয়ে সংস্কার করার কাল্পনিক পরিকল্পনা করে তা বাস্তবায়নের উদ্যোগও গ্রহণ করেন তিনি। এর মধ্যে ছিল_ সেনাবাহিনীর যে কোনো সদস্য যে কোনো সময় বিয়ে করতে পারবেন।
বিশৃঙ্খলা পরিকল্পনায় জড়িত থাকায় এরই মধ্যে সেনাবাহিনীর দু'সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়। তারা হলেন লে. কর্নেল (অব.) এহসান ইউসুফ ও মেজর (অব.) জাকির হোসেন। জব্দ করা হয় এহসানের একটি ল্যাপটপসহ বেশ কিছু জিনিস। এহসানের ল্যাপটপ থেকে অভ্যুত্থান পরিকল্পনার ব্যাপারে বেশকিছু তথ্য পাওয়া যায়। সংশ্লিষ্ট নির্ভরযোগ্য সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
নির্ভরশীল সূত্র জানায়, বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির পেছনে যে ১৪ থেকে ১৬ সেনা কর্মকর্তা জড়িত থাকার
সন্দেহ করা হচ্ছে, তাদের নজরদারিতে রাখা হয়েছে। সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে তাদের সম্পৃক্ততার গভীরতা যাচাই-বাছাইও চলছে। আগামী মাসের মাঝামাঝি সময়ের মধ্যে তদন্ত শেষ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। শেখ হাসিনা সরকারকে উৎখাত করতে সেনাবাহিনীর সাবেক ও বর্তমান কিছু সদস্য অভ্যুত্থানের চেষ্টা চালান। ১৩ ডিসেম্বর এ পরিকল্পনার কথা ফাঁস হয়ে যায়।
এরপর অভ্যুত্থানচেষ্টা ব্যর্থ করে দেয় সেনাবাহিনী। এ ঘটনা তদন্তে ২৮ ডিসেম্বর একটি তদন্ত আদালত গঠন করা হয়।
গত বৃহস্পতিবার সেনা সদর সংবাদ সম্মেলনে সেনাবাহিনীতে বিশৃঙ্খলার তথ্য প্রকাশ করে বলা হয়, সেনাবাহিনীর মধ্যম সারির কয়েকজন কর্মকর্তা এর সঙ্গে জড়িত থাকতে পারেন। তিনজনের ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট তথ্য পেয়েছে সেনাবাহিনী। এ তথ্যের ভিত্তিতে অবসরপ্রাপ্ত দুই সেনা কর্মকর্তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
পলাতক রয়েছেন বিদ্রোহের অন্যতম নায়ক মেজর জিয়াউল হক। নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, সন্দেহভাজন হিসেবে যাদের নজরদারিতে রাখা হয়েছে তাদের মধ্যে একজন মেজর জেনারেল, একজন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল, একজন ক্যাপ্টেন ও বাকিরা মেজর পদবির কর্মকর্তা। তাদের মধ্যে কয়েকজন সাবেক সেনা কর্মকর্তাও রয়েছেন। বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিতে কার কী ধরনের ভূমিকা ছিল_ এ নিয়ে ব্যাপক তদন্ত চলছে। তদন্তে পরিকল্পনাকারীদের সংখ্যা বাড়তে পারে বলে একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়।
সন্দেহভাজন হিসেবে যাদের নজরদারিতে রাখা হয়েছে, তদন্তের পর তাদের সম্পৃক্ততা না পাওয়া গেলে অব্যাহতি দেওয়া হবে। কুমিল্লার ৩৩ পদাতিক ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল কামরুজ্জামানকে সপরিবারে সেনাবাহিনীর লগ এরিয়ায় রাখা হয়েছে।
এদিকে গতকাল রাতে সাভারের ৭৭ ব্রিগেড কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল তারিকুল আলমকে লগ এরিয়ায় আনা হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, গ্রেফতার হওয়া সাবেক সেনা কর্মকর্তা এহসান ইউসুফ তার কিছু সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে অভ্যুত্থানের পরিকল্পনা করেন। এসব পরিকল্পনা তার ল্যাপটপে লিখিত আকারে রাখা হয়।
অভ্যুত্থানের ব্যাপারে মোবাইল ফোনেও অনেকের সঙ্গে কথা বলেন তিনি। অতীতে সিপাহিদের যেসব দাবি-দাওয়া নিয়ে সেনা অভ্যুত্থান হয়েছে; এবারও এহসান একই দাবি-দাওয়া বাস্তবায়নের কথা বলেন। এহসান তার পরিকল্পনার কথা জানিয়ে বর্তমানে কর্মরত সেনা কর্মকর্তাদের উস্কে দেন বলে জানা যায়।
জানা গেছে, পরিকল্পনাকারীদের অন্যতম মেজর জিয়াউল হক তথ্যপ্রযুক্তির বিষয়ে বেশ পারদর্শী ছিলেন। তাই সবার সঙ্গে মেইল, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেইসবুকসহ অন্যান্য মাধ্যমে যোগাযোগ করতে তাকেই দায়িত্ব দেওয়া হয়।
এমনকি বিদেশে যেসব প্রবাসী এ পরিকল্পনার সঙ্গে জড়িত, তাদের সঙ্গে সবচেয়ে বেশি যোগাযোগ করতেন জিয়াউল।
সূত্র জানায়, সেনাবাহিনীতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির ঘটনায় জড়িতদের শনাক্তে তদন্ত আদালত কাজ করছেন। তবে সেনাবাহিনীর কার্যক্রম স্বাভাবিকভাবেই চলছে। পরিকল্পনাকারীদের সঙ্গে জঙ্গিবাদী ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বানচালে ষড়যন্ত্রকারীদের যোগসূত্র খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
এদিকে পরিকল্পনাকারীদের অন্যতম মেজর জাকির হোসেনের বাড়ি রাজধানীর জুরাইনে।
তিনি ৩২ লং কোর্সের মাধ্যমে সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে জাকির টাস্কফোর্স-১-এর দায়িত্ব পালন করেন।
আত্মসমর্পণ করা উচিত :জিয়াউলের বাবা
আমাদের মৌলভীবাজার প্রতিনিধি নুরুল ইসলাম জানান, মেজর সৈয়দ জিয়াউল হককে নিয়ে এলাকাজুড়ে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা চলছে। তার বাল্যকাল ও ছাত্রাবস্থা সময়ের সঙ্গে সম্প্রতি প্রকাশিত কর্মকাণ্ডের হিসাব মেলাতে পারছেন না অনেকে। মৌলভীবাজার সদর উপজেলার মোস্তফাপুর ইউনিয়নে জিয়াউল হকের পৈতৃক বাড়ি হলেও তারা দীর্ঘদিন ধরে ঢাকার বারিধারায় অবস্থান করেন।
তার বাবা সৈয়দ জিল্লুর হক। তিনি সত্তরের দশকে চাকরি নিয়ে সৌদি আরবে যান। তার বাবা দুই মেয়ে ও স্ত্রীকে নিয়ে সৌদি আরবে অবস্থান করেন। সে সময় ছুটিতে মাঝে মধ্যে জিয়াও মা-বাবা ও বোনদের সঙ্গে দেখা করতে সৌদি আরবে যেতেন। মেজর জিয়া দুই বোন ও এক ভাইয়ের মধ্যে সবার বড়।
তার বাবা সৌদি আরব থেকে ১৯৯৯ সালে দেশে ফিরে ঢাকায় কিছুদিন আগ পর্যন্ত গার্মেন্ট ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। সম্প্রতি তিনি সে ব্যবসা গুটিয়ে ঢাকায় ছোটখাটো ব্যবসা করছেন বলে জানা গেছে। মেজর জিয়ার তিন চাচা রয়েছেন। তারা সপরিবারে যুক্তরাজ্যে অবস্থান করেন। বাল্যকাল থেকে মেজর সৈয়দ জিয়াউল ধর্ম-কর্মের প্রতি খুব আগ্রহী ছিলেন।
তার বাবা সৈয়দ জিল্লুর হক মোবাইল ফোনে সমকালকে বলেন, জিয়া ধর্মপরায়ণ ছিল। তিনি আরও জানান, আমি একজন বাবা হিসেবে বলব_ দেশের একজন সুনাগরিক হিসেবে সবার আইন মেনে চলা উচিত। এ হিসেবে মেজর জিয়াও আইনের ঊধর্ে্ব নয়। তাই তার উচিত ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করে আত্মসমর্পণ করা।
মেজর জিয়ার স্ত্রী সাফা জোহরা জানান, ২৩ ডিসেম্বর রাতে সাভারে তার বোনের (স্ত্রীর বড় বোন) বাসায় বেড়াতে গিয়েছিলেন।
ওই দিন রাত ১০টার দিকে জিয়ার অফিস থেকে ফোন আসে দ্রুত যাওয়ার জন্য। তিনি রাত সাড়ে ১০টার দিকে অফিসের দিকে চলে যান। এর ১০-১৫ মিনিট পর জিয়ার মোবাইলে ফোন করলে তিনি জানান অফিসের দিকে যাচ্ছেন। এরপর থেকে তার সঙ্গে আর কোনো যোগাযোগ নেই। টিভি ও পত্রিকায় জিয়ার সম্পর্কে খবর দেখে বিষয়টি অবগত হন।
মেজর জিয়াউল হক প্রথমে বিয়ে করেন তার মামাতো বোন বিচারপতি মইনুল হকের মেয়ে লিপিকে। ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে ২০০৭ সালে প্রথম স্ত্রী মারা গেলে পটুয়াখালীতে দ্বিতীয় বিয়ে করেন।
আমাদের পটুয়াখালী প্রতিনিধি মুফতি সালাউদ্দিন জানান, পটুয়াখালীতে গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন মেজর জিয়াউল হকের শ্বশুরবাড়ির খোঁজ নেন। একাধিক গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন ওই বাসায় গিয়ে মেজর জিয়া সম্পর্কে তার শাশুড়ি হামিদা বেগমের কাছে নানা তথ্য জানতে চান। মেজর জিয়ার শ্বশুর মোখলেছুর রহমান পটুয়াখালী শহরের আদর্শ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ছিলেন।
শাশুড়ি হামিদা বেগম পটুয়াখালী শহরের শেরেবাংলা বালিকা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত সহকারী শিক্ষিকা।
গতকাল দুপুর সোয়া ১২টার দিকে মেজর জিয়ার শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে পাওয়া যায় তার শাশুড়ি, শ্যালক, শ্যালকের স্ত্রী এবং তাদের স্কুলপড়ূয়া (এসএসসি পরীক্ষার্থিনী) মেয়েকে। এ সময় কথা হয় মেজর জিয়ার শাশুড়ি হামিদা বেগমের সঙ্গে। তিনি সমকালকে জানান, প্রায় চার বছর আগে ২০০৭ সালের জুলাইয়ে তার ছোট মেয়ে সাফা জোহরার সঙ্গে বিয়ে হয় সেনা কর্মকর্তা মেজর জিয়াউল হক জিয়ার। ঢাকাতেই বিয়ের অনুষ্ঠান সম্পন্ন হয় তাদের।
বিয়ের পর থেকে মেয়ে ও জামাতা কখনও পটুয়াখালী আসেনি। দুই নাতি-নাতনি আয়াশা (২) ও আবদুল্লাহকে নিয়ে ঢাকায়ই থাকত তারা। তিনি আরও জানান, জামাতা নিখোঁজ হওয়ার পর তার মেয়ে তাদের কারও সঙ্গে কোনো যোগাযোগ করেনি এখন পর্যন্ত। কোনো আত্মীয়-স্বজনের বাসায় তার কোনো খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। জামাতা নিখোঁজ হওয়ার পর থেকে বেশ কিছুদিন ধরে বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন তাদের বাসায় গিয়ে নানা প্রশ্ন করে মেজর জিয়া সম্পর্কে খোঁজখবর নিচ্ছেন।
যেভাবে ছড়ানো হয় বিভ্রান্তি : একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, ৮ থেকে ১০ ডিসেম্বরের মধ্যে অভ্যুত্থান ঘটানোর পরিকল্পনা করা হয়। পরিকল্পনাকারীরা বিভিন্ন সেনাসদস্যকে ফোন করে 'সেনাবাহিনী মুভ করেছে' বলে বিভ্রান্তি ছড়াতে থাকেন। একটি ক্যান্টনমেন্টে এক সেনা কর্মকর্তাকে পরিকল্পনাকারীরা ফোন করে জানান, ওই ক্যান্টনমেন্টের এক কর্মকর্তা 'মুভ' করেছেন। তবে যে কর্মকর্তাকে পরিকল্পনাকারীরা ফোন করে 'মুভ' করা কর্মকর্তার নাম প্রকাশ করেছিলেন ওই কর্মকর্তা কাকতালীয়ভাবে তার পাশে ছিলেন। এ নিয়ে ওই সময়ই ব্যাপক হাস্যরসের সৃষ্টি হয়
Click This Link ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।