আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

পিচ্চিদের ভালোবাসা

পিচ্চিরা (বেশির ভাগ) অজানা কোন কারণে আমাকে খুব পছন্দ করে। কিছুদিন আগে বাড়ি গিয়েছিলাম। ওখানে গেলেই জানের জান ভাগ্নের সবগুলো দন্ত বিকশিত হয়ে যায়। সাথে সাথেই আমার পিছু নেয়। এরপর আমি যেখানেই যাব সে আমার সাথে সাথে যাবে।

বাথরুমে গেলেও দরজা পর্যন্ত পিছু নেয়, এরপর বাধ্য হয়ে ফিরে আসে। আগে কোন এক চ্যানেলে একটা হিন্দী সিরিয়াল হত (আমি যেগুলো দুই চক্ষে দেখতে পারি না) যেখানে দুই সিয়ামিজ টুইনের কাহিনী ছিল, দুই বোন তাদের নাম আম্বার-ধারা, তাদের দুজন পেটের দিকে জোড়া লাগানো। ভাগ্নে নামটা ঠিকমত বুঝত না। সে আমার গায়ের সাথে সারাক্ষণ লেগে থাকত আর বলত, আমরা দুজন আন্দার-ধারা। এখন অবশ্য ঐ নামটা ভুলে গিয়েছে।

এখন কেউ যদি আমাকে দেখে বলে, আরে আন্টিমনি আসছে নাকি? সে বলে, হ্যাঁ, আন্টিমনিও আসছে, সাথে তার লেজও আছে। লেজটা হল আন্টিমনির জানের জান ভাগ্নে। বিদায়ের সময় সে আমাকে আটকে রাখতে চায়। আগে দরজার সবগুলো ছিটকিনি আটকে রাখত, একবার তো কোত্থেকে একটা তালা জোগাড় করে আটকে দিয়েছিল। ইদানিং এরকম না করলেও বিদায়ের সময় মন খারাপ করে অন্যদিকে তাকিয়ে থাকে।

কথা বলেও না, শুনতেও চায় না। ছোট ভাগ্নে আবার আরেক পাগল। সে এমনিতে আমার কোলে আসে না। তবে দেখলে আন্তিমুনি আসসেএএএএএএএ বলে একটা চিৎকার দিবেই। তার চেয়েও বেশি চিৎকার করবে আমি যাওয়ার সময়।

প্রতিবারই আমি চলে আসার সময় কান্নাকাটি করে এক গামলা চোখের পানি বিসর্জন দিয়ে ফেলবে। অথচ সারাদিনে হয়ত একবারও আমার কাছে ঘেঁষবে না। কাছে আসে তখন, যখন দেখে তার বড় ভাইয়া, মানে আমার বড় ভাগ্নে আন্টিমনির কোল দখল করে আছে। এই সময় সেও একটু আদর দখল করতে চায়। একবার এমন হয়েছে যে ছোট ভাগ্নের মায়ের, মানে আমার মেজপাকে (যাকে শাহানা নামে চেনে সবাই) দেখে সবার পিচ্চি ভাগ্নীটা তার কোলে উঠতে চাইল।

এই মেজ খালা হল ভাগ্নীর ঘুমের কোল। মেজ ওকে কোলে নিয়ে ঘুম পাড়াতে থাকল। এদিকে নিজের মায়ের কোলে আরেক পিচ্চিকে দেখে ভাগ্নের গেল মাথা খারাপ হয়ে। সেও মায়ের আরেক কোল দখল করল। এইবার বড় ভাগ্নে আমার কোলে চলে এল, আর ছোট ভাইকে ডেকে বলল, এই যে আন্টিমনির কোলে আমি।

সেটা দেখে পিচ্চি ভাগ্নের মাথা আবার খারাপ। দৌড়ে মায়ের কোল ছেড়ে আমার কোল দখল করল। আবার ঐদিকে মায়ের কোলটাও দখল করে আছে আরেকজন, সেটাও তার সহ্য হচ্ছে না। একবার মায়ের কোল, আরেকবার আন্টিমনির কোল, এই দখলদারিই চলতে থাকল। শেষে ওর মা বলল, এক সাথে তো দুই কোল দখল করতে পারবা না, যে কোন একটা বেছে নাও।

বেচারা মনের দুঃখে দুই কোলই বিসর্জন দিয়ে নিজের মনে খেলতে শুরু করল। পিচ্চি ভাগ্নীটা আবার আন্টিমনির কোল দখল নিয়ে খুব বেশি চিন্তা করে না। তবে একবার আসলে আর যেতেও চায় না। কোলে উঠেই সে আঙ্গুল তুলে নির্দেশ দেয়া শুরু করে কোথায় কোথায় যেতে হবে, কী কী ধরতে দিতে হবে। মুখের বোল তো এখনও পুরোপুরি ফোটেনি, দুই-একটা শব্দ দিয়েই সব কথা বলে ফেলতে চায়।

তার মধ্যে একটা শব্দ হল, অ্যাইন। আগে অ্যাই বলত, এখন শেষে একটা 'ন' লাগিয়ে আরেকটু জোরদার করে বলে। এই অ্যাইন-এর অনেক অর্থ - কাছে আসো, কোলে নাও, হাঁটো, ঐদিকে যাও, ঐটা ধরতে দাও - সবই বুঝতে হবে এই এক শব্দে। ভীষণ গানপাগল এই ভাগ্নী। গান শুনতে পেলেই তার নাচ শুরু হয়ে যায়।

আর একটা গান শেষ হওয়া মাত্র দুঃখ করে বলতে থাকে, গান নাই, গান নাই, গান নাই। আরেকটা গান শুরু না হওয়া পর্যন্ত এই জিকির চলতে থাকে। শুধু ভাগ্নে-ভাগ্নীদের কথা বলছি, আমাকে ভালোবাসার আরও অনেক পিচ্চি আছে। যে কোন বাড়িতে গেলেই পিচ্চিরা আমার ভক্ত হয়ে যায়, আর বিদায়ের সময় সেই কান্নাকাটি। এক বাড়িতে দেড় বছরের একটা পিচ্চির সাথে সারাদিন খেলার পর যখন চলে আসব, সে এতই মাইন্ড করল যে এরপর তার সাথে দেখা করার পর সে রাগ করে আমার দিকে তাকালোও না, মুখ ঘুরিয়ে রাখল।

যা হোক, পরে তার মান ভাঙাতে পারলাম। সারাদিন আবারও আমার সাথে খেলল, এমন কি তার প্রতিদিনের খেলার সাথীদের কাছেও গেল না, যেখানে একদিনও তার না গেলে চলে না। কিন্তু আবারও সেই বিদায়ের সময় কান্নাকাটি করে হুলুস্থুল। কলিগদের পিচ্চিদের সাথেও একই কাহিনী। এক পিচ্চি তার জন্মদিনের দাওয়াত দিতে সকালবেলাই মায়ের সাথে অফিসে এল।

জন্মদিনে সে কী উপহার চায় এটা গোপনে জেনে নিয়ে বললাম, ঠিক আছে সন্ধ্যায় চলে আসব। সে এরপর হাসপাতালের সব রোগীর মাঝখানে দাঁড়িয়ে আমার হাত ধরে টানতে টানতে চিৎকার করে কান্না শুরু করল, আপু এক্ষুণি আমার বাসায় চল। (সে আবার আমাকে আন্টি ডাকতে রাজী না, আপু বলেই ডাকে। ) যতই বোঝাই এখন আমার কাজ আছে, সন্ধ্যায় আসব, কে শোনে কার কথা। এমন কি উপহারের লোভও দেখালাম, সন্ধ্যায় নিয়ে আসব।

তবু সে এখুনি আমাকে তার বাড়িতে নিয়ে যাবে, উপহারও দরকার নেই তার। তার কান্নাও থামে না, আমার হাতও ছাড়ে না। অনেক কষ্টে হাত ছাড়িয়ে নিতে হল। সন্ধ্যায় গিয়েও তার হাত থেকে আর ছাড়া পাওয়া যায় না। বাকী সবাই বিদায় নিয়ে চলে গিয়েছে, সে আমার কোলে উঠে শক্ত করে ধরে রেখেছে, এইবার কিভাবে যাবা।

আবারও তাকে কাঁদিয়েই চলে আসতে হল। এই কাহিনী অহরহই ঘটে। ওদের বাড়িতে যখনই যাই, বেচারীকে কাঁদিয়েই আসতে হয়। সেদিন অফিসে আরেক কলিগের পিচ্চি এসেছে। তার আবার সবার সাথেই খুব খাতির।

সবার সাথে গল্প আর খেলা করতে করতে হঠাৎ সে জানতে পারল আমার হাতে ব্যথা। সাথে সাথে অন্য সবার সাথে তার খেলা শেষ। আমার কাছে এসে আমার হাতে আদর করে দিল। এরপর আমার পাশে বসে আমাকে ওষুধও খাইয়ে দিল নিজের হাতে। বলতে থাকল, আন্টি শোনো, তুমি আমার বাসায় চল, চা খাও, পক্কন খাও, তাহলে দেখবা তোমার ভাল্লাগবে।

এত আদরের ডাক কি আর না করা যায়? আর না করলে সে ছাড়তও না। এরপর সে দুই হাতে আমাকে জড়িয়ে ধরে নিয়ে গেল তার বাসায়। নিজে ধরে আমাকে বসাল, আমার গায়ে লেপ তুলে দিল। পরে আবার নাচ-গানও করে দেখাল। ফেরার সময় অবশ্য এই পিচ্চি খুব একটা ঝামেলা করেনি, তবে এরপর থেকে দেখা হলেই সে লাফ দিয়ে বলে ওঠে, আন্টি আজকেও চল আমার বাসায়, অনেক মজা হবে।

বেচারীর মন খারাপ করিয়ে দিয়ে বলতে হয়, আজকে না রে আম্মু, আরেকদিন যাব। পিচ্চিগুলো এত ভালোবাসে আমাকে, আর আমি শুধু তাদের কাঁদাই, মন খারাপ করে দিই। আন্টিমনিটা এত পচা! ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.