সংসদে প্রথম আলোর বিরুদ্ধে দপ্তরবিহীন মন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের আনা সংসদ অবমাননার অভিযোগ আমরা অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছি। আমরা অবশ্যই খতিয়ে দেখতে চাই যে আমাদের মন্তব্য সংসদীয় কার্যপ্রণালি বিধি বা তার ঐতিহ্যগত রীতিনীতি লঙ্ঘন করেছে কি না। তাঁর মন্তব্যের উদ্ধৃতি ৩ জুলাইয়ের দৈনিক জনকণ্ঠ ও প্রথম আলো থেকে নেওয়া।
সেনগুপ্ত জানিয়েছেন, স্পিকার সম্পর্কে ‘যান্ত্রিক সিদ্ধান্ত ও স্পিকারের ভুল করার’ মতো মন্তব্য ‘তির্যক’, আর তির্যক মন্তব্য করার কোনো অধিকার কোনো পত্রপত্রিকার নেই। মধ্যযুগীয় ইংল্যান্ডের সামন্ততান্ত্রিক সমাজে ‘দ্য কিং ক্যান ডু নো রং’ প্রচলিত ছিল বলে আমরা জানি, কিন্তু স্পিকার সম্পর্কে কখনো এ ধরনের কিছুর প্রচলন ছিল না।
সেনগুপ্ত বলেছেন, ‘পৃথিবীর এমন কোনো সংসদ নেই, যেখানে স্পিকার গিলোটিন করেন না। তাঁর এই অধিকার সম্পর্কে কেউ কোনো দিন কোথাও, এমনকি সংসদেও প্রশ্ন তুলতে পারবে না। কিন্তু বিষয়টি নিয়ে প্রথম আলোর মতো একটি পত্রিকা তাদের সম্পাদকীয়তে (২ জুলাই প্রথম আলো) এ কথা কী করে লেখে?’
আমরা গিলোটিন বা তাঁর এখতিয়ার নিয়ে প্রশ্ন তুলিনি; শুধু আফসোস করেছি। ভারতের সঙ্গে বন্ধুত্ব করব, আর তার কাছ থেকে সংসদীয় রীতি শিখব না? যা নিয়ে বিতর্ক, তার নাম বাজেটের মঞ্জুরি দাবির ওপর ছাঁটাই প্রস্তাব। এ বিষয়ে ভারতের সংবিধান ও কার্যপ্রণালি বিধি প্রায় হুবহু নকল করেছি আমরা।
দুটি মঞ্জুরি দাবির ওপরে গিলোটিন চালিয়ে স্পিকার বাংলাদেশ সংবিধানের ৮৯(২) অনুচ্ছেদের ব্যত্যয় ঘটিয়েছেন। এই অনুচ্ছেদ বলেছে, ‘কোনো মঞ্জুরি দাবিতে সম্মতিদানের বা তাতে অস্বীকৃতিদানের ক্ষমতা সংসদের থাকবে। ’ ভারতের সংবিধানের ১১৩(২) অনুচ্ছেদে ঠিক এ কথাই লেখা। এখন আমরা দেখব, একই ধরনের বিধান ও বিরোধী দলের সৃষ্ট পরিস্থিতি সামনে রেখে দুই প্রতিবেশী স্পিকার কী করলেন। প্রতিষ্ঠিত নিয়ম হলো, স্পিকার গিলোটিনে (প্রস্তাবগুলো নাকচ) গেলে সব প্রস্তাবের মৃত্যু ঘটবে।
আলোচনার দুয়ার দড়াম করে বন্ধ হবে। গত ৩০ জুন বাংলাদেশের স্পিকারের সামনে প্রশ্ন ছিল, পদ্মা সেতু ও বিদ্যুৎ নিয়ে বিএনপিকে তিনি আলোচনা করতে দেবেন কি না। তিনি ‘সময়ের অভাব’ দেখিয়ে তা নাকচ করেন। ২০১০ সালের ২৭ এপ্রিলের ঘটনা। ভারতের স্পিকার ‘কয়েক দিনের’ আলোচনা শেষে পূর্বনির্ধারিত সময়ে গিলোটিনে যান।
এরপর সিপিআইএর একজন জ্যেষ্ঠ সদস্য নাটকীয়ভাবে উঠে দাঁড়ান। তিনি সংবিধানের ওই অনুচ্ছেদের দোহাই দিয়ে বললেন, তাঁকে এখন ছাঁটাই প্রস্তাব তুলতে ও আলোচনা করতে দিতে হবে। ভারতের ইতিহাসে এ ঘটনা কেউ কখনো দেখেনি। স্পিকার মীরা কুমার কী করলেন? তিনি নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করলেন। বললেন, ‘সাংবিধানিক অধিকার উৎকৃষ্ট অধিকার এবং তা রেওয়াজকে অতিক্রম করে।
সংবিধানে দেওয়া ছাঁটাই প্রস্তাব লোকসভার সদস্যদের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধিকার, যা ছাঁটাই করা যায় না। ’ ছয় মাস পরে জেনেভায় ইন্টার পার্লামেন্টারি ইউনিয়নের সভায় এ ঘটনা ‘স্পিকারের ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত’ হিসেবে নন্দিত হয়েছে। প্রথম আলোর সম্পাদকীয়তে কি তাহলে স্পিকারের সিদ্ধান্তকে ‘অনভিপ্রেত’ না বলে ‘অভিপ্রেত’ বলার সুযোগ ছিল? এমনকি এম কে আনোয়ার অভিযোগ করেছেন, প্রধানমন্ত্রী ঘাড় ঘুরিয়ে স্পিকারকে না করেছেন। এর ভিডিও ফুটেজ তো আছে। আমি জনাব আনোয়ারকে বললাম, আমাদের সম্পাদকীয় নয় বরং আপনাদের অভিযোগই গুরুতর সংসদ অবমাননাকর।
এর তদন্ত কাম্য।
সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত যখন প্রথম আলোর বিরুদ্ধে বক্তব্য দিচ্ছিলেন, স্পিকার তাঁকে বাধা দেননি। তবে দেখা গেছে, মওদুদ আহমদ, এম কে আনোয়ার প্রমুখ মাইক ছাড়াই সেনগুপ্তর কথার প্রতিবাদ করছেন। কিন্তু বিএনপি তার যথাদায়িত্ব পালনেও ব্যর্থ ছিল। পদ্মা সেতু ও বিদ্যুৎ নিয়ে মাত্র ৩০ মিনিট কথা বলতে রাজি ছিল তারা।
সেটুকু না পেয়ে তারা স্পিকারের বিরুদ্ধে অভিযোগ এনেছে। অবশ্য প্রায় ৩০ মিনিট এ নিয়ে তর্কও চলেছে।
অথচ আইনে ‘কয়েকটা দিন’ ছিল তাদের প্রাপ্য।
সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত আক্ষেপ করেছেন, ‘সংসদের আধাবিচারিক ক্ষমতা নেই। যদি তা থাকত, তাহলে ওই পত্রিকার সম্পাদক সাহেব অবশ্যই এখানে আসতেন।
আশা করি আমার এই বক্তব্য পত্রিকাটির সম্পাদকের কাছে যাবে এবং তিনি যা প্রয়োজন, সেই ব্যবস্থা নেবেন। যাতে করে সংসদে তাঁর (প্রথম আলোর সম্পাদক) ওপর কোনো রকম ব্যবস্থা নেওয়ার প্রয়োজন না হয়। ’
কে কাকে করুণা করছে। আর প্রকৃতপক্ষে কে বা কারা উপহাসের পাত্র? ১৯৭২ সালের সংবিধানই সংসদকে বিশেষ অধিকার আইন করতে অধিকার দেয়। হুমকি সত্ত্বেও আমরা এই আইনের সমর্থক।
কিন্তু কে কাকে কেন আইন করতে দিচ্ছে না? সেনগুপ্ত বলেছেন, ‘অনভিপ্রেত’, ‘যন্ত্রিক সিদ্ধান্ত’ ও ‘স্পিকারের ভুল’—এগুলো সংসদ অবমাননাকর। কিন্তু এগুলো অসংসদীয় বা অবমাননাকর পরিভাষা বলে বিশ্বের কোথায় কে কবে শুনেছে, তা আমাদের জানা নেই।
আগেই বলেছি, যা নিয়ে বিতর্ক, তার নাম মঞ্জুরি দাবি। এবারে এর সংখ্যা ছিল ৫৬টি। এগুলো মন্ত্রণালয়ভিত্তিক।
এবারে ৫৬টি দাবির বিপরীতে বিরোধী দল প্রায় ৮০০ ছাঁটাই প্রস্তাব দেয়। প্রতিটির বিপরীতে গড়ে প্রস্তাব দাঁড়ায় ১৫টি। এর মানে বিএনপির ১৫ জন প্রতিটি প্রস্তাবের ওপর এক মিনিট করে বলবেন। যোগাযোগমন্ত্রীর মঞ্জুরি দাবি, পদ্মা সেতু নির্মাণে সাত হাজার কোটি টাকা মঞ্জুর করা হোক। বিরোধী দল সুযোগ পেলে বলত, এই ‘দাবির পরিমাণ হ্রাস করে এক টাকা করা হোক বা ১০০ টাকায় হ্রাস করা হোক।
’ যখন এক টাকা চাইবে, তখন তা ‘নীতি অননুমোদন ছাঁটাই’ বলে গণ্য হবে। ১০০ টাকা কমানোর অর্থ হবে প্রতীক ছাঁটাই। এক টাকার প্রস্তাবে পদ্মা সেতুর ‘নীতি’ ও ১০০ টাকার প্রস্তাবে ‘অভাব-অভিযোগ’ নিয়ে কথা বলার সুযোগ থাকত।
দুই চিফ হুইপ এবং স্পিকার প্রতিনিধির মধ্যে অনুষ্ঠিত বৈঠকে আমরা ‘ঐকমত্যের ভিত্তিতে’ সংবিধানবিরুদ্ধ সিদ্ধান্ত নিতে দেখেছি। ‘সময়াভাবে’ ৫৬ দাবির বিপরীতে পদ্মা সেতু, বিদ্যুৎসহ সাতটি মঞ্জুরি দাবির ওপর কার্যত তিন ঘণ্টারও কম সময় আলোচনা করার সিদ্ধান্ত নেন তাঁরা।
সাতটির বিপরীতে প্রস্তাব ছিল শতাধিক। পাঁচটি মঞ্জুরি প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা বেলা সোয়া ১১টায় শুরু হয়ে বেলা প্রায় তিনটায় শেষ হয়। স্পিকারকে উদ্দেশ করে সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত ২ জুলাই বলেছেন, ‘আপনি লাঞ্চের সময়ও নেননি। ...এর চেয়ে ন্যায়বিচার এই সংসদে আর কী হতে পারে?’
আমাদের সংবিধান রক্ষা পেল না। সংসদীয় বিধি রক্ষা পেল না।
এরই নাম ‘ন্যায়বিচার’?
পরিহাস হলো, মঞ্জুরি দাবি নিয়ে বিএনপির আমলেও বাজেট আলোচনার শেষ দিনটিই বেছে নেওয়া হয়েছিল। তবে তাদের দাবি, তারা রাত ১০টা অবধি গলেও এবার বেলা আড়াইটায় বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
এম কে আনোয়ারকে বললাম, আপনারা কেন মাত্র এক দিন, তা-ও তিন ঘণ্টার একটা আলোচনা মানলেন? তিনি রেওয়াজের দোহাই দিলে তাঁকে বলি, আপনারা এমন কোনো রেওয়াজ করতে পারেন না, যাতে কোনো নির্দিষ্ট বিধি লঙ্ঘিত হয়। সংবিধানের সঙ্গে মশকরা ঘটে। সংসদীয় কার্যপ্রণালি বিধির ১১৭ ধারার ১ উপবিধি বলেছে, ‘মঞ্জুরি দাবি সম্পর্কে আলোচনা এবং ভোট গ্রহণের জন্য সংসদ নেতার সঙ্গে পরামর্শক্রমে স্পিকার “এমনসংখ্যক দিন” বরাদ্দ করবেন, যা জনস্বার্থের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ হবে।
’ স্পিকার ও দুই প্রধান দলের আধা বেলা আলোচনার সিদ্ধান্তকে আমরা জনস্বার্থের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ মনে করি না। ২ উপবিধি বলেছে, ‘বরাদ্দকৃত দিনসমূহের সর্বশেষ দিনে বৈঠক সমাপ্তির জন্য নির্দিষ্ট সময় বা পূর্বেই স্পিকার কর্তৃক নির্ধারিত সময় উপনীত হওয়ামাত্র মঞ্জুরি দাবি-সম্পর্কিত সমস্ত অবশিষ্ট বিষয় নিষ্পন্নের জন্য প্রয়োজনীয় প্রতিটি প্রশ্ন স্পিকার ভোটে দেবেন। ’ এই সময়ও নির্দিষ্ট বা নির্ধারিত ছিল না বলে বিএনপির দাবি। সে ক্ষেত্রেও বিধির বিচ্যুতি ঘটেছে।
আমরা সেনগুপ্তর কাছে প্রশ্ন রাখি, জনগণ আর কত দিন বাজেট পাসের যান্ত্রিক প্রক্রিয়া অবলোকন করবে? এবার তো গালাগালি ও কুৎসা নতুন মাত্রা যুক্ত করেছে! আমরা কবে সংসদীয় ও সাংবিধানিক স্খলন বা স্বৈরতান্ত্রিক মনোভাবের জাঁতাকল থেকে মুক্তি পাব? স্পিকার বা সম্পাদক কেউই আইনের ঊর্ধ্বে নন; এমনকি তাঁরা কেউ সমালোচনা ও জবাবদিহির বাইরে নন।
দিল্লির দি ইকোনমিক টাইমস-এর ২০০৫ সালের ২৪ আগস্ট একটি সম্পাদকীয়র শিরোনাম ছিল ‘ক্যান দ্য প্রেস ক্রিটিসাইজ দ্য স্পিকার?’ এটি বলেছে, ‘সমালোচনা ও শ্রদ্ধা হলো এক অপরিহার্য মূল্যবোধ এবং গণতন্ত্রকে যদি কার্যকর রাখতে হয়, তাহলে অবশ্যই এর সহাবস্থান থাকতে হবে। কারও অভিমত প্রকাশ, সমালোচনা করা এবং জনসেবক পদধারীদের জবাবদিহি নিশ্চিত করা গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অংশ। সংসদীয় রীতি ও বিশেষ অধিকার কোনো ব্যক্তি বা কারও দপ্তরকে জনগণের দৃষ্টি থেকে আড়াল করতে পারে না। ভারতীয় স্পিকারের রুলিং এটাই নিশ্চিত করল যে স্পিকার “দায়িত্বশীল” সমালোচনার ঊর্ধ্বে নন। ’
সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত যে বিশেষ অধিকারের দাবি করেছেন, তা কয়েক শ বছরের সংগ্রাম শেষে আদালত ও সংসদের মধ্যে রফা হয়েছে।
সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল মাহমুদুল ইসলামের সঙ্গে আমরা একমত যে আমাদের সংসদ ব্রিটিশ হাউস অব কমন্স নয়, এটা মার্কিন কংগ্রেসের সঙ্গে তুলনীয়। তিনি লিখেছেন, ‘সংসদের কর্তব্যে বাধাদান ছাড়া কোনো অবমাননাকর মন্তব্য প্রকাশের জন্য বাংলাদেশের সংসদ তার অবমাননার জন্য শাস্তি দিতে পারে না। ’
কর্তব্যে বাধাদান তো দূরের কথা, সংসদের কর্তব্যের বিচ্যুতি বরং আমাদের আহত করেছে, সেটাই আমরা বলেছি। আমাদের স্পিকারের গিলোটিনটি সম্পর্কে ভারতীয় স্পিকার ও অভিজ্ঞ পার্লামেন্টারিয়ান মীরা কুমারের ভাষায় বলব, স্পিকার বিএনপির প্রস্তাব ছাঁটাই করায় বাংলাদেশ সংবিধানের বিচ্যুতি ঘটেছে।
হাউস অব কমন্স তার অবমাননার জন্য আজ থেকে ৫৬ বছর আগে কোনো সম্পাদককে (সানডে এক্সপ্রেস-এর সম্পাদক জন জুনর) সর্বশেষ ডেকেছিল।
সাংসদ নন এমন কেউ (চার্লস গ্রিসেল) সংসদের বন্দিশালায় সর্বশেষ ১৮৮০ সালে জেল খাটেন। থমাস হোয়াইট সর্বশেষ এক হাজার পাউন্ড জরিমানা দিয়েছিলেন ১৬৬৬ সালে। এসব নির্দেশ করছে যে বাক্স্বাধীনতার বিকাশে বাধাদান বা বাঁধাছাদা করার সামন্তযুগীয় ধ্যানধারণা বহুকাল আগেই পরিত্যক্ত।
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক।
mrkhanbd@gmail.com।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।