নির্বাচনী গণরায় নিয়ে মানুষের অকুণ্ঠ সমর্থন আর প্রত্যাশার চলমান যুদ্ধাপরাধের বিচারপ্রক্রিয়া প্রশ্নবিদ্ধ করতে দুনিয়াজুড়ে অপপ্রচার চালাচ্ছে জামায়াত। সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে অভিযুক্তদের পরিবারের সদস্য ও সমর্থকরা। তারা আন্তর্জাতিক মিডিয়ার মাধ্যমে বিচারপ্রক্রিয়াকে বিকৃতভাবে উপস্থাপনের চেষ্টা করছেন। অপপ্রচারকারীরা বিচারকে 'প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক প্রতিহিংসা', 'ইসলামকে ধ্বংস করার প্রচেষ্টা', 'ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান সরকারের দালাল', 'মন্ত্রীরা বিচারে ফাঁসির আদেশ দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন'_ এমন সব প্রচার চালাচ্ছেন। বলে যাচ্ছেন 'গণমাধ্যম ট্রাইব্যুনাল নিয়ে কথা বললে রাষ্ট্রীয় বাহিনী কর্তৃক নির্যাতন', 'আন্তর্জাতিক মহল থাকায় ট্রাইবুন্যাল করা হয়েছে, না হলে গুলি করে বিরোধী রাজনীতিকদের মারা হতো'।
এসব অপপ্রচারের কথা স্বীকার করেছেন আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ। তিনি বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, 'বিশ্বব্যাপী এই অপপ্রচার চলছে। এটা রাষ্ট্রদ্রোহের শামিল। এ বিষয়ে শীঘ্রই পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। '
ইন্টারনেট থেকে পাওয়া তথ্যানুসারে, পশ্চিমা কিছু মানবাধিকার সংগঠন, কর্মী ও আইনজীবীর মাধ্যমে ব্যাপকভাবে বিভিন্ন সংবাদ নিবন্ধ, ব্লগ ও ভিডিওচিত্র তৈরি করে এ অপপ্রচার চালানো হচ্ছে।
সামাজিক যোগাযোগের সাইট ফেসবুক, টুইটার ছাড়াও নির্দিষ্ট কিছু সংগঠন প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে লন্ডন, নিউইয়র্ক, ওয়াশিংটন, দুবাই, রিয়াদ, কুয়ালালামপুরসহ বিশ্বের বিভিন্ন শহরে। এ ছাড়াও বিশ্বের নামকরা গণমাধ্যমগুলোতেও বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি ও বিচারবহিভর্ূত হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে সুকৌশলে প্রশ্ন তোলা হচ্ছে। নিউইয়র্ক টাইমস ও ইকোনমিস্টের মতো পত্রিকায় এ ধরনের নিবন্ধ প্রকাশের জন্য কাজ করছে বিভিন্ন লবিস্ট ফার্ম। এরই মধ্যে বিশ্বব্যাপী গ্রহণযোগ্য নিউইয়র্ক টাইমসের এক রিপোর্টে বলা হয়েছে, 'রাজনৈতিক প্রতিহিংসা ও প্রতিশোধের অংশ হিসেবে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের নামে জামায়াতে ইসলামীর মতো বাংলাদেশের একটি বড় ইসলামী সংগঠনের পাঁচ শীর্ষ কেন্দ্রীয় নেতাকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করার পাঁয়তারা চলছে। ' বিশ্বব্যাপী থিঙ্কটাঙ্ক হিসেবে কাজ করা 'দি ইকোনমিস্ট' পত্রিকায় আভাস দেওয়া হয়েছে, 'যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের নামে বাংলাদেশের একমাত্র বড় ইসলামী সংগঠনের কেন্দ্রীয় শীর্ষ নেতাদের ফাঁসিতে ঝুলিয়ে রাজনৈতিক ফায়দা লোটার চেষ্টা চলছে।
' জানা যায়, মূলত যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে আটক তিন শীর্ষ নেতা এবং আটকের বাইরে থাকা এক নেতার সন্তানরা এ অপপ্রচারে লিপ্ত রয়েছেন। তারা হলেন গোলাম আযমের ছেলে নুমান আযমী, মতিউর রহমান নিজামীর ছেলে ব্যারিস্টার নাজিব মোমেন, সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর মেয়ে ফারজিন কাদের চৌধুরী এবং এখনো আটক না হওয়া মীর কাশেম আলীর ছেলে মীর আহমদ বিন কাসেম। যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রে কাজ করা সংগঠনগুলোর মধ্যে রয়েছে 'সেভ বাংলাদেশ', 'সেভ ইসলাম', 'সেভ গোলাম আযম', 'জাস্টিস কনসার্ন', 'ওয়ার স্ট্র্যাটেজি ফোরাম' প্রভৃতি। এগুলো জাতিসংঘ সদর দফতর, মার্কিন পররাষ্ট্র দফতর, ইইউকে পার্লামেন্টের সামনে বিক্ষোভ সমাবেশ করে থাকে। জাস্টিস কনসার্ন ব্রিটেনের 'হাউস অব লর্ডস'-এ নিয়মিত সেমিনারের আয়োজন করে থাকে।
বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধের বিচারকে নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়। উপস্থিত থাকেন ব্রিটেনের পার্লামেন্টের সদস্যরা। যারা পরে বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশ সরকারকে তাদের আপত্তির কথা জানান। জাস্টিস কনসার্ন তাদের সেমিনারে বিভিন্ন সময়ে ব্রিটেনের সর্বজনস্বীকৃত 'অল পার্টি পার্লামেন্টারি হিউম্যান রাইটস গ্রুপ'-র অংশগ্রহণের কথাও বলা হয়। এ ছাড়াও ব্যবহার করা হচ্ছে আন্তর্জাতিক বার অ্যাসোসিয়েশন, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এবং বেশ কজন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন আইনজীবীকে।
সেভ গোলাম আযম ক্যাম্পেইন : ১ জানুয়ারি থেকে মালয়েশিয়া ও সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে একটি ভিডিও প্রচার করা হচ্ছে 'সেভ গোলাম আযম ক্যাম্পেইন' নামে একটি সংগঠনের ব্যানারে। সাত মিনিটের এ ভিডিওটিতে বাংলাদেশ সরকারের নামে নানা অপপ্রচার চালিয়েছেন গোলাম আযমের ছেলে নুমান আযমী। এর মূল কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে পাকিস্তান থেকে। এর নেপথ্যে রয়েছে পিআরসি নামের মালয়েশিয়ার একটি টিভি চ্যানেল যা ইসলামিক পার্টি অব মালয়েশিয়া বা পিএএস দ্বারা পরিচালিত। বিশ্বের অনেক টিভি চ্যানেলে এরই মধ্যে প্রচারিত এ ভিডিওতে নুমান আযমী বলছেন, '২০০৯ সালে বিতর্কিত এক নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পর থেকেই আওয়ামী লীগ নামের সেক্যুলারিস্ট এবং ইসলামবিরোধী একটি দল রাজনৈতিক নিপীড়ন চালাচ্ছে তার প্রতিপক্ষ দলগুলোর নেতা-কর্মীদের ওপর।
সম্প্রতি তারা তথাকথিত আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ আদালত খুলেছে। বেশ কয়েকজন মন্ত্রী প্রকাশ্যেই দাবি তুলেছেন এসব নেতাকে কোনো বিচার ছাড়াই ফাঁসিতে ঝোলানোর। ' মুসলিম সম্প্রদায়ের সাহায্য কামনা করে নুমান বলেছেন, 'এ অবৈধ শাস্তির হাত থেকে ইসলামপন্থিদের রক্ষা করতে এবং ইসলামকে দেশ থেকে উচ্ছেদের ষড়যন্ত্র থেকে বাঁচাতে সাহায্য প্রয়োজন। আমাদের দেশে ১৩ কোটি লোকেরও বেশি মুসলমান, দেশের মানুষ ইসলামকে ভালোবাসে। কিন্তু সরকারের বিরুদ্ধে মুখ খুললেই শাস্তি পেতে হয় বলে তারা ভয়ে কুঁকড়ে আছে।
তাই আমরা আপনাদের সাহায্য চাইছি যাতে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বাংলাদেশ সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করা হয়। যাতে এ সহিংসতা, এ আতঙ্কজনক পরিস্থিতি বন্ধ হয়। ' পাকিস্তানের করাচির ব্লক ৬-এর ইয়াসির রহমান, ভারতের তামিলনাড়ুর রয়াপেত্তাহ হেইট রাডের জাম্মি ভেঙ্কেটারামানায়া অ্যান্ড সন্স, আয়ারল্যান্ডের ব্রিজভিউ রাজ্যে সাউথ হারলেম অ্যাভিনিউর রেডিও ইসলাম ঠিকানা থেকে এ ভিডিও প্রচার করা হচ্ছে।
মীর কাশেম আলীর লবিস্ট ফার্ম 'ক্যাসিডি অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটস' : মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার ঠেকাতে ওয়াশিংটনে লবিস্ট ফার্ম 'ক্যাসিডি অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটস'-এর সঙ্গে চুক্তি করেছেন একাত্তরের ঘাতক হিসেবে অভিযুক্ত, জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য মীর কাশেম আলী। প্রায় দুই বছর ধরে এ ফার্মটি তার হয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশ সরকারের উচ্চপর্যায়ে তদবির চালিয়ে যাচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে থাকা প্রমাণপত্রে দেখা যায়, ২০১০ সালের ১০ মে চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয়। ক্যাসিডির পক্ষে চুক্তিতে সই করেন প্রতিষ্ঠানের জেনারেল কনসাল অ্যান্ড্র জে ক্যামেরস। আর মীর কাশেম আলী চুক্তিতে 'মীর আলী' নাম দিয়ে সই করেন। এ জন্য কাশেম আলী ওই প্রতিষ্ঠানকে দিয়েছেন আড়াই কোটি মার্কিন ডলার বা প্রায় ১৮২ কোটি টাকা। প্রথমবারের চুক্তির মেয়াদ শেষ হয় ২০১১ সালের ৫ এপ্রিল।
পরে তা আবার নবায়ন করা হয়। যুক্তরাষ্ট্রে কাজ করা বাংলাদেশের এক কূটনীতিক জানান, লবিস্ট ফার্ম 'ক্যাসিডি অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটস' মার্কিন প্রেসিডেন্ট ওবামার ঘনিষ্ঠ হওয়ায় এটি মার্কিন রাজনীতিতে বেশ প্রভাবশালী। ধারণা করা হয়, এ ফার্মেরই তৎপরতায় ঢাকা এসেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্টের যুদ্ধাপরাধবিষয়ক বিশেষ দূত ও মার্কিন একাধিক সিনেটর। মীর কাশেম আলীর পক্ষে তার ছেলে মীর আহমদ বিন কাশেম ও যুক্তরাষ্ট্র বিএনপি নেতা শরাফত হোসেন সব যোগাযোগ রক্ষা করেন।
'ডন' পত্রিকায় বিচারের বিরুদ্ধাচরণ সাকা চৌধুরীর মেয়ের : পাকিস্তানের বহুল প্রচারিত দৈনিক 'ডন'-এ বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধ বিচারপ্রক্রিয়া নিয়ে একাধিক নিবন্ধ লিখেছেন সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর মেয়ে ফারজিন কাদের চৌধুরী।
এ কাজে তাকে সহায়তা করেন সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর বাল্যবন্ধু একাধিক পাকিস্তানি বুদ্ধিজীবী।
নীরব পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় : বিশ্বব্যাপী এতসব অপপ্রচার চালানো হলেও এ বিষয়ে এখনো কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। এ বিষয়ে কোনো কর্মকর্তা কথা বলতেও ইচ্ছুক নন। তবে বহিঃপ্রচার অনুবিভাগের শামীম আহসান জানান, এ ধরনের অভিযোগ পাওয়া গেলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।