বগুড়ার তৈরি বাহারি ডিজাইনের চাদর ও কম্বল যাচ্ছে সৌদি আরব, মালয়েশিয়া, নেপাল, ভুটান, মিয়ানমার ছাড়াও মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে। বগুড়ার আদমদীঘি উপজেলার শাওইল গ্রামের ৪০ হাজার মানুষ চাদর ও কম্বল তৈরি করে নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তন করছে। এ গ্রামের তৈরি শীত পোশাক দেশের বাজার ছাড়িয়ে বিভিন্ন দেশের মার্কেট দখল করেছে। পাইকারি ব্যবসায়ীরা শাওইল গ্রাম থেকে প্রতি শীত মৌসুমে প্রায় কোটি টাকার কম্বল ও চাদর ক্রয় করে থাকেন। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা না থাকার পরও সম্ভাবনাময় এ শিল্প স্থানীয়দের প্রচেষ্টায় আজ দেশ ও বিদেশের বাজার দখল করে নিয়েছে।
জানা যায়, আদমদীঘির নশরৎপুর ইউনিয়নের শাওইল গ্রামে তাঁতি সম্প্রদায়ের কিছু লোক গামছা এবং লুঙ্গি তৈরি করে স্থানীয় হাটবাজারে বিক্রি করত। বাজারে চাহিদার সৃষ্টি হলে গার্মেন্টের সুতা কিনে তৈরি শুরু করে বিভিন্ন ডিজাইনের চাদর ও কম্বল। প্রথম দিকে গ্রামের পুরুষরা চাদর ও কম্বল বুনন ও বিক্রি শুরু করেন। কৃষি প্রধান এলাকায় বাড়তি আয়ের আশায় তাঁতি সম্প্র্রদায়ের বাহিরের মানুষও কম্বল ও চাদর বুনন শুরু করেন। এভাবে যতদিন অতিবাহিত হয়েছে শাওইল গ্রামের চাদর কম্বলের কদর ততই বেড়েছে।
আজ শাওইল ও তার আশেপাশের গ্রামের প্রায় ৭-৮ হাজার পরিবার তৈরি করছে শীতকালে ব্যবহারের বাহারি রকমের চাদর ও কম্বল। শাওইল গ্রামের এখন প্রতিটি বাড়িতে ছোট-বড় দু'একটি তাঁত বসেছে। পুরুষের পাশাপাশি গৃহবধূরাও এখন কম্বল আর চাদর বুনন করে থাকে। এর ফলে গ্রামের মানুষের মধ্যে অর্থনৈতিক সচ্ছলতাও বেড়েছে। শাওইল গ্রামের শীতবস্ত্রের কারিগর বরকত আলী জানান, দিন হাজিরাতে কম্বল বুনন করেন।
শীত আসার আগেই কাজ শুরু হয়। শীত মৌসুমের পরেও কাজ চলে। বড় মহাজনরা ডিজাইন দিয়ে সারা বছর চুক্তিতে কাজ করে নেয়। গ্রামের কহিনুর বেগম জানান, তিনি একটি তাঁত মেশিন বসিয়ে চাদর বুননের কাজ করেন। এ তাঁত মেশিনের উপর নির্ভর করে ৫ জনের সংসার চলে।
তিনিসহ পরিবারের সব সদস্য সেখানে কাজ করেন। সারা দিনে ২০ থেকে ২২টি চাদর তৈরি করেন। প্রতিটি চাদর ৩০ থেকে ৩৫ টাকা লাভে বিক্রি করে থাকেন। গ্রামের চাদর তৈরির কারিগর জহুরুল ইসলাম জানান, আগে লাভ হতো বেশি। এখন রং ও সুতার দাম বেড়ে যাওয়ায় কম্বল তৈরিতে খরচ পড়ছে বেশি।
তার মতো গ্রামের সবাই নিজেদের তাগিদেই এ কম্বল ও চাদর বুনে যাচ্ছেন। কম্বল চাদরের পাশাপাশি গামছা, সুয়েটার, হাত মোজা, শিশুদের জন্য বিভিন্ন ডিজাইনের শীতের কাপড়ও তৈরি হচ্ছে। শাওইল হাট ও বাজার কমিটির সভাপতি উজ্জ্বল হোসেন মেম্বর জানান, গ্রামের প্রায় ৮ হাজার পরিবারের মানুষ কম্বল ও চাদর তৈরি করে নিজেদের ভাগ্যোন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছে। এ কাজের সঙ্গে জড়িয়ে আছে প্রায় ৩৫ থেকে ৪০ হাজার মানুষ। বিভিন্ন জেলা থেকে পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ীরা কম্বল ও চাদর ক্রয় করতে আসেন।
প্রতি রবিবার ও বুধবার ভোর থেকে শুরু হয়ে বেলা ১০ টা পর্যন্ত হাটে কেনাবেচা হয়। হাটবার ছাড়াও বেচাকেনা হয়ে থাকে। পাইকারি ব্যবসায়ীরা এখান থেকে কেনাকাটা করে বিভিন্ন জেলায় চাদর ও কম্বল সরবরাহ করার পাশাপাশি সৌদি আরব, মালয়েশিয়া, নেপাল, ভুটান, মিয়ানমারসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে সরবরাহ করে থাকে। পাইকাররা মালামাল নিয়ে যাওয়ার পর নিজেদের সিল লাগিয়ে বিদেশের বাজারে বিক্রি করে থাকেন।
হাট ও বাজার কমিটির সাধারণ সম্পাদক জুয়েল আহম্মেদ জানান, শাওইল হাটে শুরুতে পাঁচটি দোকান থাকলেও এখন দোকান রয়েছে ছোট বড় মিলে প্রায় ১০০০ থেকে ১৫০০।
আর তৈরি হয়েছে নতুন নতুন কারিগর। খুব উন্নত মানের চাদর হওয়ায় এর চাহিদা বাংলাদেশে ব্যাপক। আর এই চাদরগুলো পৃথিবীর নানা দেশেও যায়। বিভিন্ন গার্মেন্টের সোয়েটারের সুতা প্রক্রিয়া করে তাঁতে বুনিয়ে তৈরি হয় কম্বল, চাদরসহ আনুষঙ্গিক পণ্য। কোনো ধরনের প্রচার ও সরকারি-বেসরকারি সহযোগিতা ছাড়াই এখানে গড়ে উঠেছে বিশাল এই কর্মক্ষেত্র।
চাদর তৈরির পাশাপাশি এখানে গড়ে উঠেছে শীতবস্ত্র তৈরির মেশিন, সুতা, রং, তাঁতের চরকা, তাঁত মেশিনের সরঞ্জাম ও লাটায়ের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। বাজারের আশপাশে গড়ে উঠেছে ছোট বড় অনেক দোকান। দোকানগুলোতে বেচাকেনায় নিয়োজিত কমপক্ষে ৮ হাজার শ্রমিক। যাদের মজুরি দিন শেষে ১০০ টাকা। এসব কর্মচারীর অধিকাংশ আশপাশ গ্রামের দরিদ্র মহিলা।
শাওইলের চাদর আর কম্বলের গ্রামকে ঘিরে হাজারও সম্ভাবনা থাকলেও তা সম্ভাবনার খাত হিসেবে কেউ দেখছে না। তাঁতিদের মধ্যে সরকারি সুবিধা বাড়াতে পারলে গ্রামটি হতো একটি দৃষ্টান্তমূলক রপ্তানির ক্ষেত্র। তাঁতশিল্পীদের পর্যাপ্ত মূলধনের জোগান, সঠিক বাজারজাত করণের সুযোগ এবং ঠিকমতো কাঁচামাল সরবরাহ করলে এখনো আগের মতোই জনপ্রিয় আর গৌরবময় করে তোলা যায় এদেশের তাঁতশিল্পকে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।