আজ থেকে প্রায় চার হাজার বছর আগে, রোদ থেকে বাঁচার জন্যই ছাতার প্রচলন শুরু হয়। অবশ্য ছাতা ছিল তখন ধনীদের পথচলার সঙ্গী। সাধারণ মানুষ তখন ছাতা ব্যবহার করার কথা কল্পনাই করতে পারত না। রাজা, ধনী এবং সমাজের উচুস্তরের লোকেরাই কেবল মাথার উপর ছাতা মেলে পথ চলতে পারত। ছাতা তাদের কাছে যতটা না ছিল রোদ থেকে বাঁচার জন্য, তারচেয়ে বেশি ছিল আভিজাত্যের প্রতীক।
রাজছত্রে আভিজাত্য
প্রাচীনকালে রাজাবাদশাহর মাথার উপর ভৃত্যরা উঁচু করে রাজছত্র তুলে ধরত। এটা ছিল মূলত মর্যাদা ও ক্ষমতার প্রতীক।
সে কালে রাজাবাদশাহদের পথচলার সময় একটি দৃশ্য খুব স্বাভাবিক ছিল-- রাজা আগে আগে চলছেন, আর ছত্রধর ভৃত্য ছাতা মেলে চলছে তাঁর পিছুপিছু। সেই রাজছত্র কি আমাদের সাধারণ ছাতার মতো দেখতে ছিল? মোটেই না। বাহারি নকশা-শোভিত ছিল সেই সব রাজকীয় ছাতা।
কী সুনিপুণ কারুকাজ থাকত তাতে! আকারেও হত বেশ বড় ও ভারি। রাজা যখন শোভাযাত্রা, যুদ্ধ কিংবা শিকারে এই রাজছত্র নিয়ে পথ চলতেন, তখন তা তাকে কেবল ছায়াই দিত না, ছাতা তখন তার ক্ষমতার প্রতীক হিসেবে শোভাবর্ধনও করত। হাজার হাজার বছর ধরে রাজছত্রের এই ব্যবহার চালু ছিল। মধ্যপ্রাচ্য, মিশর, আফ্রিকা, পারস্য ও এশিয়ার বিভিন্ন দেশের সকল ধর্মের শাসকরাই রাজছত্রের মাধ্যমে তাদের আভিজাত্যের জানান দিতেন। শুধু তাই না, রাজাগণ তাদের অধীন উচ্চপদস্থ কর্মচারী ও সেনাপতিদের পুরস্কার হিসেবেও ছাতা উপহার দিতেন।
রাজছত্রের ইতিহাস
কে কবে কখন ছাতা আবিষ্কার করেছিল, তা জানা যায় না। তবে ইতিহাসের ভিন্ন ভিন্ন পর্যায়ে অন্তত চারবার ছাতা আবিষ্কারের প্রমাণ পাওয়া যায়। মিশরীয় চিত্রলিপিতে এবং সমাধিতে-মন্দিরে আঁকা ছবি থেকে বোঝা যায়, খ্রিস্টপূর্ব ২৫০০-২৪০০ অব্দের দিকে রাজা ও দেবতাদের ছায়াদানের জন্য চারকোণা সমতল ছাতা ব্যবহার করা হত।
চিনদেশের ইতিহাসেও ছাতার উল্লেখ আছে। ‘ঞযব জরঃবং ঙভ তযড়ঁ’ বইতে খ্রিস্টপূর্ব ৪০০ অব্দে ব্যবহৃত গোলাকার সিল্কের ছাতা তৈরির কথা আছে।
এ ধরনের গোলাকার ছাতা শোভাযাত্রায় রথে ছায়াদানের জন্য ব্যবহৃত হত। এ ছাড়াও প্রতœতাত্তি¡ক গবেষকগণ মাটি খুঁড়ে বেশ কিছু ছাতাওয়ালা তামার মূর্তিও আবিষ্কার করেছেন। এক সময় চিনা রাজদরবারগুলোতে অসংখ্য ছাতার ছবি আঁকা থাকত। ১২৭৫ খ্রিস্টাব্দে পরিব্রাজক মার্কো পোলো গিয়েছিলেন কুবলাই খানের দরবারে। সেখানে তিনি দেখেছেন, সেনাপতির মাথার উপর সম্মানসূচক ছাতা মেলে ধরা হয়েছে।
চিন থেকেই রাজছত্রের ব্যবহার জাপান এবং কোরিয়ায় চালু হয়। জাপানে কয়েক শ বছর ধরে কেবল রাজারাই ছাতা ব্যবহার করতে পারতেন। কোরিয়ায়ও ছিল একই রীতি। সেখানেও ছাতাকে রাজকীয় প্রতীক হিসেবে মনে করা হত। সে সময় রাজার ছবি আঁকার উপরও নিষেধাজ্ঞা ছিল।
শিল্পীরা ঘোড়ার উপর রাজছত্রের ছায়া এঁকেই রাজার উপস্থিতি বোঝাতেন।
মিশরে চারকোনা ছাতা আবিষ্কারের কয়েকশ বছর পর মেসোপটেমিয়া (বর্তমানে ইরাক) অঞ্চলে রাজছত্র আবিষ্কার হয়। প্রাচীন আসিরিয়া নগর ছিল টাইগ্রিস নদীর তীরে। সে নগরের নানিভে এক খোদাইচিত্রে দেখা যায়, গোলাকার একটি ছাতা রাজার মাথার উপর ধরে রাখা হয়েছে। পরে মেসোপটেমিয়ার পূর্ব ও পশ্চিমাঞ্চলেও রাজছত্রের প্রচলন হয়।
আফ্রিকা মহাদেশেও ছিল রাজছত্রের প্রচলন। ইথিওপিয়ার দ্বাদশ শতকে আঁকা ছবি ও প্রাচীন গ্রন্থে প্রমাণ আছে রাজছত্র ব্যবহারের। এখনও সেখানে সেই ঐতিহ্য অক্ষুণ্ন রয়েছে। বিখ্যাত পর্যটক ইবনে বতুতার রচনাতেও পূর্ব আফ্রিকায় রাজকীয় ছাতা ব্যবহারের উল্লেখ রয়েছে। তিনি ১৪ শতকে পূর্ব আফ্রিকা ভ্রমণ করেছিলেন।
তার রচনায় উল্লেখ আছে, রোদ থেকে রক্ষা পেতে সে সময় সে দেশের রাজারা ছাতা ব্যবহার করতেন।
ভারতবর্ষের রাজছত্রের ইতিহাসও অনেক প্রাচীন। খ্রিস্টপূর্ব ৩০০ অব্দে রচিত বৌদ্ধদের প্রাচীন গ্রন্থ থেকে জানা যায়, তখনও ভারতবর্ষে ছাতার প্রচলন ছিল। ভারতীয় রাজাদের মধ্যে রাজছত্র ব্যবহার ছিল ঐতিহ্যের অংশ। দক্ষিণের মুসলিম রাজ্যগুলোর শিল্পকর্মে ছাতার চিত্র থেকে এটিই স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, এ অঞ্চলের হিন্দু ও মুসলিম উভয় ধর্মের শাসকরাই রাজছত্রকে বিশেষ মর্যাদার আসনে বসিয়ে ছিলেন।
খ্রিস্টীয় নবম শতকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় রাজছত্রের প্রসার ঘটে। কম্বোডিয়া, লাওস, মায়ানমার, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম এবং জাভার বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ রাজছত্র ব্যবহার শুরু করে।
গল্পে রাজছত্র
অতীতকালে রাজছত্র নিয়ে বিভিন্ন ধরনের গল্পগাঁথাও প্রচলিত ছিল। এর মধ্যে দ্বাদশ শতকের ব্রহ্মদেশের একটি কাহিনিতে রাজছত্রের ক্ষমতা চমৎকারভাবে ফুটে উঠেছে। গল্পটি এ রকম--
এক রাজা ছিলেন।
তার ছিল পাঁচ ছেলে। তার মধ্যে কে সিংহাসনে বসবে, এ নিয়ে রাজা ভারি চিন্তায় ছিলেন। কাকে রেখে কাকে ক্ষমতা দেবেন, তা ভেবেই পাচ্ছিলেন না।
অনেক ভেবে ভেবে তিনি এক বুদ্ধি বের করলেন। এক রাতে তিনি রাজছত্রটি খুলে এক জায়গায় দাঁড় করানোর আদেশ দিলেন।
এরপর পুত্রদের বললেন ছাতা ঘিরে শুয়ে পড়তে। তিনি বললেন, যার দিকে এই রাজছত্র ঝুঁকে পড়বে, তাকেই সিংহাসনে বসাবেন। সেই হবে পরবর্তী রাজা। আর এভাবেই রাজা তার সন্তানদের মধ্য থেকে উত্তরাধিকারী নির্বাচন করলেন।
বৃষ্টিতে ছাতা!
বৃষ্টি থেকে বাঁচতে ছাতা ব্যবহারের বুদ্ধিটা প্রথম এসেছিল চিনাদের মাথায়।
তারা অবশ্য ছাতা বানিয়েছিল কাগজ দিয়ে। তারপর সেই ছাতার গায়ে মোম বা বার্নিশ মেখে দিব্যি পানিরোধী করে তুলেছিল।
ছাতা যখন ফ্যাশন
রোদবৃষ্টিতে দারুণ কার্যকর বলে দিনদিন সাধারণ মানুষের কাছে ছাতা প্রয়োজনীয় হয়ে উঠতে লাগল। সপ্তদশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে ইংরেজ ও ফরাসিরা ছাতার ব্যবহার শিখল। আর তারপরে ছাতা রীতিমতো নারীদের ফ্যাশনের অংশ হয়ে দাঁড়াল।
নারীরা পোশাকের সঙ্গে মিলিয়ে রংবেরঙের ছাতা ব্যবহার করতে শুরু করল। তবে অষ্টাদশ শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত ইংল্যান্ডে ছাতার ব্যবহার ছিল বেশ সীমিত।
জন হ্যানয়ের ছাতা কাহিনি
ছাতা তো নারীদের ফ্যাশনের অংশ হয়ে গেল। ফলে বিপদে পড়ল ইংল্যান্ডের পুরুষরা। তারা প্রথম দিকে তো ছাতা ব্যবহারই করত না।
ইংরেজ পর্যটক জোনাস হ্যানওয়ে প্রথম এর ব্যাতিক্রম ঘটালেন।
১৭৫০ সাল থেকে তিনি ছাতাকে পথচলার সঙ্গী করে নিলেন। মূলত তার হাত ধরেই ইংল্যান্ডের পুরুষেদের কাছে ছাতা জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। তিনি ইংল্যান্ডের রাস্তাঘাটে, জনসম্মুখে ছাতা হাতে বের হতেন। টানা ত্রিশ বছর তিনি একাই ছাতা ব্যবহার করতেন।
এর জন্য তাকে অবশ্য কম অপমান সহ্য করতে হয়নি! পথেঘাটে তাকে দেখলেই লোকজন নানা ঠাট্টা-মশকরা করত।
প্রয়োজন বলে কথা! শেষ পর্যন্ত ইংল্যান্ডের নারী-পুরুষ সবাই ছাতা ব্যবহার করতে শুরু করে। ছাতা হয়ে উঠল সকলের পথ চলার সঙ্গী।
জেমস স্মিথ অ্যান্ড সন্স
১৮৩০ সালে লন্ডনে প্রতিষ্ঠিত হয় বিশ্বের প্রথম ছাতার দোকান। নাম ‘জেমস স্মিথ অ্যান্ড সন্স’।
লন্ডনের নিউ অক্সফোর্ড স্ট্রিটে এখনও দোকানটি চালু আছে। ১৮৩ বছর ধরে এই কোম্পানির দক্ষ কারিগররা নারী-পুরুষ উভয়ের জন্য তৈরি করে আসছে আধুনিক ও ঐতিহ্যবাহী সব ছাতা।
আধুনিক ছাতা
আঠার শতক পর্যন্ত ছাতার আকৃতি ছিল বড়। ওজনও ছিল বেশি। কারণ তখন ছাতার রড বানানো হত কাঠ বা তিমিমাছের কাঁটা দিয়ে।
আর হাতল তৈরি বানানো হত সোনা, রুপা, চামড়া, বিভিন্ন প্রাণীর শিং, বেত, হাতির দাঁত ইত্যাদি দিয়ে।
১৮৫২ সালে ব্রিটিশ শিল্পপতি স্যামুয়েল ফক্স প্রথম স্টিলের সরু দণ্ড দিয়ে ছাতা তৈরি করেন। এতে ছাতা আগের চাইতে হালকা হয়। ফলে তা বহন করাও হয়ে ওঠে সহজ।
প্রথম ফোল্ডিং ছাতা তৈরি করেন জার্মানির হ্যানস হাপট, ১৯২০ সালে।
আর তা ব্যাপক সাড়াও ফেলে। ১৯৬০ সালে বানানো হয় পলিস্টার কাপড়ের ছাতা। এভাবে সময়ের হাত ধরে ছাতার নানা উৎকর্ষ সাধিত হয়েছে। এর কাপড়ের রং ও নকশায় এসেছে বৈচিত্র্য। যুক্ত হয়েছে নানা প্রযুক্তিগত সুবিধা।
ছাতার শহর অ্যাগুয়েডা
পর্তুগালের অ্যাগুয়েডা শহরকে বলা যেতে পারে ছাতার শহর। এই শহরের কয়েকটি রাস্তার উপর রংবেরঙের ছাতা মেলে ঝুলিয়ে রাখা আছে। যাতে রোদ-বৃষ্টি যে কোনো আবহাওয়ায় লোকেরা আরামে পথ চলতে পারে। ‘দ্য আমব্রেলা স্কাই’ প্রকল্পের আওতায় ২০১২ সালে অ্যাগুয়েডা শহরের এই রাস্তাগুলোর উপর শতশত রঙিন ছাতা ঝুলিয়ে দেওয়া হয়। আর বর্ণিল ভাসমান ছাতায় ঢাকা আলো-ছায়াময় সে সব রাস্তায় হাঁটার জন্য সারা বিশ্ব থেকে বহু পর্যটক সেখানে যায় বেড়াতে।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।