ব্রাজিলের উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলিয় শহর ব্রাজিলীয়তে, ওয়ার্ক পারমিটের জন্য দল বেধে মানুষ সপ্তাহের পর সপ্তাহ অপেক্ষা করে। সাধারণত ব্রাজিল, বলিভিয়া বা হাইতির লোকেরাই এখানে আসে কাজের সন্ধানে। কিন্তু এখন বাংলাদেশের এ.এস.এম সুলতান আহাম্মদ এবং আবদুল আউয়ালও কাজের সন্ধানে ওয়ার্ক পারমিটের আশায় এদের সাথে সামিল হয়েছে।
ব্রাজিলে আসার কারণ:
সুলতান আহাম্মদের ধারনা ব্রাজিলে অর্থনীতি ক্রমেই শক্তিশালী হচ্ছ, তাই এখানে কাজের কোন অভাব হবে না। তারা খুব শীঘ্রই ওয়ার্ক পারমিট পেয়ে যাবে।
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অবস্থা বর্তমানে খুবই খারাপ। মূল্য স্ফীতি এবং একই সাথে মুদ্রা স্ফীতি জনজীবনকে বিপর্যস্ত করে তুলেছে। বাংলাদেশের অনেকেই কাজের জন্য দক্ষিণ আমেরিকাতে আসার অপেক্ষায় আছে।
সুলতান আহাম্মদ এবং আবদুল আউয়াল এর আগে কখনই ব্রাজিল আসে নাই এমনকি পর্তুগিজ ভাষাও জানে না। সুলতান আহাম্মদ একজন দক্ষ চিত্রকর।
এর আগে সে গ্রীসে কাজ করেছে। আর আবদুল আউয়াল একজন ইলেক্ট্রিশিয়ান। সে এর আগে মালয়েশিয়াতে কাজ করেছে।
সুলতান আহাম্মদ দেশে রেখে এসেছে তার স্ত্রী এবং সাত বছর বয়সের এক কন্যা সন্তান। আর আবদুল আউয়াল তার স্ত্রী, এক কন্যা এবং দুই পুত্র।
পরিবারের প্রয়োজনেই এই সুদূর প্রবাসে তারা এসেছে।
দীর্ঘ বিপদসংকুল যাত্রা:
বাংলাদেশ থেকে সুদূর ব্রাজিল। এত দীর্ঘ পথ তারা কি ভাবে পারি দিল? তারা ৯ হাজার ডলার দিয়েছে দালালকে এই কাজের জন্য। দালাল তাদের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, ইকুয়েডরে তাদেরকে উচ্চ বেতনের চাকরি যোগার করে দিবে। দালাল তাদেরকে প্রথমে ঢাকা থেকে দুবাই নিয়ে আসে।
এতে প্রায় সাড়ে চার ঘণ্টা বিমানে আসতে হয়। দুবাইয়ে ভাল কাজের সুযোগ না থাকায়, তারা ব্রাজিলকেই গন্তব্য হিসাবে বেছে নেয়।
বিরামহীন ভাবে ১৫ ঘণ্টা ফ্লাইটে তারা সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাই থেকে সাও পাওলোতে আসে। যেহেতু তাদের ব্রাজিলের কোন ভিসা ছিল না তাই প্রথমে সাও পাওলোতে আসে। কিন্তু তাদেরকে এয়ারপোর্ট থেকে বার হতে অনুমতি দেয় হয়নি।
তারপর তাদেরকে চিলির সান্তিয়াগোতে পাঠানো হয়। এখানেও প্রায় সোয়া তিন ঘণ্টার বিমান ভ্রমণ করতে হয়।
পরে অন্য একটি ফ্লাইটে তাদেরকে সান্তিয়াগো থেকে ইকুয়েডরের কোয়েটোতে পাঠানো হয়। এতে তাদের প্রায় ৫ ঘণ্টার বিমান ভ্রমণ করতে হয়। কোয়েটোতে তার কয়েক দিন অবস্থান করে।
কিন্তু ইকুয়েডরে তারা কোন কাজ যোগার করতে পরে নাই।
তারপর তারা ঠিক করে ব্রাজিল যাবে। তাদের ধারনা, যেহেতু ব্রাজিল বিশ্বের মধ্যে ৬ষ্ট বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ, তাই ব্রাজিলেই তারা কাজের সন্ধান পাবে।
কিন্তু সমস্যা হল তাদের তো ব্রাজিলের ভিসা নেই তারা কি ভাবে ব্রাজিলে প্রবেশ করবে। তাদের দালাল তাদের বাধ্য করে আরও ৫,৪০০ ডলার দিতে।
যা কিনা একজন মধ্যস্থতাকারীকে দেয়া হবে। এই মধ্যস্থতাকারী তাদের আশ্বাস দেয়, যদিও কাজটা খুব কঠিন, তবুও তারা যেন বিচলিত না হয়।
সীমান্ত অতিক্রম:
তারা ইকোয়োডরের কোয়োট থেকে ২৬ ঘণ্টায় পাবলিক বাসে করে, পেরুর লিমাতে আসে। তারপর বাস পরিবর্তন করে আরও ১২ ঘণ্টা দুর্গম পাহাড়ি পথে ব্রাজিলের নিকটবর্তী সীমান্ত শহর পেরুর ইনাপারি শহরে আসে।
এখানে এসেও তারা ব্রাজিলের ভিসা পায়নি।
এইবার দালাল আরও ৬ শত ডলার দাবি করে বসল। তাদেরকে নিয়ে যাওয়া হল, বলিভিয়া সীমান্তের দিকে। তার পর জঙ্গলের ভিতর দিয়ে কয়েক কিলোমিটার অতিক্রম করে ব্রাজিলে প্রবেশ করানো হল।
ব্রাজিলে পৌছার পর তাদের কাছে অবশিষ্ট রইল মাত্র ৩ শত ডলার। আর ডলার না থাকায় দালাল সুলতান আহাম্মদের মোবাইল ফোনটি নিয়ে নিলো।
২১ দিনের দীর্ঘ ভ্রমণে ক্লান্ত সুলতান আহাম্মদ এবং আবদুল আউয়াল এখন ব্রাজিলের ব্রাসিলিয়াতে অপেক্ষা করছে ওয়ার্ক পারমিটের জন্য। তাদের কাছে এখন আছে মাত্র ২০ ডলার। বাড়ীতে যে ফোন করবে, সেই মোবাইল ফোনটিও তাদের সাথে নেই। এতো কষ্টের মধ্যেও তারা কিছু স্ন্যাক আর কিছু পানি কিনেছে তাদের ব্রাজিল আগমনকে উদযাপনের জন্য। এইগুলি কেনার পর এখন তাদের হাতে আছে মাত্র ১০ ডলার।
তারা তাদের পাসপোর্ট স্থানীয় ফেডারেল পুলিশের কাছে হস্তান্তর করেছে ওয়ার্ক পারমিটের জন্য। কিন্তু ওয়ার্ক পারমিট পেতে তাদেরকে কম পক্ষে ৪ সপ্তাহ অপেক্ষা করতে হবে।
ভিন্ন সংস্কৃতি:
তারা বুঝতে পারছেনা কি ভাবে ব্রাজিলিয়ানদের সাথে ভাব বিনিময় করবে। এক ব্রাজিলিয়ান তাদের কে জিজ্ঞাস করল, তারা কোথা থেকে এসেছে। বাংলাদেশ শুনে, একজন বলল, ওহ বুঝেছি।
বাংলাদেশ ইন্ডিয়ার রাজধানী। সুলতান আহাম্মদ বাংলাদেশকে চিনানোর জন্য বলল, বাংলাদেশ, ইনডিয়া, পাকিস্তান।
নতুন প্রবণতা:
এটি একটি নতুন প্রবণতা। পূর্ব থেকে পশ্চিম এবং দক্ষিণ থেকে দক্ষিণে অভিবাসনের নতুন প্রবণতা। বাংলাদেশ থেকে ব্রাজিল।
বাংলাদেশিদের জন্য নতুন জায়গা। এখন তারা নিজেদেরকে নিজেদেরই রক্ষা করতে হবে। তাদেরকে সাহায্য করার জন্য কেউ নেই। একসময় অনেক বাংলাদেশি বাস করবে ব্রাজিলে। তখন একটা সমাজ গড়ে উঠবে।
যেমন, হাইতিয়ানরা এখনে সমাজবদ্ধ হয়ে বাস করছে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।