মন তুমি কৃষিকাজ জানো না, এমন মানবজমিন রইলো পতিত; ফলালে ফলতো সোনা "এক্সট্রা ম্যারিটাল অ্যাফেয়ার আজকাল খুবি নর্মাল ঘটনা" -ডায়লগটা আমার দেয়া না, সদ্য দেখা একটা নাটকের। অনেকদিন বাংলাদেশী চ্যানেল দেখা হয়না, দেখতে পারবো এই লোভে কালকে রাতে একটু দেখতে বসলাম কি দেখা যায়। ইতিমধ্যে বেশীরভাগ টিভি নাটকের অবস্হা যে যা তা সেটা আইডিয়া ছিলো। কালকেরটা খুব সম্ভবত এটিএন বাংলা; একটা নাটক দেখাচ্ছে যেখানে একজন মহিলা উগ্র সাজ করে অসম্ভব বাজে অভিনয় দিয়ে ছোটবোনকে বুঝানোর চেষ্টা করছে কেন তার রায়হানের সাথে প্রেম করা উচিত। ছোটবোন ও ততোধিক বাজে অভিনয় দিয়ে 'না এ হয় না' করে যাচ্ছে।
আমি ভাবতেছিলাম এই মেয়ে যে পোলার সাথে প্রেম করতে চাচ্ছেনা সে আসলে কতটা করুণ পোলা! তখনি ঢুম করে বড় বোনের ঐ ডায়লগ!! ডায়লগ শুনেই দেখলাম ছোট বোনের বিবেক পুরা ফকফকা! সে রাজী! তাই তো, এক্সট্রা ম্যারিটাল অ্যাফেয়ারতো করা যেতেই পারে! বুঝো!!!! [আগ্রহী দর্কশকরা দেখতে পারেন..নাটকের নাম 'বংশাল টু বারিধারা']।
এটি সদ্য দেখা তাই এটার কথা উল্ল্যেখ করলাম, তবে আমার মনে আছে ১ বছর আগেও আমাদের নাটকের মূল উপজীব্য বিষয়গুলোর মধ্যে একটা ছিলো পরকীয়া। মূলত ফারুকী ঘরানার ভাই-বেরাদারদের কিছুটা সূক্ষ্ণ, অনেকটাই স্থূল, ভাঁড়ামিপূর্ণ, অঅভিনীত নাটকগুলোতে এর প্রকোপ ছিলো চরম আকারে। বুইড়া বাচ্চাকাচ্চার বাপের অন্য মেয়েদের সাথে টাংকি মারা, অফিসের বিবাহিত বসের লুইচ্চামি, পাড়ার ইয়াং ছেলের বিবাহিত মহিলাদের সাথে প্রেম, বাচ্চার মায়ের মোবাইলে অন্যদের সাথে প্রেমালাপ খুবি স্বাভাবিক ভাবে বিভিন্ন নাটকে দেখানো হয়েছে এবং যথেষ্ট ফানি ও ইন্টারেস্টিংভাবেই দেখানো হয়েছে যাতে লোকজন দেখে মজা পান এবং এটিকে খুবি স্বাভাবিক মনে করেন! একটা নাটক দেখেছিলাম যেখানে এই ধরনের এক 'ফাউল' অভিনেতা পাড়ার বড় ভাই হাসান মাসুদের বউ বাধঁনকে রেগুলার ডিস্টার্ব করে। খুবি মজার(!) নাটক।
হাসতে হাসতে চেয়ার থেকে পড়ে যাওয়ার মতো। পরকীয়াকে এতটাই ইন্টারেস্টিংভাবে দেখানো হয়েছিলো অনেকেরই এই নাটক দেখে পাড়ার কোন এক ভাবীর সাথে টাংকি মারতে ইচ্ছা করবে!! মারজুক রাসেলকে আরেকটা নাটকে দেখেছিলাম এক বাচ্চার মা কে ফোন করে করে খাজুরা আলাপ করে এবং এটাই পুরা নাটক! এদের অভিনয় প্রতিভা ঢাকার জন্যই হয়তো এধরনের 'ফাউল' নাটকেই এরা অভিনয় করে যাচ্ছে। ফারুকীর ভাই-বেরাদারদের অধিকাংশ অভিনেতা/নেত্রীরাই অবশ্য বলেন, "আমাদেরতো কোন স্ক্রীপ্ট থাকেনা, আমরা রিয়েল লাইফের মতো করেই অভিনয় করি"। সব নাটকে তাঁদের একি ধরনের অভিনয় দেখলেই অবশ্য ব্যাপারটা বুঝা যায়। সব চরিত্রে নর্মাল লাইফের মতো করে কথা বলা তা যে অভিনয় না, এটা বুঝার ক্ষমতা তাদের নাই এবং এই সব ফা্উল অঅভিনয় করেই অনেকে এখন স্টার! তবে নাটকের চরিত্রের মতো যদি তাদের রিয়েল চরিত্র হয়ে থেকে তাহলে সেটা যথেষ্ঠ চিন্তার বিষয়।
তাদের ব্যক্তিগত জীবনে তারা যা করুক তাতে কিছু আসে যায়না, কিন্তু ঘুরেফিরে সবসময় এইরকম চরি্ত্রে অভিনয় করা মানুষগুলোই কিন্তু আমাদের অনেকের চোখে আইডল বা হিরো। হিরোরা খুব মজা করে পরকীয়ার মতো বাজে কাজ করছে যার ফলে অনেকের চোখেই বাজে কাজ আর বাজে কাজ থাকছেনা, হয়ে উঠছে খুবি 'কুল' এবং আকর্ষনীয় কাজ।
একটু অন্য কথা ঘুরে আসলাম। আমার মূল চিন্তা ছিলো মিডিয়াতে 'পরকীয়াকে উপস্হাপন' নিয়ে লেখা, কিন্তু মাঝখান থেকে কিছু অঅভিনেতাদের নিয়ে কথা বলে ফেললাম, এদের অন-স্ক্রীন কার্যকলাপ অবশ্য সম্পৃক্ত মূল বিষয়ের সাথে। মিডিয়াতে 'পরকীয়া' নিয়ে একদিন একজন মন্তব্য করেছিলেন, "ঠিকি আছে, পরকীয়া ইজ নাও এ পার্ট অফ সোসাইটি।
চারপাশে যা হচ্ছে টিভিতে রিয়েল লাইফ তুলে আনা হচ্ছে!" কথা ঠিক, চারপাশে পরকীয়া হচ্ছে। আগেও কম বেশী হতো, ভবিষ্যতেও কম বেশী হবে। এই জিনিস পুরাপুরি বন্ধ করা সম্ভবনা। মিডিয়াতে দেখাক বা না দেখাক। ঘটনা কিন্তু মিডিয়াতে দেখানো নিয়ে না, ঘটনা এটাকে সবার সমানে এত সহজ, সরল ঘটনা হিসেবে উপস্হাপনা করা নিয়ে।
এই জিনিস আদিকাল থেকেই আছে, তবে খারাপ দৃষ্টিতে দেখা হয়েছে সবসময়, কখনোই ইনডিরেক্টলীও উৎসাহিত করা হয়নি। আামাদের সবার মধ্যেই খারাপ প্রবৃত্তি রয়েছে, নিষিদ্ধ জিনিসে কম বেশী সবারই আকর্ষণ আছে, আমরা সবাই অনেককিছুই কল্পনা করি। কিন্তু আমরা আমাদের খারাপ প্রবৃত্তি দমন করে রাখি, নিষিদ্ধ জিনিস থেকে নিজেদের দূরে রাখি, মাথায় আসলেই একটা জিনিস করতে দৌড় দেইনা। কারণ আমাদের ধর্মীয়, সামাজীক, পারিবারিক শিক্ষা আমাদের শিখিয়েছে কোনটা ঠিক, কোনটা ভুল; কোনটা করা উচিত, কোনটা নয়। যে কোন নিষিদ্ধ সম্পর্কে মানুষের আগ্রহ থাকে, কিন্তু ভয়, সংস্কার, বিবেক কাজ করে, যে কারণে সবাই নিষিদ্ধ সম্পর্কে জড়ায়না।
সমস্যা ঘটে তখনি, যখন মানুষের মধ্যে সংস্কারটুকু কাজ করেনা। বিবেক বলতে ভুলে যায় ভুল হচ্ছে। নিষিদ্ধ কাজের পরিণাম মাথায় আসেনা। এইসব ভয় কেটে দেয়ার কাজ সবচেয়ে সহজে করতে পারে গণমাধ্যমগুলো। আপনি যতই বলুননা কেন যে, যারপাশে এইসব ঘটছেই, বরং সবাইকে দেখালে বা জানালেই ভালো, সাবধান হবে।
আমি পুরোপুরি দ্ধিমত পোষণ করছি। কিছু জিনিস আড়ালে আবডালে থাকায় ভালো, সবার সামনে যত স্বাভাবিকভাবে উপস্হাপন করবেন, ততই এর খারাপ দিকটা মানুষের চোখ এড়াতে থাকবে। একটা ঘটনা মনে পড়লো পেপারে পড়েছিলাম, ইংল্যান্ডে কয়েক বছর আগে একটা সেক্স এডুকেশন বিল পাশ করানো হোল এই বলে যে, স্কুলের ছেলেমেয়েরাতো সেক্স করেই; বরং তাদের মধ্যে এই ব্যাপারে শিক্ষা দিলে খারাপ কিছু কম হবে, এরা সেইফ সেক্স করবে। ফলাফল, ২ বছরের মাথায় বাচ্চা পোলাপাইনদের মধ্যে উল্টাপাল্টা সেক্স করার প্রবনতা এবং প্রেগনেন্সির হার এমন বেড়ে গেলো যে পার্লামেন্ট এখন কিভাবে কি করা যায় সেটা নিয়ে টেনশিত! ঐ যে, আগে স্কুলের ১০টা পোলাপাইন করতো, বাকি ১০ জন ভয়ে/সংস্কারে করতোনা। কিন্তু এখন ২০ জনেই করে।
কারণ সবার কাছেই এটা নর্মাল ব্যাপার।
পরকীয়ার ব্যাপারটাও আমার কাছে এমনি মনে হয়েছে। আগে ১০ জন করতো, এখন এমন সহজভাবে উপস্হাপন করা হচ্ছে যে বাকি ৯০ জনের মধ্যে অনেকেই আর তাদের অবদমিত কামনাবাসনাকে দমন করতে আগ্রহী নয়। আমাদের নাটকগুলোকে গালি দেয়ার আগেই অবশ্য আমাদের সাড়ে সর্বনাশ করে দিয়েছে হিন্দী সিরিয়ালগুলো। পশ্চিমা কালচার আমাদের সাথে যায়না, ওরা যাই দেখাক আমরা অত সহজে ফলোও করিনা।
কিন্তু ভারত পার্শ্ববর্তী দেশ হওয়ায় আমাদের সাথে সংস্কৃতিতে অনেক মিল এবং এই জায়গাটাতেই আমাদের ক্ষতি যা হওয়ার হয়ে গেছে। ওরা যা-ই দেখাক আমরা জান্তে-অজান্তে মেনে নিই। আমাদের মিডিয়া এক কাঠি সরেস হিসেবে ভারতীয় কালচার আমাদের মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টায় রত। ওদের সিরিয়ালগুলোতে পরকীয়া, ফ্যামিলী পলিটিক্স ছাড়া তেমন কিছুই আসলে নেই। যেটা এখন আমাদের সিরিয়ালগুলোরও মূল উপজীব্য।
অনেকেই খুবি উদারমনা এবং প্রগতিশীলভাবে এইসব মেনেও নিচ্ছে। অনেক আড্ডা-তর্কে পরকীয়ার স্বপক্ষেও কথা বলতে শুনেছি। যা করতে ইচ্ছা করে করা উচিত, মনের মিল না থাকলে ভালোবাসা খুঁজে ফেরা উচিত, শরীরের ডাকে সাড়া দিবেই টাইপ কথাবার্তা। হঠাৎ করে এইসব মনের অমিল গুলো, শরীরের আহবান বিবাহিত জীবনে এত বড় করে সবার সামনে দেখা দিচ্ছে কেন আমরা কি চিন্তা করেছি? মানুষের মধ্যে এইসব চিন্তা কেমন করে আসছে সেটা কি আমারা ভেবে দেখেছি? একজন বিবাহিত জীবনে সুখী মানুষের কাছেও কেন পরকীয়া আকর্ষনীয় চিন্তা? কেন অফিসের কলিগ বা আড্ডার বন্ধুরা কেউ পরকীয়া করলে তাকে খুব 'কুল' হিসেবে বরং উৎসাহ দেই? আমাদের মানসিকতার চরম অবনতি হয়েছে এটা অবশ্যই ঠিক, মিডিয়া এই অবনতিতে চরমভাবে রসদ দিয়ে যাচ্ছে। পরকীয়া কিছু মানুষের জীবন ধ্বংস করার বিপরীতে কয়টা মানুষের জীবন আসলে সত্যিকারভাবে সুখী করেছে? ধ্বংস এবং সৃষ্টির অনুপাতটা ৯৯:১ টাইপের কিছু প্রকাশ করবে বলে দেয়া যায়।
আমাদের দেশে এখনো মানুষের মধ্যে ধর্মীয়, সামাজীক সংস্কার কিছুটা রয়ে গেছে তা-ই এখনো আমরা শারীরিক চাহিদার কাছে অন্য সবকিছুকে তুচ্ছ করে দিয়ে নিজেদের পশুর কাতারে নিয়ে যাইনা; তথাকথিত মানসিক শান্তি পেতে নিজের পরিবার-পরিজনকে ভুলে যাইনা; তাইতো আমাদের সামাজীক, পারিবারিক সততা নিয়ে পশ্চিমাদের কাছে এখনো গর্ব করা যায়। কিন্তু আস্তে আস্তে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক পরকীয়ার কবলে পড়ে যেভাবে ঠুনকো হয়ে যাচ্ছে, গর্ব করার মতো খুব বেশী দিন পাওয়া যাবেনা। পত্রিকা খুললেই যেভাবে পরকীয়ার কারণে বাচ্চা খুন, স্বামী খুন, স্ত্রী খুন, নির্যাতন, বিবাহ বিচ্ছেদ চোখে পড়ে ইদানীং.....আমাদের মনমানসিকতায় বিরাট পরিবর্তন আনা জরুরী হয়ে পড়েছে। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।