আক্রান্ত সাংবাদিক, মত প্রকাশের স্বাধীনতা ও রাষ্ট্রপক্ষ
ফকির ইলিয়াস
======================================
ঢাকায় আক্রান্ত হয়েছেন আরেকজন সাংবাদিক। তিনি টিভি চ্যানেল আরটিভির স্টাফ রিপোর্টার অপর্ণা সিংহ। ছাত্র ভর্তির নামে অতিরিক্ত ফি আদায়ের খবর পেয়ে এই টিভি চ্যানেলের সাংবাদিক ঢাকার মিরপুরের মণিপুর স্কুলের মূল ক্যাম্পাসে গিয়েছিলেন। সেখানেই তাকে মারধরের অভিযোগ উঠেছে সরকারদলীয় সংসদ সদস্য ও প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা পরিষদের সভাপতি কামাল আহমেদ মজুমদারের বিরুদ্ধে। আরটিভির বরাত দিয়ে বিভিন্ন ব্লগ, ইউটিউব, মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়েছে সংবাদটি।
তাতে দেখা যাচ্ছে, সাংবাদিক অপর্ণা সিংহ কামাল আহমদ মজুমদারকে বলছেন, ‘আপনাকে একটি প্রশ্ন করতে চাই’। এটা বলার পরপরই, কামাল আহমদ মজুমদার বলছেন, ‘রাখেন আপনার এইটা’। অর্থাৎ ক্যামেরা দূরে রাখেন। বলেই শুরু হয়ে গেছে ধাক্কাধাক্কি। পরে দেখা গেছে হেনস্তা হয়ে আহত হয়েছেন এই টিভি সাংবাদিক।
এখানে লুকানোর কিছু নেই। আজকাল টিভি ফুটেজে অনেক কিছুই ধারণ করা থাকে। এই ঘটনাটিও টিভির কল্যাণে ছড়িয়ে পড়েছে দেশে- বিদেশে। এদিকে কামাল আহমেদ মজুমদার অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছেন, তিনি ওই প্রতিবেদককে সরিয়ে দিয়েছেন মাত্র।
আরটিভির যুগ্ম বার্তা সম্পাদক আকতার হোসেন বিভিন্ন মিডিয়াকে বলেছেন, মণিপুর স্কুলে সরকার নির্ধারিত পাঁচ হাজার টাকা ফির সঙ্গে উন্নয়ন ফি হিসেবে ২০ হাজার টাকা আদায় করার প্রতিবাদ করে আসছেন অভিভাবকরা।
গেলো মঙ্গলবার সকালে তাদের সঙ্গে স্থানীয় এমপি কামাল আহমেদ মজুমদারের একটি সভা হওয়ার কথা ছিল। আকতার হোসেন জানান, কামাল মজুমদার স্কুলে গেলে অপর্ণা সিংহ তার সাক্ষাৎকার নেয়ার চেষ্টা করেন। এ সময় সংসদ সদস্য আমাদের প্রতিবেদককে ধাক্কা দেন। এক পর্যায়ে তার গায়েও হাত তোলেন এবং অকথ্য ভাষায় গালাগাল করেন।
এই ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন এমপি কামাল মজুমদার অন্যভাবে।
অভিযোগ অস্বীকার করে কামাল মজুমদার বলেছেন, অভিভাবক মিটিংয়ে যোগ দিতে স্কুলে গেলে আরটিভির রিপোর্টার তার ক্যামেরাম্যানকে বলেন, ওই লোকটার ছবি তোলো। আমি তাকে সরিয়ে দিয়েছি মাত্র। মারধর কেন করবো? তিনি অভিযোগ করেন, ওই রিপোর্টার অনুমতি ছাড়াই ক্লাসরুমে ঢুকে স্কুলের প্রধান শিক্ষককে হুমকি দিয়েছেন। এদিকে ঘটনার পরপরই এই ঘটনার জন্য দুঃখ প্রকাশ করেছেন মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ।
সাংবাদিককে লাঞ্ছিত করার দায়ে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হবে কিনা সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, এ ঘটনায় আমি দুঃখিত ও মর্মাহত।
তিনি এ ঘটনার নিন্দা জানিয়ে বলেন, এ ধরনের ঘটনা কখনো সমর্থনযোগ্য নয়। তদন্ত করে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। এই আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা, গোটা সাংবাদিক সমাজের জন্য অত্যন্ত উদ্বেগজনক। এর প্রতিবাদ ও নিন্দা অব্যাহত রয়েছে দেশে বিদেশে। নারী সাংবাদিক কেন্দ্র এই হামলার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছে।
এক বিবৃতিতে সংগঠনের সভাপতি নাসিমুন আরা হক ও সাধারণ সম্পাদক পারভীন সুলতানা ঝুমা বলেছেন, পেশাগত দায়িত্ব পালনকালে সাংবাদিকের ওপর এ ধরনের পেশিশক্তির আক্রমণ অত্যন্ত উদ্বেগজনক।
এই ঘটনার মাত্র কদিন আগে ঘটেছে আরেকটি মর্মান্তিক ঘটনা। সড়ক দুর্ঘটনায় পা হারিয়েছেন দৈনিক কালের কণ্ঠ’র সিনিয়র সাংবাদিক নিখিল ভদ্র। ঘাতক বাস তাকে চাপা দিয়েছিল। কী হৃদয়বিদারক দৃশ্য! সুস্থ মানুষটি কিছু সময়ের মাঝেই পঙ্গু হয়ে গেলেন! প্রধানমন্ত্রীর অফিস থেকে জানানো হয়েছে নিখিল ভদ্রকে বিদেশে চিকিৎসার জন্য পাঠানো হবে।
এটাই শেষ কথা নয়। কেন এমন হচ্ছে? কেন বাস-ট্রাক ড্রাইভাররা ট্রাফিক আইন মানছে না? নিখিল ভদ্রের এই আহাজারি কিংবা তার জন্য তার পরিবারের কিংবা সতীর্থদের যে কান্না, তার দাম কিভাবে শোধ করবে সরকার?
ক্ষতিপূরণ দিয়ে সরকার যে কোনো দুর্ঘটনার দায় এড়াতে পারে না। পারবে না। আজ নিখিলের চিকিৎসা করাতে সরকারের পক্ষ থেকে যে ব্যয় করা হবে, সেটা তো নিখিলেরই অর্থ, সাধারণ মানুষের অর্থ। চালকের ভুলের খেসারত নিখিল বা নিখিলের মতো সাধারণ মানুষ কেন দেবে? বিআরটিসির মতো প্রতিষ্ঠানে এমন বাসচালক নিয়োগ দেয়া হয়েছে, যে ট্রাফিক আইন মানে না।
এটা অবশ্যই সরকারের ব্যর্থতা হিসেবেই গণ্য হওয়া উচিত।
সড়ক দুর্ঘটনায় আমরা হারিয়েছি তারেক মাসুদ, মিশুক মুনীরের মতো কৃতী মানুষদের। মিরসরাই ট্রাজেডির শোক জাতি ভুলে যায়নি। এবার পা হারিয়েছেন নিখিল ভদ্র।
দেশে যেন সড়ক দুর্ঘটনার হার বেড়েই চলেছে।
দেশের সব প্রান্তে নিয়মিত ঘটছে দুর্ঘটনা। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই চালকের ভুলের মাশুল গুনতে হচ্ছে নিরীহ মানুষকে। নিভে যাচ্ছে কতো জীবনপ্রদীপ। বারবার প্রতিবাদে সোচ্চার হয়েছে দেশ। নায়ক ইলিয়াস কাঞ্চন দেশের বিভিন্ন জেলায় ঘুরে ঘুরে বলছেনÑ নিরাপদ সড়ক চাই।
কিন্তু লাভ হয়নি। কেন হয়নি? কার স্বার্থে হয়নি? স্বাভাবিক মৃত্যুর নিশ্চয়তা চেয়ে পথে নেমেছে সাধারণ মানুষ। তাদের চাওয়া পূরণ হয়নি। না হওয়ার প্রধান কারণ দেশের শীর্ষ দুর্নীতি সিন্ডিকেট। যারা যাকে তাকে লাইসেন্স দেয়।
ট্রাফিক আইনের তোয়াক্কা না করেই ওরা গাড়ি চালায়।
তাই এ প্রশ্নটি বারবার আসছে, সরকার কি নিশ্চিন্তে পথে চলার নিরাপত্তাটুকুও দিতে পারবে না সাধারণ মানুষকে? সরকারের পক্ষ থেকে চালকদের প্রশিক্ষিত করার কিংবা ট্রাফিক আইন জোরদার করার উদ্যোগ নেয়ার জোর প্রচেষ্টা করা হবে না? কঠোরভাবে তা পালনের বিধিও কি করার ক্ষমতা নেই সরকারের শীর্ষ শক্তিধরদের? বাংলাদেশে সাংবাদিকরা আক্রান্ত হয়েই চলেছেন। সাংবাদিকদের ওপর অনাকাক্সিক্ষত ও অনভিপ্রেত হামলার ঘটনা প্রতিকারহীনভাবেই ঘটে চলেছে। প্রতি বছরই হামলার শিকার হয়েছেন সাংবাদিকরা। পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়েই আক্রমণের শিকার হতে হচ্ছে সাংবাদিকদের।
মতপ্রকাশের স্বাধীনতা সবারই আছে। কিন্তু কেউ প্রশ্ন করলে উত্তর না দিয়ে তাকে শাসানো কিংবা আক্রমণ তো কোনো সভ্য সমাজে হতে পারে না। সাংবাদিকদের ওপর একের পর এক হামলা ও সাংবাদিক নির্যাতনের ঘটনা থেকে এটাই প্রমাণ হয় যে মতপ্রকাশের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করতে চাইছে কেউ কেউ। তারা তাদের অপকর্ম ঢেকে দিতে চাইছে গলার জোরে। এ অবস্থার প্রতিকার দরকার।
সরকারের এ বিষয়ে বোধোদয় হওয়া দরকার। কারণ কোনো পেশিবাজ আজ আছে, কাল তার পেশি বলীয়ান নাও থাকতে পারে। কিন্তু সাংবাদিকদের কলম, সাংবাদিকদের ক্যামেরা জাতির পক্ষে আছে, থাকবে চিরঅম্লান। বাংলাদেশের সাংবাদিকরা ধনী নন। খুব বড় অংকের টাকাও তারা কামাই করেন না।
সাংবাদিকদের এমনিতেই নানা প্রতিকূলতার মধ্যে কাজ করতে হয়। শাসকদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে কাজ করতে হয়। তুষ্ট করতে না পারলে নেমে আসে নির্যাতনের যাতনা। সাংবাদিক নির্যাতনের ঘটনা আমাদের দেশে নতুন কোনো ঘটনা নয়। স্বৈরশাসনের আমল থেকে শুরু করে বর্তমান গণতান্ত্রিক শাসনামলেও ঘটছে সাংবাদিক নির্যাতনের ঘটনা।
দেশে গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় ফিরে যাওয়ার পর ধারণা করা হয়েছিল, সাংবাদিকতা পেশাও মুক্ত পরিবেশ ফিরে পাবে। না, তা হয়নি। অনেকেই দলবাজি বাড়াতে চেয়েছেন সাংবাদিকদের ঘিরে। প্রকাশ্য বিধিনিষেধ না থাকলেও পেশার ঝুঁকি আজো রয়ে গেছে। মিরপুরের ঘটনা গোটা রাষ্ট্রের জন্য বেদনাদায়ক।
এর নিন্দা জানানোর কোনো ভাষা নেই। এই ঘটনার সুবিচার হোক।
৫ জানুয়ারি ২০১২
=========================================
দৈনিক ভোরের কাগজ / ঢাকা/ ৭ জানুয়ারি ২০১২
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।