কল্পিত সুখ শুধু কল্পনায় সুন্দর বাস্তবতায় খুব বেমানান। নিম্মি, বিষণ্ণ বিকেলে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে খুব বিমর্ষ হয়ে কিছু হয়তো ভাবছে। পেছন থেকে ওর মা এসে দাঁড়াতেই যেন চমকে মেয়েটা।
নিম্মিঃ ওহ, মা তুমি।
মাঃ হুম...অনেকক্ষন ধরে খেয়াল করলাম ছুপ চাপ দাঁড়িয়ে কি যেন ভাবছিস, কি হয়েছে তোর?
নিম্মিঃ কিছুনা তো।
এমনি ভাল্লাগছেনা। তুমি অফিস থেকে কখন এলে?
মাঃ ঐযে বললাম অনেক্ষন হল। তুই কখন এসেছিস ইউনিভার্সিটি থেকে?
নিম্মিঃ না আজ তো যাই নি। শরীর ভালো লাগছিলনা তাই...
মাঃ কেন? কি হয়েছে? আমাকে ফোন দিলিনা কেন...
নিম্মিঃ এত ব্যস্ত হচ্ছও কেন? আমি ঠিক আছে। ।
অই একটু মাথা ব্যাথা ছিল তাই। এখন যাও তুমি ফ্রেশ হয়ে নাও আমি কফি করে দিচ্ছি।
এই বলে নিম্মি কফি বানাতে চলে গেলো।
নিম্মির বয়স বেশী না। খুব শান্ত কিন্তু ভীষণ অভিমানী আর খুব সহজে কষ্ট পায়।
আর অর মা টাকে নিম্মি আজ বুঝে উঠতে পারেনা। মা হিসেবে পৃথিবীর সেরা সে কিন্তু মাঝে মাঝে এই মাকেই তার খুব অচেনা লাগে। কেমন জানি মনে হয় টা মা অন্যরকম হয়ে যায়। নিজেকে একদম একা ভাবে পৃথিবীতে, কিন্তু নিম্মি আছে, যেই মেয়েকে এত ভালোবাসে সে থাকার পরেও এত একা ভাবে কেন নিজেকে মা? মাঝে মাঝে নিম্মি ভাবে হয়তো বাবা পৃথিবীতে নেই বলে...আবার নিম্মি এটা ভেবেও কষ্ট পায়, মাকে জিজ্ঞেস করে উত্তর পায়না। ।
কারন মা কখনো ওকে বুঝতে দেয়না। ওই যে মা হিসেবে সেই তো সেরা নিম্মির কাছে...।
নিম্মি তার ইউনিভার্সিটিতে একটা ছেলেকে ভালোবাসে। ভীষণ ভালোবাসে। ওই ছেলের নাম নিখিল।
নিখিল নিম্মির চেয়ে ৬বছরের বড়ো। পরিচয় ইউনিভার্সিটিতেই, পরিচয় থেকে বন্ধুত্ব আর বন্ধুত্ব থেকে ভালোবাসা। নিখিল ছেলেটা খুব ভালো কিন্তু খুব রগচটা, খুব অল্পতেই রেগে যায় আর এখানেই বনিবনা হয়না দুজনের। আর দশটা সাভাবিক সম্পর্কের মতো না ওদের সম্পর্কটা। নিম্মির স্বভাব প্রত্তেক কথায় নিখিল কে প্রশ্ন করা আর অকারনে সন্দেহ করা।
সন্দেহ টা ভালোবাসা থেকেই। কারন নিম্মি নিখিল কে কনভাবেই হারাতে চায়না। তাই অর ব্যাপার নিম্মি খুব পসসেসিভ। আর নিখিল ছোট খাট বেপারেই রেগে যায় আর নিম্মির খেয়াল রাখাটাও অনেক টা নজর রাখার মত লাগে নিখিলের আর এই নিয়েই সবসময় কথা কাতাকাতি ঝগড়া আর সেই সাধারন সমস্যা কোথায় কোথায় সম্পর্ক রাখবনা এই সেই। পরে সেই আবার দুজনই কষ্ট পায়।
আসলে কাওকে ছাড়া কারো চলবেনা। সব কিছুর উপরে দুজন দুজন কে অসম্ভব ভালোবাসতো। আর এসব কারনেই আজকাল নিম্মি খুব আনমনা থাকে। এই সব কিছুই নিম্মির মা জানে। নিম্মি মায়ের কাছে কিছুই লুকায় না।
আর এজন্যই নিম্মির মা ওকে কখনই ও বলতে না চাইলে জোর করে কিছু জানতে চায়না।
আজ ক্যাম্পাস এও সেই রোজকার ঘটনা। নিম্মির সাথে নিখিলের ঝগড়া। আজকের ঝগড়ার কারন নিখিলের একটা আজব সিদ্ধান্ত । নিখিল হঠাত নিম্মিকে এসে জানালো ওর বাবা মায়ের অমতে ও নিম্মিকে বিয়ে করতে পারবেনা।
নিম্মি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলো। হঠাত এতদিন পর আর এই সময়ে নিখিল এই কথা কেন বলছে। কারন ওর বাবা মা ওর জন্য মেয়ে দেখছে এটা নিম্মিকে নিখিল আগেও বলেছে। তবে আজ এই কথা কেন?
নিখিল জানালো ওর মা ওর জন্য মেয়ে দেখেছে আর নিখিল তখন নিম্মির কথা তার মাকে বলেছিল কিন্তু ওর মা বলে দিয়েছে সে যাকে ঠিক করেছে তার সাথেই বিয়ে দিবে। কোনোভাবেই সে অন্য কাওকে মেনে নিবেনা।
মায়ের সাথে আগের রাতের ঘটনা (যার কিছুই নিখিল নিম্মিকে বলেনি, শুধু বলেছে হয়তো নিম্মিকে ও বিয়ে করতে পারবেনা...। )
নিখিল সন্ধায় বাসায় ফিরেছে। তখন ওর মা ওকে জানালো সে নিখিলের জন্য একটা মেয়ে পছন্দ করেছে আর এই মেয়েকে নিখিলের বাবা মা দুজনেরই খুব পছন্দ। (তারা চায় নিখিল বিয়েটা করে ফেলুক আর মেয়েটা লন্ডনে পড়াশুনা করে এদিকে নিখিলেরও পড়াশুনা প্রায় শেষ তাই তারা চায় সেও লন্ডনে চলে যাক আর নিজের ক্যারিয়ার টা ঠিক করে নিক এবং সংসারী হোক। )
নিখিলঃ মা এখন তো বিয়ের ব্যাপারে ভাবছিনা।
আর তাছাড়া আমার আর অন্তত ৪মাস বাকি আছে পড়াশুনার। আমি এখনো তো নিজের কিছুই করিনা। আমার ক্যারিয়ার সবে শুরু আর এখন বিয়ে এটা কি করে সম্ভব?
মাঃ দেখ বাবা, আমরাও চাই তুই নিজের মতো কিছু কর। তারপর ও তোর বাবার পরে তো তোর বাবার সব কিছু হাল তোকেই ধরতে হবে, এত বড়ো ব্যাবসা এত কিছু সব দায়িত্ব তোরই।
নিখিলঃ কিন্তু মা এসবের সঙ্গে বিয়ের কি সম্পর্ক?
মাঃ (হঠাত-ই মায়ের চোখে জল) দেখ বাবা আজকাল তোর বাবার শরীর টা ভালো যাচ্ছেনা।
তাছাড়া একটা স্ট্রোক করার পর থেকে তার ধারনা সে হয়তো বেশীদিন বাঁচবেনা। আমি কত বুঝাই সে বুঝেনা। তোর বাবার এখন ইচ্ছা তোকে সংসারী দেখা। তুই ছাড়া আমাদের আর কে আছে বল? আর তোর বাবাকে তো জানিস এক কথার মানুষ, সে যা বলে তার কথার নড়চড় হয়না। আর এখন তাকে কোন কারণে উত্তেজিত ও করা যাবেনা।
যেকোনো বিপদ হতে পারে।
নিখিলঃ কিন্তু মা আমি কিভাবে বিয়ে করবো বল? এটাকি হয়? একটা অচেনা অজানা মেয়েকে আমি বিয়ে করে ফেলবো ? আর তাছাড়া আমি......(যেই নিখিল নিম্মির কথা বলতে যাবে, ওকে কথা শেষ করতে না দিয়েই ওর মা বলে)
মাঃ আর অচেনা অজানা না, তুই ওকে চিনিস... ঐযে তোর বাবার বন্ধু আতিক চৌধুরী? ওনার মেয়ে... তুই তো ওকে ছোটবেলা থেকেই চিনিস। ও লন্ডনে যাবার পর হয়তো দেখা নেই তাতে কি? আবার চিনে নিবি। আপনা কথা বলে ফেলেছি। অকেই আমাদের ঘরের বউ করবো।
আর তাছাড়া মেয়েতাও তকে ভীষণ পছন্দ করে। তোর বাবাকে তো চিনিসই,তুই আর অমত করিস না।
নিখিলঃ কিন্তু মা আমি তো ওকে বিয়ে করতে পারবনা। এটা সম্ভব না........................... ( নিখিল নিম্মির কথা বলতে গিয়েও বলতে পারলনা, কি জানি ভাবলো... ভেবে নিজের ঘরের দিকে চলে গেলো) ও মা ওর চলে যাওয়ার দিকে চেয়ে রইল...
তখন নিম্মি ওকে জিজ্ঞেস করল...তুমি আমাদের কথা জানালেনা কেন? কেন বললেনা তুমি আমাকে ভালোবাসো আমকে বিয়ে করবে...।
নিখিলঃ তোমার কি ধারনা আমি বলার চেষ্টা করিনি? কিন্তু কি বলব? কি ভবিষ্যৎ আমাদের এই সম্পর্কের?
(নিম্মি অবাক দৃষ্টি তে নিখলের দিয়ে চেয়ে থাকলো, কিচ্ছু বলতে পারলনা, চোখ থেকে কয়েক ফোঁটা জল ও গড়িয়ে গেলো)
নিখিলঃ দেখ নিম্মি, কোন সন্দেহ নেই আমি তোমাকে ভালোবাসি, grow up! শুধু ঝগড়া আর কষ্ট এগুল মাথায় নিয়ে কি আমরা দুজন এতবড় একটা সিদ্ধান্ত নিতে পারি যেখানে আমার পরিবার কিংবা তোমার মা কেও এটা মেনে নিতে পারবে না ?
নিম্মিঃ ভালবাসার কোনো মানে নেই এখানে?
নিখিলঃ নিম্মি ভালোবাসা অনেক বড়ো একটা ব্যাপার, শুধু বিয়ে করে সংসার করাই কি ভালোবাসা? এমন ভালবাসার কি মানে যা শুধু একটা লিগ্যাল সার্টিফিকেট এর দুইটা সিগনেচার এ সীমাবদ্ধ হয়ে যাবে।
তোমার কি ধারনা আমরা দুজন বিয়ে করে ফেল্লেই আমাদের এই ঝগড়া, রোজকার যন্ত্রনা সব ঠিক হয়ে যাবে, কিংবা আমরা বদলে যাব? বরং আমরা দুজনের চোখে আর বিষাক্ত হয়ে যাব।
(নিম্মি হঠাত রেগে গেলো)
নিম্মিঃ এতদিন আমার সাথে ঢঙ করেছো? বললেই পারো সব মিথ্যা ছিল...
নিখিলঃ নিম্মি আমি কখনই তা তোমাকে বলিনি। । আমি তোমার কথা ভেবেই বলছি সব। তুমি সবে অনার্স প্রথম ব বর্ষে আছো, তোমার ক্যারিয়ার, তোমার ভালো থাকা তোমার সব কিছু চিন্তা করেই আমি এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমরা বিয়ে করবনা।
কেন বুঝনা, ভালোবাসা মানেই বিয়ে না। । কিংবা এও না যে মাই তোমার দায়িত্ব নিতে চাইনা। আমি তোমাকে ভীষণ ভালোবাসি, শুধু মাত্র এজন্যই আমি তোমাকে পাবার আকাঙ্ক্ষার ব্যাপার টাকে বাদ দিতে চাই। আমি জানি তুমি আমাকে বিয়ে করে সুখি হবেনা এমনকি আমিও হয়তো হবনা।
তোমাকে বিয়ে না করার এই মানে না যে আমি তোমাকে ভালবাসিনা, আমি তোমাকে ভালোবাসি বলেই বিয়ে করে সেই ভালবাসাকে মেরে ফেলতে চাইনা।
নিম্মিঃ তার মানে কি? সব শেষ এত সহজে?
নিখিলঃ তা কেন... আমি কি একবার ও বলেছি? তোমার যদি মনে হয় তুমি আমার সাথে সম্পর্ক চালিয়ে যাবে, আমরা আগের মতই থাকব, ভালবাসার মানুষ হয়ে ভালো বন্ধু হয়ে।
(নিম্মির ধারনা নিখিল ভণ্ড কিংবা ও বদলে গেছে। । এবং নিখিম ওই মেয়েকে বিয়ে করতে চায় বলে এমন করছে।
। কান্না জড়ানো আর গ্রিনার স্বরে নিম্মি বলল )
নিম্মিঃ এও কি সম্ভব? এসবের কি মানে? আমি সব বুঝেছি আমার কিছু বলার নেই...
(এই বলেই নিম্মি উঠে চলে যেতে লাগলো... ঠিক তখনই নিখিল বলল)
নিখিলঃ নিম্মি তুমি কিছুই বুঝনি... যেদিন বুঝবে সেদিন হয়তো আমাকে আর ভুল বুঝবেনা। চলেই যখন যাচ্ছ একটা কথা শুনে যাও আমি তোমাকে ছাড়া কোনোদিন কাওকে ভালবাসতে পারবনা বিয়েও করতে পারবোনা... তুমি মনে রাখো না রাখো, ভালোবাসো না বাসো আমি তমাকেই ভালোবাসি, এ জায়গাতাও অন্য কেও নিতে পারবেনা। আর একটা কথা আজ সে সিদ্ধান্ত আমি নিয়েছি তোমার জন্যই নিয়েছি, তোমাকে ভালো রাখতে চাই বলে নিয়েছি তোমাকে ভালোবাসি বলে নিয়েছি। কারন আমি জানি আমক বিয়ে করে তুমি কনদিন সুখী হবেনা।
। আর আমি আমার ভালবাসার মানুষটাকে অসুখি দেখতে পারবোনা।
(নিম্মি কথা গুলোকে নিতান্তই ছলনা ভেবে নিয়ে সত্যি এ চলে গেলো)
আজ নিম্মির মন ভীষণ খারাপ। বাসায় এসে মাকে জরিয়ে ধরে অনেক্ষন কাদল তবুও ওর মন হালকা হলনা। মা কনভাবেই মেয়ের এই অবস্থা মেনে নিতে পারছিলনা।
ওর মা ওকে যখন জিজ্ঞেস করলো কি হয়েছে নিম্মি আনমনেই বলে ফেলল...।
নিম্মিঃ মা, ভালবাসলে অনেক কষ্ট পেতে হয় তাই না? সব ছেলেরা একরকম হয় তাই না? ভালবাসা ওদের জন্য শুধু খেলা... আর মেয়েরা খেলার পুতুল। । যখন ইচ্ছা হল খেলল ইচ্ছা না হলে ছুঁড়ে ফেলে দিলো।
মাঃ কি হয়েছে রে মা।
নিখিলের সাথে ঝগড়া হয়েছে? আমাকে বল যদি কিছু বলতে চাস।
নিম্মিঃ মা আমি নিখিল কে অনেক ভালোবাসি, ওকে ছাড়া আমি বাচবনা, আচ্ছা মা বলত যাকে ভালবাসি তাকেই যদি জীবনসঙ্গী হিসেবে না পেলাম তবে এ ভালবাসার মানে কি? আমার ভালর জন্য সে আমায় বিয়ে করবেনা? এটা কেমন ভালোবাসা মা?
মাঃ নিখিল তোকে এসব বলেছে? কি হয়েছে খুলে বলতো। ।
(নিম্মি মাকে শুরু থেকে সব বলল...
যে কথা গুলো নিম্মি বুঝলনা সেই কথা গুলো ওর মা ঠিক এ বুঝতে পারলো। )
নিম্মিঃ মা নিখিল, যাকে আমি এত ভালোবাসি সে আমার সাথে এমন কি করে করলো?
মাঃ এমনটা কি হতে পারেনা যে সে তোর ভালটাই চায় বলে কোন কারণে দূরে সরে যাচ্ছে?
নিম্মিঃ মা কোন ভালর কথা বলছো? আমার কোন ভালর জন্য ও আমাকে দূরে ঠেলে দিবে? ভালোবাসা কাছে টানে মা দূরে ঠেলেনা।
খুব অন্য মনস্ক হয়েই মা উত্তর দিলো...
মাঃ সত্যি ভালোবাসা শুধু কাছে টানেনা দুরেও ঠেলে দেয়... জরুরী না যে সেই দূরে ঠেলে দেয়াটা কোন ধোঁকা। মাঝে মাঝে দূরে থেকে ভালোবাসা প্রান ভরে নিঃশ্বাস নেয় যা কাছে থাকলেই কষ্ট বাড়ায়।
(মায়ের মুখে প্রথমবার ভালোবাসা নিয়ে এমন কথা শুনে থতমত খেয়ে গেলো নিম্মি। হঠাত কেন জানি নিজের কষ্ট ভুলে মা কে জিজ্ঞেস করলো ...)
নিম্মিঃ মা তুমি বাবাকে খুব ভালবাসতে তাই না? তুমি আমক আজ কোনোদিন বলনি বাবা কিভাবে মারা গেলো... কখনো কোন আত্মীয় স্বজন দেখিনি। আমাদের এত কিছু অথচ আমরা এত একা কেন মা।
তুমি আমায় আজ স্পষ্ট করে বলনি বাবার কি হয়েছিল। তোমাকে প্রায় কাঁদতে দেখি বাবার ছবি হাতে নিয়ে, মাঝে মাঝে রাতে উঠলে দেখি কি জানি লিখো ডায়েরি তে। কি মা?
মাঃ সময়মত সব জানতে পারবি, এখন অনেক রাত হয়েছে চল খাবি। সারাদিন কি খেয়েছিস না খেয়েছিস। আর একটা কথা মা জীবন তো থেমে থাকেনারে...থেমেও নেই...ভেঙ্গে পরলে চলবে না।
জীবনের কাছে, ভালবাসার কাছে আমাদের ওনেক ঋণ আছে টা যে শোধ করতে হবে। পথ চলতে হবে।
বলেই চলে গেলো মা। নিম্মি কিছু বুঝল কিছু বুঝল। ।
মায়ের কথা গুলো শুনার পর নিম্মি নিখিলের কথা গুলো ভাবতে লাগলো আর কথায় যেন মনে হল ওর ও অনেক কিছুই মিলাতে পারছে অথচ বুঝতে পারছেনা...
সেদিন সারারাত জেগে নিম্মির মা কি জানি লিখল...সকালে নিম্মিকে না জানিয়ে কোথায় যেন চলে গেলো। নিম্মি উঠে টাকে খুঁজে পেলনা, ধরে নিলো অফিস চলে গেছে... নিম্মি সেদিন সারাদিন ধরেই বাসায় ছিল। । চুপ চাপ, ও যতটা শান্ত তার চেয়েও বেশী শান্ত হয়ে গেলো সে। ।
সারাদিন গেলো মায়ের কোন খোঁজ নেই, ফোন বন্ধ, অফিস এ ফোন দিয়ে জানলো অফিস এও নেই। নিম্মি হথাত করেই ক্যালেন্ডার এর দিকে তাকাল, ১৯ নভেম্বর। দেখে খানিক্তা চুপ হয়ে গেলো। ওর বুঝ হবার পর থেকেই প্রতি বছর এই দিনটাতেই মা কোথাও চলে যায়। কিন্তু জিজ্ঞেস করলে কিছু বলেনা, নাহয় বলে কাজে গিয়েছিলাম।
নিজের লাইফ নিয়ে ব্যস্ততায় কখনো এত ভাবেনি ব্যাপার টা কিন্তু হয়তো মনভাঙ্গার কষ্টে আজ মাকে বেশী কাছে দরকার বলে ব্যাপার টা চোখে পরেছে। আজ কেন জানি নিম্মির মনে হল তার জানা দরকার মা কোথায়, কেন এত রহস্য?
নিম্মি সোজা ওর মায়ের ঘরে গেলো... সবকিছু খুজতে লাগলো, সব খুঁজে পেলো একটা ডায়েরি আর কিছু ছবি।
ছবি গুলো এক পাশে রেখেই ডায়েরি টা পড়া শুরু করলো।
ডায়েরি টা পড়তে যেয়েই নিম্মি চমকে গেলো।
আমার আসল নাম নবনি চৌধুরী, সময়ের প্রয়জনে আজ আমি অন্য নামে পরিচিত এবং ফায়সাল রহমান এর স্ত্রী।
ঢাকা মেডিক্যাল থেকে ডাক্তারি পাশ করা নবনি চৌধুরী এখন একজন বিজনেস উইমেন যাকে কেউ আর ডাক্তার নবনী নামে চেনেনা। আমার মেয়ে নিম্মি রহমান যাকে ঘিরেই আমার নতুন করে বাঁচতে শেখা, টাকে ঘিরেই আমার পৃথিবী।
নিম্মির বাবার চলে যাওয়ার পর নিম্মিকেই ঘিরেই সাজিয়েছি ছোট্ট একটা পৃথিবী। দূর থেকে এই ছোট্ট সাজানো পৃথিবী দেখতে যেমন এ লাগুক আসলে এই টা সাজানো কোন পৃথিবী নয়, প্রবল ভুমিকম্পে তছনছ হয়ে একটি ঘর।
ডাক্তার ফায়সাল রহমান, ওর সাথে আমার পরিচয় যখন আমি প্রথম বর্ষের ছাত্রী আর সে তখন পাশ করে বের হল।
তখন থেকেই দুজনের চেনা জানা... ফয়াসাল খুব ভালো একটা মানুষ ছিল। অসংখ্য কাজের ভিড়ে এমন কোন সময় যায়নি যেদিন সে আমার সাথে দেখা করেনসি। তখন আমার বয়স কম ছিল আর অনুভুতি ছিল বেশী। ফায়সালের একটা খুব ভালো গুন ছিল, ও খুব সহজে মানুষ কে আপন করে নিতে পারত। তারপর সময় গেলো ভালোবাসা বাড়ল আর দুই পরিবারেও জানাজানি হল।
সবাই মেনেও নিলো আমাদের সম্পর্ক। কিভাবে এতগুলো বছর পার হয়ে গেলো বুঝতেও পারিনি। ওই সময়ের মধ্যে ফয়াসাল নামি ডাক্তার হয়ে গেলো আর আমিও পাশ করে বের হলাম। দুজনই ডাক্তার, আর দুই পরিবারের কারো অমত থাকার কথাও না। সব যেহেতু ঠিক এ ছিল বিয়ে নিয়ে তাড়াহুড়ো করলাম না কেউ।
দুই পরিবারের সক্ষতাও বেশ হল।
এর মাঝে আমাদের জীবনে এলো স্মিতা। তারপর শুরু হল আমাদের দুই পরিবার এবং দুই ভালবাসার মানুষের জীবনের নতুন একটা অধ্যায়...। ।
স্মিতা ফয়সালের অনেক পুরনো ফ্রেন্ড, ফয়সাল স্মিতাকে ভালোবাসতো, আর স্মিতা ফয়সাল কে...কিছু ভুল বুঝাবুঝি আর স্মিতার বাবার জেদ থেকেই তাদের সম্পর্কের ইতি ঘটেছিল।
ফয়সাল, স্মিতার কথা সম্পর্ক হবার আগেই আমাকে বলেছিল। কিন্তু কে জানতো ফিরে আসবে সেই স্মিতা। আমি জানি ফয়সাল আমাকে অনেক ভালোবাসে। এজন্যই সে স্মিতা কে তার জীবনে আবার ফিরিয়ে নেয়ার কথা ভাবতেই পারেনা। স্মিতা ফিরে এসেছিলো ঠিকই কিন্তু নিজের ইচ্ছায় না।
কারন স্মিতা কখনো ফয়সাল এর সামনে আসেনি কারন ও জানতো ফয়সালের সামনে আসলে ওকে ছাড়া বেঁচে থাকার চেস্তাও স্মিতা আর করতে পারবেনা এতটাই ভালোবাসে সে ফয়সাল কে। অবশেষে ভাগ্য ওকে এনে দাঁড় করেছিলো ফয়সাল এর সামনে। স্মিতার ব্রেইন ক্যান্সার ধরা পরেছে, আর ও চিকিৎসা শুরু হয়েছে ফয়সালেরই হাস্পাতালে। স্মিতা জানেনা ওর কি হয়েছে ওকে কেও জানায়নি কিন্তু সে ঠিকই জেনে গেলো। মনে মনে খুশিই হল সে।
। আর বেশীদিন ফয়সাল কে ছাড়া তার বেঁচে থাকতে হবেনা। তারপর সেই হাস্পাতালে দেখল ফয়সাল কে। হঠাতই যেন বেঁচে থাকার ইচ্ছা হাজারগুন বেড়ে গেলো স্মিতার।
সেদিনের ঘটনা..নতুন রোগী এসেছে তাই তাকে দেখতে ফয়সাল আস্ল, ফয়সাল জানলো তার ক্যান্সার কিন্তু জানতোনা সে কে? স্মিতাকে দেখে তার মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়লো।
।
ফয়সালঃ স্মিতা???!!!
স্মিতাঃ ফয়সাল তুমি? (বলেই তার চোখ থেকে পানি গরিয়ে এলো)
ফয়সাল ও যেন সেই আগের সময়ে ফিরে গেলো, বুকের ভেতর কোথায় যেন একটা হাহাকার ছিলো ওর, যাকে সে এত ভালোবাসতো সে তার জীবনে ফিরে এলো আরেকবার অথছ এইভাবে? যাকে সুখি দেখার জন্য তার বাবার কোথায় তাকে ছেড়ে এসেছিলো তার জীবনটাই এখন অনিশ্চিত? কিছুতেই মেনে নিতে পারলনা ফয়সাল। তার মধ্যে নবনীর নিষ্পাপ মুখটা ভেসে উঠতে লাগলো বার বার, ফয়সাল নিজেকে সামলে নিলো।
স্মিতাঃ এজিবনে তোমায় আর পাওয়া হলনা। এমন কেন হল? জানো আমি এখনো স্বপ্ন দেখি তোমার সাথে ঘর বাঁধার, আজ যে তোমায় খুব ভালোবাসি।
আমার জীবনের এই শেষ সময়টাতেও তোমায় আমি পাবনা? (ফয়সাল কোন উত্তর না দিয়ে চলে গেলো, আসলে কিছুই বলতে পারলনা)
দুদিন ফয়সাল যাবত ফয়সাল খুব বিষণ্ণ আর বিমর্ষ। কোথাও জানি একটা সিদ্ধান্ত ও নিতে পারছেনা। একদিকে স্মিতা যাকে ও এত ভালোবাসতো, স্মিতার শেষ সময়ের ভালবাসার আকুতি, সে আজ মৃত্যুর সাথে লড়ছে আর এই শেষ সময়েও ফয়সাল তাকে কাছে টানতে পারছেনা। অন্যদিকে, নবনী যাকে ঘিরে ফয়সাল সাজিয়েছে নতুন জীবন, যাকে ফয়সাল খুব বেশী ভালোবাসে, নিষ্পাপ নবনী, যে প্রতিদিন ভালবাসার পৃথিবী সাজায় তাকে নিয়ে। ফয়সালের মনে হল সব কিছু ছেড়ে নিজেই চলে যেতে।
ফয়সালের সাথে এতদিনের সম্পর্ক ওকে দেখেই বুঝে ফেলল কিছু একটা হয়েছে। কিছু না ভেবেই নবনী ফয়সালকে জিজ্ঞেস করলো একদিন...
নবনিঃ কি হয়েছে ফয়সাল? তুমি ঠিক আছো?
ফয়সালঃ হুম... না আসলে নবনী আমি তোমাকে কিছু বলতে চাই।
নবনীঃ বলো...
ফয়সালঃ নবনী আমি তোমাকে ভীষণ ভালোবাসি।
নবনিঃ (হেসেই বলল) আরে বোকা আমি জানি, তা এভাবে বলছ কেন বলত...কি হয়েছে?
ফয়সালঃ তুমি আমাকে ভুল বুঝনা প্লীজ।
নবনিঃ আরে বোকা ভুল বুঝব কেন? কি হয়েছে বলতো... কোনো সমস্যা?
ফয়সাল কিছু না বলে নবনীকে হাসপাতালে নিয়ে গেলো আর দূর থেকে দেখাল স্মিতাকে।
স্মিতা আর ফয়সালের ব্যাপার টা নবনী জানতো তারপর ও যেন নবনীর মাথায় বাজ পড়লো। তারপর ফয়সাল সব নবনীকে খুকে বলল।
ফয়সালঃ নবনী আমি আর পারছিনা। সত্যি বলি আমি কারো কষ্ট দেখতে পারছিনা। আল্লাহ্ আ্মায় কি শাস্তি দিচ্ছে।
নবনীঃ এভাবে বলনা প্লীজ। তোমার কি দোষ?
ফয়সালঃ নবনি আমি তোমাকে ভীষণ ভালবাসি...আমি স্মিতাকেও ভালোবাসি... তোমাদের কাওকে কষ্ট দেবার কোন অধিকার আমার নেই। ভুল অপরাধ যাই হোক টা শুধু আমার, তোমাদের কারো কোন ভুল নেই। আমি ভালবেসে ভুল করেছি তার শাস্তি আমি তোমাদের কাওকে দিতে পারবোনা। আমি তোমাদের কারো সাথে সংসার করতে পারবোনা।
তুমি পারলে আমাকে মাফ করে দিও..আমি সবাইকে ছেড়ে অনেক দূরে চলে যাব।
আমি সব বুঝলাম। । নিজের মন থেকে তখন একটাই কথা বের হয়ে আসলো...। ।
জানিনা কিভাবে বললাম, জানিনা কিভাবে পারলাম...জানিনা কোন বোধ থেকে বললাম...
... “ফয়সাল তুমি নিজেকে দোষ দিয়না,তোমার মতো একটা মানুষ আমাকে ভালোবাসে এটা আমার অনেক পুন্যের ফল। ফয়সাল ভালোবাসা মানেই তো সংসার না। আমি তোমাকে ভালোবাসি আর তুমি আমাকে ভালোবাসো এর চেয়ে বড়ো সত্য আর কিছু নেই, আমার কপালে যদি তোমার সাথে সংসার করা লিখা থাকে আমি করব নাহয় না। তার মানে এইনা ভালোবাসা শেষ হয়ে যাবে, আমি তোমাকে ভালোবাসি ভালবাসব আজীবন। একটু থেমে গিয়েই ফয়সাল কে বললাম, “ ফয়সাল তুমি নবনী কে বিয়ে করো, ওর জীবনের এই শেষ সময়ে তুমি ওকে আপন করে নাও, আমি চাইনা আমার ভালবাসার মানুষ কে অন্য কেও ভুল বুঝুক...আর ওর ভালবাসাওত তো পবিত্র।
। শেষ বেলায় ও নাহয় প্রশান্তিতে থাক”। ফয়সাল আমার কথা শুনে থমকে গেলো কিন্তু শেষ মেষ আমি নিজেই আমার ভালবাসাকে তুলে দিলাম স্মিতার হাতে..সত্যি সেদিন মন থেকে চেয়েছি আমার খুব বেশী ভালবাসার মানুষ আর তার ভালবাসার মানুষটা সুখে থাক আর স্মিতার জীবনটা শেষ সময়ে পূর্ণ হয়ে যাক... আমিও তো ভালোবাসি তাই বুঝি ভালবাসার যন্ত্রণা কতটা পোড়ায়।
আমার কথা রাখল ফয়সাল, আমি জানি আমি ওকে বাধ্য না করলে ও কখনো এই বিয়েতে রাজি হতনা... আমার আর একটা কথা রাখলো ফয়সাল স্মিতাকে আমার আর ওর সম্পর্কের কথা কিছু বল্লনা। কিন্তু যেদিন স্মিতার আর ফয়সালের বিয়েটা হল সেদিন আরেকটা সত্য আমার পৃথিবীটাকে আরেকবার ওলটপালট করে দিয়ে গেলো।
সেদিন এলো স্মিতার মেডিক্যাল টেস্ট এর আরেকটা রিপোর্ট।
চারিদিক আরেকবার অন্ধকার হয়ে আসলো তারপর আবার মনে হল আমি কি স্বার্থপর হয়ে গেলাম এক মুহূর্তে? কাওকে কিছু না জানিয়ে ১ সপ্তাহের মধ্যে ঢাকা ছেড়ে চলে গেলাম চট্টগ্রাম। শুরু করলাম নিজের মতো আরেকটা জীবন। এই বিয়েটা আমার আর ফয়সালের পরিবারে মধ্যে একটা অনেক বড়ো দূরত্ব করে দিলো, ফয়সাল ও বাধ্য হয়ে গেলো তার পরিবার থেকে স্মিতাকে নিয়ে আলাদা হয়ে যেতে...
আর কারো খোঁজ নেইনি। আমি চেয়েছি অরা ওদের সংসার গুছিয়ে নিক, আমি সামনে থাকলে কোনোদিন ফয়সাল সেটা পারবেনা…..
এরপর ডায়েরি তে আর কিছু লিখা ছিলনা...নিম্মির চোখে পানি, নিম্মির মনে হাজারো প্রশ্ন তার পর?? ভাবতে ভাবতে হঠাত কলিং বেল এর শব্দ শুনে চমকে উঠল নিম্মি...।
বোধয় মা এসে গেছে, ডায়েরি আগের জায়গাতে রেখেই দরজা খুলে দিলো। সেই আগের মতো পুরনো সুরে নিম্মি মাকে বলল-‘মা, এত দেরি করলে যে? রাতে খেয়েছ? খাবার দিব নাকি কফি?” কাল থেকে নিম্মির অবস্থা দেখে মা খুব চিন্তিত ছিল কিন্তু আজ ওর আচরণ দেখে মনে হল বোধয় নিখিলের সাথে সব ঠিক হয়ে গেছে।
মাঃ কিরে মন ভালো?
নিম্মিঃ হুম... কেন??
মাঃ নিখিলের সাথে ঝগড়া শেষ??
নিম্মিঃ বাদ দাও তো মা যা হবে দেখা যাবে... কি হয়েছে সংসার না করলে? ভালোবাসি এটাই তো সবচেয়ে বড়ো সত্য...। (এই বলে মায়ের হাতে থেকে ব্যাগ নিয়ে ভেতরে চলে গেলো নিম্মি আর মায়ের যেন কি মনে পরে গেলো, চোখ থেকেও গড়িয়ে পড়লো পানি। )
সেদিন রাতে নিম্মি কোনোভাবেই ঘুমাতে পারছিলো না।
ও মনে অনেক প্রশ্ন ছিলো? কি হল এরপর ওর মায়ের, ওর জন্ম, ওর বাবার মৃত্যু...নাকি বাবা আজ বেঁচে আছে? মা কোথায় যায় এই ১৯ নভেম্বর? প্রশ্নগুলো মাকে করবে কিনা টাও ভেবে পাচ্ছেনা।
এদিকে নিখিলের অবস্থাও কেমন জানি। একমুহূর্তের জন্য ও এখন মেনে নিতে পারছেনা নিম্মি ওকে ভুল বুঝল। নিম্মিকে ও বুঝাতে পারলনা কেন সে এমন করলো। ও বাবা মায়ের একমাত্র ছেলে, ও বাবা মাকেও কষ্ট দিতে পারবেনা আর নিম্মিকেও না।
নিখিলের একটা বড়ো ভাই ছিলো সে মারা যাবার পর নিখিলই বাবা মায়ের জন্য সব। না পারছে মায়ের কথা ফেলতে না পারছে নিম্মির কথা ফেলতে। কিছু একথা নিখিল নিম্মিকে বুঝাতে পারছেনা। নিম্মিকে ও এত ভালোবাসে, নিম্মি ওকে এত ভালোবাসে, নিম্মি যদি ওকে না বুঝে তবে কে বুঝবে? ও যদি নিম্মিকে না বলে কাকে বলবে?? পাগল প্রায় নিখিল, কিন্তু মেনে নিলো সে নিজের সিদ্ধান্ত।
এদিকে নিম্মি নিজের মাকে নিয়ে ভাবতে ভাবতে ওই পুরো সময়টা নিজের কষ্টের কথা একবার ও ভাবলনা ।
মায়ের জন্য ওর খুব কষ্ট হচ্ছে, কষ্ট হচ্ছে বাবার জন্য... এত ভালবাসার পরও তাদের সব কেমন জানি উলটপালট। হঠাত এ নিম্মি বলে বসলো আমার মায়ের নাম তো নবনী না। কিন্তু এই ডায়েরি তো মায়ের লিখা... কিচ্ছু বুঝে উঠতে না পেরে ও মায়ের কাছে গেলো। মায়ের কলে মাথা রেখে কাঁদতে কাঁদতে বলল...
নিম্মিঃ মা, আমি কে?
মাঃ এটা কেমন কথা?? তুই আমার মেয়ে। (হেসে বলল)আমার পাগলী নিম্মি।
নিম্মিঃ মা তোমার নাম কি?
মাঃ কেন তুই জানিস না? কি হয়েছ তোর...
নিম্মিঃ (কাঁদতে কাঁদতে জড়ানো গলায় নিম্মি বলল) আমি জানি মা, আমি তোমার মুখ থেকে একবার শুনতে চাই, প্লীজ বলো... প্লীজ মা একবার।
মাঃ স্মিতা আমার নাম, স্মিতা রহমান। (অদ্ভুত এক বিমর্ষতা তার চোখে মুখে)
নিম্মিঃ মা এটা কি আসলেই তোমার নাম?
মা নিঃশব্দ কয়েক মুহুরত...তারপর এ কথা এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করলো...
মাঃ রাত হয়েছে ঘুমাবি যা আর সকালে... (কথা শেষ করতে না দিয়েই নিম্মি উঠে বসে বলল)
নিম্মিঃ মা আজ এড়িয়ে যেওনা মা, প্লিজ। আর কত কষ্ট বুকে জমিয়ে রাখবে? কত একা একাই কাঁদবে?
মাঃ আমার কোন কষ্ট নেই, আমি ঠিক আছি (বলেই চলে যাচ্ছিল তখনি নিম্মি বলে উঠলো)
নিম্মিঃ নবনী চৌধুরী এত ভয় কবে থেকে পায়? নবনী চৌধুরী তো এত সহজে হার মানতে পারেনা।
নিম্মির মুখে কথাটা শুনে থমকে গেলো নিম্মির মা, নবনী চৌধুরী, মনে হল এক মুহূর্তে আমার সব অগোছালো হয়ে গেলো, নিথর হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলো সে... নিম্মির চোখে পানি কিন্তু নবনীর চোখে পানি নেই কেমন যেন ভয়... নিম্মি মায়ের কাছাকাছি এগিয়ে গেলো, মাকে গিয়ে বলল.।
।
নিম্মিঃমা তুমি আমক সব কষ্ট থেকে আগলে রাখো, আমি একটু বেথা পেলেও তুমি কষ্ট পাও, আমি একটু কাদলেও তুমি দৌড়ে চলে আসো, তোমার সুখ আমাকে দিয়ে আমার দুখের ভাগগুলো নিয়ে যাও তোমার কষ্ট গুলো কি আমার হতে পারেনা, আমক একটু ভাগ দিতে পারোনা? মা যদি মেয়ের কষ্ট নিয়ে পারে মেয়ে কি মায়ের কষ্টের ভাগ নিতে পারেনা মা? মা তুমি আমার জন্য সব, জানিনা কেন এতদিন তুমি আমাকে বলনি তোমার আসল নাম, বাবার কি হয়েছে, স্মিতা চৌধুরী কে... আমিই বা কে? আজ তুমি আমাকে বল মা, আমি জানতে চাই মা...
নবনিঃ আগে বলেছিলাম সময় হলে সব বলব, আজ বোধয় সময় হয়েছে... বল কি জানতে চাস?
নিম্মিঃ মা। তুমি চট্টগ্রাম কেন চলে এলে, কি ছিল স্মিতা রহমানের ওই রিপোর্ট এ? বাবার কি হয়েছিলো?
নবনী বলা শুরু করল সব কথা তার মেয়েকে...
সেইদিন সেই রিপোর্ট এ ছিল স্মিতার ব্রেইন ক্যান্সার হয়নি ওর হয়েছিলো ব্রেইন টিউমার। বুঝতে পারলাম আগের রিপোর্ট টা ভুল এসেছিলো। আমি ফয়সাল কে কিছু জানালাম না।
আমি জানি তখন ও জানতে পারলে হয়তো অনেক কিছু ঘটে জেত। তাই নিজেকে ওদের জীবন থেকে সরিয়ে নেয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। চলে এলাম এখানে কাওকে না জানিয়ে। আমার বেষ্ট ফ্রেন্ড মেঘনা ও তখন ওর স্বামীর পোস্টিং ছিল চট্টগ্রামে। ওর কাছে চলে গেলাম, ওকে সব খুলে বললাম...
মেঘনাঃ তুই এটা কি করলি? যাকে এত ভালবাসিস টাকে কেও এভাবে অন্য কারো হাতে তুলে দিতে পারে?
নবনিঃ মেঘনা, আমার কতটা কষ্ট হচ্ছে আমি জানি, কিন্তু জীবনের প্রয়জনে হয়তো এটাই ঠিক।
এটা তো জরুরী না যে সব কিছু আমাদের ইচ্ছামতই হবে তাই না?
মেঘ্নাঃ আমি তোর মতো এত মহৎ না, আমি জানিনা। আমি জানি ভালবাসা মানে দুজনের সুখ, আশা প্রত্তাশা, শুধু ত্যাগ না।
নবনিঃ হয়তো...
মেঘ্নাঃ যাক এখন কি করবি ভাবছিস... ফয়সাল ভাই এক না একদিন তো রিপোর্ট না পাবে, তখন সে স্মিতাকে মেনে চলবে কিভাবে? পারবে?
নবনিঃ(কি জানি ভেলে মেঘ্নাকে বলল) পারবে...। তুই আমার একটা কাজ করবি?
হম বল...
নবনিঃ তার আগে কথা দে কাওকে বলবি না আমি এখানে আছি, তুই যদি বলিশ তবে আমি অন্য কোথাও চলে যাব, তুই ও আর জানবিনা।
মেঘনাঃ (একটু চুপথেকে বলল) আচ্ছা ঠিক আছে।
কাওকে বলবনা।
নবনিঃ তুই আমার বাড়ির খোঁজ খবর রাখবি, আর ফয়সাল আর স্মিতার ও। আমাকে একটা বাসা ভারা করে দিবি আর একটা চাকরী বা টিউশান খুঁজে দিবি। আর আমাকে খবর গুলো জানাবি সবাই কেমন আছে। কিন্তু আমার কথা কাওকে বলবি না।
পারবি?
মেঘনাঃ (নবনীর দিকে তাকিয়ে থাকলো...)
নবনীঃ কিরে পারবিনা?
মেঘনাঃ হুম পারব।
মেঘনা আমাকে সব ব্যাবস্থা করে দিলো। সব খবর ও দিত। ওর কাছে জানলাম ফয়সাল রিপোর্ট এর ব্যাপার জেনেছে, স্মিতার অপারেশন হয়েছে। ও পুরপুরি সুস্থ।
ফয়সাল আমকে হন্যে হয়ে খুঁজছে...
একদিন ফয়সাল মেঘনা কে ফোন করে বলল...
মেঘ্নাঃ হ্যালো... ফয়সাল ভাই নাকি?
ফয়সালঃ হুম মেঘনা, কেমন আছো?
মেঘনাঃ এইতো ভালো, আপনি?
ফয়সালঃ জানিনা মেঘনা, কেমন আছি বুঝতে পারছিনা...মেঘনা? নবনীর কোন খোঁজ জানো? আমাকে সুখের ভাগ দিয়ে কস্ত নিয়ে কোথায় চলে গেলো? আমি জানি ওর কথা রাখতে জেয়েই ওকে আমি ভেঙ্গে চুরমার করে দিয়েছি, স্মিতাকেও ঠকাচ্ছি। কি করবো জানিনা। বুঝতে পারছিনা স্মিতাকে সব বলে দিব কিনা... জানিনা কি করা উছিত। । কে জানে ও কেমন আছে কোথায় আছে।
মেঘনাঃ আমি কোন খোঁজ পেলে অবশ্যই জানাব ফয়সাল ভাই।
ফয়সালঃ ঠিক আছে...
সেদিন আবার বুঝলাম ফয়সাল এখনো আমাকে কতটা ভালোবাসে। কিন্তু স্মিতাকে ও কষ্ট দিচ্ছি পুর ভালো নাবেসে। আর স্মিতাকে থকাচ্ছে কারন সে আমাকে ভালোবাসে। আবার আমি ওদের সামনে বাঁধা হয়ে গেলাম।
মেঘ্নাকে বললাম ফয়সালকে ফোন করে জানাতে যে, মেঘনা জেনেছে আমি বিয়ে করেছি, সুখে আছি, আর আমি চাই স্মিতাকে নিয়ে যেন ফয়সাল সুখে থাকে, স্মিতাকে যেন না থকায়, ভালোবাসা থেকে বঞ্ছিত না করে...। মেঘনা তাই করলো কিন্তু ফয়সাল বিশ্বাস করলনা কিন্তু আবার আমার কথাই মেনে নিলো।
মেঘ্নাও চলে গেলো ঢাকা, মেঘনার কাছেই শুনেছি একবছর পরে স্মিতা আর ফয়সালের একটা মেয়ে হয়েছে। খুব মিষ্টি হয়েছে দেখতে, মেয়ের নাম রেখেছে নবনী। মেয়েতার মুখের দিকে চেয়ে নাকি ফয়সাল নিজেকে অপরাধি ভাবতো।
আমার কথা মতো একদিন মেঘলা ফয়সালের মেয়টাকে দেখতে গেলো, সেদিন হয়ে গেলো অনেক বড়ো একটা ভুল।
(স্মিতা, ফয়সাল আর মেঘনা কথা বলছে)
মেঘনাঃ ফয়সাল ভাই আপনার মেয়েটা দেখতে দারুন হয়েছে। ভাবছি বড়ো হলে আমার ছেলের সাথেই বিয়ে দেব।
স্মিতাঃ (হাসতে হাসতে স্মিতা বলল) তাহলে তো ভালই হয়, মেয়ের বিয়ের চিন্তাই থাকলো না, কি বলো ফয়সাল?
(ফয়সাল একটু অন্যমনস্ক, ব্যাপার টা খেয়াল করলো মেঘনা, তাই ঝটপট বলল
মেঘনাঃ ফয়সাল ভাই আপত্তি করবেনা।
কিছুক্ষন পর স্মিতা রান্না ঘরে গেলো নাশতা বানাতে, ফয়সালের কোলে দিয়ে গেলো ছোট্ট মেয়েটাকে।
মেঘনাঃ ফয়সাল ভাই? কি হয়েছে?
ফয়সাল মেয়ের দিকে তাকিয়ে মেঘনা কে বলল...
ফয়সালঃ জানো মেঘনা। নিজেকে খুব অপরাধি মনে হয়, মেয়েতার দিকে তাকাতে পারিনা, নিষ্পাপ মেয়েতার দিকে তাকালেই নবনীর নিষ্পাপ মুখটা ভেসে উঠে। আমি কিভাবে পারলাম নবনীকে হারাতে? জানিনা কোথায় আছে আমার নবনী, কেমন আছে?
মেঘনা আর নিজেকে আটকে রাখতে পারলনা সব বলল ফয়সাল কে। । অদিকে আড়াল থেকে সব শুনলো স্মিতা।
মেঘনার সামনে এসে স্মিতা বলল-
স্মিতাঃ এখন কোথায় নবনী?আমার সুখের জন্য সে নিজেকেই বিসর্জন করে দিলো?
আনমনে নিজেকে অপরাধি ধরে নিলো, নিজেকেই সে দোষ দিতে লাগলো। তার মনে হল সে অনেক বড়ো অপরাধ করে ফেলেছে, সে মেঘনা কে মিনতি করে বলল “ কোথায় নবনী, আমি একটা বার ওর সাথে দেখা করতে চাই। ওর কাছে যে আমার অনেক ঋণ তার কিছুটা হলেও শোধ করকে চাই মেঘনা’
মেঘনা তাদের আমার ঠিকানা দিলো। তারপরি ঘটে গেলো সবচেয়ে বড়ো অঘটন। আমার সাথে দেখা করতে আসতে যেয়েই দুর্ঘটনায় মারাত্তক আহত হয়ে হাস্পাতালে নেয়া হল ফয়সাল আর স্মিতাকে
ঘটনার দিন ১৯নভেম্বের, মেঘনা আমাকে ফোন দিয়ে বলল তুই এক্ষুনি ঢকায় চলে আয়, ফয়সাল ভাইয়ের অবস্থা খুব খারাপ।
আমি ঢকায় পৌঁছাতে পৌঁছাতে অনেক দেরি হয়ে গেলো। কিচ্ছু পেলাম না, পেলাম আমার ফয়সালের নিথর দেহ আর তার পাশে স্মিতা। কেও কিচ্ছু বললোনা, নিশ্চিন্তেই যেন গুমুচ্ছে তারা।
মেঘনা এসে আমার হাতে তুলে দিলো ফুটফুটে মেয়েটাকে, নবনী, ফয়সাল আর স্মিতার মেয়ে। দুর্ঘটনার পর হাস্পাতালে নিতে নিতেই শেষ হয়ে গিয়েছিলো ফয়সাল, স্মিতা কিছুক্ষন বেঁচে ছিল, কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি।
সে মেঘনা কে বলে গিয়েছিলো “আমি নিজের অজান্তে নবনীর ভালোবাসা কেড়ে নিয়েছি, এই পাপাএর কোন ক্ষমা নেই, আমার শাস্তি আমি পেয়েছি, আমার ছোট্ট মেয়েটাকে তুমি নবনীর হাতে তুলে দিও, নবনীর কাছে ক্ষমা চাওয়ার সুজগ টাও আল্লাহ্ দিলনা, ওকে বল আমাকে পারলে ক্ষমা করে দিতে আর আমার মেয়েটাকে নিজের মেয়ে করে রাখতে, আমার মেয়েটার দিকে তাকিয়ে যেন সে আমায় ক্ষমা করে দেয়’
এক মুহূর্তে সব শেষ হয়ে গেলো, মেয়েটার চোখের দিকে তাকিয়ে মনে হল আমার জন্য আজ মেয়টা পৃথিবীতে একা, মাই না থাকলে আজ ও ওর বাবা মায়ের কলে থাকতো। এখনো বাবা মাকেই ছিনেনা তার আগেই আমি কি সব শেষ করে দিলাম? ঢাকায় পাশাপাশি কবর দেয়া হল ফয়সাল আর স্মিতাকে। প্রতিবছর ওদের তানেই ছুটে যাই সেখানে।
শুরু হল আমার আরেক জীবন। সবার থেকে দূরে সরে গেলাম।
বদলে গেলো আমার পরিচয় আমার অস্তিত্ব। নবনী চৌধুরীকে কবর দিয়ে আমার মেয়ের জন্য আমি হয়ে গেলাম স্মিতা রহমান। নবনী নামটাকে চিরতরে চাপা দিয়ে তোর নাম রাখলাম নিম্মি রহমান। সেই ছোট্ট নবনী আজকের তুই।
তোর চোখে যদি আমি অপরাধি হইরে মা আমকে তুই ক্ষমা করে দিস।
আমি সব হারি।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।