আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

শেষটা জানা নেই : গল্প, ডেডিকেটেড টু ভূত এফএম

অপ্রিয় এবং অবাঞ্ছিত... সন্ধ্যার সময়টা রাসেলের কাছে বেশ রোমান্টিক লাগে, যখন সূর্যটা চোখ পিটপিট করে ডুবে যায়। সময়টায় বরাবরই রেণুকে আশা করে সে। রেণু? রেণু কই? অস্থির হয়ে ওঠে রাসেল। ছাদে মনে হয়। সূর্যোদয় আর সূর্যাস্ত, দুটোই রেণু খুব ভালোবাসে।

সূর্যাস্তের সময় তো হয়ে এল। রেণু নিশ্চয় ছাদে। দুদ্দাড় করে সিঁড়ি ভেঙ্গে ছাদে উঠে এল রাসেল। ওই তো রেণু! ছাদের রেলিং ধরে ঝুঁকে বাড়ির পেছনে আমবাগানটার দিকে তাকিয়ে আছে। রেণুকে চমকে দিলে কেমন হয়? পা টিপে টিপে পানির টাঙ্কির নদীর মত জাল বিছানো পাইপগুলো টপকে ওর দিকে এগোতে থাকে রাসেল।

এক হাত দূরে দাঁড়িয়ে “রেণু!” বলে ডাকল। রেণু মোটেই চমকাল না। ধীরে ধীরে ঘুরে রাসেলের দিকে চাইল। ধড়াশ করে লাফ মারল রাসেলের হৃদপিণ্ড! এ রেণু নয়! হতে পারে না! এ নিরঘাত পিশাচিনী! কোটরে চোখ নেই, নেই রেনুর টিকালো নাক, তার জায়গায় দূটো ফুটো কেবল! কঙ্কালসার মুখটা হা করে রাসেলের দিকে চেয়ে আছে! হা করা মুখের ভেতরটা অন্ধকার! বীভৎস! প্রচন্ড দুর্গন্ধে গা গুলিয়ে এল রাসেলের। ভয়ার্ত বিস্ফোরিত চোখে মূর্তমতী পিশাচিনীকে দেখল একবার সে।

পেছাতে গিয়ে পা ঠেকল পানির পাইপে। পেছন দিকে আছাড় খাবে সে। পতন ঠেকাতে চাইল খড়কুটো যাই হোক, কিছু একটা ধরে। কিছুই নেই! শূন্য! আছাড়? কই মাটি তো গায়ে ঠেকছে না? চমকে চোখ মেলল রাসেল। সিলিংটা চেনা চেনা লাগছে না? প্রচন্ড গরম! এক ঝটকায় কম্বল সড়িয়ে পাশ ফিরে শুল সে।

দুঃস্বপ্ন দেখছিল। ধাতস্থ হয়ে শ্বাস স্বাভাবিক হতে সময় লাগল। ঘর প্রায় অন্ধকার। মানে সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। সন্ধ্যা মানেই সূর্যাস্ত! রেণুর বড় পছন্দ।

কাচের চুড়ির রিনঝিন শব্দে আরেকবার চমকে উঠল রাসেল। ঝটকা দিয়ে পাশ ফিরল সে। রেণু! খাটের পাশে দাঁড়িয়ে চুড়ি নেড়ে রাসেলের দৃষ্টি আকর্ষণ করছে। কী সুন্দর মুখ! ডাগর চোখে হাসি, ঠোঁটে হাসি। কথা বলল সে ঠোঁট,”উঠবে না?” ভুলে যেতে চাইল রাসেল দুঃস্বপ্ন।

রেণুকে সে পাঁচ বছর চেনে। বড় নিষ্পাপ এ মেয়ে। মৃদু হেসে উঠে বসল বিছানায়। ”বোস না একটু, পাশে। ” মৃদু হেসে বসল রেণু।

কপালের উপর এসে পড়া চুল সড়িয়ে দিল। রাসেল কিছু না বলে তাকিয়ে আছে রেণুর চোখের দিকে। চোখ যে মনের কথা বলে! এত নিষ্পাপ চোখ রেণুর, গড গিফটেড! মুগ্ধ হয়ে চেয়ে থাকে রাসেল। “কী দেখ?” ভ্রু সামান্য কুঁচকাল রেণু। “তোমার চোখ” ধরা গলায় বলল রাসেল।

হেসে ফেলল রেণু। মেয়েটা এত মিষ্টি করে হাসে! হাসলে গালে টোল পড়ে, গড গিফটেড! অন্ধকার ঝাঁপিয়ে পড়ল ওদের রোমান্সের মাঝে। লোডশেডিং। অন্ধকারে রেণুর শাড়ির খসখসে শব্দ আর চুড়ির রিনরিনানি শুনতে পেল রাসেল। হাতরে হাতরে পাশের বেডসাইড টেবিল থেকে সিগারেট জ্বালানোর ম্যাচটা হাতে নিল সে।

খস করে ধরাল কাঠি। অগ্নিশিখার দিকে একবার তাকিয়ে রেণুর দিকে চাইল। আরেকবার চমকাল রাসেল! হাত থেকে জলন্ত ম্যাচের কাঠি বিছানায় খসে পড়ল। খসখস শব্দ করে রেণু আর তার মাঝখানে আগুন ধরে গেল। ছোট্ট একটা চিৎকার দিয়ে লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল রেণু।

খপ করে কম্বলটা দিয়ে চাপা দিল আগুন। “রাসেল?” ডাকল রেণু। রাসেল জবাব দিল না। একী দেখল সে? ম্যাচের কাঠির আগুনে রেণুর চোখের দিকে তাকিয়ে ছিল সে। ও কোনো মানুষের চোখ না।

বিড়ালের চোখ! অন্ধকারে বিড়ালের চোখে আলো পড়লে যেমন সবুজ, টানা টানা, লম্বাটে মণির একজোড়া চোখ দেখা যায়, ঠিক সেরকম চোখ। “রাসেল?” আবার ডাকল রেণু। সংবিৎ ফিরল রাসেলের। টিউব লাইটের আলোয় রেণুর মুখটা আশ্চর্য সুন্দর লাগছে। কারেন্ট চলে এসেছে।

কই, না? রেণুর চোখ তো আগের মতই মানবীয়, টানাটানা। “রাসেল, ঠিক আছো তুমি? কী হয়েছে?” রেণুর গলায় উদ্বেগ। রাসেল অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকাল ওর দিকে। রোবটের মত বল্ল,”কই ঠিক আছি তো। এক কাপ চা দিও তো।

এখুনি বের হব। ” *** ভুত এফএম চলছে। রেডিওর শো করা পরিশ্রমের কাজ। আনন্দের সাথেই করে রাসেল। তবে আজ জোর করে মন দিতে হচ্ছে।

বাসা থেকে স্টুডিওতে আসার পথে অনেক ভেবেছে রাসেল। সমস্যাটা আসলে কার? ওর, না রেণুর? আজ যা যা ঘটল, তার রহস্য কী? ভুত এফএমের কল্যাণে এতদিন অন্যের ঘটনা শুনে এসেছে। প্রায় সবগুলোকেই ভুয়া মনে হয়েছে। রাসেল আসলে ভুত-প্রেতে অবিশ্বাসী মানুষ, তবে প্যারানরমাল ঘটনা বলে হতে পারে কিছু একটা আছে তার মনে হয়। আজকের ঘটনাগুলোও এমনই ‘কিছু একটা’ হতে পারে।

রেণুর সাথে পাঁচ বছর প্রেম করে বিয়ে করেছে রাসেল। বিয়ে করেছে দিন পনের হল। রাসেলের ধারণা, রেণুর সবকিছুই সে জানে। আজ প্রথম ওকে অচেনা মনে হল। রেণু কী ওকে পাগল ভাবছে? আজ দিবানিদ্রায় যে দুঃস্বপ্ন দেখেছে, তার কোন মাথামুন্ডু খুঁজে পাচ্ছে না রাসেল।

এরকম স্বপ্ন ছাড়া ছাড়া ভাবে দু’চার দিন আগে-পরে বার দুয়েক দেখেছে। তবে ওই স্বপ্নগুলোতে রেণুকে সে খুঁজেই পায়নি। আজ যখন পেল… নাহ! কী হচ্ছে এসব? রেণু চমৎকার মেয়ে। রাগতে দেখেনি ওকে রাসেল। সুন্দর রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতে পারে ও।

চেহারায় সব সময় মায়া মায়া ভাব থাকে। … নাহ! সমস্যা বোধহয় রাসেলেরই। “……আজকের মত এখানেই শেষ করতে হচ্ছে। ফিরে আসব আবারও আগামী শুক্রবার একই সময়ে। ততদিন পর্যন্ত ভাল থাকুন, সুস্থ থাকুন, আর মোস্ট ইম্পরটেন্টলি, ফুর্তিতে থাকুন।

শুভ রাত্রি। ” একনাগাড়ে বলে গান ছেড়ে ঝিম মেরে কিছুক্ষণ চেয়ারে বসে থাকলো রাসেল। ভৌতিস্ট টিম হৈ হৈ করতে করতে গেস্টরুমে চলে গেছে ততক্ষণে। সিগারেট দরকার। সাথে নেই।

নিজেই যাবে আনতে। স্টুডিও থেকে বেরিয়ে দুদ্দাড় করে সিঁড়ি বেয়ে দো’তলা থেকে নিচে নামলো রাসেল। শুক্রবার বলে রাস্তাঘাট বেশ ফাঁকা। এবং অন্ধকার। হঠাৎ ওকে দেখে চমকে গেছিল দারোয়ান।

সামলে নিল। বিরক্ত হল রাসেল, ও সব সময়ই দুদ্দাড় শব্দ করে সিঁড়ি থেকে নামে, এখনও তাইই। ব্যাটা কি শুনতে পায় না? এই রাস্তার চা-সিগারেটের দোকানগুলো বন্ধ। বেশ কিছুদূর হেঁটে মোড়ের বাক পেরিয়ে আরও কিছুদূর। হুম, একটা দোকান খোলা।

রাস্তাঘাট যেন স্বাভাবিকের চেয়ে একটু বেশিই ফাঁকা? চারটা সিগারেট নিল রাসেল। একটা ধরিয়ে ফিরে চলল। মোড়ের কাছটায় এসে সিগারেট টানতে টানতে ভ্রু কুঁচকে রেণুর ব্যাপারটা নিয়ে ভাবছে। আবার চমকে উঠল রাসেল, হাত থেকে জ্বলন্ত সিগারেটটা পড়ে গেল; কী যেন নরম, রোমশ, তুলতুলে কিছু একটা ওর পা ঘেঁষে গেল! ধুর! কালো বিড়াল একটা। অন্ধকার কোণ থেকে বেরিয়ে ওকে চমকে দিয়ে পা ঘেঁষে চলে গেছে।

কিছুদূর গিয়ে ফিরে তাকাল বিড়ালটা। ধক করে উঠল রাসেলের বুক। জমে গেল প্রায় সে। অবিকল এই চোখ দেখেছে সে রেণুর, ম্যাচের কাঠির আলোয়! একটা চাপা কান্নার আওয়াজ পেটের মধ্যে খামচি দিয়ে ধরল ওর। রেডিওর শোতে বহু ধরণের ভয়ঙ্কর আওয়াজ শুনেছে সে, তবে সে এবার সত্যিকার ভয় অনুভব করল।

কান্নার উৎস রাস্তার শেষ চায়ের ছাপড়া দোকানটা। বন্ধ দোকানটা। বেঞ্চগুলো আড়াআড়ি করে শেকল দিয়ে বাঁধা। ওগুলোর ফাঁকে হাঁটু গেড়ে বসে মুখ গুঁজে কাঁদছে এক তরুণীর প্রতিকৃতি। বাঁ চোখটা কাঁপতে থাকে রাসেলের।

দম বন্ধ হয়ে আসতে থাকে ওর, খেয়াল করে তরুণীর পরণের শাড়িটা; এই শাড়ি রাসেলের বড় চেনা। সেই শাড়িটা রেণুকে কিনে দিয়েছিল। এবং আজ রেণু এই শাড়িটা পড়েছিল! দমকে দমকে কান্নার আওয়াজটা বাড়তে থাকে। রাসেলের অবাধ্য পা এগোতে থাকে কান্নার উৎসের দিকে। রাসেল রোবটের গলায় ডাকে,”রেণু!” থমকে যায় কান্নার আওয়াজ।

গোঁজা মাথা সোজা হয়, ধীরে ধীরে রাসেলের দিকে ফিরে তাকায়। গলা শুকিয়ে যায় রাসেলের। দুঃস্বপ্নের সেই শুন্য-কোটর রেণু! সরীসৃপের মত উত্তল নাকের জায়গায় দুটো ছিদ্র, আর হা করা সেই মুখ, যেন সে মুখ বুজতে জানেনা! গা গুলিয়ে আসে রাসেলের, প্রচন্ডের দুর্গন্ধে! হাঁটু ভাজ হয়ে আসে ওর। সহ্যশক্তি সীমা ছাড়িয়েছে! *** শান্তভাবে চোখ মেলল রাসেল। পিটপিট করে তাকিয়ে দেখল রেডিও ফুর্তির গেস্টরুমের সিলিং এবং তার কাউচ ঘিরে কয়েকটা মুখ।

ভৌতিস্ট টিমের সুমন, জিবরান আর শাকিব, সাথে সাউন্ড ইঞ্জিনিয়ার এবং আরও কয়েকজন সহকর্মী এবং দারোয়ানটা। কিছুক্ষণ পর গরম কফির মগ হাতে রাসেল ভৌতিস্ট টিমের সাথে বসল। জানল, তার রাস্তায় পরে থাকাটা দারোয়ানই দূর থেকে খেয়াল করে এবং তার চেঁচামেচিতে অফিসের সবাই ছুটে আসে। রাসেল ছাড়া কেউ ছিল না ওখানে। গেস্টরুমে ওকে ধরাধরি করে আনার পর সুমন আর জীবরান পানি-টানির ছিঁটায় ওর জ্ঞান ফেরান।

জীবরান এবার মুখ খুললেন,”রাসেল, হোয়াট’স রঙ উইথ ইউ?” শূন্য দৃষ্টিতে তার দিকে চাইল রাসেল। তারপর ভৌতিস্টকে বলতে থাকে সব ঘটনা। সে জানে, ভৌতিস্ট এটাকে উড়িয়ে দেবে। অতিরিক্ত কাজের চাপে মানসিকভাবে চাপে ছিলে, ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু রাসেল মেলাতে পারছে না।

আজ মনে হয় সত্যি সত্যি কোনও প্যারানরমাল ঘটনার মুখোমুখি হয়েছে সে। ভৌতিস্ট টিম কিছু বলার আগেই গেস্টরুমের দরজায় উঁকি দিল একটা উদ্বিগ্ন মুখ। রেণু। রেণুকে কেউ ফোন করেনি। সে দুঃস্বপ্ন দেখেছে, রাসেলকে খুঁজতে ছাদে গিয়েছিল সন্ধ্যায়, রাসেল রেলিঙে হাত রেখে আমবাগানের দিকে তাকিয়ে ছিল।

ওর নাম ধরে ডাকায় ফিরে তাকায়, কিন্তু রাসেলের মুখটা বড় বীভৎস ছিল। কোটরে চোখ ছিল না, নাকের জায়গায় স্রেফ দুটো ফুটো, আর মুখটা হা করা, যার ভেতরটা অন্ধকার। ঘুম ভেঙ্গে যায় তার, সাথে সাথে ফোন করে রাসেলকে। কিন্তু ফোন ছিল বন্ধ। বাবার বাড়িতে ফোন করে গাড়ি আনায় এবং সেই গাড়িতে করে চলে আসে স্টুডিওতে।

রাসেল রেণুর দিকে তাকাল। সে ভয় পেয়েছে। তার ভয় পাওয়া মুখটাও আশ্চর্য সুন্দর। মায়া হরিণের মত। রেণু সত্যি গড গিফটেড।

[ আমার মন্তব্যঃ আমার দুই নাম্বার গল্প। ভেবেছিলাম ইউটিউবে প্যারানরমাল শর্ট ফিল্ম দেখে ওটার কাহিনী মেরে দিব। হল না। গল্পের পুরোটাই আমার উর্বর মস্তিষ্ক থেকে ডাউনলোড করতে হয়েছে। গাঁজাখুরি গল্প হয়েছে, না? কিন্তু বিশ্বাস করেন, আর নাই করেন, আমি মোটেও গাঁজা খাই না।

এই লেখাটা লেখার সময় পর্যন্ত আমি নিশ্চিত না রাসেল বিবাহিত কীনা, এমনকি রেডিও ফুর্তির অফিস ঠিক কোথায়, কয়তলায়, রাতের শিফটে কারা থাকেন, এইসব কিচ্ছু জানিনা। পুরো লেখাটাই কল্পনাভিত্তিক। আমি তো সিরিয়াস মুডেই লিখেছিলাম, কতিপয় দুষ্ট বালক-বালিকা এই গল্প পড়ে হা হা প গে করেছে। ] কালো হিমুর নোটবুক ...  ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.