এই একবিংশ শতাব্দীতেও কেউ যে ফটিক হইতে পারে তাহা আমার এই গল্প না পড়িলে বিশ্বাসযোগ্য হইবে না। আমার গল্পের ফটিকের নাম রাখিলাম সোহেল। সম্পর্কে আমি তাহার বন্ধু বিশেষ। পিতৃহারা সোহেলের গায়ের রঙ শ্যাম বর্ণের হইলেও তাহার চেহারাখানা ছিল বেশ দেখিবার মতো। ডাগর ডাগর চোখ সাথে মাথা ভর্তি কুচকুচে কাল চুল।
ছাত্র হিসাবেও সুনাম ছিল আমাদের ফটিকের। বরিশাল জিলা স্কুলে সেই প্রথম শ্রেণী হইতে তাহার বয়স বৃদ্ধির সহিত ক্লাসের সংখ্যা বৃদ্ধি পাইয়াছিলো ঠিকই কিন্তু ক্রমিক নং তাহার সেই ‘এক’ এই অপরিবর্তিত রহিয়াছিল অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত।
ছেলেকে আর ভালো দেখিবার বাসনায় সোহেলের মা সোহেলকে ঢাকা পাঠাইয়া দিলেন। নবম শ্রেণীতে সোহেল ভর্তি হইল ঢাকার একটি নামকরা স্কুলে। সঙ্গত কারনেই আমি স্কুলটির নাম বলিব না।
আর তাহার জায়গা হইল মামার বাসায়। বলিয়া রাখি সোহেলের মামা একটি মাল্টি ন্যাশনাল কোম্পানিতে চাকুরি করিত আর মামী ছিল একটি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের শিক্ষিকা। তাহারা বাপহারা সোহেলকে নিজেদের সন্তানের মতোই যত্নআত্তি করিত।
প্রথম দিকে সোহেলের পড়াশুনার অবস্থা ছিল খুবই আশাব্যঞ্জক। নতুন ছাত্র হইয়াও ক্লাসে সে তাহার বিদ্যার দৌড় দ্বারা সবাইকে তাক লাগাইয়া দিতে লাগিল।
এইভাবে প্রথম পার্বিক পরীক্ষায় ফার্স্ট হইতে না পারিলেও বেশ ভালো করিল সোহেল। ইহাই বা কম কিসে। বরিশাল থেকে আসিয়া রাজধানীর একটি নামি স্কুলে প্রতিযোগিতা করিয়া ভালো অবস্থান করিয়া লওয়া তো মুখের কথা নহে।
কিন্তু এরপর কিভাবে যেন কি হইয়া গেলো। প্রথমে কিছুই বুঝিলাম না।
শুধু লক্ষ্য করিলাম আমাদের সেই মেধাবী সোহেল আর নাই। তাহার জায়গায় অদ্ভুত বিস্ময় লইয়া আবিষ্কার করিলাম নতুন এক সোহেলকে যে কিনা ক্লাসের শেষের সারিতে বসিতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। পড়ালেখার সহিত ছাত্রের যে সম্পর্ক থাকা উচিত বিশেষ করিয়া সোহেলের মতো ছাত্রের তাহার মধ্যে তা পুরোপুরি অনুপুস্থিত দেখা যাইতে লাগিল। স্বভাবতই দিনে দিনে শিক্ষকদের ও বদ নজরে পরিতে লাগিল বেচারা। আমরা যেই খানে সকাল হইতে সন্ধ্যা পর্যন্ত শিক্ষকের বাসা আর স্কুল এই দুইয়ের মাঝে দৌড়াদৌড়িতে ব্যস্ত সোহেল তখন অন্য জগতে হারাইয়া গিয়াছে।
কোন সে জগত আমরা কেহই জানি না। আর আমি ও নিজেকে লইয়াই ব্যস্ত হইয়া পরিলাম। প্রতিযোগিতার এই যুগে গোল্ডেন জি পি এ ৫ ছাড়া ঘরে আসিলে যে একরকম সমাজ চ্যুত হইতে হইবে এই আশঙ্কা মনের মাঝে এলার্ম ঘড়ির মতো নিয়মিত এলার্ম বাজাইতে লাগিল।
এইভাবে আমরা নবম শ্রেণী হইতে দশম শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হইয়া গেলাম। সোহেল ও হইল তবে টানিয়া টুনিয়া।
আর আশাতীত ভালো ফল করিয়া আমার নিজের মধ্যে কেমন জানি অন্যরকম একটা ভাব আসিয়া পরিল। ধরাকে সরা জ্ঞান করিবার মতো আর কি। তাই পড়ালেখায় অটোম্যাটিক ঢিল পড়িয়া গেলো আমার। এই পর্যায় আমি বলিব বিষয়টা খুব একটা খারাপ হয় নাই নইলে হয়তোবা আমি সোহেলের ফটিক হইবার ঘটনাটাই জানিতে পারিতাম না কোন কালে। আমি ও টুকটাক ক্লাস মিস দেয়া শুরু করিলাম আর সোহেলের সাথে মিশিতে চেষ্টা করিলাম আগের মতো।
প্রথম দিকে বেপারটা মোটেও সহজ ছিল না কারণ ওর জগত ছিল আমাদের হইতে আলাদা; সিগারেট খাওয়া ও ধরিয়াছিল ইদানীং। বহু চেষ্টা করিয়া আমি আবার ওর ঘনিষ্ঠতা লাভে সক্ষম হইলাম। কেন চেষ্টা করিলাম জানি না, তবে বোধ হয় কৌতূহলই এর প্রধান হেতু। ওর ঘনিষ্ঠতার জন্য কিভাবে কি করিয়াছিলাম সেই দিকে যাইব না; ঘটনা নইলে বৃহৎ হইয়া যাইবে।
টেসটসটেরন হরমোনের স্বাভাবিক ক্ষরণ ও যে বাপ মা ছাড়া পরিবেশে একটি ছেলের জন্য কতটা সমস্যার তৈরি করিতে পারে তাহা আমি প্রথম উপলব্ধি করিলাম সোহেলের ঘটনা হইতে।
আমাদের স্কুলেরই অষ্টম শ্রেণীতে পড়িত সোহেলের মামীর আপন বোন। অর্থাৎ সম্পর্কে সোহেলের আন্টি। একটি মেয়ের যতটুকু রূপ থাকিলে আমরা তাহাকে রূপসী বলি তাহা ওই মেয়ের মধ্যে পরিমাণে সৃষ্টিকর্তা মনে হয় একটু বেশিই দিয়াছিলেন। প্রথমদিক কার সখ্যতার দরুন আমার ওই মেয়েকে অনেক বারই দেখিবার সুযোগ হইয়াছিল। আমি ও বয়ঃসন্ধি জনিত কারনে ওই মেয়ের প্রতি এক আধটু দুর্বল ছিলাম বৈকি কিন্তু তা মুখ ফুটিয়া প্রকাশ করিবার মতো বেপার ছিল না।
হয়তো মাঝে মধ্যে সোহেলের সাথে এই নিয়া ঠাট্টা তামাশা করিতাম। এই পর্যন্তই। কিন্তু তখন লক্ষ্য করি নাই কিন্তু এখন বুঝিতে পারি কেন সোহেল বেপারটাকে ভালো চোখে দেখিত না। আমি সুবোধ ভাবিয়াছিলাম মামীর বোন বিধায় সোহেল এমনটা করিত। তাই আমি ও ঠাট্টা তামাশা করা বাদ দিয়াছিলাম।
কিন্তু কিছু বাস্তবতা যে গল্পকেও হার মানায় তা ওই দিন বুঝিলাম। যখন জানিলাম যে আসলে ওই মেয়েই সোহেলের মনের রানী হইয়া তাহার হৃদয় সাম্রাজ্যে রাজত্ব করিতেছে। আর তাহার রাজ্য শাসনের প্রগাঢ়তা এতই বেশি ছিল যে ওইটুকু বালকের পক্ষে তা হজম করা বোধ করি কঠিন হইয়া গিয়াছিল। যেই কারনে সোহেল পড়ালেখা সামলানো বাদ দিয়া মনের রানীকে সামলানোতেই বেশি ব্যস্ত হইয়া পরে। অবুঝই বলিব নয়তো কি।
তাহারা যখন এইরূপ অসম সম্পর্ক গড়নের স্বপ্নে বিভোর তখন তাহাদের স্বপ্নের ঢেউ যে কখন বাস্তবতাকে আঘাত করিয়া বসিল নিজেরাও বুঝিয়া উঠিতে পারে নাই। ফলশ্রুতিতে তা মামা মামীর চক্ষুগোচর হইয়া যায়। এরপরে ফলাফল কি হইবে তা সকলেরই কম বেশি অনুমেয়। আর হইয়াছিল ও তাই। সোহেল হইয়া উঠিল এ কালের ফটিক।
তবে সোহেলের মামা বিধবা বোনের মুখ পানে চাহিয়া অনেকটাই নীরবে বেপারটাকে চাপিয়া যায়। শ্যালিকাকে ও শ্বশুর বাড়ি চিটাগাং পাঠাইয়া দেয়। সেই সাথে তাহার বউকে ও বুঝাইতে চেষ্টা করে। কিন্তু বুঝাইলে কি আর হয়। মাতৃতুল্য মামীর চোখে সোহেল হইয়া উঠে ফটিক।
অপরদিকে হৃদয়ের রানী হারাইয়া সোহেলের যে অবস্থা হয় তা তাহার ফটিকতার মাত্রাকে দিন দিন আরো বাড়াইয়া তুলিতে থাকে।
ঘটনার এইখানেই পরিসমাপ্তি নয়; কিন্তু বোধ করি পাঠক বাকিটুকু অনুমান করিয়া লইতে পারিবেন তাই আর অনর্থক প্রলম্বিত করিলাম না।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।