আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

রাজাকার শক্তির পুনরুত্থান (২)

বাংলা আমার দেশ আমার জনৈক পরিচিত মুক্তিবাহিনী এক সভায় বলেছিলেন, একজন মুক্তিবাহিনী সময়ান্তরে রাজাকার হতে পারে রাজাকার কখনো মুক্তি হয় না। তার সঙ্গে আমি একমত নই। কারণ মুক্তিযুদ্ধের সময়ই এর বিপরীত চিত্রটিও দুর্লক্ষ্য নয়। আমি এদিকে যাচ্ছি না। তবে এ দেশে রাজাকার শক্তির পুনরুত্থানের কারণসমূহ কিঞ্চিৎ পর্যালোচনায় আনতে চাই।

প্রথমত ধর্মীয় কারণে রাজাকার হবার যুক্তিটি আপাতগ্রাহ্য না হলেও, তাই সত্য। ’৭১এ প্রধানত ধর্মীয় কারণটিকে সামনে রেখেই, আলেম সম্প্রদায় রাজাকার হন। পাকিস্তান না থাকলে এখানে ইসলাম থাকবেনা। এ কোন মুক্তিযুদ্ধ নয়। হিন্দু ভারতের পাক ও তানকে দ্বিখন্ডিত করার ষড়যন্ত্র।

ইসলাম গেল ভারত এল শ্লোগানে মত্ত মোল্লা সম্প্রদায় মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে ছিল সদা খড়গহস্ত। এমনকি, পাকবাহিনীর নারীধর্ষণের মত জঘন্য আচরণকেও নির্দ্বিধায় স্বীকৃতি দিয়েছে। তাদের দৃষ্টিতে পাকবাহিনী দখলকৃত পূর্বপাকিস্তানের নারীসম্প্রদায় গণিমতের মাল। তারা তো আর এখানে বিবি-বাচ্চা সঙ্গে নিয়ে আসেনি। এসেছে পাকিস্তানের অখন্ডতা রক্ষার শপথ নিয়ে, আল্লাহর রাস্তায় জেহাদ করতে।

তাদের যে কোন প্রকার সহায়তা দান জেহাদে অংশগ্রহণের শামিল। এভাবেই নারীগৃধ্মু, বর্বর পাকবাহিনীর নারীধর্ষণকে জায়েজ ফতোয়া দেয়া হয়। বঙ্গবন্ধু প্রচারিত ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শকে তারা ধর্মহীনতা বা কুফরের নিয়ম বলে, ফতোয়া জারি করে। অথচ ধর্মের নামে এ দেশে কোটি কোটি মুসলমানের মুক্তির আকাঙ্ক্ষাকে অস্ত্রের জোরে দমন করাকে তাদের চোখে অন্যায় বা ধর্মবিরুদ্ধ বলে মনে হয়নি। এমনি চোখে ঠুলিপরা তথাকথিত ধর্মীয় মোহাচ্ছন্নতায় সমস্ত পাকিস্তান আমলব্যাপী যা করেছে, স্বাধীনতা আন্দোলনের দশ মাস তাই মরণ ছোবল হিসেবে চরম বিস্ফোরিত অগ্নিলাভায় ফেটে পড়ে।

এই মাত্র কিছুদিন আগেও জনৈক ষাট ছুঁই ছুঁই লোক আমাকে প্রশ্ন করে এ দেশে তো কোন রাজাকার খুঁজে পাইনে। কারণ জানতে চাইলে সে বলে যারা রাজাকার ছিল তাদের জিজ্ঞেস করলেই বলে তাদের কেউ স্বেচ্ছায় রাজাকার হয়নি। পাকবাহিনী ও পাকপন্থিদের জোরজবরদস্তিতে প্রাণের ভয়ে রাজাকারে নাম লিখিয়েছে অথবা তাদের বাহ্যত সমর্থন জ্ঞাপন করেছে। আমি উত্তরে জানাই কথাটি অসংগত নয়। বন্দুকের নলের মুখে ইচ্ছের বিরুদ্ধেও অনেক কিছুই করানো সম্ভব।

কিন্তু যারা এমন বলছে তাদের এখনকার কি ভূমিকা তাতেই বুঝবেন কে আসলই রাজাকার, কে নয়। এ নিরিখে বিচার করলে এখন পর্যন্ত হুজুর সম্প্রদায়ের ৮০% জনের প্রশ্নে রায়টা কোনদিকে যাবে, এ বিচার ভার তাদের উপরই আরোপ করা হোক না হয়। আত্মবিশ্লেষণের কষ্টিপাথরে যাচাই করে তারা নিজেদের রায় নিজেরাই দিন। ধর্মীয় কারণে রাজাকার প্রবণতার তথ্য বা তত্ত্বগত বিশ্লেষণটি আর অধিক দীর্ঘায়িত করা নিষ্প্রয়োজন। দ্বিতীয়ত রাজনৈতিক অঙ্গনে রাজাকারতন্ত্রের পূর্ণবিন্যাসের রূপ দীর্ঘতর এবং ব্যাপক।

৭৫’র আগে এবং পরে এর সুস্পষ্ট দুটি রূপ। একটি আরেকটির বিপরীত। ৭৫’র আগে দেশে রাজাকার যে ছিল না তা নয়। তারা পাকবাহিনীর সরাসরি দালাল বা সমর্থক গোষ্ঠী। সাধারণ ক্ষমার অজুহাতে তারা শুধু দেশে সাধারণ নাগরিক রূপে বসবাসের সুযোগ লাভ করেছিল।

পাকআমল সুলভ ধর্মীয় রাজনীতির ভাওতায় কোন অধিকার খাটানোর বিন্দুমাত্র অবকাশ ছিল না। কিন্তু পচাত্তর ট্র্যাজেডির পরিণামে তারা আবার সত্যিকার শক্তি নিয়ে মাথা চাড়া দেয়। ৭৫’র ট্র্যাজেডিতে যারা জড়িত ছিল, তাদের কেউই আপাত রাজাকারদের মধ্যে নেই। মুজিব হত্যায় অভিযুক্তদের তালিকা দেখে তাই নিজামিরা আত্মতৃপ্তির ঢেকুর তোলেন এ তালিকায় তাদের একটি লোকও নেই। বস্তুত পচাঁত্তর ট্যাজেডির সঙ্গে জড়িতরা রাজাকার নয় মীর জাফর।

তবে মীর জাফররা নব্য রাজাকার। মত বদলের পালায় মুক্তি থেকে রাজাকারে পরিবর্তন এদেশের অনেকের বেলায়ই সত্য। এ দলের শীর্ষে যে সব মীর জাফর বেশি নব্য রাজাকার রয়েছে তারাই ৭৫’র ট্র্যাজেডির জন্য দায়ী। পচাঁত্তরের ইতিহাসযুগের বিশ্বব্যতিক্রম মহাট্র্যাজেডি শুধু নব্য রাজাকার তন্ত্রেরই জন্ম দেয়নি স্বাধীনতা আন্দোলনকালীন পাকসহযোগীদের মনে পাঁচ হাতির বল যুগিয়েছে। অর্থাৎ নতুন রাজাকারের বীরদর্পিত শুভজন্ম এবং পুরাতন রাজাকারতন্ত্রের পুনরুত্থান।

এরপর রাষ্ট্র পরিচালনায় জিয়াতন্ত্রের একচ্ছন্ন আধিপত্য। মুক্তিযুদ্ধের একজন সেক্টর কমান্ডার হলেও শেখ মুজিবের চিন্তাচেতনা ও আদর্শের সঙ্গে তার ছিল যোজন যোজন ব্যবধান। এ মতাদর্শগত পার্থক্যের প্রধানত দুটি ধারা। এক, তিনি বঙ্গবন্ধুর একদলীয় বাকশাল নীতিতে কিছুতেই বিশ্বাসী ছিলেন না। বঙ্গবন্ধুর বাকশাল গঠনের কারণ উদ্দেশ্য ও পরিস্থিতিগত পর্যালোচনায় যাব না।

বা সে সুযোগ এখানে নেই। তবে এ ব্যাপারে কর্নেল ওসমানিসহ অনেকের সঙ্গে তার দ্বিমত হয়। ৭৫’র ঘটনার আবর্তন বিবর্তনে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হবার পর বুঝা যায় জেনারেল জিয়াও সে দলেরই একজন। আর্মি শাসনের বিশেষ সময়টি অতিক্রান্ত হবার পর তিনি আপাত দৃশ্যে বহুদলীয় গণতান্ত্রিক ধারায় প্রত্যাবর্তন করেন। অপর যে মতপার্থক্যটি শেখ মুজিবের সঙ্গে জেনারেল জিয়ার বিশেষভাবে স্পষ্টতা লাভ করে এটিই ছিল দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে নেতিবাচক সমস্যা।

তাই পাক আমলের তথাকথিত ধর্মীয় রাজনীতির পুনরাগমন ঘটায়। তা ছিল কার্যত বঙ্গবন্ধু প্রবর্তিত ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতির আদর্শ প্রত্যাখ্যান। বঙ্গবন্ধু এ আদর্শ গ্রহণ করেছিলেন দুটি কারণে। এক, বঙ্গবন্ধুর প্রবর্তিত এ নীতি ছিল পাক আমলে বহু পোড় খাওয়া তেতোতিক্ত অভিজ্ঞতার পরিণাম। দুই, ধর্ম যার তার রাষ্ট্র সবার- এ হচ্ছে সাম্প্রদায়িক চেতনামুক্ত আধুনিক বিশ্বের গণতান্ত্রিক রাজনীতির ধারা।

কিন্তু জেনারেল জিয়া এ আদর্শ থেকে বিচ্যুত হয়ে বহুদলীয় রাজনীতির নামে ধর্মীয় রাজনীতির ছদ্মচারিতায়, কার্যত রাজাকারতন্ত্রের স্বীকৃতি প্রদান করেন। এ স্বীকৃতি পাওয়া মাত্র জামাত ইসলাম, নেজা ইসলাম ইত্যাদি পুরাতন নামে ধর্মীয় মৌলবাদী দলসমূহ কোন প্রকার আত্মশুদ্ধি বা আত্মঅনুশোচনা ছাড়াই, রাজনীতিতে পুনর্বাসিতই শুধু হয়নি, তাদের প্রোপাকিস্তানী মনোভাবকে অকপটে চাঙ্গা করে তোলে। পতাকা ভিন্ন হলেও দেশে আবার পাকপন্থী বস্তাপচাঁ রাজনীতির গলিজ বদঁবু বিস্তার লাভ করে। শুরু হয় ধর্মের নাম ভাঙিয়ে রাজনীতির খেলা। জিয়া সংবিধানে সংযোজন করেন বিসমিল্লাহ পরবর্তী সামরিক সরকার জেনারেল এরশাদ মরহুম জিয়াকে টেক্কা দেন রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম করে।

শুধু তাই নয়। তিনি মৌলবাদীদের খুশি করার জন্য পথে-বিপথে ছাত্রবিহীন শিক্ষক সর্বস্ব মাদ্রাসার সংখ্যাবৃদ্ধিই শুধু ঘটাননি মাদ্রাসা শিক্ষাকে সাধারণ শিক্ষার প্রায় প্রতিদ্বন্দ্বী করে তোলেন। এর শিক্ষকরা কলেজ শিক্ষকের মর্যাদায় অভিষিক্ত হয়। (চলবে) ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.