আমি আজীবন লিখতে চাই ইনশা আল্লাহ্ । আমার কৈশোরে দেখা মুক্তিযুদ্ধ আমার মানসিকতার মধ্যে এমন এক প্রভাব বিস্তার করে আছে- যা আমি কখনোই মুক্ত হতে পারিনি । আমি অনেক অনেকবার এই মনস্তাত্বিক বিষয়টিকে বুঝতে চেষ্টা করেছি । খোঁজতে চেষ্টা করেছি, কেন প্রাণের মায়া ত্যাগ করে, প্রিয়জনদের ত্যাগ করে, শুধু দেশের জন্য মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছে মানুষ ? দেশতো কারো একার নয়, জীবনতো প্রত্যেকেরই একার ।
তবে কি প্রাণ উৎসর্গের দূর্নীবার আকর্ষণের নামই মুক্তিযুদ্ধ ? মা-বাবা, ভাই-বোন, স্বামী-স্ত্রী, সন্তান-সন্ততি, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব, পাড়া-প্রতিবেশী সকলের আকর্ষণ ছিন্ন করে নিযে যায় যে আকর্ষণ- তার নাম মুক্তিযুদ্ধ ! কেমন সে আকর্ষণ, তা কে বুঝতে পারে ? কেউ বুঝাতে পারবেনা ।
এযে অন্যকে বুঝানোর বিষয় নয় । এ শুধু অন্তর দিয়ে অনুধাবন করার বিষয় । আমরা যারা কথায় কথায় মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কথার খৈ ফুঁটাই, তারা কি বিষয়টি অন্তর দিয়ে অনুধাবন করে দেখেছি ? হয়তে দেখিনি ।
সবাইতো মুক্তিযুদ্ধে যায়নি । অনেকেতো এখানেই লুট তরাজে জড়িয়ে জীবনকে আরো উপভোগ্য করেছে দেখেছি ।
জুলহাস ওতো তা করতে পারতো । আমার পাশের বাড়ীর কিশোর বন্ধু জুলহাস । মুক্তিযুদ্ধে গিযে আর ফিরে আসেনি ! মুক্তিযুদ্ধের কোন ইতিহাসে তার নাম লিখা হয়নি । শহীদের তালিকায় জুলহাসের নাম পাইনি । তাহলে সে কি পেলো নিজের জীবন দিয়ে ? মা-বাবা, ভাই-বোন, আত্মীয়-পরিজনকে কাঁদিয়ে দেশ রক্ষার যুদ্ধে যে জীবন উৎসর্গ করলো, দেশ তার জন্য কি করলো ? তাহলে দেখা যাচ্ছে, কোন নিশ্চিত বিনিময়ের জন্যও যুদ্ধ করেনি মুক্তিযোদ্ধারা ! বিনিময় আসবে কিনা তাওতো জানার কথা নয় ।
কোন মাসের ঘটনা আজ আর মনে নেই । একদিন দেখা গেল জুলহাসকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছেনা । নাই, নাই, কোথাও নাই জুলহাস । পরে অন্যান্য বন্ধুদের থেকে জেনেছি জুলহাস মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছে । কষ্ট পেলেও একটু তৃপ্তিও পেয়েছি এই ভেবে যে জুলহাসতো আমাদেরই বন্ধু ।
এই তৃপ্তিটুকু শুধু সেই বুঝবে যার কেউ মক্তিযুদ্ধে গিয়েছিল । দেশ স্বাধীন হওয়া পর্যন্ত ওর অপেক্ষায় ছিলাম, যদি জুলহাস আসে তবে ওর সাথে কথা বলে জেনে নেবো মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার পথ । কিংবা ওর সাথেই চলে যাবো মুক্তিযুদ্ধে । দেশ স্বাধীন হয়েছে, কিন্তু জুলহাস আর ফিরে আসেনি ! আজো আসেনি । কেউ জুলহাসের কোন তথ্যই দিতে পারেনি ।
ওকি যাওয়ার পথেই শহীদ হয়েছে, নাকি যুদ্ধ করে শহীদ হয়েছে, নাকি অন্য কিছু । কেউ জানেনা ।
সে সমযে কিশোর বয়সে আমরা হাফ প্যান্ট পড়তাম । জুলহাসও হাফ প্যান্ট পড়তো । কুচকুচে কালো গায়ের রং, লম্বাটে দেহ, স্বাস্থ্য ভাল, নাকটি একটু বাঁকানো মনে হতো ।
মনে হতো বয়সের তুলনায় দৈহিক সামর্থ্য বেশি । একটু ঝগড়াটে স্বভাবের ছিলো । তবে খুব সাহসী ছিলো । দুঃসাহসীকতায় ওর জুড়ি ছিলোনা । অনেকে ওকে ভয়ও পেতো আগ্রাসী মনোভাবের জন্য ।
অনেকটা গোঁয়ার প্রকৃতির মানুষ ছিলো জুলহাস । কণ্ঠস্বর চড়া ও রুক্ষ ছিলো । হাত পা ছিলো বড় বড় । ও' ছিলো বাঁ হাতি । বাম হাত ব্যবহার করতো ডান হাতের কাজে ।
ওর বাড়ী নারায়ণগঞ্জের দেওভোগের আলী আহাম্মদ চুনকার পুরান বাড়ীর লাগোয়া উত্তর-পূর্ব পাশে । ১৭৮ আলী আহাম্মদ চুনকা সড়কের দক্ষিণ পাশে । চুনকার বাড়ীর পূর্ব পাশে মাঠ, মাঠের পূর্ব পাশে আমাদের বাড়ী । এলাকার সকলে সেই মাঠেই খেলাধুলা করতাম । সমবয়সী সকলের কাছে জুলহাস প্রিয় ব্যক্তি ছিলোনা ।
আমারও না । কিন্তু সেই জুলহাসই আমার গর্ব হয়ে উঠলো । আমি ওর জন্য গর্ববোধ করি । ওর আত্মার মাগফেরাত কামনা করি । আমার স্মৃতিতে ওর অবয়ব আজে অমলীন ।
ওর প্রিয়জনরা ওর লাশটিও দেখতে পেলোনা । মুক্তিযুদ্ধের কোনও জায়গায় ওর নাম নেই । কিন্তু ওযে জীবন দিয়েছে তাতো সত্য । ওর মতো কতো জুলহাসের ইতিহাস যে ইতিহাসে নেই তা কে জানে ! ওদের রক্তে আমরা পেয়েছি স্বাধীনতা । ওদেরকে কি বিনিময় দিয়েছি আমরা ? মনেহয় আমার এই লেখাটুকু ছাড়া আর কিছুই দিতে পারিনি !
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।