আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

খাঁটি গরুর দুধ না গরুর খাঁটি দুধ?

গরুর দুধ স্বাস্থ্যকর খাদ্য, তবে দুধ খেতে গিয়ে তা জলমেশানো না খাঁটি এ নিয়ে ভোক্তাদের মধ্যে সন্দেহ চলছে বহুযুগ আগে থেকেই। গরুর দুধ আর জল উভয়েরই ধর্ম যেহেতু তারল্য এবং দুধে জল মেশালে যেহেতু তার পরিমাণ লাভজনকভাবে বৃদ্ধি পায়, সুতরাং এ ‘জলতরঙ্গ’ রোধিবে কে? এখন কথা হচ্ছে, দুধে জল মেশালে তার খাঁটিত্ব মার খায়। ফলত মানুষ খাঁটি দুধের সন্ধান করে। । খাঁটি দুধ খেয়ে স্বাস্থ্য ও পুষ্টি নিশ্চিত করতে চায়।

এ পর্যন্ত ঘটনা মোটামুটি সরলরেখায় এগিয়েছে। কিন্তু বিষয়টা জটিল হয়েছে তখনই, যখন দুধের খাঁটিত্ব আর গরুর খাঁটিত্বের অনর্থক তর্ক তুলে ভাষাগত শুদ্ধতা-অশুদ্ধতার প্রশ্ন উত্থাপন করা হয়েছে। কথা উঠেছে ‘খাঁটি গরুর দুধ’ না ‘গরুর খাঁটি দুধ’? এতকাল আমরা ‘খাঁটি গরুর দুধ’ বলেছি, কিন্তু যাঁরা শুদ্ধতাবাদী, যাঁরা সুনির্দিষ্ট করে শব্দপ্রয়োগ করতে চান, তাঁরা বলেন, ‘গরুর খাঁটি দুধ’ লিখতে হবে, কেননা দুধ খাঁটি কি না সেটাই প্রশ্ন, গরুর খাঁটিত্ব তো কেউ বিচার করছে না। অতএব ‘খাঁটি গরুর দুধ’ বলা যাবে না, বলতে হবে ‘গরুর খাঁটি দুধ’। সবচাইতে বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে, বাংলা একাডেমী ১৯৮৮ সনে প্রকাশিত তাদের একটি বইয়ে ঠিক এরকম একটি নির্দেশনাই দিয়েছে।

বইটির নাম ‘বাংলাভাষার প্রয়োগ ও অপপ্রয়োগ’। এই বইয়ের ৭৮ পৃষ্ঠায় ‘বাংলা শব্দের অশুদ্ধ ও শুদ্ধ প্রয়োগ’ অধ্যায়ে ‘খাঁটি গরুর দুধ স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী’। । এই বাক্যটিকে অশুদ্ধ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। আর তার পাশেই বাক্যটির শুদ্ধরূপ দেওয়া হয়েছে, ‘গরুর খাঁটি দুধ স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী।

’ এখন কথা হচ্ছে, ব্যাপারটি কি আসলেই তাই? ‘খাঁটি গরুর দুধ’ বলা যাবে না? এটি কি অশুদ্ধ? না, এটি মোটেই অশুদ্ধ নয়, বরং শতভাগ শুদ্ধ। আচ্ছা, ‘খাঁটি গরুর দুধ’ না লিখে কেউ যদি ‘খাঁটি গোদুগ্ধ’ লেখেন, তাহলে কি আমরা তাঁকে ভুল বলব? নিশ্চয়ই নয়। ‘খাঁটি গোদুগ্ধ’ যদি কোনো দোষ না করে থাকে, তাহলে ‘খাঁটি গরুর দুধ’ কী দোষ করল? ‘গোদুগ্ধ’ ষষ্ঠী তৎপুরুষ সমাস। আর ‘গরুর দুধ’ও সমাসবদ্ধ পদ। সমাসের নিয়ম অনুসারে বিভক্তি লোপ না পাওয়ায় এটি অলুক ষষ্ঠী তৎপুরুষ সমাস।

এ ধরনের সমাসের আরও উদাহরণ ‘কলের গান’, ‘তেলের বড়া’ ইত্যাদি। এগুলো সমাসবদ্ধ একক পদ হিসেবেই গণ্য। ধরা যাক, কেউ লিখলেন : ‘সুমধুর কলের গান’। তিনি কি ভুল লিখলেন? না, তিনি ভুল লেখেন নি। কেননা ‘কলের গান’।

। এই পদের বিশেষণ হচ্ছে ‘সুমধুর’। এখন এরকম তর্ক কেউ তুলতে পারেন, কল তো সুমধুর নয়, সুমধুর হচ্ছে গান, সুতরাং লিখতে হবে ‘কলের সুমধুর গান’। একথা কি আমরা মেনে নেব? কিংবা কেউ লিখলেন, ‘সুস্বাদু তেলের বড়া’। এখন কি বলা হবে এটা ভুল? কেননা তেল তো সুস্বাদু নয়, বড়া সুস্বাদু।

অতএব লিখতে হবে ‘তেলের সুস্বাদু বড়া’। এরকম কি আদৌ লেখা যায়, না এর কোনো অর্থ হয়? এগুলো শুদ্ধ নয়, হাস্যকরও বটে। ‘গরুর খাঁটি দুধ’-এর বেলায়ও কথাটা একইভাবে সত্য! আসলে যাঁরা বলেন, ‘গরুর খাঁটি দুধ’ লিখতে হবে, তাঁরা বাক্যের বিশেষণ পদটিকে বিশেষ্যের পাশে বসাতে চান। সাধারণভাবে বিশেষণের এরকম ব্যবহারই আমরা দেখে থাকি। যেমন লাল ফুল, নীল আকাশ, নির্মল বাতাস, জাতীয় সম্পদ, কৃতী ছাত্র ইত্যাদি।

কিন্তু বাক্যের পদবিন্যাস সবসময়ই এই রীতি মেনে চলে এমন নয়। অনেক ক্ষেত্রে বিশেষণ বিশেষ্যের চাইতে দূরে অবস্থান নেয়। যেমন ‘জাতীয় অন্ধ সমিতি’। এই শব্দবন্ধটিতে ‘জাতীয়’ হচ্ছে ‘সমিতি’র বিশেষণ, তা কোনোভাবেই ‘অন্ধে’র বিশেষণ নয় এবং বিশেষণ এখানে বিশেষ্যের পাশাপাশি বসে নি, বরং দূরে বসেছে। আমরা নিশ্চয়ই কাউকে ‘জাতীয় অন্ধ’ বা কাউকে ‘প্রাদেশিক অন্ধ’ বলছি না, অন্ধদের সমিতিটা যে ‘জাতীয়’ পর্যায়ের, সেকথাই বলছি।

ব্যাপারটা খুবই সহজ। ‘অন্ধ সমিতি’র বিশেষণ হচ্ছে ‘জাতীয়’। ঠিক একইভাবে ‘গরুর দুধ’-এর বিশেষণ হচ্ছে ‘খাঁটি’। দূরস্থিত বিশেষণের আরও উদাহরণ : আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস, আন্তর্জাতিক বর্ণবৈষম্য বিলোপ দিবস, জাতীয় ভূমিহীন ও খেতমজুর কল্যাণ সমিতি ইত্যাদি। এখানে ‘সাক্ষরতা দিবস’-এর বিশেষণ ‘আন্তর্জাতিক’, ‘বর্ণবৈষম্য বিলোপ দিবস’-এর বিশেষণ আন্তর্জাতিক, ‘ভূমিহীন ও খেতমজুর কল্যাণ সমিতি’র বিশেষণ ‘জাতীয়’।

দূরস্থিত বিশেষণ এখানে অর্থোপলব্ধির ক্ষেত্রে কোনো সমস্যা তৈরি করে নি, শব্দগুলোর পারস্পরিক অন্বয়ও সামঞ্জস্যপূর্ণ রয়েছে। সুতরাং বিশেষণকে বিশেষ্যের পাশে বসিয়ে ‘গরু খাঁটি নয়, দুধ খাঁটি’ এরকম সত্য আবিষ্কারের কোনো প্রয়োজন বা যৌক্তিকতা নেই। অতএব নিশ্চিন্ত মনে ‘খাঁটি গরুর দুধ’ লিখুন এবং পান করুন। (পাঠক, এই জ্ঞানী লেখাটা আমার নয়-আমার স্কুল শিক্ষিকা মায়ের লেখা। মায়ের মৃত্যুর পর তাঁর লেখাগুলো আমার স্ত্রী সংরক্ষণ করার সময় অন্য লেখাগুলোর সাথে এই লেখাটাও পেয়েছে।

যা পাঠকদের সাথে শেয়ার করার লোভ সামলাতে পারলামনা) ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।