শিতের সকাল। কুয়াশায় ঢেকে আছে চার দিক। অন্ধকার নেই কিন্তু সূর্য দেব এখন কুয়াশার চাদর কে ভেদ করতে পারেনি। চোখ থেকে ঘুম চলে গেলেও লেপের উষ্ণতায় অলস ভাবে শুয়ে থাকতে ভালো লাগছে। মাঝে মাঝে হিমালয় ছোঁয়া উত্তরে বাতাসে কুয়াশায় জবুথবু হওয়া গাছ গুল নড়ে অঠে।
গাছের পাতায় লেগে থাকা শিশির বিন্দু গুলো টিনের চালে বৃষ্টির মত রিমঝিম শব্দ তোলে। যাবতীয় যান্ত্রিকতা থেকে এ গ্রাম টি প্রায় দশ বার কি.মি. দূরে হলেও শীতের এই চুপচাপ শান্ত সকালে শুধু প্রকৃতির শব্দের মাঝে মনেই হয় না পৃথিবী র কোথাও যান্ত্রিকতা বলে কিছু আছে। এটি আমার নানি র বাড়ির গ্রাম। বগুড়া জেলার দুট থানা সোনাতলা আর গাবতলী কে ত্রিভুজ এর দুই বিন্দু তে রেখে নিজে এ দুটির মাঝ বরাবর আর একটি বিন্দুতে অবস্থান করছে। গ্রামটি লম্বালম্বি আকৃতির।
L.G.E.D র সড়ক থেকে একটি মেঠোপথ কয়েক টি গ্রামের মাঝ দিয়ে একটি খালের উপর উচু বৃজের পর নিঃসঙ্গ এক টি নারকেল গাছের পরথেকে গ্রাম টি শুরু হয়ে এই ন্রাস্তা ধরেই দক্ষিনে দু কি। মি। পর্যন্ত বিস্তৃত। একটি মাত্রই রাস্তা, ঠিক রাস্তা বলতে নুন্যতম শর্তাবলি পুরন করে ঈমন আর দ্বিতীয়টি নেই। এই রাস্তার একপাশে নিচু ফসলী ক্ষেত আর এক পাশে লম্বা উঠন পেরিয়ে রাস্তার সমান্তরালে গ্রামের বাড়ি গুল।
অধিকাংশ বাড়িই টিনের চালা টিনের বেড়া। বাড়ি গুলোর পেছনেই জঙ্গল স্থানীয় ভাবে এগুলো কে আড়া বলে। গ্রামের মৃত মানুষ দের কবর গুলো এখানেই হয়। দিনের বেলাতেও এর ভেতর টা গা ছমছম করা পরিবেশ থাকে।
আমি শুয়ে আছি লেপটি গায়ে মাথায় দিয়ে।
নড়াচড়া করছি না, নড়লেই পাশের ঠান্ডা বিছানা র ছেকা লাগবে। আমার বিছানা টি ঠিক বিছানা নয়। এটি একটি কাঠের বাক্স। আগে গ্রামে প্রতি বাড়িতেই এমন কাঠের বড় বাক্স থাকত। এটি এত বড় যে হাল ফ্যাশনের বড় আকৃতির তিন চার টি অয়ার্ডব এর মাঝে অনায়াসে যায়গা করে নিতে পারবে।
এ বাক্স টি বার্মা থেকে আনা কোন এক বিশেষ কাঠে তৈরি। গায়ের কারু কার্য গুল অতিত অতিহ্য প্রকাশ করছে। ঢাকনা টিতে পিতলের পুরন চাইনিজ তালা লাগান। যাবতীয় মুল্যবান সম্পদ এর মাঝে রাখা হয়। আর চোরের ভয়ে আমার নানি এর উপর বিছানা করে থাকেন।
আর আমি আসলে এর একচ্ছত্র অধিপতি আমি।
নানি, বাড়ির বছর কামলা ইফাস মামা কে মেঝেতে খেতে দিয়েছেন। প্লেটে তার পাহাড় পরিমান উচু ভাত। পাশে একটি শুকন মরিচ গুজে দেয়া। নানাই বাটিতে করে ফুলকপির ধোয়া অঠা তরকারি তাকে তুলে দিচ্ছে আর দিনের কাজের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে।
উত্তর পাথারের জমু চাষ হয়নি বলে কিছুটা রাগও করছে। কিন্তু ইফাস মামা র মাঝে কোন অভিব্যাক্তি নেই। সে শান্ত স্বরে বলছে “আর একটু ঝোল দেন, বু”
সত্তর পেরোন আমার নানিটির রাগে এখন আর কেউ মাথা ঘামায় না। বাড়ির কামলা টিও না।
যুদ্ধের সময় তার বড় ছেলে মানে আমার বড় মামা পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি থাকার সময় থেকে শুরু করে ১৯৭৩ সে ফিরে আসার আগ পর্যন্ত নানি এত চোখের পানি ফেলেছেন যে এখন এমনি এমনি চোখ দিয়ে পানি পরে।
তার পরও এ বয়সে অনার এ পাড়া ওপাড়া বেরাতে চশ্মার দরকার হয়না। আমি যখন থেকে বুঝতে শুখেছি তখন থেকেই দেখছি তার মুখে বয়সের বলি রেখার আকিবুকি। শুকন খাটো শরীর টাকে রগা বলে মনে হয় না। ফর্সা মুখের থুতনিতে ছোট্ট একটা কালো আচিল। এ বয়সেও সাদা চুল গুলো তার কাধ ছাড়িয়ে যায়।
আর নানা কে আমার যতদুর মনে পরে সে নানি কে ইকবালে র মা বলে ডাকত। ইকবাল আমার বড় মামা র নাম। আর নানি নানা কে আপন বলে সম্বধন করত। নানা কে কখন তার উপর রাগ করতে দেখিনি। আর নানি তাকে আপনি বলে যেভাবে ভক্তির মত শ্রদ্ধা করত তাতে রাগ অভিমান বলে যে উনি ওনার স্বামির উপর কিছু করতে পারেন এটা ধারনাতেও আসত না।
নানা মারা গেছেন ১৯৯২ এ যে দিন আমার বয়স পাচ পূর্ন হয়েছিল সেদিন। তার আদরের নাতি টির জন্ম দিনের সাথে নিজের মৃত্যু দিন কে মিলিয়ে দিয়ে আজীবনের জন্য তিনি আমার সঙ্গী হয়েছেন।
নানি ভাপা পিঠা বানাচ্ছে রান্না ঘরে। মাঝে মাঝে আমাকে এসে ডেকে যাচ্ছে। আমি বলছি ঊঠতে পারব না।
বিছানাতেই এনে দাও। সে কিছুতেই তা দেবে না। ওনার কথা চুলার পাশে আগুনের আচে বসে খেতে হবে। কি যন্ত্রনা, উঠতেই হল নানির হাতের ভাপা পিঠা যে আমার খুবই পছন্দের। উলের সোয়েটার টি গায়ে গলিয়ে স্পঞ্জ স্যান্ডেল পরে মাজন আঙ্গুলের ডগায় ভরিয়ে মুখের ভেতরেদিক অদিক দুই ডলা দিয়ে ইদারার পারে চলে যাই।
ছোট মামি পানি ঊঠিয়ে দেন। মুখ ধুয়ে গামছাতে মুখ মুছে ঠক ঠক করে মারি কাপতে থাকে। মামি একটি চাদর জরিয়ে দেন গায়ে। কিন্তু এ চাদর সাওলান রাজ্য সামলনোর মতই আমার কাছে কঠিন। একপাশ ভালো করে জরিয়ে হাটতে গিয়ে দেখি আর একপাশ মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে।
চুলর পারে পিড়িতে আমরা তিন মামাত ভাইবোন গোল হয়ে বসি। নানি পিঠার জন্য তোইরি ঝুর ঝুরে চালের আটা একটা ছোট বাটিতে ভরে এর মাঝে ছোট ফুট করে গুড় ঢুকিয়ে দেন। এরপর সাদা কাপড়ে মুড়ে উল্ট করে ফুটন্ত পানির পাতিলের ফুটো করা ঢাকনার উপর বসিয়ে দেন। আমরা পাট কাঠি চুলায় দিয়ে এর পেছন দিয়ে ধোয়া বেরন দেখতে থাকি। নানি মাঝে মাঝে কপট রাগ করেন।
বলেন “ এই আগুন নিয়ে খেলিস না রাতে বিছানা ভেজাবি”। ছোট মামি একটি কাসার থালা আমাদের সামনে রাখেন । নানি পিঠা উঠিয়ে সেই থালায় রাখেন আর আমরা ভেঙ্গে ভেঙ্গে খেতে থাকি। মাঝে মাঝে গলে যাওয়া গুড় আমাদের তালু পরিয়ে দেয়। আমরা এক্টির পর একটি পিঠা সাবার করতে থাকি।
পেট ভরলেও আমাদের চোখ ভরে না। শেষে পানি খেয়ে উঠতে গিয়ে দেখি পেট টিংটিং এ হয়ে আছে। স্বাশ নিতেও কষ্ট হয়। এরপর নানা খেলায় হুটোপুটি করে সকাল কেটে দুপুর হয়। দুপুরে শীতে কমে আসা পুকুরে আমরা গোসল করি সালিক পাখির মত।
যত ইচ্ছাই থাকুক এই ঠান্ডা পানিতে লাগঝাপ করার সাহস হয়না। দুপুরে খাবার খেয়ে অলস হয়ে আবার ঘুম। বিকেলে গ্রামের মাথায় বৃজের উপর অনেকের সাথে বসে আড্ডা দেই। সূর্য পশ্চিম আকাশে তাড়াতাড়ি ডুবতে থাকে। ইফাস মামা উত্তরের জমি চাষ শেষ করে লাঙ্গল কাধে ফেলে গরু হাকিয়ে ফিরতে থাকে।
সারা গায়ে কাদা মাখা জীবন্ত মূর্তি হয়ে। বৃজে আমাদের দেখে বলে “ মামু একটা গান শুনবা” । আমরা মাথা নাড়ি। বৃজের নিচে গরু বেধে লুঙ্গির কোছা খুলে সে পলেথিনে পেচানো আজিজ বিড়ি বের করে। দেশ্লাই জ্বেলে বিড়িতে টান দেয় অত্যন্ত শুখের সাথে।
তারপর আকাশের দিকে তাকিয়ে গলা চড়ায়। গাইতে গাইতে মাঝে আমাদের দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়ে। মাঝে মাঝে গান থামিয়ে বিড়ি টানে। থামার মূহুর্ত টিতে মোহাচ্ছন্ন হয়ে থাকি, কোন বাদ্যযন্ত্র নেই কিন্তু আমরা যেন কল্পনাতেই নানা বাদ্যযন্ত্রের অনুরুনন শুনতে পাই।
স্বন্ধ্যা হতে না হতেই রাত নেমে আসে।
ইলেক্ট্রিসিটি নেই তাই হারিকেন আর পিদিমের আলোয় অন্ধকার কে তাড়ানোর চেষ্টা। সেই আলোয় অন্ধকার কে আরো রহস্যময় করে তোলে। বৃজ থেকে বাড়ি ফেরার সময় দূরে কোন এক পীরের ছাউনি দেয়া কবরের পাশে নিভু নিভু আলো দেখতে পাই। অন্ধকার, ঠান্ডা, এ নিশ্চুপ পরিবেশ সব কিছুর মাঝ দিয়ে এক অদ্ভুত সুখের পরশ মন কে ছুয়ে যায়। আমরা ভাই বোন রা হুটোপুটি করতে করতে গল্প করি।
নানি রাতের খাবার বেড়ে ডাকে। মাদুরে খেতে বসি। ভাত খাওয়া শেষ হলে নানি চুলা থেকে লাল হয়ে যাওয়া গরম দুধ এনে আমাদের গ্লাসে ঢেলে দেন। আমরা জিভ পুরিয়ে স্রুতস্রুত শব্দ তুলে খেতে থাকি। দুধ টুকু খেয়ে শুয়ে পরি।
আমি যথারীতি বাক্সের উপর। আমার সাথে নানি থাকেন যাতে আমি বাক্স থেকে পরে না যাই। নানি হাতের কাজ শেষ করে হেরিকেন্টা তিম করে দিয়ে মশারি ঠেলে আমার কাছে শোন। নানি র কাছে অনেক গল্প শুনি। ছোট বেলায় মা কেমন ছিল, ছোট মামা কি করে বাড়ি থেকে পালিয়েছিল।
নানা বৃটিশ আর্মি তে চাকরি করত। ২য় বিশ্ব যুদ্ধের সময় জাহাজে চেপে নানা দূর কোন দেখে গেছেন। সেখানে টুক টাক যুদ্ধ হলেও নানি কাছে সেসব দেশের মজার মজার সব গল্প করেছেন। নানি সেগুলো এতটুকু না ভুলে আমাকে শোনান। বহুবার শোনার পরও সেসব গল্প পুরনো হয় না।
নানা র কথা গল্প করতে গিয়ে নানি এক দিন আমাকে বলে “ ক্যা মনা তুই না না কে স্বপ্ন দেখিস”? আমি বল, দেখেছিলাম অনেক দিন আগে। সে বলে কিছু বলেছে তোকে? আমি বলি, না ত।
আমি বলি আপনি স্বপ্ন দেখেন না?
সে উত্তর দেয় “ কাল দেখছি”
আমি জিজ্ঞেস করি কি বলল,
সে বলে “ মানুষ টা অনেক দিন পর আসছিল। আমি তারে বললাম বাচে থাকতেও সেই যেতেন দুই এক বছর পর আসতেন। এখনও এমন করেন ক্যান?”
আমি অবাক হয়ে শুনি নানি যেন কিশোরী র মত অভিমান জানাচ্ছে।
নানি র মুখ দেখে কখনই মনে আসেনি সে যখন কিশোরী ছিল কেমন ছিল দেখতে?নানা না কি এক দেখাতেই তাকে বিয়ে করে এনেছিলেন। তখন তার বয়স বালিকা ছেড়ে কিশোরী তে পা দেয় নি। এই জীবনে বিশাল সন্সার চালিয়েছেন। ছেলেমেয়ে দের মানুষ করেছেন। নানা র সং সে কত টুকু পেয়েছে কে জানে? আমার বোঝার বয়স থেকে তাকে বুড়িই দেখছি।
তাকে নিয়ে কখন ভালোবাসা প্রেম এসব বিষয় মাথায় আসেনি। আমার মনের কোথাও হয়ত ধারোনা ছিল এসব বয়স কালের ব্যাপার। বুড়ো বুড়ির জন্য নয়। কিন্তু নানির এক কথায় আমার সে ধারনা ভেঙ্গেচুড়ে যায়। কত টা গভীর অকৃত্তিম আর শ্রদ্ধা ভরে ভালোবাস্ত সে স্বামীকে, যে সে তার মৃত্যুর দশ বার বছর পরও স্বপ্নে দেরি করে আসছে জন্য অভিমান করেছে।
যে কোন বিশেষণই এ বর্ননা দেয়ার জন্য যথেষ্ট নয়। যে কোন ভাষাতেই এ প্রেমের বর্ননা দিতে গেলে তা নিশ্চুপ হয়ে যাবে। এ শুধু প্রবল ভাবে হৃদয়ে অনুভব করতে হয়।
এই নানা লোকটিকে এখন আমার হিংসে হয়, সে এমন ভালোবাসা পেয়েছিল যেনে। এ আধুনিক যান্ত্রিকতার যুগে কেউ কি পারবে যান্ত্রিক ভালোবাসা থেকে বেরিয়ে আর এক জন কে হৃদয়ের গভীরে আমার নানি র মত করে ভালবাসতে?
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।