প্রকৃতিকে করো তব দাস-চে দ্য আইডল (ব্লগার নং - ৩১৩৩৯) আমার সময় শেষ। ঘড়ির কাঁটাগুলো চলতে চলতে ঠিক এগারোটা উনপঞ্চাশে থেমে গেছে। আর একটু যেতে পারলেই হত। শেষের সূচনা। আরেকটা নতুন দিনের সূচনা।
আজব! আমাদের এখানে দিন শুরু হয় প্রচন্ড রাতে। আর রাত শুরু হয় প্রচন্ড দিনে। !
'প্রচন্ড দিনে' কথাটা ঠিক হয়নি। রাত কখন শুরু হয় কেউ জানে না। সন্ধ্যা ঝুপমাতালে বাড়তে বাড়তে কখনো যে সন্ধ্যা হয়ে যায়!
বলছিলাম ঘড়ির কাঁটার কথা।
ঠিক এগারোটা উনপঞ্চাশ। শূণ্য ঘন্টায় যাবার আগে ব্যাটারী থেমে গেছে। আর চলবে না এই ঘড়ি। এই মাঝ রাত্তিরে সময়কে আবার চালানোর জন্য কে ঘড়ি ধার দেবে! দেয় কখনো!
মধ্যরাতে যখন থেমে যাওয়া ট্রেনে বসে বসে ঝিম অথবা ছাদের উপর চাঁদের আলোয় এক বোতল হুইস্কি আর ছেঁড়া তারের গিটার নিয়ে গাঁজাবিলাস অথবা ফুটপাতে আদিম সঙ্গমে ভুলে থাকা নাগরিক যন্ত্রণা অথবা বিরহী প্রেমিকের কলমের ডগা ফেটে বের হওয়া কালো রক্ত অথবা আমাদের পাড়ার ঠিক মধ্যবরাবর হেঁতে বেড়ানো হুইসেলঅলা রাতপ্রহরী ও সস্তা লিপস্টিকে রাঙা ঠোঁটে রাতনন্দিনী আর ময়লা চুল দাঁড়ির পাগল ও বেওয়ারিশ কালো কুকুর অথবা যখন অন্যান্য মানুষ-প্রাণী-কথা-দৃশ্যগুলো জট পাকিয়ে যায়, আমার মনে হয় এটাই সময় স্থির হয়ে যাবার। তবে সেই স্থিরতা গতিশীল সময়ের সাপেক্ষে।
সময় স্থির হয়ে গেলে ত হবে না।
ঘুম আসেনা। দুই চোখের পাতা ধরে ফেলতে চায় সমুদ্র-আকাশ-বন। তাই আমি ঢুকে পড়ি ট্রেনের ইঞ্জিনরুমে, দুই বগির সংযোগকারী আঙটা ধরে উল্টো ঝুলে গুণতে থাকি দ্রুত অপসৃয়মান কাঠের স্লিপার, অথবা চুপি চুপি অজল হুইস্কির পেয়ালা গলায় ঢেলে সেই তীব্র জ্বলুনির গায়ে অগন্ধ গাঁজার ধোঁয়াদর। আমায় তখন রাতপ্রহরী সতর্ক করে, রাতনন্দিনী জড়িয়ে ধরে ন্যাতানো হাতে আর এইসব দেখে পাগলটার কোলে মাথা রেখে খেঁকিয়ে উঠে কালো কুকুরটা।
অথচ এই রাতপ্রহরী ছিলো তেজী ঘোড়া, রেসে রেসে ক্ষুরাঘাতে ভেঙে গেছে সহস্র প্রস্তর। আর এই রাতনন্দিনীই ছিলো সবচেয়ে কাম ও প্রেমময়ী, কখনো হেলেন, কখনো এরেন্দিরা।
আমার সময় শেষ। ঘড়ির কাঁটা আর চলবে না। কলমের কালি শুঁকিয়ে গেছে।
আমি তাই আর কবিতা লিখি না। কবিতার খাতায় উঁইপোকারা নির্ভয়ে সঙ্গম করে। আর আমি হিসেব কষি, যদি বাতাস থেকে খুলে আনি জোছনার চৌকাঠ, তবে কার কার কী কী আসবে যাবে।
হিসেবের খাতায় কয়েকজন কবি, কিছু বন্ধু, প্রাক্তন প্রেমিকা। আর কবিতাবন্ধু।
যে আমার ইদানিং খুব ভুল ধরে। আমি কিছু বলি না। হাসি। আমিও কিছুদিন তাকে বলতাম, তুই পঁচা, তোর সব কিছু পঁচা। কাওকে ভালোবেসে ফেলে আবার সহসা সেই ভালোবাসা থেকে উঠে আসার সহজসাধ্য পথ হচ্ছে এটা।
তাকে আমি সহযোগিতা করি। তার ইনবক্স খালি ফেলে রেখেছি অনেক দিন।
তারচেয়ে বরঙ শেষবারের মত নত হওয়া যাক ঈশ্বরের কাছে। আমি অবনত মস্তকে খুলে দেই নিজস্ব পাপসমগ্র। ভুল বানানের সব কবিতা দুমড়ে মুচড়ে ফেলে রাখি ঈশ্বরের দরবারে।
আমি জানি, আমার নির্বাসন অগ্নিকুন্ডে। আমি সেখানে অনন্তকাল পুড়ে যাব। আর আমার কবিতাগুলো অপ্সরাদের রাতকেলির অনুষঙ্গ হবে। আপেক্ষিকভাবে আমি আর আমার কবিতা, দুই ই ব্যর্থ। কিন্তু প্রকৃতার্থে! নিশ্চয় অসফল নয় একেবারে।
আমার পুড়ে যাবার বদৌলতে যাদের জন্ম, তারাই তো হাসাবে অন্য কাওকে। কিছু মানুষ হাসবে বলে প্রাণ খুলে, আমার মত অনেকগুলো মানুষ অগোচরে পুড়ে গেছে, যাচ্ছে, যাবে। সমস্যা হল, পুড়ে যাওয়াটা ঈশ্বরের অপছন্দনীয়। তাই আমি এবার সমর্পিত হব ঈশ্বরের কাছে। অনন্তদহনে আমি বুঝতে চাই, এতদিন আমি নির্বাসনে ছিলাম কেন!
ঘড়ির প্রসঙ্গে আসি।
ঘড়ির কাঁটায় একবার টিকটিকির বাস হয়েছিলো। দশ বারোতা হাত নিয়ে অনেকগুলো শিশু রোজ এইসব দেয়াল বেয়ে উঠে যেত, ঘুরে বেড়াত ঘরময়। কি দুঃসহ আনন্দের সময় ছিলো সেসব! বাতাস হতো। বৃষ্টিভেজা বাতাস। রিকশাপেইন্টারের কবি আর পাখি ও পাপের কবির মুখোমুখি আলাপচারিতা ছিলো।
কবিরা এখনো মুখোমুখি বসেন কিন্তু তাদের শব্দমালা এখন আর এদিকে আসে না।
সেবার পাখিমেলায় কবির সবগুলো পাপাকে নিঃসঙ্গ ফেলে রেখে পাখিটা উড়ে গেলো। সারা পাড়ায় শোরগোল, হারানো বিজ্ঞপ্তি। কিন্তু কবির কিছু যায় আসে নি। পাপ থেকে ঠিকই নতুন পাখি বানিয়ে নিয়েছেন, যে পাখি আগের চেয়েও সুমধুর ডাকে।
আশ্চর্য! এখানে এখনো শীতকালে বৃষ্টি হয় আর পাখিদের জন্ম হয় পাপ থেকে।
কবি একদিন সেই পাখিটা ছেড়ে দিলেন আর বললেন, ধুর! এত সুমধুর গান যে ভালো লাগে না।
ভালো লাগে না। কিছুই না। সময় সেটা বুঝতে পেরেছে।
তাই সলতেবাতির মত আপনা থেকে ফুরিয়ে গেছে। কিছু আর করার নেই। আমাকেও সবকিছু এখানেই থামিয়ে দিতে হবে। এই পোড়া শহর, এই তামাটে মানুষ, এই কংক্রীটের উদ্যান, সবকিছু। যাবার আগে কিছু কি লিখে রাখা যায়? কোনো এলিজি? অস্তিত্বহীনতার আগাম প্রস্তুতি নিতে নিতে কিছু অস্তিত্ব কি রেখে যাওয়া যায়? কী লাভ! কেউ তো নেই যে পড়বে, দেখে রাখবে।
একজন ছিলো। সেও আর থাকছে না। এই মাত্র জানিয়ে দিলো, সে সমসাময়িকদের চেয়ে অনেক বদলে যাচ্ছে, তাই অনেক দূর চলে যাবে কিংবা পালাবে। তাকে ধরে রাখার নিয়মাবলি আমার জানা নেই। তাই তার চলে যাওয়া দেখার প্রস্তুতি নিয়ে রাখতে হবে।
আর আমার এইসব থাক বরঙ মধ্যরাতের ঘড়ির কাঁটায়। যার ঘড়িপাঠের অভ্যাস আছে সে ঠিকই বুঝে নেবে।
কবিকে একটা কথা বলা হয়নি। কবি, আপনার রিকশাপেইন্টারের কবিতায় একটা শব্দ ভুল আছে। আপনি দয়া করে অসমাপ্ত পেইন্টিঙে মুখোশছাড়া মানুষ এঁকে দেবেন।
আঁকতে গেলেই ভুলশব্দের সাথে আপনার দেখা হবে।
আর প্রিয় কবি, কিছু পাপ খুব গোপনে রয়ে গেল এখানে। আপনি এই পাপের ইতিহাস ও গতিপ্রকৃতি জানেন। একটা অন্তত পাখি যদি সৃজতে পারেন তবে একবার ঘড়িটার দিকে তাকাবেন। সেদিন হয়তো ঘড়িটা আবার চলতে শুরু করবে আর গল্পকারের আত্মার হয়ে বলবে, শীতলকারক যন্ত্র কেবল সব শীতল করে ফেলার জন্যে নয়, কিছু কিছু সুপ্ত তাপ দঃরে রাখাটাও মুখ্য উদ্দেশ্য।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।