বাংলা সংস্কৃতিকে এক দূর্যোগপূর্ণ সময়ের ভিতর দিয়ে অতিবাহিত হতে হচ্ছে। এম্নিতেই এতদিন হিন্দি নাটক সিনেমার দৌরাত্মে হিন্দি ভাষা না পারাটা বন্ধুবান্ধবের নিকট মারাত্মক একটা উপহাস এবং হাস্যকর বিষয় হিসেবে বিবেচিত হত। এখন আবার নতুন সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে শুদ্ধ বাংলায় কথা বলা। “আমরা আমড়া খাব” এর থেকে “আমড়া আমড়া খাব”টা এখনকার নতুন প্রজন্মের কাছে বেশি গ্রহনযোগ্য। কথা বলব বাংলায় কিন্তু মনে হতে হবে আমি ইংরেজি ভাষায় কম দক্ষ নই।
আর এই ব্যাপারটা বর্তমান সময়ে কতটা ভয়াবহ আকার ধারন করেছে তা আমরা বুঝতে পারি হাল সময়ে মারাত্মক জনপ্রিয়তা পাওয়া বিভিন্ন এফ.এম. রেডিওর আর.জে.দের উপস্থাপনা শুনে। এদের আরজেয়িং শুনে মনে হয় বিদেশ থেকে ধরে আনা কিছু তরুন তরুনী যারা জীবনেও বাংলা ভাষা শেখেনি বা শুনেওনি, এফ.এম. চ্যানেলগুলোতে তাদের জোর করে বাংলা শেখানো হচ্ছে এবং বহু কষ্টে তারা ইংরেজির ঢঙ্গে বাংলা বলার চেষ্টা করছে। তাদের এই কথা বলার মাঝে মাঝে আবার সমানুপাতিক হারে ইংরেজি শব্দ-ও বেরিয়ে যাচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রেই এদের কথাবার্তা শুনে মনেই হয়না যে এদের ন্যুনতম বোধ জ্ঞান আছে। একবার কোন এক শ্রোতা এরকমই দুজন আর.জ়ে. কে বলেছিল,”ভাইয়া এবং আপুরা এখন ফেব্রুয়ারি মাস, আসুন এই মাসে অন্তত আমরা শুদ্ধ বাংলায় কথা বলি”।
তারপর ঐ দুজন উত্তর দিল অনেকটা এইভাবে,”লিসেনার,আপনি কেন ফেব্রুয়ারি মাসে আমাদের এই এস.এম.এস.টা সেন্ড করলেন?আপনি যদি আদার্স কোন মাসে এই এস.এম.এস.টা পাঠাতেন তাহলে আমরা আরো হ্যাপি হতাম। বিকজ ভাষার প্রতি আমদের অনার থাকবে থ্রু অল দ্য ইয়ার,নট অনলি ইন দিস মান্থ। ”এটা ঠিক যে ভাষার প্রতি আমাদের এই ভালবাসা থাকা উচিত সবসময়। কিন্তু আর.জে.দের এই বিষাক্ত আর.জেয়িং মনে করিয়ে দেয় একটি প্রবাদের,”চোরে না শুনে ধর্মের কাহিনী। ”এই বাংলিশ সংস্কৃতি আমাদের আজ যে ভয়াবহ দিকে নিয়ে যাচ্ছে,তা থেকে কি আমরা আদৌ রক্ষা পাবো? এই আর.জে.দের উদ্দেশ্যে বলতে ইচ্ছা করে,
“যেসব বঙ্গে জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী,
সেসব কাহার জন্ম,নির্ণয় ন জানি।
”
আমাদের ইতিহাসের অন্যতম গৌরবজ্জ্বল দিন হচ্ছে একুশে ফেব্রুয়ারি। ভাষার মর্যাদা রক্ষার জন্য ৫২’র এই দিনে বাঙ্গালি প্রাণ দিয়েছে। পৃথিবীর ইতিহাসে আর কোন জাতির ভাষার জন্য প্রাণ দেয়ার ইতিহাস নেই। অথচ এই এফ.এম. চ্যানেলগুলোতে এই দিনটাকে টুয়েন্টি ফার্স্ট ফেব্রুয়ারি বলতে শোনা গেছে পর্যন্ত। সালাম রফিকেরা বোধহয় এই জন্য প্রাণ দিয়ে যাননি! তারা নিশ্চয়ই একটি খিচুড়ি ভাষায় তাদের সন্তানেরা কথা বলবে এই স্বপ্ন দেখেননি!
যা হোক, এ সব আক্ষেপের কথা! এফ.এম. চ্যানেলগুলো সত্যিই বাংলা গানের জন্য একটি নবদিগন্তের সূচনা করেছে সন্দেহ নেই।
কিন্তু শুদ্ধ বাংলার প্রতি কেন এতো অনীহা! আজ এই এফ.এম. চ্যানেলগুলোতে যে বিপজ্জনক বাংলার চর্চা চলছে,তাতে করে এখন বিপদের আবহই পাওয়া যায়।
আমাদের দেশের এখন অধিকাংশ বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের নাম ইংরেজি ভাষায় লেখা হচ্ছে। এরই ধারা বজায় রেখে বেশিরভাগ প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের নামও দেখা যায় ইংরেজি। ঢাকার অভিজাত এলাকা হিসাবে পরিচিত গুলশান বনানির প্রায় ৯০শতাংশ প্রতিষ্ঠানের নাম ইংরেজি ভাষায় লেখা। এখন কথা হচ্ছে এই যে ইংরেজি ভাষার প্রতি দূর্বলতা,এটি কেন? আমাদের বাংলা ভাষা কি তাহলে ইংরেজি ভাষা থেকে কম স্বয়ংসম্পূর্ণ ? নাকি ইংরেজি ভাষার নাম বাংলা ভাষার থেকে অধিক শ্রুতিমধুর? নাকি বাংলা ভাষায় নাম লিখলে সম্মানহানির আশংকা থাকে?
সত্যিকার অর্থে এটি কিছু মানুষের নিচু মানসিকতা ছাড়া কিছুই নয়।
আমাদের দেশেতো উত্তর দক্ষিন,পূর্ব পশ্চিম সব দিকের ইংরেজি প্রতিভাষাতেই কিছু বিখ্যাত (!!) বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম আছে (লোকে বলে এগুলোও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান। এখানে পণ্য হচ্ছে শিক্ষা। )। একটু চিন্তা করে দেখলাম,”শান্তিনিকেতন” নামের সাথে মাধূর্যতার পরীক্ষায় এগুলো একটিও কি টিকতে পারবে? মনে হল বেশ বড় সড় একটি অসম প্রতিযোগিতা হয়ে গেলো।
কথা হচ্ছে অপরের গোলামি করার স্বভাব যাদের,তাদের কাছে এধরণের কাজই আশা করা যায়।
নিজের ভাষার সাহিত্য সংস্কৃতিসম্পর্কিত জ্ঞান না থাকা সত্ত্বেও অপরের সাহিত্য সংস্কৃতি তাদের বেশি আলোড়িত করে। এ ধরণের মানুষকে নির্বোধ বললেই হবে না,এরা আসলে মেরুদণ্ডহীন।
ভাষা ও সংস্কৃতি নিয়ে আমাদের যে গর্ব তা আজ হুমকির মুখে। কতিপয় ভাষা সন্ত্রাসীর জন্য আমরা আমাদের ঐতিহ্যকে হারাতে পারিনা। পর ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি মেরুদণ্ডহীন প্রাণীর মত এই আসক্তি আমাদের দ্রুত কাটিয়ে উঠতে হবে।
নইলে নির্বোধের উৎপাতে স্তব্ধ বিবেকের অবরুদ্ধ চেতনার দ্বার উন্মোচিত হবে না কোনদিন।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।