আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

গর্ভবতী নারীর পেট চিরে বের করা হয় শিশু একাত্তরে নৃশংসতার নীরব সাৰী কুষ্টিয়ার কোহিনূর ভিলা

আমি একজন আম জনতা গর্ভবতী নারীর পেট চিরে বের করা হয় শিশু একাত্তরে নৃশংসতার নীরব সাৰী কুষ্টিয়ার কোহিনূর ভিলা বাড়ির ছাদে মাইক। একের পর এক গান বাজছে। আর ভেতরে সংঘটিত হচ্ছে ইতিহাসের বর্বরতম হত্যাকান্ড। রাতের আঁধারে একই বাড়ির ১৬ জনকে এভাবে হত্যা করা হয়। গর্ভবতী নারীর পেট চিরে বের করে আনা হয় শিশুকে।

বড়দের কাউকে কেটে কুয়োয় ফেলা হয়। কাউকে ফেলে রাখা হয় মেঝেতে। ক্ষতবিক্ষত নারী পুরুষের রক্তে বাড়ির ড্রেন ভেসে যায়। সকালে সে ড্রেনের দিকে তাকিয়ে প্রথমবারের মতো বাইরের মানুষ জানতে পারে_ রাতে এ বাড়িতে কোন বিয়ের অনুষ্ঠান হয়নি। চলেছে নৃশংসতা।

১৯৭১ সালে ইতিহাসের বর্বরতম এ হত্যাকান্ড সংঘটিত হয় কুষ্টিয়া শহরের কহিনূর ভিলা নামের একটি বাড়িতে। হানাদার পাকিস্তানী বাহিনীর ঔরসজাত বিহারী ও রাজাকাররা এ বাড়িতে ঢুকে সিনেমা স্টাইলে হত্যা করে কহিনূর মিলকো ব্রেড এ্যান্ড বেকারির মালিক রবিউল হক ও তাঁর ছোট ভাই আরশেদ আলীসহ পরিবারের সকল সদস্যকে। বিজয়ের চল্লিশ বছর পরও বাড়িটি আছে। ভুতুড়ে রূপ নেয়া এ বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করলে গা এখনও শিউরে ওঠে। সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, জরাজীর্ণ বাড়িটি এখনও বহন করে চলেছে সেই ক্ষতচিহ্ন।

কুয়োটি আছে আগের মতোই। যে ড্রেন দিয়ে রক্ত পানির স্র্রোতের মতো বেরিয়ে পড়েছিল সেই ড্রেনটিও একই রকম আছে। বাড়ির ওঠোনটিতে এখন খেলা করে নিহতদের স্বজনরা। স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, রবিউল ও আরশেদদের আদি নিবাস ভারতের হুগলি জেলায়। ভারত ভাগের পর সেখান থেকে কুষ্টিয়ায় চলে আসেন তাঁরা।

শহরের ১৯ নং রজব আলী চৌধুরী লেনের দেশওয়ালী পাড়ায় বাড়ি কেনেন। বাড়িটির নাম দেয়া হয় কহিনূর ভিলা। এ বাড়িতেই বেকারির ফ্যাক্টরি বসান তাঁরা। কোহিনূর মিলকো ব্রেড এ্যান্ড বেকারির রম্নটি, কেক, বিস্কিটের চাহিদা দ্রম্নতই বাড়তে থাকে। সততা ও আনত্মরিকতার কারণে অল্পদিনের মধ্যেই সুনাম ছড়িয়ে পড়ে বেকারির।

এ অবস্থায় শুরম্ন হয়ে যায় মুক্তিযুদ্ধ। আড়ুয়াপাড়া ছোট ওয়ারলেস এলাকায় অবস্থান নেয় মুক্তিযোদ্ধারা। তারও বহু আগে কহিনূর ভিলার খুব কাছে বসে পিস কমিটির অফিস। এখান থেকে বাড়ির কর্তাদের গতিবিধির ওপর নজর রাখা হয়। এরপরও রাত গভীর হলে বিস্কিট, কেক, পানি ইত্যাদি নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়তেন রবিউল আরশাদরা।

সঙ্গোপনে মুক্তিযোদ্ধাদের খাবার পেঁৗছে দিয়ে ঘরে ফিরে আসতেন। কখনও কখনও দোকানের কর্মচারী আসাদকে দিয়ে খাবার পাঠাতেন। এদিকে শহরের বেশিরভাগ মানুষ বাড়ি ছেড়ে অন্যত্র চলে আশ্রয় নিয়েছে। কুষ্টিয়া শহরময় আতঙ্ক_ কখন কি হয়। আলবদর আলসামস বাহিনী হত্যা, ধর্ষণ, লুণ্ঠন করে চলেছে।

রাতে বিহারীরা বাঙালীদের বাড়িতে ঢুকে নানা রকম অত্যাচার চালাচ্ছে। এ অবস্থায় শঙ্কিত হয়ে রবিউলরা সপরিবারে সদর উপজেলার কমলাপুর এক আত্মীয়ের বাড়িতে পালিয়ে যায়। কিন্তু এর কয়েক দিন পর পাশের বাড়ির কোরবান বিহারীসহ কয়েকজন কমলাপুর গিয়ে হাজির হয়। রবিউল ও আরশেদদের আশ্বসত্ম করে বলে, আপনাদের কিছু হবে না। বাড়িতে এসে বেকারির কাজ শুরম্ন করেন।

খান সেনারা আপনাদের তৈরি খাবার খাবে। এমন কথায় আশ্বসত্ম হয়ে পুরো পরিবারটি ফিরে আসে কহিনূর ভিলায়। ব্যবসা পুনরায় শুরম্ন করতে ব্যাংক থেকে ৫৭ হাজার টাকা তোলেন রবিউল। কিন্তু তখনও তাঁরা জানতেন না, এটি ফাঁদ। নির্মম পরিণতি অপেৰা করছে তাঁদের জন্য।

স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, একদিন পর ১৮ সেপ্টেম্বর রাতে মজিদ বিহারীর নেতৃত্বে কহিনূর ভিলায় ঢুকে ঘাতকের দল। রাত তখন আনুমানিক সাড়ে ১০টা। বাড়ির সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। এমন সময় বাড়ির দরজায় বিকট শব্দ করে শুরম্ন হয় ডাকাডাকি। উদর্ু গালাগাল চলে।

এর পরও দরজা খোলা না হলে তা ভেঙ্গে ভেতরে প্রবেশ করে গলায় লাল কাপড় বাঁধা নাক-মুখ ঢাকা একদল নরপশু। তাদের হাতে ধারালো হাসুয়া, ছোরাসহ ধারালো সব অস্ত্র। রেলের পিলার বসানো ছোট্ট একতলা বাড়ির সব ক'টি ঘর তছনছ করে তারা। নগদ অর্থ, স্বর্ণালঙ্কার লুট করে। পরে পুরম্নষ, নারী, শিশু সকলকে বাড়ির পেছনের একটি কক্ষের মধ্যে জড়ো করে।

বাড়ির বারান্দায় চুলা জ্বালানো হয়। তাতে বড় বড় হাঁড়ি। সব মিলিয়ে উৎসবের আবহ। তবে রাত গভীর হলে মদ্যপ দলটি মাতলামি শুরম্ন করে দেয়। বন্ধ করে দেয়া হয় প্রবেশদ্বার।

এরপর ভেতরের ঘর থেকে ধরে নিয়ে আসা হয় দু'জন যুবতীকে। বাড়ির বারান্দা লাগোয়া ঘরটিতে নিয়ে তাদের ওপর পাশবিক নির্যাতন চালায়। এরপর দু'জনকে পাশাপাশি মাটিতে শুইয়ে জবাই করা হয়। পুরম্নষদের চোখ বেঁধে মাটিতে বসিয়ে এক কোপে শরীর থেকে মাথা আলাদা করা হয়। তিনটি শিশুকে ধরে নিয়ে বাড়ির ভেতরের ড্রেনের কাছে শুইয়ে বেওনেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করা হয়।

নরপশুদের হাত থেকে রেহাই পায় না রবিউল ও আরশেদের অনত্মঃসত্ত্বা স্ত্রীরাও। একটি কামরার মধ্যে দু'জনকে দাঁড় করিয়ে ধারালো ছুরি দিয়ে পেট চিরে ফেলা হয় তাঁদের। পেট থেকে টেনে বাচ্চা বের করে শূন্যে ছুড়ে মারা হয়। এভাবে একে একে ১৬ নারী-পুরম্নষ ও শিশুকে তারা হত্যা করে। অনেকের লাশ পাশের কুয়োয় ফেলে দেয়া হয়।

বাকিদের ফেলে রাখা হয় বিভিন্ন কৰে। উঠোনে। হত্যাকা- শেষে ঘাতকরা ভূরিভোজ করে সারারাত। ফজরের আজান ভেসে আসলে বাড়ি ছাড়ে তারা। কিন্তু রক্ত বাড়ির ড্রেন দিয়ে বাইরে বের হতে থাকে।

সকালে বাড়ির কাজের মহিলা এসে হত্যাকা-ের খবর সকলকে জানায়। ওই রাতে প্রাণ হারান- রবিউল হক, তার স্ত্রী, আত্মীয় রিজিয়া বেগম, ছেলে আব্দুন হান্নান, মান্নান, ভাই আরশেদ হক, আরশেদের স্ত্রী, মেয়ে আনু, আফরোজা, ছেলে আশরাফ, অতিথি রেজাউল, দোকান কর্মচারী আসাদ, বাতাসি ও জরিনা। এই নৃশংস হত্যাযজ্ঞের বর্ণনা দিয়ে স্থানীয় বাসিন্দা পঞ্চাশোর্ধ আব্দুল কাদের বলেন, সেদিন এ বাড়ির সামনে পাকসেনার একজন অফিসার আসে। পরে লম্বা সাদা কাপড় এনে কোনভাবে বাড়ির পেছনে লাশগুলোকে গণকবর দেয়া হয়। কহিনূর ভিলার পেছনে সেই ১৬ জনের গণকবরটি এখনও আছে।

পৈশাচিকতার বর্ণনা দিতে গিয়ে বার বার আবেগাপস্নুত হয়ে পড়ছিলেন বৃদ্ধ আব্দুল কাদের। সেই দিনের লোমহর্ষক ঘটনার বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, সেদিন ভোরে কয়েকজন কহিনূর ভিলার সামনে দিয়ে ফজরের নামাজ পড়তে যাচ্ছিলেন। এ সময় কয়েকজন পথচারী বাড়ির সামনের ড্রেনে রক্ত দেখে ভয় পেয়ে চিৎকার করে ওঠে। আর এখন চিৎকার করে যেন কহিনূর ভিলা। নীরব ভাষায় বর্বরতার বিচার দাবি করে বাড়িট সুত্রঃ জনকন্ঠ ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ১১ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.