দিনের শুরুতে অ্যাসেমব্লি করার সময় প্রথমে কী করতে হয়? অ্যাসেমব্লির সময় কে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন? একজনের পাশে আরেকজনের দাঁড়ানোকে কী বলা হয়?
চমকাবেন না। এই ধরনের বিষয়গুলোকে এখন মুখস্থ করানো হচ্ছে আমাদের কোমলমতি শিক্ষার্থীদের। ঢাকার একটি বিখ্যাত স্কুলের অর্ধবার্ষিক পরীক্ষার ‘শারীরিক শিক্ষা’ বিষয়ের ২৫ নম্বরের লিখিত পরীক্ষার প্রশ্নপত্রের এটি একটি অংশ মাত্র। আমার এক বন্ধু তাঁর ছেলের স্কুলের এই প্রশ্নটি আমার কাছে পাঠিয়েছেন। শারীরিক শিক্ষার ব্যাপারটি যে এখন আর শারীরিক শিক্ষায় সীমাবদ্ধ নেই, পরীক্ষার খাতায় গড়িয়েছে, এই প্রশ্নপত্রটি না দেখলে আমি বিশ্বাস করতাম না! সম্ভবত শারীরিক শিক্ষার ব্যাপারটি এখন আর মাঠে হয় না, ক্লাসরুমে হয়!
অনেকেই বলবেন, এখন বেশির ভাগ স্কুলে কোনো মাঠ নেই।
কাজে শারীরিক শিক্ষার কোনো ব্যবস্থা করা সম্ভব নয়। সম্ভব হয় না প্রতিদিন ক্লাস শুরুর আগে অ্যাসেমব্লি করার। ফলে তারা আর এই কাজগুলো করে না। এই জন্য বোর্ডে লিখে লিখে এগুলো শেখানোর চেষ্টা হতে পারে। বিচিত্র এই দুনিয়ায় কত কিছু শেখার আছে!
শুধু শারীরিক শিক্ষা নয়।
শিক্ষার্থীদের অনেকেই এখন আর শুদ্ধ করে জাতীয় সংগীত গাইতে পারে না, যা থেকে ধারণা করা যায় যে বেশির ভাগ স্কুলে প্রতিদিন সকালে জাতীয় সংগীতের সঙ্গে জাতীয় পতাকা উত্তোলনের রেওয়াজ মনে হয় আর নেই! এই চল উঠে গেছে বলেই এখন জাতীয় পতাকা কে তোলেন, সেটি লিখিত প্রশ্ন করে জানার চেষ্টা করতে হয়।
আমার বন্ধুটি জানিয়েছেন, তাঁর সন্তানকে ষষ্ঠ শ্রেণীতে মোট ১৩টি বিষয়ের পরীক্ষা দিতে হয়েছে। প্রতিটায় কমবেশি ৪০টি নৈর্ব্যক্তিক প্রশ্ন এবং ছয়-নয়টি সৃজনশীল প্রশ্ন! স্কুলের সব কর্মকাণ্ড পরিচালিত হচ্ছে এই প্রশ্নগুলোকে কেন্দ্র করে। সন্তানের মুখস্থক্ষমতা কম বলে স্কুল থেকে শাসিয়ে দিয়েছে, যেন আমার বন্ধু তাঁর সন্তানকে ওই স্কুল থেকে নিয়ে যায়। নতুবা তার জন্য তাদের স্কুলের সবার জিপিএ-৫ পাওয়া হবে না! স্কুলের রেকর্ড খারাপ হয়ে যাবে।
আমি আগে একদিন লিখেছি পঞ্চম শ্রেণীর সমাপনী পরীক্ষা নামের অত্যাচারে অত্যাচারিত একজন শিক্ষার্থীকে প্রতিটি বিষয়ের জন্য কমপক্ষে ৩০টি প্রশ্নের প্রস্তুতি নিতে হয়। প্রাথমিক শিক্ষা কিন্তু আমাদের সৃজনশীল মুখস্থপদ্ধতির!
যেকোনো শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষার্থী কাঙ্ক্ষিত শিখনফল অর্জন করছে কি না, তা মূল্যায়ন করতে হয়। সেটি রেওয়াজ। তবে সব কর্মকাণ্ড ওই মূল্যায়নকে কেন্দ্র করেই করতে হবে, এমন কোনো বিষয় নেই। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার যারা বাপ-মা, তাঁরা প্রায়ই ভুলে যান যে লিখিত পরীক্ষা মূল্যায়নের একমাত্র পদ্ধতি নয়।
আরও অনেক পদ্ধতি রয়েছে। আর লিখিত পরীক্ষা নিলেই সেখানে যা-তা বিষয়ে শিক্ষার্থীর মুখস্থবিদ্যার পরীক্ষা নিতে হবে, এমনটা কে বলেছে?
বাংলা পরীক্ষায় এক শিক্ষার্থী ‘মিনি কী করে?’ এই প্রশ্নের জবাবে লিখেছে: মিনি বাবার স্যান্ডেল মুখে করে বারান্দায় রেখে আসে। উত্তর দেখে বোঝা যায়, ওই শিক্ষার্থী তাদের বাসার বিড়ালের কর্মকাণ্ড নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করে সেটিই পরীক্ষার খাতায় লিখেছে। শিক্ষক সেটি কেটে দিয়ে জানিয়ে দিয়েছেন, লিখতে হবে: মিনি রান্নাঘরে মাছের হাঁড়িতে মুখ দেয়! বলিহারি আমাদের শিক্ষক! জয় হোক মুখস্থবিদ্যার!
বাংলাদেশের মতো লিখিত পরীক্ষার প্রকোপ এই মহাবিশ্বের কোথাও নেই! ১২ বছরের শিক্ষাজীবনে বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের মাত্র চার-চারটি পাবলিক পরীক্ষায় অবতীর্ণ হতে হয়। পঞ্চম শ্রেণী শেষে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী, অষ্টম শ্রেণীর জেএসসি, দশম শ্রেণী শেষে এসএসসি এবং দ্বাদশ শ্রেণীতে এইচএসসি।
তবে মজার বিষয় হলো, যে কারণে এই পরীক্ষাগুলোর অবতারণা, তা কিন্তু পরিপালন হয় না। যেমন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির ক্ষেত্রে এইচএসসি পরীক্ষায় প্রধান নিয়ামক হওয়ার কথা। সারা বিশ্বে সেটিই নিয়ম। তবে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সেটি মানতে নারাজ। এই চারটি পাবলিক পরীক্ষা নিয়ে কারও কোনো মাথাব্যথা আছে বলে মনে হয় না।
মনে হয়, আমাদের পরীক্ষাপদ্ধতির উদ্দেশ্য হচ্ছে সৈয়দ মুজতবা আলীর ভাষায় ‘বইপূর্ণ গর্দভ’ তৈরি করা।
আমরা কয়েক দিন আগে দেশের ৫১ জন শিক্ষার্থীকে নিয়ে একটি বিজ্ঞান ক্যাম্পের আয়োজন করেছিলাম। ঢাকার আশুলিয়ায় ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির স্থায়ী ক্যাম্পাসে সবাইকে কয়েকটি দলে ভাগ করে প্রজেক্ট করতে দেওয়া হয়। এদের একটি দল, পরীক্ষা আর পর্যবেক্ষণ করে বের করেছে লজ্জাবতী গাছের পাতা একবার লজ্জা পাওয়ার কত সময় পর আবার পাতা মেলে? একদল বের করেছে, কেন গাছের গোড়ার কাঁঠালের চেয়ে গাছের ডালের কাঁঠাল সুস্বাদু। এ রকম নানা কিছু।
এবং ক্যাম্পের শেষ দিনে তারা তাদের প্রজেক্টের ফলাফল একটি পোস্টারের মাধ্যমে উপস্থাপন করে, যেটি কিনা তাদের সতীর্থরাই মূল্যায়ন করেছে (পিয়ার রিভিউ)! এই ধরনের একটি আনন্দদায়ক আবহ শিক্ষার্থীদের শেখার আগ্রহ অনেকখানি বাড়িয়ে দেয়, যা শত পরীক্ষা নিয়ে অর্জিত হয় না।
ভারতের রাজস্থানের সপ্তম শ্রেণীতে পড়ুয়া তিনজন শিক্ষার্থী তাদের প্রজেক্ট ওয়ার্কের মাধ্যমে পুরো গ্রামকে পাল্টে দিয়েছিল কয়েক বছর আগে। তাদের
প্রজেক্ট ছিল, কেন এলাকায় বেশি ডায়রিয়া হয়। তারা তাদের যৌথ কাজের মাধ্যমে এর কারণ বের করে, পঞ্চায়েত সভায় নলকূপের আরজি করে এবং বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে খাওয়ার আগে সাবান দিয়ে হাত ধোয়া চর্চার সংস্কৃতি গড়ে তোলার চেষ্টা করে। তাদের কারণে মাত্র বছর খানেকের মধ্যে ওই গ্রামের চেহারাই পাল্টে যায়।
আমাদের শিক্ষার্থীদের এমন সুযোগ দিলে তারাও তাদের আশপাশের নানা সমস্যার সমাধান করতে পারবে। এ জন্য আমাদের শিক্ষকদের যেমন খোলা মনের হতে হবে, তেমনি শিক্ষা ব্যবস্থাপনার সঙ্গে যুক্ত পণ্ডিতদেরও বাক্সের বাইরে আসতে হবে। কবিগুরুর গল্পের তোতা পাখির পরিণতি যেন আমাদের শিক্ষার্থীদের না হয়, সে জন্য সবার সতর্ক হওয়া দরকার।
মুনির হাসান: সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াড কমিটি। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।