আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

শায়েস্তা খাঁর আমল বনাম নতুন ইতিহাসে ‘অর্থলিপ্সু ও শোষক’ শায়েস্তা খাঁ

বাস্তবতা ফেরী করে বেড়াচ্ছে আমার সহজ শর্তের সময়গুলোকে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড আসন্ন ২০১২ শিক্ষাবর্ষ থেকে অষ্টম শ্রেণীতে পড়ানোর জন্য “বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয়” নামে একটি পাঠ্যপুস্তক প্রস্তুত করেছে। সামাজিক বিজ্ঞানের পরিবর্তে বইটি পড়ানো হবে। সেখানে “প্রজাদের শোষণ-বঞ্চনা” শিরোনামে লেখা রয়েছে। যাতে লেখা হয়েছে- তখন সাধারণ মানুষের দারিদ্র্য এমন পর্যায়ে পৌছেছিল যে তাদের ক্রয়ক্ষমতা বলে আসলে কিছুই ছিল না। তাই চালসহ নিত্য ব্যবহার্য জিনিস বা গরু- ছাগলের দাম অবিশ্বাস্য রকম কম হলেও তা প্রজাদের কোনো উপকারে আসে নি।

শায়েস্তা খানের নিজের অর্থলিপ্সা এত প্রচণ্ড ছিল যে এক ইংরেজ ব্যবসায়ী ১৬৭৬ সালে লিখেছেন, শায়েস্তা খানের কর্মচারীরা সাধারণ মানুষকে এমন শোষণ করত যে, এমনকি পশুখাদ্যেও (মূলত ঘাস) ব্যবসাও তাদের একচেটিয়া ছিল। আর এক ব্যবসায়ী জানাচ্ছেন, ১৩ বছর বাংলার সুবেদার থেকে শায়েস্তা খান যে পরিমাণ সম্পদের মালিক হয়েছিলেন তা তখনকার বিশ্বে বিরল। তিনি ছিলেন অন্তত ৩৮ কোটি টাকার মালিক এবং তার দৈনিক আয় ছিল দুই লক্ষ টাকা”। এছাড়া বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনকে চিহ্নিত করা হয়েছে ‘স্বদেশচেতনা’র জাগরণকারী আন্দোলন হিসেবে। শায়েস্তা খাঁর আমল নিয়ে কিছুটা পড়া ছিল এফ. বি. ব্রাডলী বার্ট রচিত ‘রোমান্স অব অ্যান ইস্টার্ন ক্যাপিটাল’ (প্রাচ্যের রহস্যনগরী, অনুবাদ- রহীম উদ্দীন সিদ্দিকী) নামের বইটির কল্যানে।

৮ম শ্রেণীর বইয়ে লেখা ইতিহাস পড়ে অবাক হলাম। আমরা যে ইতিহাস জেনে এসেছি এতোদিন এবং ব্রাডলীর বইয়ে যেভাবে শায়েস্তা খাঁ সম্পর্কে জেনেছি তার সাথে কোনভাবেই মেলাতে পারলাম না। ভারতীয় সিভিল সার্ভিসের সদস্য ও অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের খ্যাতনামা পণ্ডিত এফ. বি. ব্রাডলী বার্ট (F B Bradley Birt) রচিত 'প্রাচ্যের রহস্যনগরী' (Romance of an Eastern Capital) [বাংলায় অনুবাদ করেছেন রহীম উদ্দীন সিদ্দিকী] বইয়ের ষষ্ঠ অধ্যায়টি শায়েস্তা খাঁ’কে নিয়ে লেখা রয়েছে। অধ্যায়ের শুরুতেই ব্রাডলী বার্ট লেখেছেন- ঢাকার সাথে শায়েস্তা খাঁর নাম যে-রূপ ঘনিষ্টভাবে জড়িত হয়ে আছে, অন্য কোন শাসনকর্তা, এমন কি, এই নগরীর প্রতিষ্ঠাতা ইসলাম খাঁর নামও সেরূপ নিবিড়ভাবে জড়িত হয়ে আসে নাই। যে-সময়ে মোগল সাম্রাজ্যের পূর্ব সীমান্তের প্রদেশটি শাহজাদাদের মল্লভূমি হয়ে দাঁড়িয়েছিল, পূর্ব বাংলা যে-সময়ে তাঁদের উচ্চাভিলাষ বাস্তবায়নের প্রথম ধাপ পরিগণিত হয়েছিল এবং যে সময়ে চারদিকে অশান্তি, বিশৃঙ্খলা ও নৈরাজ্যিক অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল, সেই সময়েই পূর্বাঞ্চলের এই শ্রেষ্ঠ সুবেদার দীর্ঘকাল ধরে নিরুপদ্রুবভাবে এই অঞ্চল শাসন করে গেছেন।

(প্রাচ্যের রহস্যনগরী, পৃ. ৮১) অন্য এক জায়গায় ব্রাডলী লেখেছেন, মগ ও পর্তুগীজদের পৌনঃপুনিক হানা ও অমানুষিক অত্যাচারে পূর্ব বাংলার দুর্ভোগের অন্ত ছিল না। ইহাদের অরাজকতার অবসান হওয়ায় প্রদেশে শান্তি ফিরে আসে। এই শান্তি বহু ক্লিষ্ট ও নির্জিত পূর্ব বাংলা এবং এর অধিবাসীদের কাছে এক চরম আশীর্বাদরূপে কাজ করেছিল। এই সময় ঢাকা সমৃদ্ধির উচ্চতম শিখরে আরোহন করে। এখান থেকে যে-সব পণ্য বিদেশে রফতানি হত, সেগুলোর সংখ্যা ও রকমারীই এর সমৃদ্ধির সাক্ষ্য বহন করে।

পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি দেশেই ঢাকা তার উৎপাদিত পণ্য রফতানি করত। (প্রাচ্যের রহস্যনগরী, পৃ. ৮৮) ইংরেজদের অনধিকার প্রবেশকারী মনে করতেন শায়েস্তা খাঁ। ব্রাডলী লেখেছেন- ইংরেজদের লিখিত ইতিহাসে ‘স্বেচ্ছাসারী’ ও ‘বুদ্ধিভ্রষ্ট বৃদ্ধ নওয়াব’ চিত্রিত হলেও প্রাজ্ঞতা, বিচক্ষণা ও ন্যায়ানুগতার জন্যে বাংলার শাসন কর্তাদের মধ্যে তিনি বিশিষ্ট হয়ে আছেন। স্বাভাবিকভাবেই তিনি ইংরেজদের অনধিকার প্রবেশকারীর দল বলে মনে করতেন। (প্রাচ্যের রহস্যনগরী, পৃ. ১০৫) শায়েস্তা খাঁর বিদায় পর্ব ছিল গৌরবব্যঞ্জক।

বিপুল জনতা মিছিলের মাধ্যমে তাকে বিদায় জানিয়েছিল। একটি শতাব্দীর প্রায় এক-চতুথাংশকাল শাসন করে তিনি গৌরবের সাথে বিদায় নিয়েছিলেন। অথচ শিক্ষার্থীদের জন্য লেখা নতুন ইতিহাসে শায়েস্তা খানকে দেখানো হয়েছে অর্থলিপ্সু ও শোষক সুবেদার হিসেবে, যেমন করে ইংরেজদের লিখিত ইতিহাসে তিনি ‘স্বেচ্ছাসারী’ ও ‘বুদ্ধিভ্রষ্ট বৃদ্ধ নওয়াব’ হিসেবে চিত্রিত হয়েছেন। নতুন ইতিহাস অনুযায়ী, দ্রব্যমূল্যের দাম কম হলেও মানুষ তার সুফল পায়নি, মানুষকে অত্যাচার করা হয়েছে। অথচ ব্রাডলী বার্টের লেখা ইতিহাস অনুযায়ী শায়েস্তা খাঁর শাসনামলে বাংলার মানুষ শান্তিতে ছিল।

প্রশ্ন হলো নতুন ইতিহাসের বইয়ে কেন শায়েস্তা খাঁকে নেতিবাচক চরিত্র হিসেবে উপস্থাপন করা হচ্ছে? কেনইবা ইংরেজ শাসনের নেতিবাচক দিক নিয়ে কথাবার্তা নেই? ‘শায়েস্তা খানের আমল’ বলে কিছু ছিল না, এমনটা প্রমাণ করতে পারলে কী কী সুবিধা পাওয়া যেতে পারে? এই প্রশ্নের উত্তরগুলো কি দিবেন নব্য ইতিহাস রচয়িতারা? প্রসঙ্গত মনে পড়ছে, ২০০৮ সালের দিকে একজন অর্থ উপদেষ্টা দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি ঠেকাতে না পেরে বলেছিলেন, ‘এটি শায়েস্তা খাঁর আমল নয়’। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.