পঁচা মানুষ হিটলার। এ নাম কেবল নাম নয়, নামের অধিক কিছু। এ নাম কেবল জার্মান নাৎসি নেতা অ্যাডলফ হিটলার-এর নাম নয়, পৃথিবীর প্রায় সকল ভাষায় বিশেষ অর্থে স্থান করে নেয়া এক ভয়-দেখানো দুঃস্বপ্নের নাম। হিটলার অর্থ ডিক্টেটর, একনায়ক। হিটলার-এর সমার্থক স্বৈরশাসক, বলদর্পী।
বিশ্ব-ইতিহাসে এ নাম প্রতীক হয়ে আছে ক্ষমতার দম্ভ, ক্রূরতা, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, নিধনযজ্ঞ সহ সকল অপ ও অশুভর।
গত শতকের তিরিশ দশকে ক্ষমতার শীর্ষে হিটলারের যাত্রা শুরু নির্বাচনী ষড়যন্ত্র-কারচুপির মাধ্যমে, তারপর চূড়ান্তসীমায় পৌঁছে দেখা দেন এক ক্ষ্যাপা নাৎসি ফুয়েরার (নেতা) হিসেবে। ১৯৩৩ সালের জানুয়ারিতে চ্যান্সেলর (সরকার-প্রধান, প্রধানমন্ত্রী) হওয়ার পর নিজের গণতান্ত্রিক অবস্থানকে ক্রমে পরিণত করেন একনায়কীয় শক্তিতে। সাধারণ নির্বাচন আহ্বান করেন, তারপর রাইকস্টাগ (পার্লামেন্ট)-এ অগ্নিকাণ্ডের সুযোগ নিয়ে রাইকস্টাগকে দিয়ে পাস করান এনাব্লিং অ্যাক্ট (জনসাধারণ ও রাইক-এর সঙ্কট মোচন আইন)। এই ক্ষমতার চরম অপব্যবহার করে নিজের ইচ্ছামতো আইন প্রণয়ন করতে থাকেন হিটলার, গঠন করেন গেসটাপো (গোপন রাষ্ট্রীয় পুলিশ) বাহিনী, ট্রেড ইউনিয়ন ও সকল বিরোধী দল নিষিদ্ধ করেন, শেষে নাইট অব দ্য লং নাইভস (অপারেশন হামিংবার্ড)-এর মাধ্যমে নিজের নাৎসি পার্টির ভিন্নমতাবলম্বীদেরও খতম করেন নিষ্ঠুরতার সঙ্গে।
প্রেসিডেন্ট পল ফন হিনডেনবুর্গ মারা গেলে নিজেকে ফুয়েরার ঘোষণা করেন হিটলার। তাঁর চরম একনায়ক হওয়ার পথে ছিল আটটি পদক্ষেপ। সেই ‘নষ্ট অষ্ট’ হচ্ছে-
রাইকস্টাগে অগ্নিকাণ্ড, ২৭শে ফেব্রুয়ারি ১৯৩৩: রাইকস্টাগ ভস্মীভূত হয়। দেশলাই ও আগুন ধরানোর সরঞ্জাম সহ হাতেনাতে ধরা পড়ে ভান ডের লুবে নামের এক ডাচ কম্যুনিস্ট। এ ঘটনাকে অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করে বহু কম্যুনিস্ট প্রতিপক্ষকে গ্রেপ্তার করেন হিটলার, পরের মাসে সাধারণ নির্বাচনে ঘটনাটিকে তিনি করে তোলেন অন্যতম প্রধান ইস্যু।
অগ্নিকাণ্ডের ব্যাপারে তখন অনেকে বলেছেন, এ কাজ নাৎসিরা করে দোষ চাপিয়েছে কম্যুনিস্টদের ঘাড়ে। একালের ঐতিহাসিকরা অবশ্য মনে করেন, ভান ডের লুবে-ই ধরিয়েছিল আগুন, হিটলার এ থেকে ফায়দা লুটেছে মাত্র।
সাধারণ নির্বাচন, ৫ই মার্চ ১৯৩৩: সাধারণ নির্বাচনের আয়োজন করে হিটলার জার্মান জাতির কাছে আবেদন জানিয়েছিলেন, ‘আমাকে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা দিন। ’ কিন্তু নাৎসি পার্টি ভোট পায় মাত্র ৪৪%, ফলে রাইকস্টাগে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেতে ব্যর্থ হন হিটলার। তখন ৮১ জন কম্যুনিস্ট ডেপুটিকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে ঢোকান তিনি।
আর এভাবে অর্জন করেন সংখ্যাগরিষ্ঠতা। রাইকস্টাগ-এর স্পিকার হন হেরমান ভিলহেলম গোয়েরিং।
এনাব্লিং অ্যাক্ট, ২৩শে মার্চ ১৯৩৩: রাইকস্টাগ নিজস্ব আইন প্রণয়নের ক্ষমতা তুলে দেয় হিটলারের হাতে। বিরোধী ডেপুটিদের ভেতরে যেতে বাধা দেয় নাৎসি ঝটিকা বাহিনী। যাঁরা বিরুদ্ধে বলার সাহস করেন তাঁদের রীতিমতো মারধর করে তারা।
এনাব্লিং অ্যাক্ট আইনসম্মত ভাবেই জার্মানির ডিক্টেটর করে তোলে হিটলারকে।
স্থানীয় সরকার, ২৬শে এপ্রিল ১৯৩৩: স্থানীয় সরকার ও পুলিশের কর্তৃত্ব গ্রহণ করে নাৎসিরা। এর পর শুরু করে বিরোধী মতাবলম্বী শিক্ষক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকদের অপসারণ। গেসটাপো বাহিনী গঠন করে হিটলার নানাভাবে উৎসাহ দিতে থাকেন জার্মানদের- যাতে বিরোধী ও অসন্তুষ্টদের চিনিয়ে দেন তাঁরা। লাখ-লাখ ইহুদি, কম্যুনিস্ট, প্রোটেস্টান্ট, যিহোভা’স উইটনেস, জিপসি, সমকামী, মদ্যপ ও যৌনকর্মীদের গ্রেপ্তার করে পাঠানো হয় নির্যাতন শিবিরে।
নাৎসি-বিরোধী দেয়াল লিখন, নিষিদ্ধ বই ঘরে রাখা, এমনকি ‘ব্যবসা ভাল চলছে না’ বলাটাও ছিল গুরুতর অপরাধ। এসব কারণেও আটক করে নির্যাতন শিবিরে পাঠানো হতো নির্বিশেষে।
ট্রেড ইউনিয়ন নিষিদ্ধ, ২রা মে ১৯৩৩: ট্রেড ইউনিয়নগুলোর সব অফিস বন্ধ ও তহবিল বাজেয়াপ্ত করে নেতাদের ঢোকানো হয় জেলে। জার্মান লেবার ফ্রন্ট-কে তাদের স্থলাভিষিক্ত করেন হিটলার। শ্রমিকদের মজুরি হ্রাস ও ধর্মঘটের অধিকার হরণ করে তারা।
রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ, ১৪ই জুলাই ১৯৩৩: রাজনৈতিক দল গঠন বিরোধী আইন ঘোষণা করে- নাৎসি পার্টি-ই জার্মানির একমাত্র রাজনৈতিক দল। অন্য সকল রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে ওইসব দলের নেতাদের ঢোকানো হয় জেলে।
নাইট অব দ্য লং নাইভস্, ৩০শে জুন ১৯৩৪: স্টারমাবটেইলিং (সংক্ষেপে এসএ) বা ঝটিকা বাহিনী ছিল গুণ্ডাপাণ্ডাদের দল। তাদের ব্যবহার করে ক্ষমতায় ওঠেন হিটলার। তারা হামলা চালাতো বিরোধীদের ওপর, আর হামলা ঠেকাতো হিটলারের সভায়।
১৯৩৪ সালে নাগাদ তাদের সংখ্যা দাঁড়িয়েছিল ১০ লাখেরও বেশি।
হিটলার কেন চড়াও হয়েছিলেন এসএ-র ওপর তা এখনও এক বিস্ময় হয়ে আছে ইতিহাসবিদদের কাছে। তবে ১৯৩৪ সালে তিনি যখন ক্ষমতায় তখন তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী কেউ নেই, বিরোধীরাও সমূলে নির্মূল। এসএ-র কোনও উপযোগিতা নেই তখন, বরং নানা রকম বিরক্তি-বিড়ম্বনার কারণ। এছাড়া তাদের নেতা আর্নস্ট রোম চাইছিলেন সেনাবাহিনীর কর্তৃত্ব নিয়ে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব ঘটাতে।
১৯৩৪ সালের ৩০শে জুন রাতে এসএ-র চার শতাধিক নেতা-কর্মীকে হত্যার নির্দেশ দেন হিটলার। তাঁর ওই নির্দেশ পালন করে স্কুৎসস্তাফেল (সংক্ষেপে এসএস) বা প্রতিরক্ষা বাহিনী। এ হত্যা-অভিযানের সাঙ্কেতিক নাম ছিল ‘হামিংবার্ড’।
ফুয়েরার, ১৯শে আগস্ট ১৯৩৪: প্রেসিডেন্ট পল ফন হিনডেনবুর্গ মারা গেলে হিটলার গ্রহণ করেন প্রেসিডেন্ট ও সৈন্যবাহিনীর সর্বাধিনায়কের দায়িত্ব। হিটলারের জন্য প্রয়োজনে মৃত্যুবরণের শপথ নিতে হতো সৈন্যদের।
এরপর হিটলার নিজেকে ঘোষণা করেন ‘ফুয়েরার’ (মহান নেতা)।
হিটলার বুঝেছিলেন, সরকারের বাইরে থেকে বিপ্লব ঘটিয়ে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়া সম্ভব নয় তাঁর পক্ষে- যেতে হবে বৈধ পথেই, আইনসম্মতভাবে, গণতান্ত্রিক বিধিবিধান যেটুকু যা আছে সেগুলোকেই কাজে লাগিয়ে। তবে ওই উচ্চাভিলাষ পূরণ করে চূড়ান্ত একনায়ক হওয়া তাঁর পক্ষে যে সম্ভব হয়েছিল শেষ পর্যন্ত সেজন্য বেশি দায়ী জার্মানির নাৎসিবাদ-বিরোধীদের ঐক্যবদ্ধ হতে না পারা। তাদের অনৈক্যই শক্তি যুগিয়ে হিটলারকে করেছে ডিক্টেটর। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।