ভালবাসি এনবিআরের মতো দুদকও কোনো প্রশ্ন করবে না, দাবি ব্যবসায়ীদের
সরকারি হিসেবে দেশে অপ্রদর্শিত আয় বা কালো টাকার পরিমাণ ৪ লাখ ৪৯ হাজার ৮৩৫ কোটি টাকা, যা মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ৫০ শতাংশ। আর ব্যবসায়ীদের হিসাবে কালো টাকার পরিমাণ ২ লাখ ৯৯ হাজার ৮৯০ কোটি টাকা, যা জিডিপির এক-তৃতীয়াংশ। তবে এ টাকা পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের সুযোগ দেয়াকে নৈতিকতা বিবর্জিত মনে করেন অর্থনীতিবিদরা। আর ব্যবসায়ীরা নিশ্চয়তা চান শুধু এনবিআর নয়, সরকারের কোনো প্রতিষ্ঠান এ বিষয়ে প্রশ্ন তুলবে না। তাই বিশেষজ্ঞরা ধারণা করছেন, শতভাগ নিশ্চয়তা না পেলে পুঁজিবাজারে কালো টাকা বিনিয়োগ হবে না।
কালো টাকার পরিমাণ নিয়ে বিশ্বব্যাংক ২০০২ সালে বিশ্বের ১১০টি দেশের আনুষ্ঠানিক অর্থের পরিমাণ নিয়ে একটি প্রতিবেদন তৈরি করে। তাতে দেখা যায়, বাংলাদেশে কালো টাকার হার মোট জিডিপির ৩৫ দশমিক ৬০ শতাংশ।
অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত মনে করেন, দেশে কালোটাকা জিডিপির ৫০ শতাংশ। তবে ফেডারেশন অফ বাংলাদেশ চেম্বার্স অফ কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এফবিসিসিআই) এবং অন্যান্য ব্যবসায়ী সংগঠন সূত্রে জানা গেছে, দেশে কালো টাকার পরিমাণ জিডিপির এক-তৃতীয়াংশ।
অপরদিকে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আবুল বারাকাতের গবেষণা অনুযায়ী বছরে ৭০ হাজার কোটি কালোটাকা তৈরি হয়।
এদিকে কালো টাকার সংজ্ঞায় ব্যবসায়ীরা সরাসরি কালোটাকা না বলে ইনফরমাল ইকোনমি (অনানুষ্ঠানিক অর্থনীতি) বা আন্ডারগ্রাউন্ড ইকোনমি আর বাংলায় অপ্রদর্শিত অর্থ বলে থাকেন।
বিশিষ্টজনদের মতে, সরকার পুঁজিবাজারে কালো টাকা বিনিয়োগের সুযোগ দিলেও যাদের হাতে কালো টাকা আছে তারা বিনিয়োগে আকৃষ্ট হবেন না। যদিও এনবিআর থেকে বলা হয়েছে, যারা অপ্রদর্শিত অর্থ পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করবেন তাদের কোনো ধরনের প্রশ্ন করা হবে না।
পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্টদের মতে, যাদের হাতে কর বহির্ভূত অর্থ আছে তারা চান নিজেদের নিরাপত্তা। যা এনবিআরের প্রজ্ঞাপন দ্বারা নিশ্চিত হয়নি।
তাদের মতে এনবিআর কোনো প্রশ্ন না করলেও দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) যে কোনো সময় এ টাকা নিয়ে প্রশ্ন করতে পারে। আর দুদক প্রশ্ন করা মানেই মামলা জেল-জরিমানা। তাই নিজের টাকা বিনিয়োগ করে কেউ এ ঝামেলায় পড়তে চাইবেন না।
সংশ্লিষ্টদের মতে, অপ্রদর্শিত অর্থ পুঁজিবাজারে বিনিয়োগে আকৃষ্ট করতে হলে দুদক থেকেও একটি প্রজ্ঞাপন জারি করতে হবে। আর তাতে বলতে হবে এ টাকা বিনিয়োগে দুদক কোনো প্রশ্ন করবে না।
কারণ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ট্রুথ কমিশন গঠন করে অবৈধ আয় বৈধ করার সুযোগ দেয়া হয়। পরে সে আমলেই যারা অবৈধ আয় বৈধ করেছিল দুদক তাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে।
অর্থনীতিবিদরা জানান, সাধারণত সব ধরনের অনিবন্ধিত অর্থনৈতিক কর্মকা-ই অনানুষ্ঠানিক অর্থনীতি। সাধারণত যে সব কর্মকা- করের আওতায় থাকলেও তা মানা হয় না তাকেও কালো অর্থনীতি বলে। এমনি বৈধ আয় যখন করের আওতার বাইরে রাখা হয় তখন তাও অবৈধ বা অনানুষ্ঠানিক অর্থনীতি।
ব্যবসায়ীরা এটাকে বলেন, আন ডিক্লিয়ার্ড বা অঘোষিত আয়। এ ধরনের আয়কে প্রশ্রয় দিলে দিন দিন তা বেড়ে যাবে। যারা কর দেন তারা নিরুৎসাহিত হবে, এতে সরকার রাজস্ব হারাবে।
দেশের ব্যবসায়ী-শিল্পপতিদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের তথ্য অনুযায়ী, দেশে অপ্রদর্শিত অর্থের পরিমাণ জিডিপির প্রায় এক তৃতীয়াংশের বেশি। তবে অবৈধ পথে আয়কৃত- যেমন মাদক ব্যবসা, অস্ত্র ব্যবসা, পাচার, ডাকাতিসহ অবৈধ পথে উপার্জিত অর্থ এ টাকার মধ্যে নেই।
আর এ অবৈধ টাকার পরিমাণ তাদের হিসেবে নেই।
সূত্র জানায়, ২০১১-১২ অর্থবছরে চলতি মূল্যে জিডিপির পরিমাণ হচ্ছে প্রায় ৮ লাখ ৯৯ হাজার ৬৭০ কোটি টাকা। ২০১১-১২ অর্থবছরে সরকারি বিনিয়োগের পরিমাণ প্রাক্কলন করা হয়েছে ৪৬ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ দেশে যে পরিমাণ কালোটাকা রয়েছে আনুপাতিক হারে তা মোট সরকারি বিনিয়োগের প্রায় ৯ দশমিক ৮ গুণ আর ৬ দশমিক ৫ গুণের ওপরে এবং মোট জিডিপির ২ ভাগের এক ভাগ আর তিন ভাগের ১ ভাগের সমান। কিন্তু দেশে প্রকৃত কালোটাকার পরিমাণ কত, তা নিয়ে ভিন্নতা থাকলেও এ সত্যকে কেউ অস্বীকার করছেন না।
আবার যার কাছে কালোটাকা আছে তিনিও স্বীকার করেন না। টাকার পরিমাণ যাই হোক এ বিশাল অপ্রদর্শিত অর্থ করের আওতার বাইরে রয়ে গেছে। তবে কালোটাকার পরিমাণ নিয়ে মত ভিন্নতা থাকলেও এ টাকা কোনো না কোনোভাবে দেশীয় অর্থনীতিতে অবদান রাখছে।
সরকারি হিসেবে দেশে অপ্রদর্শিত আয় বা কালোটাকার পরিমাণ ৪ লাখ ৪৯ হাজার ৮৩৫ কোটি টাকা। যা মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ৫০ শতাংশ।
আর ব্যবসায়ীদের হিসাবে এর পরিমাণ ২ লাখ ৯৯ হাজার ৮৯০ কোটি টাকা। ধারণা করা হয়, এ বিপুল পরিমাণ অর্থের মধ্যে পুঁজিবাজারের অর্থও রয়েছে। যার পরিমাণ আনুমানিক ১৫ থেকে ২০ হাজার কোটি টাকা, যা বেশকিছু ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের কাছে রয়েছে।
বর্ষীয়ান অর্থনীতিবিদ এবং সাবেক অর্থ উপদেষ্টা মির্জ্জা আজিজ এ ব্যাপারে বলেন, পুঁজিবাজারে কালোটাকা (অপ্রদর্শিত অর্থ) বিনিয়োগ করাকে কোনোভাবেই সমর্থন করা যায় না। এটা নৈতিকতা বিবর্জিত।
তার মতে, এভাবে সুযোগ দিলে ব্যবসায়ীরা কর দিতে নিরুৎসাহিত হবেন, আর সরকারের আয় কমে যাবে।
অর্থনীতিবিদ ও সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. আকবর আলি খান বলেন, কাস্টমস ও ভ্যাট হচ্ছে অবৈধ সম্পদ আয় করার উৎস। তাই আয়কর আইন সংশোধন করাসহ কাস্টমস ও ভ্যাট আইন সংশোধন করতে হবে। ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিরা কর ফাঁকি দেয়ার সুযোগ খুঁজে বেড়ান। তিনি বলেন, আয়কর আইনের ভেতরেই আয়কর ফাঁকি দেয়ার ব্যবস্থা রয়েছে।
ওই আইনের মাধ্যমে কর্মকর্তারা দুর্নীতি করতে সুযোগ পান। আর এডিপির আকার যত বড় হয় দুর্নীতি তত বেশি হয়।
এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান বদিউর রহমান বলেন, অনেক ব্যবসায়ী বৈধ পথে টাকা আয় করে সে টাকার কর দেননি। এ টাকাকেই অপ্রদর্শিত আয় বলা হয়। আর এ অর্থ পুঁজিবাজারে বিনিয়োগে উৎসাহিত করতে হলে তাদের নিশ্চয়তা দিতে হবে যে, সরকারের কোনো প্রতিষ্ঠানই এ টাকার বিষয়ে প্রশ্ন করবে না।
সরকার এ নিশ্চয়তা দিলেই তারা বিনিয়োগ করবেন নয়তো নন। কারণ অতীত ইতিহাস ভালো না। আর নিজের টাকা বিনিয়োগ করে কেউই বিপদ ডেকে আনতে চাইবেন না। আর এ টাকা অলস পড়ে আছে তাও না, কোনো না কোনোভাবে এ টাকা দেশের অর্থনীতির মধ্যেই রয়েছে। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।