আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বিশেষ সাক্ষাৎকারে ব্যারিস্টার রাজ্জাক: ৫ মহাদেশ থেকে ৩ জন করে ১৫ বিচারকের সমন্বয়ে ট্রাইব্যুনাল গঠনের প্রস্তাব

অশুভ শক্তির মুখোশ উন্মোচনেই তৃপ্তি একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে নয়া প্রস্তাব দিয়েছেন মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে আটক জামায়াত নেতাদের ডিফেন্স টিমের প্রধান ও সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাক। পাঁচটি মহাদেশ থেকে তিন জন করে মোট ১৫ বিচারককে নিয়ে ট্রাইব্যুনাল গঠনের প্রস্তাব দিয়েছেন তিনি। তার ভাষায়, সরকার যদি সত্যি ন্যায়বিচার করতে চায় তাহলে পৃথিবীর পাঁচটি মহাদেশ থেকে তিন জন করে ১৫ বিচারক নিয়োগ করা হোক। ১৯৭৩ সালের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনকে আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করা হোক। সরকার ও অভিযুক্ত পক্ষকে তাদের পছন্দমতো বিদেশী আইনজীবী নিয়োগ দেয়ার সুযোগ দেয়া হোক।

বিচার ঢাকা অথবা দ্য হেগে হতে পারে। আন্তর্জাতিক সমপ্রদায় এ ব্যাপারে অর্থায়নেও রাজি হতে পারে। প্রায় ১৭ মাস ধরে আটককৃত ৭ জন শীর্ষস্থানীয় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ- যাদের অনেকেরই বয়স ৭০-এর ঊর্ধ্বে, তাদের জামিনেরও ব্যবস্থা করা হোক। নয়াপল্টনের চেম্বারে মানবজমিনকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি এ প্রস্তাব দেন। এই প্রথম যুদ্ধাপরাধের বিচার নিয়ে খোলামেলা বিস্তারিত কথা বললেন তিনি।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ট্রাইব্যুনাল পর্যবেক্ষণের অভিজ্ঞতার কথা উল্লেখ করে ব্যারিস্টার রাজ্জাক বলেন, রুয়ান্ডাতে অবস্থিত আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের বিচারকের সংখ্যা সর্বমোট ২৫, প্রাক্তন যুগোস্লাভিয়ার জন্য গঠিত আন্তর্জাতিক আদালতের বিচারকের সংখ্যাও ২৫, কম্বোডিয়ার আদালতের বিচারক সংখ্যা (৬ জন রিজার্ভ বিচারক সহ) ২৩, আফ্রিকার সিয়েরা লিয়নে অবস্থিত আদালতের বিচারক সংখ্যা ১২। তিনি বলেন, এ রকম একটা বিচার হলে তা দেশে ও আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য হবে। এ ইস্যুতে জাতি যে বিভক্ত হয়ে আছে তা দূর করে হয়তো জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করা সম্ভব হবে। এছাড়া, অভিযুক্ত ব্যক্তিরা কোন অবস্থাতেই ন্যায় বিচার পাবেন না। জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে যুদ্ধাপরাধের বিচার হলে ইতিহাসের একটি অধ্যায় অতিক্রম করে নতুন অধ্যায়ে প্রবেশ করা যেতো বলেও মনে করেন তিনি।

তিনি বলেন, যুদ্ধাপরাধ একটি জঘন্য ও ঘৃণ্য অপরাধ। বাংলাদেশে কোন যুদ্ধাপরাধী থেকে থাকলে দল, মত, সমপ্রদায় নির্বিশেষে তার বিচার অবশ্যই হওয়া উচিত। তবে রাজনৈতিক কারণে কাউকে এ অপরাধের বিচারের সম্মুখীন করা হলে তা ঘোরতর অন্যায় হবে। সমস্যার সমাধান না হয়ে নতুন সমস্যা সৃষ্টি হবে। যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে প্রধান দু’টি বিরোধী দলের সাত জন শীর্ষ রাজনৈতিক নেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

দেশ-বিদেশে এ প্রশ্ন উঠেছে- সরকার যাদের গ্রেপ্তার করেছে তারা সবাই বিরোধী দলের উচ্চ পর্যায়ের রাজনীতিবিদ। বিশেষ করে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল কয়েক দিন আগেও এ প্রশ্ন তুলেছে। আন্তর্জাতিক সমপ্রদায়ের কাছে এটা প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে যে, রাজনৈতিক কারণে এ বিচার প্রক্রিয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। প্রধান দুই বিরোধী রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে এ বিচারকে প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে। ব্যারিস্টার রাজ্জাক বলেন, সামপ্রতিককালে রুয়ান্ডা, সিয়েরা লিয়ন, প্রাক্তন যুগোস্লাভিয়া এবং হেগে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে যুদ্ধাপরাধীর বিচার হয়েছে।

কম্বোডিয়াতে বিচার চলছে। এই সব বিচারেই জাতিসংঘের সম্পৃক্ততা ছিল বা আছে। কিন্তু আমাদের যে বিচার হচ্ছে সেখানে জাতিসংঘের কোন সম্পৃক্ততা নেই। তিনি বলেন, এর আগে যুদ্ধাপরাধের যত বিচার হয়েছে সেখানে সামরিক ব্যক্তিদের বিচার হয়েছে। অথবা যারা ওই সময়ে ক্ষমতায় ছিলেন তাদের বিচার হয়েছে।

বাংলাদেশেই প্রথম এমন ব্যক্তিদের বিচার হচ্ছে যারা সামরিক বাহিনীতে ছিলেন না বা ক্ষমতায়ও ছিলেন না। তিনি বলেন, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর যুদ্ধাপরাধের আন্তর্জাতিক আইনে অনেক পরিবর্তন এসেছে। রোম সংবিধি হয়েছে ১৯৯৮ সালে, এটা কার্যকর হয়েছে ২০০১ সালে। বাংলাদেশ এতে স্বাক্ষর করেছে ২০১০ সালে । এ আইন একটা যৌক্তিক পর্যায়ে পৌঁছেছে।

এর একটি গ্রহণযোগ্য আন্তর্জাতিক মান আছে। দুই ভাবে যুদ্ধাপরাধের বিচার হচ্ছে: কোনটা হচ্ছে আন্তর্জাতিক ও দেশীয় সমপ্রদায় মিলে, আর কোনটা হচ্ছে সম্পূর্ণ আন্তর্জাতিকভাবে। আন্তর্জাতিক সমপ্রদায় এক বাক্যে বলছে বাংলাদেশে প্রণীত ১৯৭৩ সালের আইন আন্তর্জাতিক মানের অনেক অনেক নিচে। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ, ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর ট্রানজিশনাল জাস্টিস, ইন্টারন্যাশনাল বার এসোসিয়েশন, ওপেন সোসাইটি জাস্টিস সবাই একযোগে বলছে, এ আইনে বিচার হলে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড রক্ষা করা হবে না। এদের মধ্যে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এবং হিউম্যান রাইটস ওয়াচ সরাসরি আমাদের প্রধানমন্ত্রীর কাছে চিঠি দিয়ে আইনটি সংশোধন করতে বলেছে।

জাতিসংঘের অফিস অব দ্য হাইকমিশনার ফর হিউম্যান রাইটস ইন জেনেভা ২০০৯ সালের জুন মাসে বাংলাদেশকে চিঠি দিয়ে বলেছে, ১৯৭৩ সালের আইনে বিচার হলে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড রক্ষা হবে না। মার্কিন প্রেসিডেন্টের যুদ্ধাপরাধ বিষয়ক বিশেষ দূত স্টিফেন র‌্যাপও অনুরূপ মতামত দিয়েছেন। সবাই আইন পরিবর্তনের কথা বলেছেন। বাংলাদেশ সরকার আইন পরিবর্তন করেনি। সামান্য যে পরিবর্তন করেছে এটাকে বলা যায় ‘কসমেটিক’।

তাছাড়া, ১৯৭৩ সালে আইনটি করা হয়েছিল বিদেশী নাগরিকদের জন্য। যেহেতু বিদেশী নাগরিকদের জন্য এই আইন করা হয়েছিল সেহেতু তাদের কোন মৌলিক অধিকার সংরক্ষণ করা হয়নি। বাংলাদেশের কোন নাগরিকের মৌলিক অধিকার ক্ষুণ্ন হলে তিনি হাইকোর্টে যেতে পারেন। বাংলাদেশে অবস্থানরত বিদেশী একজন নাগরিকও তার মৌলিক অধিকার বাস্তবায়নের জন্য হাইকোর্টের আশ্রয় নিতে পারেন। কিন্তু যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে যারা কারাগারে আটক আছেন তারা হাইকোর্টে যেতে পারবেন না।

এ নিয়েও বাংলাদেশ সরকার যথেষ্ট সমালোচিত হচ্ছে। ৪০ বছর পর আমরা আমাদের নাগরিকদের বিচার করছি। তাদের কোন মৌলিক অধিকার নেই। সভ্য সমাজে এটা কল্পনাও করা যায় না। তিনি বলেন, বাংলাদেশ সরকার আন্তর্জাতিক আইন মানছে না।

যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে দেশীয় আইনও প্রযোজ্য নয়। সর্বোচ্চ আইন সংবিধান তো নয়ই। আমাদের দেশে প্রচলিত দু’টি প্রধান আইন আছে। একটা ফৌজদারি কার্যবিধি, আরেকটি সাক্ষ্য আইন। এর কোনটাই মানা হচ্ছে না।

বিচারকরা তাদের তৈরী বিধি অনুযায়ীই বিচার করবেন। এ জন্যই আন্তর্জাতিক সমপ্রদায় খুবই শঙ্কিত, চিন্তিত যে বিচারের নামে অবিচার হবে। ব্যারিস্টার রাজ্জাক বলেন, ট্রাইব্যুনালের তিন জন বিচারক আছেন। চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে এ সত্যটা প্রমাণিত হয়েছে তিনি যুদ্ধাপরাধের তদন্তের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। সব দেশে (এমনকি কমিউনিস্ট দেশেও) স্বীকৃত যে, যিনি তদন্তের সঙ্গে জড়িত থাকেন তিনি বিচারক হতে পারবেন না।

তারপরও মাননীয় চেয়ারম্যান বিচারকাজ পরিচালনা করে যাচ্ছেন। এ বিচার দেশেও গ্রহণযোগ্য হবে না, বিদেশেও হবে না। এই ট্রাইব্যুনাল বিভিন্ন কারণে সকলের আস্থা হারিয়েছে। তিনি বলেন, বিশ্বের অন্যান্য ট্রাইব্যুনালে দেখা গেছে অভিযোগপত্র আগে থেকেই তৈরি থাকে। গ্রেপ্তারের পরপরই অভিযোগ গঠন করা হয়।

নুরেমবার্গ থেকে যুগোস্লাভিয়া, সিয়েরা লিয়ন থেকে কম্বোডিয়া বিগত ৬০ বছরের দীর্ঘ সময়ের আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালে এর অসংখ্য নজির আছে। সর্বশেষ নজির হচ্ছে: বসনীয় সার্ব মিলিটারি কমান্ডার রাটকো স্লাডিকের বিচার শুরুর ঘটনা। ২০১১ সালের ২৬শে মে তাকে সার্বিয়ায় গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তারের মাত্র ৭ দিনের মাথায় তাকে ৩রা জুন দ্য হেগের আন্তর্জাতিক আদালতে হাজির করে ওইদিনই তার বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়। গ্রেপ্তারের ১৭ মাস পর বাংলাদেশের ৭ অভিযুক্তদের মাত্র একজনের বিরুদ্ধে গত মাসে অভিযোগ গঠন হয়েছে।

৪০ বছরের পুরাতন অপরাধের তদন্ত দীর্ঘ দেড় বছর অতিবাহিত হয়ে যাওয়ার পরও শেষ হয় না। এসব থেকে এই সত্যই সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয় যে, এ বিচারের আসল উদ্দেশ্য রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করা। তার এই বক্তব্যের সমর্থনে ব্যারিস্টার রাজ্জাক ইন্টারন্যাশনাল হেরাল্ড ট্রিবিউন এবং দ্য ইকোনমিস্ট-এ প্রকাশিত ৮ ও ২৫শে নভেম্বরের দু’টি প্রতিবেদনের কথা উল্লেখ করেন। সূত্র: দৈনিক মানবজমিন  ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.