আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মেহেরজান : বিশেষ এজেন্ডার বিশেষ ছবি



বিশেষ এজেন্ডার বিশেষ ছবি ছবির নাম : মেহেরজান পরিচালনা : রুবাইয়াত হোসেন অভিনয়ে : জয়া বচ্চন, ভিক্টর ব্যানার্জি, শায়না আমিন, ঋতু সাত্তার, আজাদ আবুল কালাম, শতাব্দী ওয়াদুদ, রুবাইয়াত হোসেন, হুমায়ুন ফরীদি, খায়রুল আলম সবুজ প্রমুখ রেটিং : ২.৫/৫ দাউদ হোসাইন রনি সারাদেশে যখন যুদ্ধ চলে, তখন একজন পাকিস্তানি সৈন্যের চোখজোড়া মেহেরজানের কাছে মায়া মায়া লাগে। একটা নিষিদ্ধ টান অনুভব করে মেহেরজান। একদিন এই দলত্যাগী পাকিস্তানী বেলুচ সৈন্য নিশ্চিত সম্ভ্রমহানির হাত থেকে রক্ষা করে তাকে। আহত ওয়াসিম খানের সেবা করে নিজস্ব মানবিক বিচারবোধে। ওয়াসিম পড়ে উভয় সঙ্কটে।

মৃত্যু তাকে তাড়া করে ফেরে। পাকিস্তানি সৈন্যরা তাকে পেলে তুলবে কোর্ট মার্শালে, মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে পড়লেও নিস্তার নেই। প্রেমই মেহেরজান-ওয়াসিমের এই সম্পর্কের প্রত্যাশিত গন্তব্য। হয়ও তাই। যদিও ভালোবাসার মানুষকে নিজের করে রাখতে পারেনি অষ্টাদশী মেহেরজান।

শত্রুপক্ষকে ভালোবাসার অপরাধবোধেও আক্রান্ত হয় মেহেরজান। ৪০ বছর সেই অপরাধবোধ সঙ্গী করেই বাঁচে সে, একা নিঃসঙ্গ। ততদিনে মেহেরজান নামকরা ভাস্কর। খালাতো বোনের মেয়ে সারাহ নিজের অস্তিত্ব অনুসন্ধানে মেহেরজানের কাছে এসে গ্লানিমুক্ত করে তাকে। এক বিদেশি দম্পতি যুদ্ধশিশু সারাহকে দত্তক নিয়েছিলো।

সারাহ নিজের শেকড় জানতে শরনাপন্ন হয় মেহেরজানের। মেহেরজান তখন স্মৃতির ডায়েরিতে ডুব মারেন। ভেসে ওঠে অনেক গল্প। এ ছবির মূল গল্প যদি এটাই হতো অনেক ভালো হতো। মনে হতো, প্রেম ভালোবাসার একটা ভিন্ন স্বাদের ছবি।

পাকিস্তানি সৈন্যের সঙ্গে বাঙালি কিশোরীর প্রেম মেনে নেওয়ার উদারতা অনেক বাংলাদেশীরই আছে। বিশ্ব চলচ্চিত্রের দর্শক হিসেবে এমন ছবি দেখে অনেকেই হয়তো বাহবা দিবেন। ভিয়েতনাম যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে এরকম একটা ছবি দেখলে আমরা অনেকেই মেনে নিতাম, ক্ষেত্রবিশেষে মুগ্ধও হতাম। কিন্তু কোনো দর্শকের মধ্যে যদি বাংলাদেশী সত্ত্বা থাকে, Ñ‘মেহেরজান’ তাকে ভেতরে ভেতরে পোড়াবে, যন্ত্রনা দেবে। তার যথেষ্ট কারণও রয়েছে।

সুকৌশলে প্রেমের আবরণে রাজনৈতিক তথ্য সন্ত্রাস করা হয়েছে এখানে। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ এখানকার মানুষের বড় আবেগের জায়গা। সেখানে কারো কারো ভিন্ন মত থাকতেই পারে। সেটা প্রকাশের স্বাধীনতাও তার আছে, তবে তার একটা ভিত্তি থাকা চাই। ‘যুদ্ধ এবং ভালোবাসা’র এ ছবিতে পরিচালক বিন্দুর মাঝে সিন্ধু ধারণ করতে চেয়েছেন।

গল্পে প্রেম-ভালোবাসা ছাড়াও উঠে এসেছে নারীবাদ, সমকামিতা, সুফিবাদ, যুদ্ধের বিরোধিতা, চীনপন্থি বাম-রাজনীতি, ফ্যান্টাসি, বাঙালি মুসলমানের মন, বীরাঙ্গনার মতো আরো বেশ কিছু উপাদান। আর এ উপাদানগুলো এসেছে মুক্তিযুদ্ধকে ঘিরেই। বলার অপেক্ষা রাখে না, এত এত উপাদান এক নৌকায় তুলে তাল সামলাতে পারেননি পরিচালক। মেহেরজানের বাবা-মা তাকে নিয়ে যুদ্ধের সময় পালিয়ে এসেছে তার নানা খাজা সাহেবের বাড়িতে। তিনি শান্তিকামী মানুষ, কিন্তু শান্তিকমিটির সদস্য হতে ভয় পান।

একজন অবিশ্বাস্য মুসলিম লীগার এই খাজা সাহেব। জিন্নাহর দ্বি-জাতি তত্ত্বে তার ‘ঈমান’ নাই। লাহোর প্রস্তাবেও তার বিশ্বাস ছিল না। সেখানে নাকি বাংলার উল্লেখ ছিল না! ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাব আর ১৯৪৭-এর দ্বিজাতি তত্ত্বে যার বিশ্বাস নেই, তিনি কী করে ৭১ সালে মুসলিম লীগার হন! তিনি রক্তপাত পছন্দ করেন না, এ কারণে এই গ্রামে তিনি কাউকে যুদ্ধ করতে দেন না। যদিও পুরো ছবির কোথাও পাক সেনাদের অত্যাচারের কোনো প্রতিবাদ করতে দেখা যায়নি তাকে।

নিজের মেয়ের কন্যা যখন পাকিস্তানি ক্যাম্প থেকে ধর্ষিতা হয়ে আসে, তখনও তার মধ্যে কোনো বিকার নেই। পাকিস্তানের অখণ্ডতার কামনা তার চোখে মুখে, আবার মুক্তিযুদ্ধে যেতে চায় যারা তাদের সঙ্গেও তার ভালো খাতির। অথচ ছবিতে এই নানাজানকে মহীরূহ হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে। পাড়ার দোকানিরাও তার প্রসংশায় পঞ্চমুখ। আর তাতেই ধ্বসে পড়ে এতদিনে গড়ে ওঠা অনেক ঐতিহাসিক সত্যের পলেস্তরা।

‘আপনি অনুমতি দিলে আমরা অ্যাকশনে যেতে পারি’-একজন যোদ্ধাও যুদ্ধে যাবার জন্য তার অনুমতি ভিক্ষা করছেন! ছবিতে পাকিস্তানি চরিত্র দুটি। বিপরীতে মুক্তিযোদ্ধার চরিত্র ৩টি। পাকিস্তানি চরিত্রের দুজনই সৈনিক। একজন ওয়াসিম খান। মেহেরজানের প্রেমিক।

মসজিদে হামলা চালিয়ে বাঙালিদের মেরে ফেলার আদেশ দেওয়া হয় তাকে। একজন মুসলমান হয়ে অন্য মুসলমানদের মারতে পারবে না বলে সে দলত্যাগী হয়। নারী ও প্রকৃতির প্রতি বেশ সদয়বান এ যুবক। আরেকজন মেজর বাসেত। তাকে কেবলই পাকিস্তান প্রেমিক হিসেবে দেখানো হয়েছে, তার নৃশংসতা দেখানো হয়নি।

বিপরীতে মুক্তিযোদ্ধাদের তিনটি চরিত্রই ভঙ্গুর। একজন ‘যুদ্ধ করতে করতে ক্লান্ত’। নাম তার ‘লম্বু’। মুক্তিযুদ্ধ করতে চায়। খাজা সাহেবের অপ্রকৃস্থ বিয়ে পাগল মেয়ে সালমা তাকে বিয়ে করতে চায়।

খাজা সাহেবের কাছে প্রস্তাব নিয়ে যায় নিজেই। বলে, ‘যুদ্ধে যুদ্ধে আমি কান্ত। এবার বিয়ে করতে চাই। ’ দ্বিতীয়জন মেহেরজানের খালাত ভাই। মেহেরকে পছন্দ করে।

আয়োজন করে যুদ্ধে যাবে বলে বাড়ি ছাড়ে। দুইদিন পরেই বাড়ি ফিরে মাকে বলে, ‘মা আমি মরতে চাই না, বিয়ে করতে চাই। ’ মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ওয়াসিমকে সে মারতে যায় না, মেহেরের প্রেমিক শুধু এ কারণেই তার পিছু নেয় এবং দেশছাড়া করে। তৃতীয়জন মুক্তিযুদ্ধের কমান্ডার। যুদ্ধে যাওয়ার জন্য খাজা সাহেবের অনুমতি চান! এই ৫টি চরিত্রের বিচার বিশ্লেষণ করলে যে কারোই মনে হবে, একটি বিশেষ অ্যাসাইনমেন্ট নিয়ে ছবিটি বানানো হয়েছে।

হতেও পারে। প্রচারযন্ত্র যদি স্বাধীনতা বিরোধীরা চালাতে পারেন, আধুনিক এ সময়ে এসে তারা ছবিতে বিনিয়োগ করবেন না তার কী নিশ্চয়তা? অবাক করা ব্যাপার হচ্ছে, সেন্সরবোর্ড এ ছবিটি নিয়ে কোনো আপত্তিই তুললো না! হয়তো পরিচালক, চিত্রনাট্যকার, ‘হƒদয়ে বাংলাদেশ’ বা প্রযোজকের বিশেষ পরিচয়ই এখানে মূখ্য হয়ে উঠেছে। সমকামিতার বিষয়টা নেহায়েতই অকারণে উঠে এসেছে ছবিতে। সারাহ এদেশে এসে মেহেরজানরূপী জয়া বচ্চনকে ইংরেজিতে বলে, ‘আমার গার্লফ্রেন্ড তার বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে ভেগে গেছে, আমার মনটা ভীষণ খারাপ। ’ কিশোরী মেহেরের দুই বন্ধু অরূপ ও রাহী।

এ দুজন একসঙ্গে থাকে। অরূপ ওয়াসিমকে দুইজনের সম্পর্কের কথা বলে এভাবে, ‘হি ইজ মাই সৌলমেট, প্রাণের সখা। বুঝছো কিছু?’ পুরুষতান্ত্রিকতার মূলে আঘাত করতে চেয়েছেন পরিচালক। ‘নারীবাদী’ হয়েও অজ্ঞাতসারে ধরা দিয়েছেন পুরুষতন্ত্রের জালে। কখনো তা ব্যঙ্গ করেছে মুক্তিযুদ্ধ এমনকি যোদ্ধাদেরও।

কীভাবে? ছাত্র ইউনিয়নের নেত্রী নীলা পাকি ক্যাম্প থেকে ফিরে আসে হিস্টিরিয়াগ্রস্থ হয়ে। চীনপন্থি বাম সমর্থক সুমন তাকে শারিরীকভাবে পেতে চায়। সে তিরস্কার করে বলে, ‘সব পুরুষ এক। পাকিস্তানি মিলিটারির আগেও আমি অনেক পুরুষের নিপীড়নের স্বীকার হয়েছি। তুমিও তো আমার শরীরটাই চাও।

’ সুমন তখন আমতা আমতা করে বলে ‘এভাবে বলো না। ’ পাকিস্তানি সৈন্য কর্তৃক নির্যাতনের সঙ্গে ‘সব পুরুষ’কে এক পাল্লায় মাপায় সুকৌশলে মূল বিষয়টাকে হালকা করা হয়েছে। নারীবাদী এই রূপ দেখিয়ে নীলা একটু পরেই নানাজানকে বলছেন, ‘সুমনের সাথে বিয়ে না হলে আমার কী হবে!’ ক্যাম্প থেকে ফিরে এসে চুপচাপ থাকলেও সুমনকে বিয়ে করতে না পেরে নিজেকে যখন একা ভাবে ঠিক তখনই যুদ্ধে যাওয়ার চিন্তা আসে নীলার মাথায়। কিশোরী মেহেরকেও পর্দায় উপস্থাপন করা হয় ঠিক পুরুষতন্ত্রের চাহিদামাফিক করে-এটাতো আরো বেশি স্ববিরোধীতা। গল্পের শাখা-প্রশাখা বাদ দিলে ছবির মূল থিম বেশ চমকপ্রদ, সাহসীও বলতে হবে।

ক্যামেরার কাজও ভালো। এডিটিং-এ একটা ছন্দ আছে। পুরো ছবিতে একটা বিশেষ কালার [গোলাপী] ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছেন পরিচালক। দোলনা, কবুতর, প্রকৃতি কাব্যিকভাবে ধরা পড়েছে ক্যামেরায়। ঝকঝকে পর্দা।

অভিনয়ে ভিক্টর ব্যানার্জি অপ্রতিদ্বন্দী। পরিচালকের সবচাইতে বাধ্য অভিনেতা মনে হয়েছে তাকেই। তার অভিনয়ে ঢাকা পড়ে গেছেন জয়া বচ্চন। ভালো অভিনয় করেছেন ঋতু সাত্তার, শায়না আমিন, আজাদ আবুল কালাম, স্বল্প চরিত্রের শতাব্দী ওয়াদুদ এমনকি পরিচালক নিজেও। অভিনয়ে ভালো করেননি পাকিস্তানি অভিনেতা ওমর রহীম।

এত গুরুত্বহীন একটি চরিত্রে হুমায়ুন ফরীদি অভিনয় না করলেও পারতেন। তবে গল্প বলায় পরিচালক মুন্সিয়ানা দেখাতে পারেননি। অসঙ্গতি প্রচুর। বড় অসঙ্গতি চরিত্রগুলোর মুখের ভাষা। এ সময়ের ‘ডিজুস’ উচ্চারণ একাত্তরে, এও সম্ভব! একই এলাকার মানুষ, তবুও একেকজনের মুখে একেক রকম ভাষা।

বেশি কানে লেগেছে ‘খাইছি, করছি’। এর পরেই আসে পোশাক। বলিউডি নায়িকাদের মতো শায়নার আটসাট সালোয়ার কামিজ সময়ের প্রেক্ষাপটে পুরোপুরি বেমানান। ঋতু যে বোরকাটি পরেছেন সেটি এ সময়ের আধুনিক মেয়েদের। ওয়াসিম খানকে পাকিস্তানি সেনারা খুঁজছেন, মুক্তিবাহিনীর হাতে ধরা পড়ার ভয়ও আছে।

এমন অবস্থায় মেহেরজানের হাতে হাত রেখে নির্ভয়ে ঘুরে বেড়ানোর কোনো যৌক্তিকতা নেই। এত বিতর্ক আর অসঙ্গতির পর এ ছবিটি যদি অস্কারেও চলে যায়, তাতে অবাক হওয়ার কিছুই থাকবে না। কারণ, কারো ‘হাহাকার’, অন্য কারো ‘বিশেষ উদ্দেশ্য’ থাকে যে ছবিটিকে ঘিরেÑ তৃতীয় বিশ্বের সে ছবিগুলোরই ডাক পড়ে অস্কারে। আফসোস!

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.