স্টেডিয়াম থেকে ফিরে ছোটবোন সটান বিছানায়। আড়াআড়িভাবে শোয়াতে হাটু পর্যন্ত বিছানায়,বাকি অংশ ঝুলন্ত। আমিও ওইরকমভাবে শুয়ে পড়লাম! শুরু হলো গল্পসল্প-
ঃ ভাইয়া, জানো, আজ এতো কষ্ট হয়েছে, মনে হচ্ছিলো গেটের মামাকে দশ-বিশ টাকা ঘুষ দিয়ে পালাই!
(বোন ছোটবেলা থেকেই আমাকে "ভাইয়া" ডাকে)
চোখ কপালে তুলে বললাম-
ঃ পালাবি মানে! কেন পালাবি?
ঃ জানোনা, এতো কষ্ট হয়েছে আজ। কি রোদ!
গভীর মনোযোগে সিলিং ফ্যানের ঘুরন্ত পাখা দেখতে দেখতে আমি বললাম-
ঃ হুম, ঠিকই বলেছিস! রোদে কষ্ট হয়েছে খুব।
ঃ না গেলেও চলতো।
স্কুলের কতো মেয়েই তো যায়নি।
ঃ হুম, না গেলেও চলতো!
ঃ আচ্ছা ভাইয়া, এইযে এতো মানুষ এতো কষ্ট করে জাতীয় সংগীত গাইলাম। কী হবে? গ্রীণিচ বুকে নাম উঠবে??
(গত বিজয় দিবসে দু'দুটো বিশ্বরেকর্ডের সুবাদে আমার ক্লাশ ফোরে পড়া বোন গ্রীণিচ বুকের নাম জেনেছে। )
আমি চট করে ওর দিকে ফিরলাম-
ঃ ঠিকই বলেছিস,কষ্ট হয়েছে। কিন্তু আমরা, এতোগুলো মানুষ কষ্ট করে জাতীয় সংগীত গেয়েছি।
তুই কী বুঝেছিস ব্যাপারটা, শুধু ফরিদপুর স্টেডিয়াম বা ঢাকা প্যারেড স্কোয়াডে না, সারাদেশে যে যেখানে ছিলো, যে অবস্থায় ছিলো,সকাল এগারোটায় দাঁড়িয়ে জাতীয় সংগীত গেয়েছে। কেন জানিস! সবারই দেশকে ভালোবাসি বলে।
বোন চোখ বড় করে তাকানো!
আমি প্রশ্নের ভঙ্গিতে বললাম-
ঃ গ্রীণিচ বুকে নাম উঠবে কিনা জিজ্ঞেস করছিস? সত্যিকার নামটা কোথায় উঠবে জানিস?
বোনের ছোট্ট হাতটা নিয়ে ওর বুকের বামপাশে রাখলাম।
ঃ এখানে। এখানে উঠেছে দেশের নাম! আমাদের মাতৃভূমি বাংলাদেশের নাম!
বোনের দ্রুত নিঃশ্বাস পড়ছে, চোখেমুখে দেশপ্রেমের আভা দেখতে পেলাম!
বুঝলাম,কথাগুলো ওর চেতনায় নাড়া দিয়েছে!
সেই চেতনা, যার জন্য হাটি-হাটি-পা-পা অবস্থা থেকে ওকে স্টেডিয়ামে নিয়ে যাই, প্রচন্ড রোদে কষ্ট করে ছোট্ট মানুষটা ডিসপ্লে দেখে!
বাসায় পার্মানেন্ট শহীদমিনার থাকা সত্ত্বেও কেন্দ্রীয় শহীদমিনারে নিয়ে যাই।
বিরক্ত হলেও পিচ্চি মেয়েটা খালি পায়ে ফুল দিতে যায়!
কষ্ট হলেও বিশেষ দিনগুলোতে হিন্দি CID, কার্টুন নেটওয়ার্ক বন্ধ রাখে!
সবার ভিতরেই দেশের জন্য ভালোবাসা থাকে। "দেশ মায়ের মতো"- এই বোধ/অনুভূতি/চেতনা সুপ্ত থাকে... শুধু তাকে জাগিয়ে তুলতে হয়। কাজেই যারা বিশেষ দিনগুলোতে দেশের প্রতি, ভাষার প্রতি, স্বদেশী ঐতিহ্যের প্রতি সন্মান/দায়িত্ববোধ দেখানো থেকে বিরত থাকেন এবং গলা ফুলিয়ে "বছরে দু'একদিন দেশের প্রতি ভালোবাসা দেখিয়ে কি হবে" টাইপ কথা বলাবলি করতে থাকেন কিংবা স্ট্যাটাস-পোষ্টে ফেসবুক-ব্লগের হোমপেজ ভরে দেন, তাদেরকে বলি- ওই "দু'এক"-দিনগুলোতে আমরা আমাদের সন্তানদের মধ্যে স্বদেশী ঐতিহ্য-প্রীতি কিংবা দেশপ্রেমের বীজ বপন করি। সেই বীজ থেকে চারা গজিয়ে বাকি দিনগুলোতে দেশকে পরম মমতায় ছায়া দেয়!
ছোটবেলার চারাগাছ একদিন বটবৃক্ষের মতো বড় হয়। বাসচালক সুবল কিংবা রানাপ্লাজার উদ্ধারকর্মী এজাজের মতো মানুষদের বটবৃক্ষই একদিন ভাষাশহীদ সালাম কিংবা বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আবদুর রউফ হয়ে ওঠে!
আজ আসুক আরেকটা বায়ান্ন, আরেকটা একাত্তর, দেখবেন, আমাদের হিন্দি চ্যানেল দেখা ছেলেমেয়েরাই সবার আগে ঝাপিয়ে পড়বে! পড়বেই!!
আজকের রোদ-ঝলসানো স্টেডিয়ামে সমবেত জনস্রোত অন্তত তাই প্রমাণ করে!
সবাইকে স্বাধীনতা দিবসের শুভেচ্ছা!।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।