টিপাইমুখ বাঁধ ও বাস্তবতা
লিখেছেনঃ আবদুল্লাহ হারুন জ... (তারিখঃ বৃহঃ, ২৪/১১/২০১১ - ২২:১০
টিপাইমুখ বাঁধ হলে কোন প্রকার ক্ষতির সম্ভাবনা নেই বরং উভয় দেশের জনগণ উপকৃত হবে : বেগম খালেদা জিয়া।
অবাক হবার কিছু নেই। এ মন্তব্যটি ২০০৩ সালের, প্রধানমন্ত্রী খালেদার জিয়ার উক্তি।
স্বাধীনতাপূর্ব সময় থেকে আলোচিত বিষয়গুলোর মধ্যে টিপাইমুখ বাধ ইস্যুটি অন্যতম। আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী কোন নদীর প্রবাহ যদি একাধিক দেশজুড়ে হয়ে থাকে সেক্ষেত্রে সেই নদী কর্তৃক প্রভাবিত যেকোনো প্রকল্পের কাজে সংশ্লিষ্ট দেশের মতামত বিবেচনা করা আবশ্যকীয় অর্থাৎ কোনও দেশ কোনও নদীর উজানে বাঁধ নির্মাণ করতে চাইলে ভাটির দেশের সঙ্গে আলোচনা করতে হবে।
প্রকল্পের প্রভাবিত সম্পর্কে অনেকে ভবিষ্যৎবাণী প্রকাশ করেছেন; বিশেষজ্ঞদের ব্যবহৃত পরিভাষা সম্পর্কেও সাধারণ মানুষ পরিচিত নয় - এমন একটি স্পর্শকাতর বিষয়ে পরিবেশবাদীদের চিরাচরিত বিরোধিতা ও রাজনীতিকদের রাজনীতি-করণে মূল বিষয়টি সম্পর্কে সাধারণ জনগণকে অবহিত করা প্রয়োজন।
টিপাইমুখ বাঁধের লাভ-ক্ষতির বিষয়টি এখনও ধারণার উপর প্রতিষ্ঠিত। বেগম খালেদা জিয়া এ সংশ্লিষ্ট জরীপ করার জন্য প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংকে চিঠি দিয়েছেন। উল্লেখ্য এর রিপোর্ট ২০০৯ সালে পানিসম্পদ মন্ত্রী কর্তৃক সংসদে স্পীকার বরাবর পেশ করা হয় এবং টিপাইমুখের শুধু জরীপ যথেষ্ট নয় বলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্পূর্ণ পর্যালোচনার জন্য ব্যবস্থা গ্রহণের কথা বলেছেন।
প্রাক-কথন
১৯৫৪ সালে যখন যৌথ নদী কমিশন গঠিত হয় তখন থেকে টিপাইমুখ নিয়ে আলোচনা শুরু হয়।
আসাম ও পার্শ্ববর্তী এলাকায় বন্যার কারণে পরিকল্পনা করা হয় অতিরিক্ত পানি কিভাবে কোন জলাধারে আটকে রাখা যায় এবং শুষ্ক-মওসুমে সে পানি সরবরাহের মাধ্যমে সেচসুবিধা প্রদান করা যায়। এ কারণেই টিপাইমুখ বাধ পরিকল্পনা করা হয়। যেকোনো স্থানে চাইলেই ড্যাম তৈরি করা যায় না। সে স্থানের উপযোগিতা থাকতে হয়। টিপাইমুখের সে উপযোগিতা থাকায় স্বাধীনতার পর বিষয়টি যৌথ-নদী কমিশনে আলোচনায় আসে।
১৯৭৮ সালে সিলেট ও পার্শ্ববর্তী এলাকায় বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও সেচ সুবিধা নিশ্চিত করতে জিয়াউর রহমান উভয় দেশের জন্য লাভজনক হিসাবে এ বাধের আলোচনা শুরু করেন যার সফল সমাপ্তি হয়নি। ১৯৯১ থেকে ১৯৯৬ পর্যন্ত যৌথ নদী কমিশনের একটি বৈঠকও অনুষ্ঠিত হয়নি। ফলে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে কূটনৈতিক প্রচেষ্টার অভাবে পানি সমস্যা অমীমাংসিত থাকে।
ব্যারেজ ও ড্যাম
বাংলায় আমরা বাঁধ বললেও ব্যারেজ ও ড্যাম শব্দ দুটির মধ্যে মৌলিক কিছু পার্থক্য রয়েছে। ব্যারেজ হল কোন নদীর কিছু অংশ পানিকে আটকে অন্যদিকে প্রবাহিত করা।
ড্যাম হল নদীর প্রবাহ যখন এত-বেশী হয় যে বন্যা হবার সম্ভাবনা থাকে তখন অতিরিক্ত পানিকে আটকে রাখা। শুষ্ক মওসুমে যখন পানির প্রবাহ কম থাকে তখন জলাধার থেকে পানি ছেড়ে নদীর প্রবাহ ঠিক রাখা। টিপাইমুখ কোন ব্যারেজ নয় এটি ড্যাম।
টিপাইমুখ বাঁধ
টিপাইমুখ বাঁধ বাংলাদেশ বর্ডার থেকে ২১০ কিলোমিটার দূরে নির্মাণের পরিকল্পনা করা হয়। বর্ডার এবং টিপাইমুখের মাঝে ফুলেরতলা নামক একটি স্থান আছে যেখানে ভারত অতিরিক্ত প্রবাহিত পানি আটকে রাখতে ১০০ কি:মি: এলাকা জুড়ে ব্যারেজ নির্মাণ পরিকল্পনা করেছিল।
২০০৩ সালে গৃহীত টিপাইমুখ বাঁধ প্রকল্পের অন্তর্ভুক্ত ছিল এই ফুলেরতলা ব্যারেজ। বাংলাদেশের প্রায় এক কোটি জনগোষ্ঠীর বসতি মরুভূমিতে পরিণত করতে এই ফুলেরতলা ছিল প্রধান নিয়ামক। ২০০৯ সাল থেকে কূটনৈতিক প্রচেষ্টার ফলে এই ফুলেরতলা ব্যারেজ টিপাইমুখ প্রকল্প থেকে বাতিল করা হয়।
টিপাইমুখ বাঁধের উচ্চতা সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে ১৬৬ মি., ১৭৮ মিটার সর্বাধিক গভীর স্তর এবং ১৩৬ মিটার সর্বনিম্ন স্তর, দৈর্ঘ্য = ৩৯০ মিটার, পানি বহন ক্ষমতা = ১৬ কিউসেক মিটার, (৮ টি গ্রামের ২৬৬ পরিবারের আবাসভূমিতে)।
প্রকল্প বিদ্যুৎ = ১৫০০ মেগাওয়াট।
পরিবেশবাদীদের মতামত:
পরিবেশবাদীরা পরিবেশ রক্ষায় সব সময় তৎপর। প্রকৃতিতে প্রাকৃতিক যেকোনো হস্তক্ষেপের বিরোধী তারা। ইকোলজিক্যাল ইমপ্যাক্ট বিবেচনা করে তাদের এ অবস্থান। সুতরাং তারা তাদের অবস্থানে সঙ্গত কারণেই যৌক্তিক। তারা যেকোনো প্রকার বাঁধ/ব্যারেজ/ড্যাম নির্মাণের বিরোধী।
যদিও লাভ-ক্ষতি বিবেচনা করে পদক্ষেপ গৃহীত হয়। শিল্পায়নের ফলেও নেতিবাচক ইকোলজিক্যাল প্রভাব রয়েছে, একটি বিল্ডিং তৈরির ক্ষেত্রেও। তবে তাদের ধারণা যতটা তত্ত্ব-ভিত্তিক ততটা তথ্য-ভিত্তিক নয়। যেমন:
পলি জমা ও ভূমিকম্প:
কয়েক ধরণের পলিমাটি দেখা যায়। ভাসমান পলি প্রবাহিত হবে কিন্তু ভারী পলি প্রবাহিত হবেনা।
আর প্রবাহিত হলেও ২১০কি.মি দূরে অবস্থানের কারণে বাংলাদেশে সেই পলি আসার কোন সম্ভাবনা নেই। অন্যদিকে বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী টারবাইন শুধুমাত্র পলিবিহীন পানিকে ব্যবহার করে।
এর ফলে ভূমিকম্প সৃষ্টির কথা বলা হয়েছে কিন্তু পৃথিবীর ক্ষমতাশালী টেকটনিক প্লেট এর সাথে এই ছোট আকারের পানির জলাধারের তুলনা অবান্তর। তাছাড়া রিখটারস্কেল ৭ মাত্রায় ভূমিকম্পের প্রভাব ১০০ কি:মি: এর মধ্যে হয়ে থাকে; সেক্ষেত্রে ক্ষতির সম্মুখীন হবে ভারত।
লবণাক্ততা:
অনেকে মতপ্রকাশ করেছেন বাঁধ অঞ্চলের লবণাক্ততা।
মূলত: নদীর লবনাক্ততা বেগ ও স্রোতের উপর নির্ভরশীল আবার ঋতু পরিবর্তনের ফলেও এর হ্রাসবৃদ্ধি ঘটে। যেমন: বর্ষার পানি। কিন্তু শীতের সময় জলাধার থেকে পানি রিলিজ ব্যবস্থা এর উন্নয়ন ঘটাতে পারে।
উল্লেখ্য এর মাধ্যমে উৎপাদিত বিদ্যুৎ পরিবেশ বান্ধব উপায়ে সৃষ্ট।
পরিবেশবাদীদের বিরোধিতার অন্যতম কারণ এ প্রকল্পের ফলে ভারতের ২৭ হাজার ২৪২ হেক্টর বনভূমি বিনষ্ট হবে।
বিরোধিতা ও স্ববিরোধীতা
বিএনপি সময়ে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক প্রণীত একটি রিপোর্ট (SNC-Lavalin International) থেকে জানা যায়, বন্যার নিয়ন্ত্রণে মেঘনা, বারাক, সুরমা এবং কুশিয়ারা নদী মধ্যে প্রবাহ হ্রাস করা হবে যা ২০ শতাংশ বন্যা হ্রাস করবে।
শুষ্ক মওসুমে পানি প্রবাহের মাধ্যমে সেচ-ব্যবস্থার মাধ্যমে কৃষিক্ষেত্র সুবিধা ভোগ করা যাবে। [যৌথ নদী কমিশনের (JRC) এর 35th (২০০৩ সাল) এবং 36th মিটিং (২০০৫)। ]
এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ করা প্রয়োজন ভাটির দেশ হিসাবে বাংলাদেশের সিলেট অঞ্চল যদি প্লাবিত হয় তবে তাত্ত্বিকভাবে আসাম, মনিপুর ও মিজোরামের বৃহৎ অঞ্চলও প্লাবিত হবে। বাংলাদেশের এক কোটি জনসংখ্যার বসতী যদি মরুভূমিতে পরিণত হয় তবে তাত্ত্বিকভাবে আসাম, মনিপুর ও মিজোরামের বৃহৎ অঞ্চলও প্লাবিত হবে।
এটি বলার অপেক্ষা রাখেনা যে পারস্পরিক-স্বার্থের আলোকেই আন্তর্জাতিক রাজনীতি ও কূটনীতি পরিচালিত হয়। বাংলাদেশ নেপালে ৭টি ড্যাম নির্মাণের দাবী ও প্রস্তাব জানিয়েছে যা মূলত ভারতের অসহযোগিতার কারণেই হয়নি। বর্তমানে একটি ড্যামের কাজ শুরু হয়েছে। প্রস্তাবিত ৭টি ড্যামের উচ্চতাই সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৩০০ মি: উঁচুতে। পরিবেশগত বিষয় যদি মুখ্য হয় তবে সেই ৭টি ড্যাম নির্মাণের জন্য বাংলাদেশের প্রস্তাব কিভাবে মূল্যায়ন করা হবে তা বলা বাহুল্য।
প্রয়োজন জাতীয় ঐক্যের
টিপাইমুখ বাঁধ একটি জাতীয় ইস্যু। বিরোধিতার জন্য বিরোধিতা না করে দেশের স্বার্থে সিদ্ধান্ত নেয়া প্রয়োজন। এখনই এ বাঁধ নির্মাণ হচ্ছেনা। জরীপ যথেষ্ট নয় তাই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্পূর্ণ পর্যালোচনার কথা বলেছেন। আশা করা বৃথা তবু আশা করি পানি ঘোলা করার রাজনীতি না করে, বিরোধিতার বন্য বিরোধিতার রাজনীতি না করে জনগণের স্বার্থ বিবেচনা করে জাতীয় বিষয়গুলোর সমাধান হবে।
।
[Extracted from A. Arafat's Interview
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।