আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ক্ষতিপূরণ হিসেবে ক্ষতিকারক বীজ: ক্ষতিপূরণ না প্রমোশনাল ক্যাম্পেইন?

নষ্ট/রোগাক্রান্ত বীজ থেকেফসল না হওয়ার বা ফসল নষ্ট হওয়ার ক্ষতিপূরণ কি বীজ দিয়ে বা সার দিয়ে হয় নাকি বীজ থেকে সম্ভাব্য ফসলের মূল্য হিসেব করে তারপর ক্ষতিপূরণ নির্ধারিত হয়? কিংবা যে হাইব্রিড বীজ কৃষকের সর্বনাশের কারণ সেই ক্ষতিকারক বীজ কি ক্ষতিপূরণ হিসেবে ব্যাবহ্রত হতে পারে? সরকার সম্প্রতি হাইব্রিড বীজ চাষ করে ধান ও টমেটো না হওয়ার ক্ষতিপূরণ করার জন্য ৩টি কোম্পানিকে নির্দিষ্ট পরিমাণ বীজ ও সার ক্ষতিপূরণ হিসেবে দেয়ার নির্দেশ দিয়েছে দেখে প্রশ্নগুলো তোলা হল। ২ কেজি ধান বীজ চাষ করে কৃষক যদি কোন ফসল না পায় তাহলে খুব স্বাভাবিক ভাবেই স্রেফ দুই কেজি ধান বীজ এবং সেই বীজ চাষ করার জন্য প্রয়োজনীয় সার দিয়ে তার ক্ষতিপূরণ হতে পারে না। কারণ বীজ নষ্ট না হলে কৃষক ২ কেজি বীজ থেকে হয়তো ২০ মণ ধান পেত ফলে তার ক্ষতি প্রকৃত পক্ষে ২ কেজি বীজ নয়- ২০মণ ধান। সেই সাথে ধান না হওয়ার ফলে কৃষক তার সারা বছরের খোরাকী থেকে বঞ্চিত হয়, মহাজনের কাছ থেকে চড়া সুদে ঋণ নিতে বাধ্য হয়- এই ক্ষতিগুলোর হিসেব ও নষ্ট বীজের ক্ষতিপূরণের ক্ষেত্রে আমলে নিতে হয়। কিন্তু কোম্পানি অন্ত:প্রাণ সরকার এই সম্ভাব্য ফসল, মহাজনী ঋণের সুদ, কৃষকের হয়রানি ইত্যাদির হিসেব তো আমলে নেয়নি বরং ক্ষতিপূরণ হিসেবে প্রদর্শনী প্লটের মাধ্যমে অল্প কিছু কৃষককে যেভাবে ক্ষতিপূরণ হিসেবে স্রেফ কিছু বীজ ও সার দেয়ার কথা বলেছে তাতে এ উদ্যোগকে ক্ষতিপূরণের বদলে বীজ প্রমোশন বলেই মনে হচ্ছে।

যে ক্ষতিগ্রস্থ কৃষকরা আর এইসব কোম্পানির টমেটো ও ধানবীজ চাষ না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো তাদেরকে এখন ক্ষতিপূরণের নামে আসলে বীজ আর সার দিয়ে নতুন করে এসব ঝুকিপূর্ণ বীজ চাষকরতে উদ্বুদ্ধ করে আবারও ঝুকিতে ফেলা হচ্ছে। বীজ আইনে ক্ষতিপূরণের কোন বিধান না থাকার অযুহাতে সরকার এই ক্ষতিপূরণ-তামাশার আয়োজন করেছে। বীজ আইনে ক্ষতিপূরণের কথা নাই কিন্তু আমরা বীজ আইন তন্ন তন্ন করে খুজেও এভাবে প্রদর্শনী প্লটের আয়োজন করে বীজ আর সার উপঢৌকনের মাধ্যমে বীজ প্রমোশনেরও কোন বিধান দেখলাম না! ক্ষতিগ্রস্থ কৃষকরা কিন্তু বলেছেন বীজ আইনে না থাকলেও একর প্রতি ১২০/১৩৫ মণ ফলনের যে প্রতিশ্রুতি কোম্পানিগুলো তাদের প্যাকেটে দিয়েছে সেটা ব্যাবহার করেই প্রতারণার অভিযোগে এবং সেই সাথে লাইসেন্স বাতিলের হুমকি দিয়েই এদের কাছ থেকে উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ আদায় করা সম্ভব হতো যদি শাসক গোষ্ঠী এরকম কোম্পানি বান্ধব না হতো! সরকারি সিদ্ধান্ত অনুযায়ি কোম্পানিগুলো বিভিন্ন অঞ্চলে প্রদর্শনী প্লট করে বীজ উৎপাদন করবে এবং টমেটোর ক্ষেত্রে বহুজাতিক সিনজেন্টা রাজশাহী ও চাপাই নবাবগঞ্জের দেড় হাজার কৃষককে ২০ গ্রাম করে টমেটোর বীজ দেবে এবং ধানের ক্ষেত্রে এনার্জি প্যাক এগ্রো ও মেসার্স মেটাল এগ্রো মিলিত ভাবে নোয়াখালী, গোপালগঞ্জসহ দেশেরঅন্যান্য এলাকার ক্ষতিগ্রস্ত দুই হাজার কৃষককে দুই কেজি করে ধানবীজ, ২৫কেজি ইউরিয়া, ১০ কেজি ডাই অ্যামোনিয়াম ফসফেট (ডিএপি) ও ১৫ কেজি মিউরেট অবপটাশ (এমওপি) সার সরবরাহ করবে। (সূত্র: প্রথম আলো, ০২ নভেম্বর ২০১১ Click This Link) এই ক্ষতিপূরণ বাস্তবে ক্ষতিগ্রস্থ কৃষকের সংখ্যা এবং ক্ষতির পরিমাণ অনুযায়ী এত সামান্য যে একে ক্ষতিপূরণ-তামাশা আর বীজ প্রমোশন ক্যাম্পেইন ছাড়া আর কোন কিছু বলার উপায় নেই। হাইব্রিড ঝলক চাষ করে শুধু মাত্র নোয়াখালি অঞ্চলের ক্ষতিগ্রস্থ কৃষকের ক্ষতির হিসেবের সাথে সরকারি ক্ষতিপূরণের হিসেব তুলনা করলেই বিষয়টি পরিস্কার বোঝা যায়।

নোয়াখালি অঞ্চলে গত বোরো মৌসুমে ১ হাজার ৬৬৫ হেক্টর জমিতে হাইব্রিড ঝলক জাতের ধান আবাদ করা হয়। এর মধ্যে ১ হাজার ১৯৫ হেক্টর বা প্রতি হেক্টর সমান ২.৪৭ হিসেবে ২৯৫২ একর জমির ঝলক ধান সম্পূর্ণ নষ্ট হয়। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন ৬ হাজার ৯২৬ জন কৃষক। (সূত্র: সমকাল ২৭ সেপ্টেম্বর ২০১১ Click This Link) অর্থাৎ একেকজন কৃষকের গড়ে ০.৪২ একর বা ৪২ শতাংশ জমির ফসল নষ্ট হয়েছে। এনার্জি প্যাক এগ্রো কোম্পানির ঝলক ধানের প্যাকেটের গায়ের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ি প্রতি একর জমিতে ১২০ থেকে ১৩৫ মণ ধান হওয়ার কথা।

ছবি: প্যাকেটের গায়ে একর প্রতি ১২০ থেকে ১৩৫ মণ ফলনের প্রতিশ্রুতি একর প্রতি ফলন ১২০ মণ ধরলে ৪২ শতাংশ জমিতে ফলন হতো ৫০ মণেরও বেশি ধান। ঐসময় ধানের দাম ছিলো প্রতি মণ ৭০০-৭৫০ টাকা। ৭০০ টাকা মণ ধরলে ৫০ মণ ধানের দাম ৩৫ হাজার টাকা। এখন এই ফসল না হওয়ার ফলে কৃষকের খাদ্যের অনিশ্চয়তা, মহাজনের কাছ থেকে নেয়া ঋণের সুদসহ বিভিন্ন ভোগান্তির কথা যদি বাদও দেই তাহলে গড়ে প্রত্যেক কৃষক অন্তত ৩৫ হাজার টাকা করে ক্ষতিপূরণ পাওয়ার কথা যার পরিমাণ শুধু নোয়াখালি অঞ্চলের ক্ষতিগ্রস্থ ৬৯২৬ জন কৃষকের জন্যই দাড়ায় ২৪ কেটি ২৪ লক্ষ ১০ হাজার টাকা। অথচ সরকারের সিদ্ধান্ত অনুসারে সারা বাংলাদেশের হাইব্রিড ধান ও টমোটো বীজ কিনে প্রতারিত হওয়া কৃষকের জন্য ক্ষতিপূরণের পরিমাণ সর্বমোট ৬০ লক্ষ টাকা! সরকারি সিদ্ধান্ত মোতাবেক এনার্জি প্যাক এগ্রো ও মেসার্স মেটাল এগ্রো মিলিত ভাবে নোয়াখালী, গোপালগঞ্জসহ দেশেরঅন্যান্য এলাকার ক্ষতিগ্রস্ত দুই হাজার কৃষককে দুই কেজি করে ধানবীজ, ২৫কেজি ইউরিয়া, ১০ কেজি ডাই অ্যামোনিয়াম ফসফেট (ডিএপি) ও ১৫ কেজি মিউরেট অবপটাশ (এমওপি) সার সরবরাহ করবে।

প্রতি কেজি ২৫০ করে ২ কেজি হাইব্রিড ধান বীজের দাম ৫০০ টাকা, প্রতি কেজি ১৩ টাকা করে ২৫ কেজি ইউরিয়ার দাম ৩২৫ টাকা, প্রতি কেজি ২৭ টাকা করে ১০ কেজি ডিএপি’র দাম ২৭০ টাকা এবং প্রতি কেজি ২৫ টাকা হিসেবে ১৫ কেজি পটাশ সারের দাম ৩৭৫ টাকা। সব মিলিয়ে মাত্র ২ হাজার কৃষকের প্রত্যেকে মাত্র ১৪৭০ টাকার সমপরিমাণ ক্ষতিপূরণ পাবে! অথচ শুধু নোয়াখালি অঞ্চলেই প্রায় ৭ হাজার কৃষক শুধু ঝলক বীজের ফসল হানির ক্ষতিপূরণ হিসেবে প্রত্যেকে ৩৫ হাজার টাকা করে পাওয়ার কথা। একই ভাবে বহুজাতিক সিনজেন্টা কোম্পানির হাইব্রিড ‘সবল’বীজ চাষ করে শুধু মাত্র রাজশাহীর গোদা বাড়িতেইক্ষতিগ্রস্থ হয়েছেন প্রায় সাড়ে ৮ হাজার কৃষক অথচ ক্ষতিপূরণ দেয়া হচ্ছে মাত্র দেড় হাজার কৃষককে প্রতিজনকে ২০ গ্রাম করে বীজ দিয়ে! ছবি: সিনজেন্টা’র সকল পণ্য বয়কটের ডাক আসলে ক্ষতিপূরণ দেয়ার কোন ইচ্ছা কোম্পানি অন্ত:প্রাণ শাসক গোষ্ঠীর নাই, কোন কালে ছিলও না। যে কারণে বীজ আইনে ক্ষতিপূরণের কোন বিধানই তারা রাখেনি এবং বারবার হাইব্রিড ধানের ঝুকি ও ক্ষতির বিষয়টি স্পষ্ট হওয়ার পরও তারা হাইব্রিড ধানের অনুমোদন বাতিল করা তো দূরের কথা বীজ আইনে স্রেফ ক্ষতিপূরণের বিধান অন্তর্ভুক্ত করার প্রয়োজন বোধ করছেনা। এই তথাকথিত ক্ষতিপূরণ তামাশার ঘোষণা আসার আগপর্যন্ত সরকার তো স্বীকারই করেনি যে হাইব্রিড ধান ও টমেটো বীজের সমস্যার কারণেই এই ফসল হানি ঘটেছে, সরকারি তদন্ত কমিটি কোম্পানির সুরে সুর মিলিয়ে বারবার আবহাওয়াকে দায়ি করেছে।

কিন্তু যখন দেখছে আবহাওয়াকে দায়ী করে লাভ হচ্ছে না, কৃষকরা সোজা যুক্তি দিয়েছে বীজে যদি সমস্যা না থাকতো, যদি আবহাওয়ার কারণেই হতো তাহলে অন্য কোম্পানির বীজের টমেটো ও ধানের ফলনও নষ্ট হতো এবং যখন দেখা গেল কৃষকরা ঐসব কোম্পানির ধান ও টমেটো বীজসহ সকল পণ্য বর্জন করেতে শুরু করেছে তখন শাসক গোষ্ঠী বীজ কোম্পানিগুলোকে উদ্ধার করার তরিকা হিসেবে এই প্রদর্শনী প্লট উৎপাদিত বীজ দিয়ে ‘ক্ষতিপূরণ’এর তামাশা সাজালো। এর ফলে কোম্পানির লাভ বহুবিধ: ১)প্রকৃত ক্ষতিপূরণ দেয়ার বিপুল অর্থ বেচে গেল ২) নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে রোগমুক্ত বীজ থেকে ফসল উৎপাদন করে দেখিয়ে দেয়া যে বীজের কোন সমস্যা ছিল না(অথচ অত্যাধিক স্পর্শকাতর হাইব্রিড জাতের এই বীজে এইবারে প্রদর্শনী প্লটের ক্ষেত্রে সমস্যা না হলেই যে গত বছরের বীজে সমস্যা ছিলনা কিংবা ভবিষ্যতেও সামান্য আবহাওয়ার তারতম্যে কিংবা অন্যকোন কারণে হবে না তার কোন নিশ্চয়তা প্রতিষ্ঠা হলো না। ) ৩) ঠিক কত তাপমাত্রা, কেমন আবহাওয়া ও বৃষ্টিপাতে এই বীজ থেকে ফসল ভালো হবে তা সুনির্দিষ্ট করার বিপদেও পড়ল না কোম্পানি। ৪) বীজ বর্জনের ডাক দেয়া কৃষকদেরকে কৌশলে সেই বীজ ব্যাবহারে উদ্বুদ্ধ করণ ৫) সারাদেশে বীজগুলোর যে দুর্নাম রটেছে তার হাত থেকে স্বল্প খরচেই রক্ষা পাওয়া ৬) বীজ আইনে এবারও ক্ষতিপূরণের ধারা যুক্ত না হওয়াতে ভবিষ্যতেও এই ধরণের প্রদশর্নী প্লটের মাধ্যমে ‘ক্ষতিপূরণ’ করার প্রক্রিয়াকে একটি মডেল হিসেবে কাজে লাগানোর সুযোগ তৈরী হওয়া। ফলে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, এই তথাকথিত ক্ষতিপূরণ আসলে ঝুকিপূর্ণ ও ক্ষতিকর বীজ হিসেবে পরিচয় পাওয়া হাইব্রিড সবল, ঝলক ও সারথী ইত্যাদি বীজগুলোকে দুর্নাম থেকে উদ্ধার করে পুনরায় বাজার জাত যোগ্য করার জন্য কোম্পানি স্পন্সরড ক্যামপেইন বা কোম্পানি প্রযোজিত প্রচারণা, যেটাকে সরকার ক্ষতিপূরণ হিসেবে চালিয়ে দিতে চাইছে! অবশ্য এইসব ধান্দা কৃষক খুব ভালো ভাবেই বোঝে, এই তৎপরতার খবর শুনে যে কারণে ক্ষতিগ্রস্থ কৃষক সামছুদ্দিন বলেছিলেন: “ঝলকের প্রদর্শনী খামার করার অর্থই হচ্ছে ঝলকের বীজের পক্ষে সাফাই গাওয়া, তাদের সার্টিফিকেট দেওয়া।

কৃষকের ক্ষতিকরে বীজ কোম্পানির স্বার্থ রক্ষা ছাড়া আর কিছুই নয়। আমাদের আগে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হোক। ” আমরা কৃষক সামছুদ্দিনের সাথে সম্পূর্ন একমত পোষণ করি, বীজ আইনে বীজের কারণে ফসলহানির ন্যায্য ক্ষতিপূরণের ব্যাবস্থা রাখার দাবী জানাই এবং সেই সাথে বীজ নিরাপত্তার প্রসঙ্গটি সামনে রেখে হাইব্রিড বীজের অনুমোদনের যৌক্তিকতাকে নিয়ে প্রশ্ন উঠানো জরুরী মনে করছি। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.