আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

রক্ষক যখন ভক্ষক,আর শিক্ষক যখন ব্যাবসায়ী!!

গতরাতে ব্লগার টিভি পাগলা'র একটা পোস্ট পড়েছিলাম যার শিরোনাম হল,"ভিকারুন্নেসা আর আইডিয়াল, ছাত্রছাত্রীরা এক অসুস্হ প্রতিযোগীতায় ব্যস্ত। "ব্লগটি আর ব্লগের কমেন্টগুলো পড়ে মনে হল আমিও আমার নিজের তিক্ত অভিজ্ঞতা সবার সাথে শেয়ার করি। যদিও এই ব্যাপারটায় আমি এতই হতাশ হয়ে পড়েছি যে ব্লগে লিখতে গিয়ে মনে হয় কি হবে এইসব লিখে?শুধু আলোচনাই হবে,কিন্তু কোন পরিবর্তন তো আসবে না!সেকারনেই হয়ত মনের ভেতর অনেক যন্ত্রনা থাকা সত্বেও কিছু লেখা হয়নি কখনো। কিন্তু এই পোস্টটি পড়ে আমি উদ্বু্দ্ধ হয়েছি নিজের অভিজ্ঞতা নিয়ে কিছুটা আলোকপাত করার। আমরা যে কিভাবে শিক্ষকদের হাতে জিম্মি তা একমাত্র ভুক্তভোগীমাত্রই জানে।

আমার মেয়ে ক্লাস ৫ এ পড়ে। এইবছর সমাপনী দিবে। কিন্তু আমি তাকে যে স্কুলে ভর্তি করিয়েছি সেই স্কুলে আবার সমাপনীর পাশাপাশি রাজঊক স্কুলে ভর্তির জন্যও চাপ দেয়া হয়। দেখা গেল যত না সমাপনি,তারচেয়ে বেশী রাজউকে ভর্তির ব্যাপারেই তাদের মাথা ব্যাথা বেশি। কিন্তু যেহেতু আমার মেয়ে লেখাপড়ায় দুর্বল তাই আমি তাকে এই বাড়তি চাপ থেকে দূরে রাখতাম।

আমার মত অনেকেই ছিল যারা তার সন্তানকে শুধুই সমাপনি দেয়াতে চাচ্ছিল,এডমিশন নয়। কিন্তু টিচারেরা বাধ্যতামুলোকভাবে এডমিশনের কোচিং করাচ্ছিল এবং প্রতি সপ্তাহে পরীক্ষা নিচ্ছিল। আমার মেয়ের স্কুল শুরু হত ৭ঃ৩০ টায় আর স্কুল শেষ হতেই শুরু হত কোচিং ঠিক ২ঃ৪০ পর্যন্ত,যা আমি মনে করি ১০ বছরের একটা বাচ্চার জন্য অতিরিক্ত চাপ ছাড়া আর কিছুই না। (কোচিং এর জন্য ১০০০ টাকাও নেয়া হয়। ) তারপর বাসায় ফিরে গোসল করে খেতে খেতে ৩ঃ৩০টা।

এরপর ঘুম। সন্ধ্যায় আমি ওকে পড়াতে বসালে দেখতাম সমাপনীর পড়া আর স্পকুলের হোময়ার্ক করতেই সময় চলে যেত। এডমিশনের পড়া সে কখনই কমপ্লিট করতে পারত না। তাছাড়া সম্পুর্ন দুইরকম পড়া তার মাথায় ঢুকবে না বলে আমিও আর চাপ দেইনি। কিন্তু তার দরুন যে ক্লাসের এডমিশনের মডেল পরীক্ষাগুলোতে সে (এবং আরো অনেকে) খারাপ করত,তার জন্য তাকে রোজ পানিশমেন্ট দেয়া হত এবং গার্জিয়ান ডাকা হত।

এমনকি আমাদের মোবাইলে তার ক্লাস টীচার দু একদিন পর পর ফোন করে বলত যে সে পরীক্ষায় ভাল করছে না,তাই তার টিচার দরকার। আমি তাদের কিছুতেই বলে বোঝাতে পারি না যে আমার মেয়েকে তো আমি রাজউকে এডমিশন দেয়াব না,তাহলে পড়াব কেন। কিন্তু টিচার আমাকে বোঝায় যে আপনার মেয়ে পারবে আপনি চেষ্টা করেন। যেন রাজউকে ভর্তি না করালে আমার মেয়ের জীবনটাই বৃথা ! আমার কাছে আমার মেয়ের শৈশবটাই ইম্পর্ট্যান্ট,একাডেমিক শিক্ষার চেয়ে সত্যিকার মানুষ হওয়াটাই জরুরী,-আমি তাকে নিয়ে বৃষ্টিতে ভিজতে চাই,আকাশের বিশালতা দেখাতে চাই,তার সৃষ্টিশীল মনটাকে খুজে বের করতে চাই,জীবনের সৌন্দর্য বোঝাতে চাই। তাকে যাঁতাকলে পিষে ফেলে জীবনের সব রং-রুপ-রস শেষ করে দিতে চাই না।

কিন্তু স্যারের কথায় মনে হয় যেন আমার জীবনের এখন একমাত্র উদ্দেশ্য হওয়া উচিত রাজউকে মেয়েকে ভর্তি করানো! ছয়টা মাস এই টিচার আমাকে দিন নেই রাত নেই বিরক্ত করতে লাগল এই বলে যে আমাকে এডমিশন দেয়াতেই হবে এবং তার জন্য টিচার রাখতেই হবে। রোজ সে আমাকে স্কুলে ডেকে নিত,নাহলে কল করত। আমার হাজব্যান্ডকেও কল করত অফিস টাইমে। এমনকি আমার ছোট ছেলেটিকে ক্লাস থেকে ডেকে নিয়ে মেয়ের খাতা দেখিয়ে বকাবকি করত যে তোমার বোনত কিছুই পারে না!শুধু তাই নয়,বাচ্চাদের কাছে বারবার সন্দেহবশত জিজ্ঞেস করত তারা কোচিং করে কিনা কিংবা বাসায় টিচার আছে কিনা!কিনতু তাতেও যখন কাজ হচ্ছিল না তখন তিনি আমার মেয়ের নাম্বার কম দিতে লাগলেন। যেহেতু তিনি ফর্ম টিচার,তাই তার কথায় অন্যরাও কম দেয়া শুরু করল।

অযথাই নাম্বার কাটতে লাগলেন টিচারেরা। মেয়ের এই কম নাম্বার দেখে আমার আত্মবিশ্বাস আমি হারিয়ে ফেললাম। তখন মনে হল আমি বোধহয় ঠিকমত পড়াতে পারছি না। ভয় পেয়ে গেলাম সমাপনি পরীক্ষা নিয়ে যে যদি সে ফেল করে তো জীবন থেকে একটি বছর তার হারিয়ে যাবে। শেষ পর্যন্ত বিরক্ত হয়ে আমি বাধ্য হলাম তার কাছে আমার মেয়েকে পড়াতে।

। কিন্তু তাতে কি কোন লাভ হয়েছে?সারা মাস কিছুই না পড়িয়ে,৬দিনের জায়গায় প্রায়ই ৪দিন এসে,এবং ১ঘন্টার আগেই পড়া শেষ করে সে তার টিউশনি চালাতে লাগল। এমনকি অঙ্কটাও সে বেছে বেছে করাতে লাগল। আমি যখন টেনশনে পড়ে গেলাম যে থরোলি পড়ে যেখানে আমার মেয়ে কোনমতে পাশ করত,সেখানে এত কম পড়ে সে কিভাবে পাশ করবে?তাছাড়াও আমার মেয়ের একটা বড় সমস্যা হল সে কোন পড়াই মনে রাখতে পারে না। তাকে একই পড়া বারবার রিভিশন দিতে হয়।

এবং যতবার সে রিভিশন দেয়,ততবারই সে মুখস্থ করে। কিন্তু টিচারদের এত ধৈর্য কোথায়?যেখানে একবার পড়াতেই তাদের সময় হয় না,সেখানে বারবার কে রিভিশন দেয়াবে?তারা তো বাচ্চার হোমওয়ার্কটুকুও চেক করে দেখে না!কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার যে সে পাশ করল,এবং ৯৮% মার্ক্স নিয়েই, যা সে তার ইহজীবনে কোনোদিন পাওয়ার স্বপ্নও দেখেনি!কিভাবে?কারন তার শ্রদ্ধেয় স্যার পরীক্ষার আগে তাকে পুরো কোয়েশ্চেন্টাই আউট করে দিয়েছিলেন!!! এ হেন অবস্থা চাক্ষুষ দেখে কি কোন বিবেকবান শিক্ষিত মানুষ স্থির থাকতে পারে?আমিও পারিনি। সবার নিষেধ সত্ত্বেও আমি প্রমানসহ প্রিন্সিপালের কাছে গিয়ে কমপ্লেইন করলাম । কারন আমার মনে হয়েছিল যে ব্যাপারটা সবার জানা দরকার এবং এই অন্যায় বন্ধ করা দরকার। একেতো জোর করে মেয়েকে পড়াতে চাওয়া,তায় আবার পড়াতে এসে না পড়িয়ে কোয়েশ্চেন আউট করে দেয়া,এর চেয়ে বড় অন্যায় আর কি হতে পারে?আমি এভাবে দুর্নীতি করে আমার মেয়েকে ১ম করতে চাইনি,তার চেয়ে সে তার যোগ্যতায় ফেল করাও ভাল মনে হয়েছে আমার কাছে।

প্রিন্সিপাল ভাল মানুষ,তিনি এই ঘটনার জন্য আমার কাছে মাফ চেয়েছেন এবং এরপর আর সেই টিচারকে কোন পরীক্ষার দায়িত্বে দেননি। কিন্তু এরপর আমি শত্রু হয়ে গেলাম পুরো স্কুলের টিচারদের কাছে। খুটিনাটি ব্যাপারে বার বার কমপ্লেইন আসা শুরু হল,আর সব পরীক্ষায় মেয়ের ন্যুনতম নাম্বার পাওয়া তো আছেই। নানাভাবে আমাকে এবং আমার মেয়েকে হ্যারেসমেন্ট করতে লাগল স্কুলের কিছু তথাকথিত শিক্ষক। আমার যে স্বামী এবং পরিবার আমার এই সাহসিকতায় আমাকে বাহবা দিয়েছিল,তারাই একসময় আমাকে বকতে লাগল এই বলে যে কেন আমি জলে বসে কুমিরের সঙ্গে লড়তে গেলাম।

স্কুলে পড়াতে গেলে এরকম হবেই এবং আমাদের এটা মেনে নিয়েই চলতে হবে। যে মানতে পারবে না সে হবে সবচাইতে বোকা। এইসব দেখে আমি একদম হতাশ হয়ে গেলাম। এই কি সততা আর মানবিকতা?এই কি একজন শিক্ষকের আচরন?নিজের মনকে কিছুতেই বোঝাতে পারছিলাম না। কিন্তু সবার কথা শুনে আর মেয়ের কথা ভেবেই মনে হল বিবেককে এবার বর্জন করতেই হবে।

শেষপর্যন্ত সবার কথামত স্কুলের দুইজন সিনিয়র টিচারকে নিয়োগ করলাম আমার মেয়েকে পড়ানোর জন্য!বাধ্য হয়ে। তাতে করে অন্য সব টিচারেরা আমাদের যন্ত্রনা করা তো বন্ধ করল,কিন্তু আমার বিবেকের যন্ত্রনা যেন বেড়ে গেল এভাবে অন্যায়ের সাথে আপোষ করতে হল বলে। এখন সন্ধ্যার পর দুইজন টিচার আসে মেয়েকে পড়াতে। তারা এসে স্কুলের মত সব পড়া বুঝিয়ে দিয়ে চলে যান বাসায় পড়তে নির্দেশ দিয়ে। তারা চলে গেলে রাত ৯টায় আমি মেয়েকে নিয়ে বসি স্যরদের পড়া মুখস্ত,স্কুলের হোময়ার্ক কমপ্লিট করার জন্য।

সব শেষ করতে করতে কখনো রাত ১২টা আবার কখনো ১টা বাজে। তারপর মেয়ে আমার ঘুমাতে যায়। বাড়ির সবাই রাগ করে আমার উপর যে আমার বাড়াবাড়ির জন্ই নাকি এই অবস্থা!আমি শুনি আর লজ্জায় কুকড়ে যাই!মনে মনে ভাবি,আমি এমন কেন?কেন আর দশজনের মত সবকিছু স্বাভাবিকভাবে নিতে পারি না? মজার ব্যাপার হল,এখন আবার আমার মেয়ে ভাল পরীক্ষা না দিয়েও ভাল মার্ক্স নিয়ে পাশ করছে। এখন স্কুল মিস দিলে কিংবা কোচিং না করলেও কেউ বার বার ফোন করে কমপ্লেইন করে না যে সে কেন আসে না?এখন এডমিশনের পড়া না পড়লেও কেউ পানিশমন্ট দেয় না। বরং স্কুলে না গেলেও সে ঘরে বসেই সব পড়া পেয়ে যায়।

কোন রচনা পড়তে হবে,কোন কবিতাটা পড়ে গেলেই হবে সবই সে এখন আগে থেকে জানতে পারে। আমি ঠিক বুঝি না যে এটা কি ওর জন্য ভাল হচ্ছে নাকি খারাপ হচ্ছে। আমার বোধশক্তিও যেন আমি হারিয়ে ফেলেছি। আমি শুধু দিন গুনছি যে কবে ওর পরীক্ষা শেষ হবে!কারন বাংলা মিডিয়ামগুলোর পঙ্কিলতা আমার দেখা হয়ে গেছে। এই জিনিস হজম করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।

তাই ভাবছি পরীক্ষা শেষ হওয়া মাত্র তাকে ইংলিশ মিডিয়ামে নিয়ে যাব। যদিও সেখানেও তাকে কোচিং করতে হবে,কিন্তু ভাল রেজাল্টের জন্য ইদুর দৌড় সেখানে না করলেও চলবে। ্ফলে স্কুলের টিচারদের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে হবে না আমাকে। তার যা মেধা ঠিক সে অনুযায়ী সে পড়াশোনা করতে পারবে। আজ এই শিক্ষকদের জন্য আমাকে যে হয়রানির শিকার হতে হল,তার জন্য দায়ী কে?সরকার,বড় বড় বুদ্ধিজীবিরা নতুন নতুন শিক্ষাব্যাবস্থা চালু করছেন।

দেশকে ডিজিটাল করার চেষ্টা করছেন। ডঃমুহম্মদ জাফর ইকবাল তো ভাবছেন যে সৃজনশীল পদ্ধতির কারনে শিক্ষার্থীরা এখন আগের চেয়েও অনেক বেশি শিক্ষিত হচ্ছে!কিন্তু বাস্তবতা কি বলে?যতদিন শিক্ষকদের উপযুক্ত বেতন নিশ্চিত না করা হবে,যতদিন কোচিং ব্যাবস্থা বন্ধ না করা হবে,যতদিন বাইরের দেশগুলোর মত স্কুলেই সব পড়া শেষ করে আসার ব্যাবস্থা করা না হবে,ততদিন শিক্ষার্থীরা এভাবেই মুখস্ত বিদ্যার উপর নির্ভর করে চলবে। ফলে গাইড বই আর নোট খাতার কদর কখনোই কমবে না। আর সেই সুযোগে কিছু অসাধু শিক্ষক শিক্ষার্থীদের জিম্মি করে তাদের রক্ত চুষে খাবে। এতে কি দেশ এগিয়ে যাচ্ছে,নাকি পিছিয়ে?বাইরের দেশে তো শুনেছি কেউ ইচ্ছা করলেই যা খুশী তা পড়তে পারে না।

তাকে তার মেধা অনুযায়ী তার সাবজেক্ট দেয়া হয় পড়তে। কিন্তু আমাদের দেশে যার অঙ্কের মাথা নেই তাকে সাইন্স পড়ানোর জন্য কিরকম অমানবিকভাবে পড়ার চাপে রাখা হয়!ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার প্রতিযোগিতায় লাভবান হয় শিক্ষকেরা। তারা সুযোগ নেয় এইসব অভিবাবকদের এই প্রতিযোগিতার দুর্বলতার । আর এভাবেই সুযোগ নিতে নিতে একসময় তাদের লোভ এতই বেড়ে যায় যে শিক্ষাটা তখন আর তাদের কাছে নোবল প্রফেশন না হয়ে,হয়ে যায় টাকা কামানোর সহজ ব্যাবসা। আর তাদের বলির পাঠা হয় ছোট ছোট কোমলমতি শিশুরা।

এভাবেই মুখস্ত বিদ্যার উপর নির্ভর করে আর পরীক্ষার প্রশ্নপত্র আগেই পড়ে ফেলে বিকাশহীনভাবে বেড়ে উঠছে আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্ম। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।