আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বুড়ি বয়সে ছুঁড়ি

I am what I am and that's how I would be. No I am not stubborn. I just want to be myself. বয়স হয়ে যাচ্ছে। সত্যি? কথাটা কেন যেন মেলাতে পারিনা ভাবনাগুলোর সাথে। স্কুলে কিংবা কলেজে পড়ার সময় কোন এক বিনোদন ম্যাগাজিনে একবার পড়েছিলাম “ত্রিশে পা দিলেন সূবর্ণা। ” তখন মনে হয়েছিল “ত্রিশ?!! সে তো অ-নে-ক বয়স! সূবর্ণার বয়স এ-তো?!!” এই কথা মনে পড়লো যেদিন আমার ত্রিশ হলো। তখনও আমি গ্রামীণফোনে কাজ করি।

সকাল থেকেই ভাবছিলাম, আমি ত্রিশ, আই এম থার্টি। ফেইসবুকে সেরকম একটা স্ট্যাটাসও দিয়ে দিয়েছিলাম, দুইকন্যা-সন্তানের জননী একজন মধ্যবয়সী মহিলা আমি। ওয়াও, ম-হি-লা। বালিকা/কিশোরী/তরূণী কিংবা যুবতী-ও নই, এমনকি আমাকে কেউ “মেয়ে” বলেও সম্বোধন করবেনা, বলবে মহিলা। ছোটবেলায় খুব বড় হওয়ার স্বপ্ন দেখতাম।

কখন বড় হবো। কখন পড়াশুনা শেষ হবে। নিজের ইচ্ছেমত ঘর থেকে বের হওয়া যাবে। পকেটে টাকা থাকবে, একটা স্নিকার্স কিংবা আইসক্রীমের জন্য আম্মুর কাছে চাইতে হবেনা। যখন খুশী তখন টিভি দেখা যাবে, ঘন্টার পর ঘন্টা ফোনে আড্ডা মারা যাবে, কেউ নিষেধ করবেনা, কারণ আমি বড়! বালিকা বয়সে ভাবতাম কোনদিন আমি নিজে আম্মু হবো।

আমার কবে মেয়ে হবে। এটাও আশ্চর্য, স্বপ্ন দেখার বয়সে কোনওদিন মাথায় স্ট্রাইক করেনি আমার কবে ছেলে হবে। বরাবর নিজের সাথে আম্মুকে দেখে ভেবে এসেছি, আমি মেয়ের-মা হলে কেমন হবে!! আম্মু এটা-সেটা নিষেধ করে, আমি সেটা করবোনা, ইত্যাদি। আম্মুও বলতো, নিজে যেদিন মা-হবা, সেদিন বুঝবা, ইত্যাদি। সেদিন বলতে গেলে সারাদিন এই কথাই ভাবছিলাম, আমি তো ত্রিশে পা দিয়ে দিলাম।

খুব বড় হয়ে গেলাম কি?? এখন আমি আম্মু, এখন আমি মহিলা। ছোটবেলায় যে-যে কারণ থেকে আমার বড় হওয়ার স্বপ্ন ছিল, সবই এখন আমার হাতের নাগালে। খুব কি স্বাধীন হয়ে গেলাম? আছে তো পকেটে টাকা, পারি কি ইচ্ছেমত খরচ করতে? ঘর থেকে যখন খুশী বের হয়ে কি পারি যেখানে খুশী সেখানে যেতে? হয়ে তো যাচ্ছে অনেক বয়স, কই তবুও তো স্বপ্ন দেখা শেষ হয়না! স্বপ্ন এখনও পূরণ হয়নি আমার! আমি আজও ছোটবেলার মতই স্বপ্ন দেখি, কবে এমন করবো, কবে এটা-সেটা হবে। স্কুলের স্মৃতি রোমন্থন করতে গিয়ে সেদিন বাল্যবন্ধু বলেই বসলো, “সত্যি, তখন আমরা আসলে জানতামই না, জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়টা পার করছি!” এখন মনে হয়ে সেসময়টাই তো ভালো ছিল! নস্টালজিয়া। মানুষকে কাতর করে নস্টালজিয়া, যখন কিনা সে সামনে আগানোয় আগ্রহ কমিয়ে ফেলে।

বারবার পেছনে ছুটে যায় মন, অনাগত দিনগুলোকে নিয়ে যখন আর স্বপ্নেরা বাসা বাঁধেনা। কিন্তু আমার বেলায় এখনও স্বপ্নেরা রঙীন পাখা মেলে চোখের পাতায় নাচতে থাকে। বাধ সাধে এই বয়স। জিন্দেগী-না-মিলেগি-দোবারা মুভির সেনোরিটা গানটা মেয়েদের সাথে নিয়ে প্রায়ই দেখি, আর নাচি। আমরা তিনজনে একটা টিম।

যখনই সময় মেলে, তিনজনে একসাথে নাচি, গান গাই, অনেক গরম পড়লে একসাথে অসময়ে শাওয়ার নেই। মেয়ের স্কুলের বান্ধবীর মা, রুনা, আমাকে একদিন বাসায় এমন নাচতে দেখে বলে বসলো “বয়স হচ্ছে ভুলে যাচ্ছ?” বয়স!! বয়স কি আমার, নাকি আমি বয়সের? কে কোথায় লিখে রেখেছে বয়স-ভেদে কিভাবে বদলে যাবে মানবাচরণ? নিজের অজান্তেই শিস দিয়ে ফেলি এখনও। বয়স, আমাকে সেটা করতে দেবেনা। উচ্ছ্বসিত হয়ে লাফিয়ে হাততালি দেওয়া যাবেনা, বয়স বাড়লে সাথে গাম্ভীর্যের মুখোশ ফ্রী। বয়সের সাথে সাথে বাতের ব্যাথা হবে, চুল পেকে যাবে কিংবা পড়ে যাবে, আমি চাই বা না-চাই।

বয়সের মানে তো এইই। এরই সাথে, বয়সের মানে কি নিজেকে অনাগত বার্ধক্যের জন্যে তৈরী করা? বাতের ব্যাথা হবার আগেই নাচে ইস্তফা দেওয়া? মুখে ভাঁজ পড়ার আগেই মুখ কুঁচকে ফেলা? দু’বছর গ্যাপ দিয়ে নতুন কাজে যখন পুরোনো সহকর্মীদের সাথে আবার দেখা হলো, সেই একই কথা। “শাফ্ক্বাত তুমি কিন্তু এখন আর আগের বয়সটাতে নেই!” একটু ভাব ধরে না-চল্লে যেন আমার আচরণ বয়সের সাথে খাপ খায়না। খুব কাছের কেউ না-হলে কেন জানিনা ফোনে কথা বলতে ভালো লাগেনা। সামনাসামনি নতুন মানুষের সাথে আগের মত জমিয়ে আলাপ করতে পারিনা।

কোনও একটা টপিক কিংবা কমন ইন্টারেস্ট না-পেলে কারো সাথে কথা বলাই বাহুল্য মনে হয় আজকাল। যোগাযোগ রাখতে হবে বলেই রাখা, এমন আত্মীয়তা মাঝে মাঝে মাথাব্যাথার মত হয়ে দাঁড়ায়। এ-ও কি বয়সের লক্ষণ? নাকি এটাই স্বাভাবিক? অনলাইন যোগাযোগ বরং বেশ ভালো লাগে ইদানিং। কেউ নক করলো, ইচ্ছে হলে জবাব দিলাম, ইচ্ছে না-হলে দিলাম না। ইমেইল যোগাযোগ বরং স্বস্তিদায়ক, চাহিদার ভার অনেক কম।

যাহোক, এই অনলাইন যোগাযোগে এমন-এমন মানুষের সাথে নিত্য যোগাযোগ শুরু হলো, অবাক লাগে ভাবতে, আত্মীয়তার সূত্র তাদের সাথে খুবই ক্ষীণ, কিংবা নাই বললেই চলে। ভার্চুয়াল যোগাযোগে কেউ বয়সের কথা মনে করিয়ে দেয়না। বয়স বাড়ার সাথে সাথে আচরণ বদলানোর দায়বদ্ধতা নেই অনলাইন যোগাযোগে। কী অদ্ভূত ব্যাপার, একটি গায়েবী যোগাযোগ উপায় করে দিচ্ছে নিজের ভাবনা মত নিজেকে প্রকাশ করার। বয়স যেখানে কোনও নিষেধ নয়, যেখানে বয়স চাপিয়ে দিচ্ছেনা কোনও আড়াল।

কোনও মুরুব্বীসুলভ আচরণের বাহুল্য নেই, আমার চেয়ে ১০ বছরের কম বয়সী কাউকে যেখানে আদবকায়দার মাপকাঠিতে মাপা হবেনা। এই যে আদব-কায়দা, এটা কার জন্যে প্রযোজ্য? এই সীমারেখা টেনেছে কারা, এর শুরু কোথায়, এর শেষ কোথায়? শুধুই কি বয়স দিয়ে আচরণের সীমা টানা যায়? ভাইপোর বিয়ের জের ধরে সম্প্রতি শাশুড়ী হলাম। মুরুব্বী-পর্যায়ে চলে গেলাম হুট করে। নতুন বউ, বয়সে আমার চেয়ে বছর পাঁচেক ছোট হবে, নানাবিধ আদব-কায়দার মাধ্যমে আমাকে বেশ অস্বস্তির মধ্যে ফেলে দিল। এর চেয়েও বেশি অস্বস্তির কারণ হয়ে দাঁড়ালাম আমি নিজেই।

বেয়াইন-দের সাথে মানানসই শাড়ী পরতে হবে আমাকে, কামিজ পরবে বাচ্চারা। গায়ে হলুদ অনুষ্ঠানে, হুলস্থুল উল্লাসের মাঝে, শাড়ী পরা আমি মুরুব্বী হওয়ার সূত্র ধরে কপট গাম্ভীর্যে বসে ছিলাম। এক পর্যায়ে যা-থাকে কপালে, ভেবে কোমরে আঁচল পেঁচিয়ে নেমে পড়লাম ড্যান্সফ্লোরে। সাথে আমার সমবয়সী কিংবা অল্প-বয়সী সকলেই সম্পর্কে ছোট, আমি-ই কেবল মুরুব্বী। রাতভর তাদের সাথে নাচানাচির পরবর্তী আলোচনা-পর্যালোচনায় নাহয় আর নাইই গেলাম।

বেয়াইসাহেব আমার চাচা-মামার বয়সী, কিন্তু বিয়ের দিন তাদের সাথে তাল মিলিয়ে হাহা-হিহি করে ঠাট্টামস্করায় শামিল হলাম। বয়স-ছাপিয়ে এখানে তেড়েফুঁড়ে উঠছে কিছু সম্পর্কনির্ভর গৎবাঁধা আচরণবিধি। বয়স হয়ে না-গেলেও, তখন মনে হয় বুড়ো হয়ে যাচ্ছি। আজকে শাশুড়ী হলাম, কালকে নানী হবো। মুরুব্বীয়ানার পরত চাপাতে থাকবো হাবে-ভাবে, স্বপ্নদেখার বদলে আক্রান্ত হবো স্মৃতিকাতরতায়।

“আমাদের যূগে আমরা যখন খেলেছি পুতুল খেলা, তোমরা এ-যূগে সেই বয়সেই লেখাপড়া করো ম্যালা” গোছের বাণী শোনাতে থাকবো যখন-তখন। ভুলেও যদি কোমরে ওড়না পেঁচিয়ে বাচ্চাদের সাথে ক্রিকেটের ব্যাট হাতে ছক্কা পিটিয়ে ফেলি, আশেপাশে চোরাচোখে দ্রূত দেখে নেব, কেউ দেখে ফেল্লোনা তো! এই বয়সে, এসব কি মানায়? ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.