সন্ধ্যার আঁধারে আমি যদি হারিয়ে যাই বন্ধু, আমাকে মনে রেখো তোমার ঘরের ধূপ-আগরের সুবাসে- তোমার ঘরের প্রদীপের আলোয়, আমাকে ফেলে দিও না বাসি ফুলের মত। মনের ঘরেই রেখো বন্ধু পথের ধারের ফুলটি ভেবে। আমি যে জলসাঘরে ...www.jolsaghor.com খালপারের থুরথুরি বুড়ির বাড়িতে প্রতিদিন সকাল একটু আগেই হয়। কাক হয়তো তখনও ডাকেনি। মোরগটা হয়তো তখনও দিন শুরুর খবর পড়েনি।
বুড়ির ঘুম ভেঙ্গে যায়। বুড়ি উঠে পড়ে। বাইরে গিয়ে প্রাকৃতিক কাজ সারে। উঠোন ঝাট দেয়। এই কাজগুলো শেষ হলেই শুরু হয়- নাতনির উদ্দেশ্যে তার ভাষণ।
মাইলোনাউরি এখনও কিতা তোর ঘুম ভাঙছে নানি? কুড়িয়ার কুড়িয়া, তোর মা আছিল আরেক কুড়িয়া। ও লো ডেমসি-বান্দির ঝি উঠি যা। উঠি যা রে। মরি গেছত না কিতা বেড়বেড়াউরি। ওতো আরামর ঘুম তোর লাগে কিলা রে মরকিনাউরি।
এই যে ভাষণটা শুরু হয়, তা বেশ খানিকক্ষণ অবধি এক নাগাড়ে চলতে থাকে। নাম যেমন বুড়ির চলনও তেমন। আর বুড়ির মুখটাও খুব চলে বেশি। নাতনি জানে, এক কাপ চা না পেলে বুড়ির মন ভালো হয় না। এই যে গালাগালি তা মন থেকে নয়।
এক কাপ চা পেলে এক মুঠো মুড়ি নিয়ে বুড়ি দেউড়িতে বসে। মৃত ছেলেকে মনে করে। কোনদিন কাঁদে। কোনদিন সুখের স্মৃতি মনে করে হাসে। আর এই যে গালাগালি, কোনটাই মন থেকে নয়।
নাতনিও জানে। না হলে, মা-বাপ মরা মেয়েটিকে এতটা দিন কি আর সে আগলে রাখত। অন্য কেউ হলে কারও বাড়িতে কাজে দিয়ে দিত। বিয়ে-শাদিও দিয়ে দিত, গায়ে-গতরে নাতনি তো আর কম বাড়ে নাই। আলাপ যে আসেনি তাও নয়।
বস্তা ভরা টাকার বিনিময়ে খেদমতি বিয়ের প্রস্তাবও এসেছিল। বুড়ির এক কথা- দরকার অইলে ভিক্ষা করি খাইমু তবুতড়ি ইলাখান কাম করতাম নায়, নাতনি আমার হেদিনখানর। বয়স অউক, বিয়া দিমু। আমি মরি গেলে মায়-মুরুব্বি আছইন তাইনতাইন দেখবা।
প্রতিদিনকার চা পান পর্বের স্মৃতিরোমন্থনে সেদিনের বিষয় ছিল বাজার থেকে কিনে আনা বড় মাছ।
ছেলে বেঁচে থাকতে বড় বড় মাছ কিনে আনত। তাদের পরিবারে মানুষ বেশি ছিল না। বড় বড় মাছের টুকরো পাতে পড়ত। পানিকদু দিয়ে মাছের মাথা রান্না করত ছেলের বউ। বুড়ির পাতে দিত।
বউটা তার খুব লক্ষ্মী ছিল। চাঁদের মত সুন্দর ছিল। ছেলের বউয়ের কথা মনে হতে বুড়ি কাঁদল। সেই সাথে বুড়ির মনে পড়ল তার মেয়ের কথা। জন্মের পরপরেই যে মেয়ে মরে গিয়েছিল।
তার পরে বুড়ির আর কোন সন্তান হয়নি। অন্যদিন বুড়ি নিজে নিজেই বকবক করে চাল ধুতে চলে যায়। সেদিন নাতনিকে ডাকল। নাতনি তখন রাতের ঠাণ্ডা ঝোল চুলোয় গরম করছিল।
ও লো সোয়ারুন, হুনি যা।
তোর মা তোর থাকি আরও বেশি সুন্দর আছিল। তুই পাইছত তোর বাপর রঙ। আমার পুত কুনু দেখতে-উখতে অতো খারাপ আছিল না। ফুয়াইনতর মাঝে রাজপুত্রর লাখান আছিল। তুই কপাল পুড়ি রে বইন, তোর মায়-বাপে আমার টাইন তোরে তইয়া গেল।
তোরে কিতা আর খাবাই, কিতা ফিন্দাই। গাল্লাই-অউত্তো হারাদিন। বইনরে মরি গেলে গাইল্লাইছ না। আইজ আমার শরিল অতো ভালা লাগের না রে। কাইল রাইত তোর বাপরে স্বপ্নে দেখছি।
হে ডাকের আইয়া আমারে। আম্মাগো, খই তুমি। ঘর থাকি বার অও। তোর মারেও দেখলাম। আমারে খর- আম্মা ভাত বাড়িলাইছি, আইওইন খাইলিবা।
কথা বলতে বলতে, স্মৃতি রোমন্থন করতে করতে বুড়ি সেদিন অনেকক্ষণ কাঁদল। নাতনিও কাঁদল। সেদিন অনেক দেরীতে ঘাটে চাল ধুতে গেল। আগের দিন সন্ধ্যায় পুতে রাখা বরশী তুলতে গিয়ে বুড়ি দেখল মাছ লেগে আছে। বড়সড় একটা মাগুর মাছ লেগেছিল।
বুড়ি চাল ধুয়ে মাছ সাথে নিয়ে ফিরল।
সিদ্ধ আলু আর লঙ পাতা দিয়ে রান্না করা মাছের ঝুল দিয়ে বুড়ি পেট পুরে খেল। নাতনির অনেক প্রশংসা করল সেদিন। দোয়া করল। যেন সুখে শান্তিতে সংসার করে।
খেয়ে দেয়ে মুখে পান-সুপারি-চুন-জর্দা পুরে বুড়ি পাশের বাড়ি চলল। পাশের বাড়ির নাম মিঞা বাড়ি। সম্ভ্রান্ত পরিবার, প্রতাপশালী। তাদেরই ছত্রছায়ায় বুড়ি উঠতি বয়সী নাতনিকে নিয়ে নির্ঝঞ্ঝাট ছিল। বুড়ির কিছু জমি আছে, কাগজপত্র মিঞা বাড়িতেই থাকে।
তাদের বর্গাদার বুড়ির জমি চাষ করে দেয়, ফসল উঠলে অর্ধেক ফসল দিয়ে যায়।
মিঞার বিবি রান্না ঘরে বসে রান্নার ফরমায়েশ দিচ্ছিলেন বউদের। বুড়িকে দেখে বললেন- কিতা গো মায়ারুন, লাগা বাড়ি অইয়াও দেখি তুমি বিদেশী অই গেলায়। অতোদিন বাদে মনে অইলোনি?
না গো বুয়াই, আর মাতিও না। আগর লাখান জোর পাই না।
অন থাকি অনো আটিয়া যাইতাম পারি না। শাস মারা দরে। অউ তুড়া জেগা আটিয়া আইয়া বুদ পাইয়ার দম বন্ধ অই যার। মনো অয় আর বেশিদিন বাচতাম নায়।
ইতা কিতা খইরে গো বইন, তোর বয়স আর কতখান অইছে।
তোর বিয়া দেখলাম। লাগের হেদিনখানর মাত। মনো আছেনি, তুই লাল ডুরা শাড়ি ফিন্দিয়া আমরার বাড়িত আইছলে। যেলাখান সুন্দর আছলে গো বইন তুই। তোর মিঞা ভাইয়ে খইছলা, আগে পাইলে তোরেউ বিয়া করলা নে।
বুড়ি লজ্জা পেল। তার মনে প্রথম জীবনের স্মৃতিগুলো স্পষ্ট হয়ে উঠলো। যেন- এইতো সে লাল পেড়ে শাড়ী পড়েছে। নতুন বউয়ের মত হেঁটে যাচ্ছে। ঘোমটা পড়ছে কি না- সেই ভয় লেগে আছে।
হাঁটতে গেলে শাড়ী পায়ে বেড় দিচ্ছে। পাড়ার বউ-ঝিরা কাছে এসে ঘোমটা তোলে মুখ দেখছে। ঠাট্টা করছে। বুড়ি অন্যমনস্ক হয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। বিবির কথায় সম্বিত ফিরে পেল।
কিতার লাগি আইছতগো বইন খো তে অখন?
বুয়াই, কুনতার লাগি নায়। আইছলাম এখান মাত মাতিতাম। বউত দিন দরি মনর মাঝে ঘুরার।
কিতা তে খইলা। আমার গেছে শরমানির কিতা।
না বুয়াই শরমানির নায়। তুমরা তো জানউ- সোয়ারুন এতিম পুড়ি। আমি বাদে দেখার আর কেউ নাই। যদি কুনুদিন আমার কিচ্ছু অই যায়, বুয়াই তুমিতাইন তাইরে দেখিয়া রাখিও?
ইতা কিতা মাতছ গো ধন, তাই কিতা আমার পর নি? আর তুই মরতে কিতা লো। অখনউ হাজাইলে বেটাইন পাগল অইজিবা।
বিবি ঠাট্টার কথা বললেন। সবাই হাসল। সাথে বুড়িও। চা-পান খেয়ে, অনেকক্ষণ গল্প করে সে বাড়ি ফিরল।
বিকেলে উঠোনে বসে বুড়ি নাতনির চুল আঁচড়ে দিল।
উকুন বেছে দিল। বুড়ি তার জোয়ান কালের গল্প করল। সোয়ারুনের দাদাজান কিভাবে তাকে দেখলেন। কিভাবে বিয়ের প্রস্তাব গেল। বিয়ের দিনের কথা, দাম্পত্য জীবনের কথা।
সব গল্পের সাথে ছিল নাতনির জন্য উপদেশ।
বইনরে, বেটা মাইনসর মন অইলো খানির মাঝে। ভালা করি রান্ধিবায়, কিয়াল খরি খাওয়াইবায়। দুনিয়ার রাগ মাথাত থাকলেও পানি অইজিবো। কাম-কাজ থাকি আইলে রে বইন কুনতা মাতাত যাইও না।
মাথা গরম থাকে তারার। ভালা মাত মাতিলেও ঘেটকি মারব। হক্কলতা আগে থাকি জুইত করি রাখিও। দেখবায় সংসারো ঝামেলা লাগতো নায়। জামাইয়ে মায়া করবো।
দাদীর কথা নাতনি চুপ করে শুনে যায়। স্বপ্ন দেখে। দাদীর কথামতো দৃশ্যগুলো তার চোখে ভাসতে থাকে। গল্পে-গল্পে, সপ্ন দেখাদেখিতে সন্ধ্যে হয়।
বুড়ি খুব সকালে যেমন ঘুম থেকে জাগে।
সন্ধ্যের একটু পরেই খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। কবিতার মত- ‘পাখির ডাকে ঘুমিয়ে পড়ে পাখির ডাকে জাগে’।
মিঞা বাড়ি থেকে পাওয়া মোরগের মাংস দিয়ে দাদী-নাতনি পেট পুরে খেল। শিয়রের কাছে কুপি আর দিয়াশলাই রেখে, কুপি নিভিয়ে শুয়ে পড়ল দুজন।
পরদিন সকালে, বুড়ি আর আগে আগে ঘুম থেকে জাগল না।
নাতনি অপেক্ষায় ছিল গালি শুনার। কেউ গালি দিল না। নাতনি ভাবল, আজ দাদীকে কথা শুনাবে সে। আলসেমিতে আরও কিছুক্ষণ মুখে ঢেকে শুয়ে থাকল সে।
কিছুক্ষণ পরে নাতনির চিৎকারে মিঞাবাড়ির লোকজন ছুটে এলেন।
কান্না প্লাবিত গলায় একটা কথাই বারবার ভেসে আসছিল-
ও দাদী গো, আমারে তইয়া তুমি কই গেলায় গো...
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।