আমি লেখক খারাপ হতে পারি কিন্তু ছেলে ভাল ছেলেটার নাম কাব্য। বয়স দশ।
মাথার চুল উশকু খুশক। বড় বড় চোখ।
বেশ মায়া কাড়া চেহারা।
ড জিয়া জিজ্ঞেস করলেন, “আজ কেমন আছ কাব্য?”
কাব্য আস্তে মাথা ঝাকাল, কোন কথা বলল না। ছেলেটা কথাবার্তা খুব কম বলে, বেশির ভাগ প্রশ্নের উত্তরেই মাথা ঝাঁকায়।
ড জিয়া বললেন, “তুমি মাথা ঝাঁকালে যার মানে ভাল বা খারাপ দুটোই হতে পারে, তাই না?”
কাব্য উত্তর দেয় না।
“তাহলে কি আমি ধরে নেব তুমি আজ ভালো নেই?”
“আমি ভাল আছি। ” অরুন খুব আস্তে জবাব দিল।
“খুব ভালো। তোমার জন্যে আজ একটা সুখবর আছে। আমি বিদায় নেবার আগে তোমাকে সুখবরটা দিয়ে যাব। ”
কাব্য আস্তে মাথা কাত করল। ছেলেটা খুব সহজেই সব কিছু মেনে নেয়।
“এখন বল দুপুরের খাওয়া হয়েছে?”
কাব্য মাথা নাড়ল, হয়নি।
“সেকি, কেন?”
কাব্য জবাব দেয় না।
“খাওয়া নিয়ে অনিয়ম করা তো একদম ভালো কথা নয়। আমি চলে গেলেই তুমি খেতে বসবে, ঠিক আছে?”
কাব্য আবার মাথা কাত করে সম্মতি জানাল। ড জিয়া অবশ্য জানেন ছেলেটা কথা রাখবে না।
মা বেঁচে থকতেই সে খয়া নিয়ে বেশ যন্ত্রনা করত। মা মারা যাওয়ার পর ছেলেটা খাওয়া দাওয়া একদম ছেরেই দিয়েছে। অবশ্য এর একটা সমাধান জিয়া আজকে সাথে কতে নিয়ে এসেছেন। তার ধারনা এতে কাজ হবে।
“এবার বল সারা দিন কি কি করলে?”
কাব্য এবার একটু সমস্যায় পরে গেল।
এই প্রশ্নের উত্তর মাথা ঝাকিয়ে দেয়া সম্ভব না।
ড জিয়া সাহাজ্য করলেন, “আজকে নতুন কোন ছবি এঁকেছ?”
কাব্য মাথা ঝাঁকাল।
“কিসের ছবি? নিয়ে এসো তো দেখি?”
কাব্যর ছবি দেখানোর খুব একটা আগ্রহ নেই। তবুও বাধ্য হয়েই উঠে গেল।
ড জিয়া প্রায় আধ ঘণ্টা কাব্যর সাথে কথা বললেন।
তারপর কাঁচ ঘেরা ঘরটা থেকে বাইরে এলেন। বাহিরে তার জন্যে শাহবাগ থানার সাব ইনস্পেক্টর বেলাল অপেক্ষা করছিলেন। তিনি বের হতেই বেলাল তাকে চেপে ধরলেন।
“কি বুঝলেন ডক্টর?”
“আমি এখন প্রিলিমিনারি পর্যায়ে আছি। খুব তাড়াতাড়ি কোন মেজর ব্রেকথ্রু আশা করা ঠিক হবে না।
”
“কিন্তু আমার হাতে তো আর সময় নেই। ”
“এই ধরনের কেসে সময় তো দিতেই হয়। ”
“আমাকে আর হপ্তা দেরেকের মধ্যে চার্জ সিট দিতে হবে। আমি হাতে আসামি নিয়ে বসে আছি, কিন্তু কাঁধের উপর থেকে ঝামেলা সরাতে পারছি না। মিডিয়াগুলোও যা হয়েছে, পারলে আমাদের ছিঁড়ে খায় আরকি!”
“অধৈর্য হবেন না।
আর শুনুন এই প্যকেটটা ধরুন। এতে ডোরেমন এর পাঁচটা সিডি আছে। বাচ্চাটাকে এগুলো চালিয়ে দেখান। আর যতক্ষণ ও কার্টুন দেখবে তার পুরো সময়ের ভিডিও করার ব্যবস্থা করুন। দুটো ক্যমেরা রাখবেন, একটা ওর মুখের ক্লোজ আপ সট নেবে, আরেকটাতে ওর পুরো বডি ধরা পড়তে হবে।
”
“আপনি তো অর্ডার দিয়েই খালাস। আমি এতো আয়োজন কিভাবে করব?”
“তদন্তের সার্থেই এসব করতে হবে। ”
“দেখুন, ডক্টর আমার কাছে মনে হচ্ছে তদন্তের চেয়ে আপনি আপনার গবেষণাকে বেশি প্রাধান্য দিচ্ছেন”
“একজন সাইকিয়াট্রিস্ট হিসেবে আমার যে এব্যপারে কোন একাডেমিক আগ্রহ নেই তা বলব না, তবে আপনি নিশ্চিত থাকুন তদন্তটাই আমার কাছে সবার আগে। ”
ড জিয়া হাঁটা ধরলেন। তার মুখে একটা চিকন হাসি।
কিসের তদন্ত, তিনি তার লাইফের সবচে ইন্টারেস্টিং কেসটা পেয়েছেন। যত দেরিতে কনভিকশন হয় ততই ভালো, অরুনকে আরও সময় নিয়ে স্টাডি করা দরকার।
ইনস্পেক্টর বেলাল চিন্তিত মুখে জিয়ার গমন পথের দিকে তাকিয়ে আছেন। লোকটার ভাবগতিক সুবিধার ঠেকছে না। তিনি পড়েছেন মহা ঝামেলায়।
ছেলে তার বাবাকে খুন করে ফেলেছে। মাঝ রাতে দাদা দাদিকে ঘুম থেকে ডেকে তুলে বলেছে, বাবাকে খুন করে ফেললাম। ছেলের হাতে তখন রক্ত মাখা বড় একটা ছুরি। সবি ঠিক আছে। আসামি নিজের মুখে খুনের কথা সিকার করেছে।
খুনের মোটিভ ও পরিষ্কার, ছেলে দিনের পর দিন বাবার হাতে মা’কে এবিউজড হতে দেখেছে। অবশেষে যখন মা গলায় ওড়না পেঁচিয়ে আত্মহত্যা করল, তখন ছেলেও মাথা খারাপ করে বাপকে খুন করে ফেলল। কিন্তু ঝামেলা শুরু করল মিডিয়াগুলা। তাদের কথা দশ বছরের একটা ছেলের পক্ষে এভাবে বাপকে খুন করা সম্ভব না। নিহত বাবার শরিরের অন্তত দশ জায়গায় ছুরির আঘাত দেখা গেছে।
একটা বাচ্চা ছেলে কোন রকম প্রতিরোধ ছাড়াই এতবার একজন পুর্ন বয়স্ক মানুষকে এতবার আঘাত করতে পার না। আর পাশের ঘরেই দাদা দাদি ঘুমিয়ে ছিল। এত ভয়ানক একটা হত্যাকান্ড ঘটে গেল অথচ তারা কিছুই টের পেল নাএইতা কি করে সম্ভব। দুষ্ট মিডিয়া গুজব ছরাচ্ছে বিশেষ কোন মহলের ইশারায় আসল ঘটনা চেপে গিয়ে পুলিশ একটা দশ বছরের ছেলের বিরুদ্ধে হস্যকর একটা কেস সাজাতে চাইছে। এর পেছনে তারা বিশাল রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের ইংগিত পেয়েছে।
যত্তসব। সত্যি কথা হচ্ছে এই ছেলেটা ছাড়া পুলিশের হাতে আর কোন সাসপেক্টই নেই। ইনস্পেক্টর বেলাল মিডিয়া আর উপর হল দুই পক্ষের থকেই ভীষণ চাপের মধ্যে আছেন।
বেলালের মোবাইল ফোনের ম্যসেজ এল্যার্ট বেজে উঠল। পলি ম্যসেজ পাঠিয়েছে।
আজ রাত নয়টায় দেখা করতে বলছে।
বেলাল একটা নিঃশ্বাস ফেললেন। পলির কাছে যাওয়া ঠিক না। খারাপ মেয়ে। কিন্তু বেলালের উপায় নেই।
এত টেনশনের মধ্যে এই পলির কাছে গিয়েই তিনি খনিকের সস্তি পান। এই যে পলির ম্যসেজটা দেখেই তার শরীর সিরসির করছে। শরিরের প্রতিটি কোষে ভালো লাগার অনুভূতি ছরিয়ে পড়ছে। বেলাল একটা অদৃশ্য জালে জরিয়ে পড়ছেন, এর থেকে তিনি মুক্তি পেতে চান না।
***
ড জিয়া তার স্টাডি রুমে সোফায় আধশোয়া হয়ে আছেন।
তার হাতে একটি টেপ রেকর্ডার। এতে অরুণের সাথে তার সবগুলো কথোপকথন রেকর্ড করা আছে। তিনি তাদের দ্বিতীয় কথোপকথনটি চালু করলেন।
ড জিয়াঃ কাব্য তুমি জান তোমার বাবার কি হয়েছে?
কাব্যঃ ...... (সে মাথা ঝাকিয়ে হ্যাঁ সুচক জবাব দেয়)
ড জিয়াঃ বলতো বাবার কি হয়েছে?
কাব্যঃ বাবা মরে গেছে
ড জিয়াঃ তুমি জান বাবা কিভাবে মারা গেছেন?
কাব্যঃ ...... (হ্যাঁ সুচক মাথা নাড়ানো)
ড জিয়াঃ তাহলে আমাকে বল।
কাব্যঃ তুমি তো জান আমার বাবা কিভাবে মারা গেছে।
ড জিয়াঃ হ্যাঁ, তোমার পুলিশ আঙ্কেল আমাকে বলেছে। তবুও আমি তোমার মুখ থাকে শুনতে চাচ্ছি। তুমি কি আমাকে সেই রাতের ঘটনাটা খুলে বলবে?
কাব্যঃ তখন রাত একটা বাজে।
ড জিয়াঃ তুমি কি ঘড়ি দেখেছিলে?
কাব্যঃ না, কিন্তু আমি জানতাম।
ড জিয়াঃ আচ্ছা তারপর?
কাব্যঃ আমার কিছুতেই ঘুম আসছিল না।
সেদিন সারাদিন বাসায় অনেক মানুষ ছিল। অনেক হইচই। মা মরে গেছে। সবাই মাকে দেখতে আসছে। নানা নানু আমাকে সাথে করে নিয়ে যেতে চাইল।
বাবা আর দাদা আমাকে কিছুতেই ওদের সাথে যেতে দেবে না। কত পুলিশ! কত ক্যমেরা!
ড জিয়াঃ তারপর?
কাব্যঃ রাতে আমার ঘুম আসছে না। মা নেই, মা সব সময় মাকে ঘুম পারিয়ে দেয়। আজকে মা নেই। ... আমার ঘুম আসছে না।
এই সময় ডোরেমন আমার কাছে এল।
ড জিয়াঃ ডোরেমন কে?
কাব্যঃ তুমি ডোরেমনকে চেন না? নোবিতার বিড়াল। ঐ যে ডিজনি চ্যনেলে দেখায়।
ড জিয়াঃ ওহ আমি তো ডিজনি চ্যনেল দেখি না। এটা কি তোমার প্রিয় কার্টুন?
কাব্যঃ ... (হ্যাঁ সুচক মাথা ঝাঁকানো)
ড জিয়াঃ ডোরেমন কি মাঝে মাঝেই তোমার কাছে আসে?
কাব্যঃ সবসময় আসে না।
আমার মন খারাপ থাকলে আসে। কিন্তু ডোরেমন আমাকে কোন গ্যজেট দিতে পারে না। শুধু সান্ত্বনা দেয়।
ড জিয়াঃ আচ্ছা আচ্ছা, তারপর বল ঐ রাতে কি হল।
কাব্যঃ ডোরেমন আমাকে বলল যে আমার মা এমনি এমনি মারা যায়নি।
বাবাই মাকে কষ্ট দিয়ে দিয়ে মেরে ফেলেছে।
ড জিয়াঃ তাই?
কাব্যঃ হু। তারপর ডোরেমন আমাকে বলল আম্মুর জন্যে আমাকে একটা কাজ করতে হবে। আমি যদি কাজটা করতে পারি তাহলে আম্মু অনেক খুশী হবে। আম্মুর আর কোন দুঃখ থাকবে না।
ডোরেমন বলল কিচেনে গিয়ে বড় দেখে একটা ছুরি বেছে নিতে।
ড জিয়াঃ তারপর?
কাব্যঃ আমি বড় একটা ছুরি খুঁজে বের করলাম। আম্মুর মাংস কাটার ছুরিটা। ডোরেমন এবার বলল ওর পেছন পেছন বাবার ঘরে যেতে।
ড জিয়াঃ আচ্ছা, তুমি কি ডোরেমনের কথা কখনো আর কাউকে বলেছ?
কাব্যঃ মা’কে বলেছিলাম।
ড জিয়াঃ মা কি বলল?
কাব্যঃ মা কিছু বলেনি। শুধু হেসেছে।
ড জিয়াঃ তোমার স্কুলের কোন বন্ধুকে বলনি?
কাব্যঃ নাহ স্কুলের ওরা তো আমার কথা বিশ্বাসই করবে না।
জিয়া টেপ বন্ধ করে দিলেন। ডোরেমনের পাঁচটা সিডি তিনি কিনেছেন।
আজ সারা রাত এগুল দেখার প্লান আছে। তিনি ডভিডি প্লেয়ার চালিয়ে দিলেন। ডোরেমন বাচ্চাদের কাছে অসম্ভব জনপ্রিয় একটা কার্টুন। বিশেষ করে চার থেকে দশ এগার বছরের বাচ্চারা এই কার্টুনের জন্যে পাগল। জাপানি এই কার্টুনটি হিন্দি ভাষায় অনুবাদ করে ডিজনি চ্যনেলে দেখানো হয়।
কার্টুনের কাহিনি মুলত নোবিতা নামের এক নয় দশ বছরের বাচ্চাকে নিয়ে। নোবিতার আছে ডোরেমন নামের এক রোবট বিড়াল, যে কিনা ভবিষ্যৎ থেকে এসেছে। নোবিতা ভীষণ আলসে প্রকৃতির ছেলে; পড়াশোনা, বাড়ির কাজ কিছুতেই তার মন নেই। প্রায়ই সে ইস্কুলে বা পাড়ার ছেলেদের কাছে বিপদে পরে যায়। আর তাকে উদ্ধার করতে এগিয়ে আসে ডোরেমন।
ডোরেমন নানা ধরনের ইলেকট্রিক গ্যজেট দিয়ে নোবিতাকে বিপদ থেকে উদ্ধার পেতে সাহাজ্য করে। সংক্ষেপে এই হচ্ছে ডোরেমন এর কাহিনী। কার্টুনটিতে বাচ্চাদের ফ্যন্টাসিকে চমৎকার ভাবে তুলে আনা হয়েছে।
কার্টুন দেখতে দেখতে কখন যে জিয়ার চোখ লেগে এল তিনি বলতেও পারবেন না। ঘুমের মাঝে তিনি দেখলেন তিনি আবার তার শৈশবে ফিরে গেছেন।
হাফ প্যন্ট পরে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। তার সাথে আছে ডোরেমন। তারা দুজন দারুন আনন্দ করছেন; গাছে চরছেন, পুকুরে ঝাঁপিয়ে পড়ছেন, বড়ই টোকাচ্ছেন। এমনি সময় গ্রামের দুষ্টু ছেলে আকবর ও তার দল ওদের ঘিরে ধরল। হাতের বড়ই গুলো সব দিয়ে দিতে বলল।
দশ বছরের জিয়া অসহায়ের মত ডোরেমনের দিকে তাকাল। ডোরেমন তাকে বলল চিন্তা কর না, এক্ষুনি আকবরকে শায়েস্তা করছি। ডোরেমন তার পকেট থেকে ধারাল এক চাপাতি বের করল। তারপর কচু গাছ কাটার মত করে সাই সাই কোপে আকবর আর তার দলবলকে টুকরো টুকরো করে ফেলল।
চমকে গিয়ে ড জিয়া জেগে উঠলেন।
তার শরীর ঘামে ভিজে গেছে। ঘর অন্ধকার। শুধু টিভিটা থেকে যা একটু আলো আসছে। টিভির স্ক্রিন জুরে শুধুই ঝির ঝির। জিয়া বাতি জালাতে উঠে বসতে গিয়ে আবিস্কার করলেন তিনি হাত পা নারাতে পারছেন না।
তার শরীর যেন একটা জড় বস্তুতে রূপান্তরিত হয়েছে। টিভির আবছা আলোয় তিনি ঘরের মাঝে কাব্যকে দেখতে পেলেন। ছেলেটার হাতে একটা মস্ত বড় ছুরি। সে এক দৃষ্টিতে জিয়ার দিকে তাকিয়ে আছে।
জিয়া কাব্যকে ডাকার চেষ্টা করলেন।
তার গলা দিয়ে কোন শব্দ বের হল না। ছেলেটা এখন তার দিকে এক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। চোখের পলক পর্যন্ত ফেলছে না। নড়ে না কেন ছেলেটা!!?
মোবাইল ফোনের রিঙয়ের শব্দে ঝাকি খেয়ে জিয়া বাস্তবে ফিরে এলেন। স্তাডির বাতি জলছে।
টিভিও ঠিকঠাক চলছে। ঘরে কাব্যের কোন চিহ্ন ও নেই। জিয়া বুঝতে পারলেন আসলে তিনি পুরোটাই সপ্ন দেখেছেন। তার জেগে উঠাটা ছিল নতুন একটা দুঃস্বপ্নের শুরু।
মোবাইল ফোনটা বেজেই চলেছে।
ঘড়ির কাটায় রাত পৌনে চারটা। তিনি উঠে গিয়ে ফোন ধরলেন।
ওপাশ থেকে ইনস্পেকটর বেলালের কণ্ঠ ভেসে এল, “হ্যলো হ্যলো ড জিয়া। সর্বনাশ হয়েছে। কাব্য কাস্টডি থেকে পালিয়েছে।
”
***
অন্তু ভয়ে কাঁপছে। বাবা কি আজ মা’কে মেরেই ফেলবে!
বাবা মা’র ঘরের দরোজাটা সামান্য ফাঁক করা। অন্তু সেখান দিয়ে দুরু দুরু বুকে উঁকি মারছে। তার ভীষণ ইচ্ছে করছে চোখ ঢেকে ছুটে পালিয়ে যেতে। কিন্তু সে নড়তে পারছে না।
কি এক ভয়ঙ্কর কৌতুহল তাকে বাধ্য করছে দরোজার পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে।
বাবা ম’কে মেঝেতে ফেলে লাথি মারছে। মা’এর শাড়ি অর্ধেক খুলে এসেছে, নাক মুখ থেঁতলে গেছে। বাবা এবার মা’এর বুকে পা দিয়ে মেঝের সাথে চেপে ধরল। মা নিঃশ্বাস নিতে পারছে না! অন্তু আর সহ্য করতে পারল না।
এক ছুটে ঘরে ঢুকে বাবার পা চেপে ধরল।
“বাবা বাবা প্লিজ ম’কে আজ ছেরে দাও। মা মরে যাচ্ছে!” অন্তুর দুই চোখ দিয়ে অঝোরে পানি পড়ছে।
বাবা অন্তুর দিকে ঘুরে তাকালেন। কি শিতল সেই চোখের দৃষ্টি!!
চুলের মুঠি ধরে অন্তকে তার বাবা দার করালেন।
দাড়াতেই বাবার মুখ থেকে অন্ত মদের গন্ধ পেল। মদ খেলে বাবা প্রায় পশুর মত হয়ে যায়। চুল ধরে অন্তর মুখটা বাবা নিজের আর ও কাছাকাছি নিয়ে এলেন। পর মুহুর্তেই প্রচন্ড একটা ঘুষিতে অন্তু ঘরের কোনায় ছিটকে পড়ল। ওর পৃথিবী আঁধার হয়ে এল।
***
“ডক্টর সাহেব, এখন গবেষণার সময় নয়। বাচ্চাটাকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব খুঁজে বের করতে হবে। খবরটা মিডিয়ার কাছ থেকে বেশি সময় গোপন রাখা যাবে না। ওরা যদি জানতে পারে যে এতগুলা পুলিশের পাহারা থেকে দশ বছরের একটা বাচ্চা পালিয়েছে তাহলে আমাদের একে বারে নেংটো করে ছাড়বে। ” ইনস্পেকটর বেলাল অধৈর্য হয়ে বললেন।
ড জিয়ার চোখ তখন টিভি স্ক্রিনের দিকে। গতকাল কাব্য যতক্ষণ ডোরেমনের কার্টুন দেখেছে পুরো সময়টা ওকে নির্দেশ মত ভিডিও করা হয়েছে। জিয়া এখন বসে বসে সেই ভিডিও দেখছেন। তিনি টিভির থেকে দৃষ্টি না সরিয়েই বললেন, “আপনি এখন আমাকে কি করতে বলেন? ”
“আরে আপনি ওর সাইকিয়াট্রিস্ট। আপনি আমাদের একটা ধারনা দেন ও এই মুহুর্তে কোথায় যেতে পারে।
” বিরক্তিতে বেলালের মুখ কুচকে আছে।
“আমি আসলে সেটাই বুঝতে চেষ্টা করছি। আপনি এক কাজ করুন, আপনি আপনার মত করে খোঁজ খবর করুন। আমি কিছু বুঝতে পারলে আপনাকে সাথে সাথে জানাব। ”
বেলাল অসন্তুষ্ট মুখে উঠে গেলেন।
তার কিচ্ছু ভালো লাগছে না। পলির ওখানে যেতে মন চাইছে। কিন্তু চাইলেই এখন যাওয়া যাবে না।
জিয়া আবার টিভির স্ক্রিনে মনযোগ ফেরালেন। তার মন বলছে কাব্য এখন কোথায় আছে তার উত্তর লুকানো আছে এই ভিডিও তে।
তিনি একটা ভুল করে ফেলেছেন। কাব্যর মুখের অভিব্যক্তি ভিডিও করেছেন কিন্তু কার্টুনের ঠিক কোন দৃশ্যটি দেখে এই অভিব্যক্তি আসছে সেটা ভিডিও তে ধরা পড়ছে না।
***
কাব্য একা ছাদে শুয়ে আছে। তার দৃষ্টি উর্ধের রাতের কালো আকাশে লক্ষ কোটি তারার দিকে। একটু আগে বৃষ্টি হয়ে গেছে, ছাদ ভেজা।
ভেজা ছাদে শুয়ে থাকতে কাব্যর খারাপ লাগছে না। ডোরেমন এসেছে। তার পাশে বসে আছে। ডোরেমনের মন ভালো নেই। কাব্য জিজ্ঞেস করল, “তোমার মন খারাপ কেন বল তো, আম্মুর জন্যে?”
“হু” ডোরেমন মাথা ঝাঁকায়।
“কার ও আম্মু কি আর সারা জীবন বেঁচে থাকে বোকা। আমরা এখন বড় হয়েছি না, এখন আম্মুকে ছাড়াই আমাদের বড় হতে হবে বুঝেছ?”
ডোরেমন বলে, “আমি বড় হতে চেই না। আমি আম্মুর কাছে যেতে চাই। “
“আম্মুর কাছে কি করে যাবে? আম্মু এখন ওই আকাশের উপরে চলে গেছে। ”
“তুমি খুব দুষ্টু ছেলে তো, তাই তোমার আম্মু মরে গেছে।
”
“এই তুমি এই কথা কেন বলছ? তুমিই তো বলেছ আম্মুকে আব্বু মেরে ফেলেছে। ”
“তুমি খুব দুষ্টু ছেলে। আম্মুকে আব্বু কত কষ্ট দিত, কিন্তু তুমি কিছুই করনি। ”
“আমি কি করতে পারতাম?”
“সেটা আমি কি জানি! তুমি কোন কাজের না। ”
***
অন্তু বিছানায় চাদরে মুখ গুজে শুয়ে আছে।
তাদের বাসায় ধুন্ধুমার কান্ড লেগে গেছে। বাবা বাসায় ফিরে আজ ভীষণ খেপে গেছে। গ্লাস প্লেট ভাংচুর করেছে। আম্মু কান্নাকাটি করছে। পাশের ঘর থেকে আম্মুর কাতর কণ্ঠ একটু একটু শোনা যাচ্ছে।
“তুমি আজকে আবার ওই মেয়ে লোকটার কাছে গিয়েছিলে, তাই না?”
“এই খবর্দার, তোকে বলেছিলাম না পলির ব্যপারে কোন কথা বলবি না। ” বাবার গর্জন শোনা যায়।
“ওই বাজারের মেয়ে লোকটার কাছে তুমি বারবার কেন যাও। তোমার নিজের সংসারের চেয়ে ওই মেয়েটা তোমার কাছে বড় হল! কি সুখ পাও ওই মাগির কাছে?”
“ওই খানকি, খবর্দার পলিকে নিয়ে বাজে কথা বলবি না। ”
“একশ বার বলব।
তুমি আজ আমাকে মার-কাট যা খুশী কর কিন্তু আমার মুখ চাপা দিতে পারবে না। পলি একটা বেশ্যা মাগি, বেশ্যা মাগি। ”
“ওরে ......মারানি...”
এই সময় অন্তুকে কেযেন ডাকল। “অন্তু, অন্তু...”
কে কে?? কাব্য চমকে এদিক অদিক তাকাল।
“অন্তু, এদিকে তাকাও।
আমি এখানে। ”
অন্তু কণ্ঠের মালিককে দেখতে পেল।
“আমাকে চিনতে পারছ?”
“হ্যা, তুমি ডোরেমন”
“তোমার কি ভয় লাগছে?”
“হু”
“ভয়ের কিছু নেই, আমি আছি না”
“আমার ভয় লাগছে। ”
“তোমার আম্মুর ভীষণ বিপদ”
“হু”
“আম্মুকে বাঁচাতে হবে। ”
“আমি কি করব?”
“আমি বলছি, তুমি শুধু আমার কথা মত কাজ করবে।
ঠিক আছে?”
“আচ্ছা। ”
“এখন তোমাকে বড় দেখে একটা ধারালো ছুরি খুঁজে বের করতে হবে। তোমাদের বাসায় বড় ছুরি আছে না?”
“না। ”
“ছুরি না থাকলে রান্নাঘরে বটি আছে না। ধারালো বটি হলেও চলবে।
”
“বটি আছে। ”
“তাহলে তুমি বটিটা নাও তারপর তোমার বাবার কাছে যাও। ”
“আমার ভয় করছে। ”
“ভয়ের কিছু নেই। আমি তোমার সাথে আছি।
”
***
জিয়া কাব্যকে খুঁজে পেলেন তাদের স্কুলের ছাদে। ডোরেমন কার্টুনের এক পর্বে নোবিতা বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়েছিল। রাতে সে আশ্রয় নিয়েছিল স্কুলের ছাদে। জিয়া ধারনা করেছিলেন কাব্যও নোবিতাকে অনুসরণ করতে পারে। তার অনুমান ভুল হয়নি।
জিয়া যখন কাব্যকে খুঁজে পেলেন তখন কাব্য একটা ট্র্যান্সের ভেতর চলে গেছে। তার সারা শরীর হিস্টিরিয়া রোগীর মত খিঁচুনি দিয়ে কাঁপছে। মুখ দিয়ে ফেনা গড়াচ্ছে। তার চোখ দুটো শক্ত করে বন্ধ করা। সে এক সুরে বলছে, “ডোরেমন, ডোরেমন প্লিজ না।
প্লিজ ডোরেমন তুমি এটা কোর না। প্লিজ থাম ডোরেমন, থাম প্লিজ। ”
জিয়া কাব্যকে ধরে জোরে ঝাকুনি দিলেন। লাভ হল না। এবার তিনি জোরে কাব্যকে চর মারলেন।
এবার কাব্য চোখ খুলে তাকাল। তার চোখের দৃষ্টি ঘোলা, মনে হয় সে এখনো ঘোরের মধ্যে আছে। জিয়া দেখেই সে কাতর সুরে কেদে উঠল, “ও চলে গেছে। ও আমাকে ছেরে চলে গেছে। ”
জিয়া জিজ্ঞেস করলেন,” কি হয়েছে কাব্য, কে চলে গেছে?”
“ডোরেমন, ও আমাকে ছেরে চলে গেছে।
আমার আম্মু নেই। তাই ও আর আমার সাথে থাকবে না। ও অন্তুর কাছে গেছে। ”
“অন্তু কে?”
“ইনস্পেক্টর আঙ্কেলের ছেলে। ইনস্পেক্টর আঙ্কেল ওর আম্মুকে মেরে ফেলছে।
ডোরেমন ওর আম্মুকে বাঁচাতে গেছে। ওর আম্মু বেঁচে গেলে ডোরেমন আর ফিরে আসবে না। ও অন্তুর সাথে থাকবে। ”
জিয়া অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন।
***
সাইকোলজি বড় ধুসর একটি দুনিয়া।
এখানে কোন কিছুই ফিজিক্সের সুত্রের মত ছকে বাঁধা নয়। আমরা এই অসম্ভব জটিল ও অসম্ভব হেঁয়ালি পুর্ন দুনিয়াটাকে একটা ক্যনভাসে আঁকার চেষ্টা করি। কিন্তু দিন শেষে দুনিয়াটির রুপ কেমন হবে তা নির্ভর করে শিল্পীর কল্পনা ও দক্ষতার উপর। সত্যিকারের দুনিয়াটি কিন্তু কখনই ক্যনভাসে ধরা দেয় না।
কাব্য মারা গেছে।
ব্রেনে রক্তক্ষরণে তার মৃত্যু ঘটে।
অন্তু আর তার মা ভালো আছে। অন্তুর মা এখনো হাসপাতালে, কিন্তু তিনি খুব দ্রুত সেরে উঠছেন।
রমনা থানার ওসিকে ড জিয়া তার ইভাল্যুয়েশন রিপোর্ট দিয়েছেন। রিপোর্ট পরে ওসি সাহেব জিয়াকে বললেন, “আপনি জানেন যে এই রিপোর্ট আমি ইউজ করতে পারব না।
আপনি এখানে বলেছেন কাব্যর সাইকিক ক্ষমতা ছিল, সে তার কল্পনাকে জীবন দিতে পারত, আরেকজন মানুষের ব্রেনের দখল নিয়ে নিতে পারত। মিডিয়া এই রিপোর্ট হাতে পেলে কি হবে জানেন? আপনার আমার সবার স্থান হবে হেমায়েতপুরে। ”
“আমি জানি, রিপোর্টটা নিয়ে আমি নিজেও সন্তুষ্ট নই। সময় পেলে আরও বাস্তবসম্মত একটা ব্যখ্যা নিশ্চয় খুঁজে পাওয়া সম্ভব। কিন্তু কি জানেন, আমি ভীষণ ক্লান্ত।
এই কেসটা আমার সব জীবনী শক্তি শুষে নিয়েছে। আমি এখন শুধু মুক্তি চাই। ” ড জিয়া জবাব দিলেন।
“আমি বুঝতে পারছি। কেসটা নিয়ে আমি নিজেও যথেষ্ট বিব্রত।
যাক, আপনি চিন্তা করবেন না। আপনার যা দায়িত্ব ছিল আপনি করেছেন। আপনার কাছে আমরা কৃতজ্ঞ। ”
ড জিয়া বিদায় নিলেন। ওসি সাহেব জিয়ার তৈরি করা রিপোর্টটি আবার পরে দেখলেন।
নিঃসঙ্গ বালক কাব্য তার পারিবারিক বিভীষিকা থেকে মুক্তি পেতে একটা কার্টুনের চরিত্র ডোরেমনকে নিজের সঙ্গি করে নিয়েছিল। কিন্তু কাব্যর ছিল অসম্ভব কল্পনা ক্ষমতা। ছেলেটা সিজোফ্রেনিয়া তে ভুগছিল। তার এক্সট্রিম সিজোফ্রেনিয়া তাকে দিয়েছিল আরেকজনের মনের কথা পরে ফেলার ক্ষমতা এবং নিজের কল্পনাকে আরেকজনের মনে প্রক্ষেপণ করার ক্ষমতা। আর এই ক্ষমতাই ওর জন্যে কাল হয়ে দাড়ায়।
ওসি সাহেব ফাইলটা বন্ধ করে জোরে একটা নিঃশ্বাস ফেললেন। আজকে বাড়ি থেকে বের হয়ার আগে বউকে মেজাজ খারাপ করে একটা চর মেরেছিলেন। বাড়ি ফিরেই মাফ চাইতে হবে। নাহ, তিনি এখনই মাফ চাইবেন। ওসি সাহেব দ্রুত স্ত্রীর নম্বরে ফোন করলেন।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।