মানুষ রাস্তায় নেমে আসছে। অর্থনৈতিক নাভিশ্বাস, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ জীবনের নিরাপত্তাহীনতা যে ক্ষোভের জন্ম দিয়েছে, তা আজ মানুষের শ্লোগানের ভাষা। সবার বাড়ীর পাশেই মাত্র ১%১ লোকই সকল সমস্যার মূলে একথা এখন সকলের কাছে পরিষ্কার। বাকী ৯৯%২ লোকের মিলন আর জাতি, ধর্ম, বর্ণ দ্বারা আলাদা নয়। নজীর দেখা যায় তাহরির স্কয়ার, তেল-আবিবসহ আরও অনেক জায়গায়।
আর সব মন্দার মতো এবারও ১%রা ৯/১১৩ এর নামে দেশ দখলে নামে। এসব যুদ্ধ বিশেষত ইরাক যুদ্ধের প্রতিবাদে সারা দুনিয়ার মানুষ নেমে এসেছিল রাস্তায়। এবার শুধু রাস্তায় নামা নয়, সাথে দখলও। আন্দোলনের নামই হল “অকিপাই টুগেদার” (সকলে মিলে দখল কর)।
এই মন্দাও ১%দের তৈরি বা পুঁজিবাদেরই নিয়ম।
কিন্তু ফলাফলে ব্যাংক বেল আউট পেল, আর ৯৯%রা পেল অস্টারিটি৪। হতাশ হয়েছে মানুষ ইউরোপে, আমেরিকায়। বিশেষত ওবামার তথাকথিত পরিবর্তনের বুলির সারহীনতায়। এখন খুব জনপ্রিয় একটি শ্লোগান হল “ ব্যাংকস গট বেল আউট, উই গট সোল্ড আউট” (ব্যাংকের মুক্তি, আমাদের বিক্রি)।
১৭ সেপ্টেম্বর “অকিপাই ওয়াল স্ট্রীট” নামে নিউইয়র্কে ওয়াল স্ট্রীট দখলে নেমেছে মেহনতি মানুষেরা।
মিশর গ্রীস তেল-আবিব স্পেনের ঢেউ আমেরিকার মেডিসন হয়ে এখন নিউইয়র্কে। শুরুর দিকে আন্দোলনকারীদের একটি মিছিল থেকে ৮০ জন গ্রেফতার, এবং পুলিশের মরিচ মেশানো পানি স্প্রে করার ঘটনা নজর কাড়ে সকলের। এবছরের ফেব্রুয়ারিতে অকিপাই মেডিসন আন্দোলনে শ্রমিকদের পরাজয়ে নেতৃবৃন্দের উপর ক্ষিপ্ত শ্রমিক ও রাজনৈতিক কর্মীরা। আমেরিকার সকল শ্রমিক ইউনিয়নই রাজনৈতিকভাবে ডেমোক্রেট পার্টির সাথে যুক্ত, রিপাবলিকানদের কোন শ্রমিক সংগঠন নাই। শ্রমিক ইউনিয়সমূহ আমলাতন্ত্রের দখলে।
ডেমোক্রেটরা ক্ষমতায় থাকলে সাধারণত শ্রমিক বা অন্যান্য প্রগতিশীল আন্দোলন কম হয়। কিন্তু অর্থনৈতিক মন্দার ধাক্কা শুধুই শ্রমিকদের বহন করার প্রতিবাদে মানুষ ক্ষিপ্ত হয়ে রাস্তায় নামে। একে একে শ্রমিক ইউনিয়নগুলো সমর্থন দিতে থাকে “অকিপাই ওয়াল স্ট্রীট” আন্দোলনে। মেয়র ব্লুমবার্গ পার্ক পরিষ্কারের নামে জুকাতি পার্ক থেকে উচ্ছেদ করতে চেয়েছিল নাইনটি নাইনারদের (৯৯%, অকিপাই ওয়াল স্ট্রীট আন্দোলনকারীরা এ নামে পরিচিত)। শ্রমিকদের সক্রিয় অংশগ্রহণে মেয়র পিছু হটতে বাধ্য হয়।
লিবারেশন পার্ক হয়ে উঠা যুকাতি পার্কের এটি প্রথম জয়। পুঁজিবাদ, কর্পোরেশনের বিপরীতে নতুন গণতান্ত্রিক সমাজ গড়ার ডাক দিয়েছে ইতিহাসে বহু সফল আন্দোলনকারী আমেরিকান শ্রমিকেরা।
হে মার্কেট৫ আন্দোলন, ট্রায়াঙ্গেল ফ্যাক্টরির৬ আন্দোলনসহ অনেক আন্দোলন করে আমেরিকার শ্রমিকরা কাজের পরিবেশের নিরাপত্তাসহ বেশকিছু অধিকার আদায়ে সক্ষম হয়। সত্তুরের দশকে কায়াহোগা৭ নদীতে আগুন ধরে গেলে বেগবান হয়ে উঠে পরিবেশবাদী আন্দোলন। একই সময়ে কালোদের সিভিল রাইট৮ আন্দোলন, ভিয়েতনাম যুদ্ধবিরোধী৯ আন্দোলনে আলোড়িত হয়ে উঠে আমেরিকা।
পুঁজিপতিরা আমেরিকা ও পশ্চিম ইউরোপ ছেড়ে চলে যায় এশিয়া, আফ্রিকা ও দক্ষিণ আমেরিকায়। যা বিশ্বায়ন নামে পরিচিত। পশ্চিমে কনজুমারিজম১০ চালু হয়। হিপ্পি/ বিটদের১১ বদলে আগমন ঘটে ইয়াপ্পিদের১২।
‘৯০ দশকের শেষের দিকে টেক বাবল বার্স্টে১৩ ধ্বস নামে ইয়াপ্পিদের স্বপ্নের।
মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থার অবনতি ঘটে। বিপুল সংখ্যক মানুষ দরিদ্রতার সাথে জীবন যাপন করতে বাধ্য হয়। কালোদের গরীব হওয়ার হার বেড়ে যায় অনেক। সিভিল রাইট আন্দোলনের পর এরা সমান অধিকার দাবি করতে থাকলে, ১%রা হিস্প্যানিক১৪ ও অপি-ডিভির১৫ মাধ্যমে নিশ্চিত করে সস্তা শ্রমের যোগান। কালো তরুণদের বিশাল একটি অংশ বন্দি থাকে জেলে।
৯/১১ পরবর্তি যুদ্ধের প্রতিবাদে মানুষ ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে, দুনিয়ার বিভিন্ন জায়গায় মানুষ একসাথে চড়াও হয় ১%দের উপর। আমেরিকায় পরিবর্তনের দাবি জোরদার হতে থাকলে ওবামা পুরো পরিস্থিতির মোড় ঘড়িয়ে দেয়। নিজের বাগ্মিতা ও কালোদের প্রতিনিধি হয়ে জয় করে তরুণদের। হাউজিং বাবল বার্স্টের১৬ পর ডেমোক্রেটদের পুরনো রূপ আবার দেখা দেয়। কার্টার-ওবামারূপীদের কবলে তরুণদের অনেক আন্দোলন থমকে গেছে।
ডেমোক্রেট পার্টি পরিণত হয়েছে সকল আন্দোলন-সংগ্রামের গোরস্থানে। এখন তরুণদের মাঝে স্লোগান উঠছে “ ওয়াল স্ট্রীট গট টু পার্টি, উই নিড ওয়ান”(ওয়াল স্ট্রীটের দুটি পার্টি আছে, আমাদের একটি দরকার)।
১%দের মিডিয়া প্রথম থেকেই ওয়াল স্ট্রীটের আন্দোলনকারিদের সম্পর্কে বলছে এরা হল গুটিকতক হিপ্পি/ কমিউনিস্ট/ এনার্কিস্ট। গত ৪০ বছরে এসব শব্দকে গালি হিসেবে প্রচার করেছে মিডিয়া। কিন্তু এখন এসব গালিগালাজে কাজ হচ্ছে না।
মূলধারার মেডিয়াকে প্রত্যাখান করে নিজেদের মিডিয়া ও অলটারনেটিভ মিডিয়ার (ফেসবুক, টুইটার, ব্লগ...) উপর নির্ভর করছে আন্দোলনকারীরা। একমাসেরও অধিক সময় ধরে একসাথে থেকে নিজেদের সংহতি দৃঢ় হচ্ছে, আর আন্দোলনকারীদের কণ্ঠে আওয়াজ উঠছে “ দিস ইস হোয়াট ডেমোক্রেসি লুকস লাইক” (আমরা গণতন্ত্রের চর্চা করছি)।
১। দাসমালিক, ল্যান্ডলর্ড (জমিদার), পুঁজিপতি...
২। দাস, ভুমিদাস, শ্রমিক, গরীব ইত্যাদি নানা নামে এরা পরিচিত।
৩। টুইন টাওয়ারে আত্মঘাতি বিমান হামলা এ নামে পরিচিত। আমেরিকাতে যেকোন জরুরী অবস্থায় এই ৯১১ নাম্বারে ফোন দিতে হয় বলে এটি সবার মুখস্ত। কারা এই ঘটনার জন্য দায়ি তা নিয়ে নানা মত চালু আছে।
৪।
কৃচ্ছতা সাধন! স্পেকুলেটিভ (অগ্রীম) মূল্য ও বাস্তব মূল্যের ফারাকের যে সহ্য সীমা তা পার হওয়ায় যে মন্দা শুরু হয়, তা থেকে উদ্ধারে এই মহান সাধন! গ্রীস একটি ভাল উদাহরণ। ব্যাংক ও কর্পোরেশন বেল আউটের নামে সরকারের বিশাল অংকের টাকা নিয়ে নিয়েছে। আর সরকারের ব্যয় কমানো ও ব্যাংকের লোন শোধ করার জন্য ছাটাই করা হচ্ছে হাজার হাজার শ্রমিক, বিক্রি করা হচ্ছে সরকারি সম্পত্তি।
৫। আট ঘণ্টা কর্মদিবস আদায়ে শ্রমিক আন্দোলনের শহর শিকাগোর একটি মার্কেট।
ঘটনাটি মে দিবস নামে পরিচিত।
৬। ট্রায়াঙ্গেল ফ্যাক্টরিতে (গার্মেন্ট) আগুন ধরে ১৯১১ সালে, ১৪৬ জন শ্রমিক মারা যায়। গার্মেন্ট ফ্যাক্টরিগুলোতে আগুন লাগার ঘটনা এমন ঘটছিল যে মেয়েরা আন্দোলনে নেমেছিল দলে দলে। সেসব আন্দোলনে সক্রিয় অনেক মেয়েই কাজ করতো ট্রায়াঙ্গেল ফ্যাক্টরিতে, যাদের অধিকাংশই মারা যায় আগুনে পুড়ে।
৭। কায়াহোগার তীরে ওহাইওর ক্লিভল্যান্ড শহরের তেল শোধনাগারের বজ্যই আগুনের কারণ। ১৯৬৯ সালের এই ঘটনার আন্দোলনে তৈরি হয় ইপিএ (Environmental Protection Agency)।
৮। কালোদের সমঅধিকার আদায়ের আন্দোলন সিভিল রাইট আন্দোলন নামে পরিচিত।
১৯৬৪ সালে তারা কাগজে কলমে এই অধিকার পায়।
৯। ৬০-৭০রের দশকে চলা দীর্ঘ ভিয়েতনাম যুদ্ধে আমেরিকান তরুণদের জোর করে যুদ্ধে পাঠানো হচ্ছিল, এর প্রতিবাদে যুদ্ধবিরোধী আন্দোলন গড়ে উঠে।
১০। ভোগবাদ।
তথাকথিত ৩য় বিশ্বে শ্রম শোষণ ও পরিবেশ ধ্বংস করে মুনাফার হার এমন বাড়ানো সম্ভব হয়েছে যে, পশ্চিম ইউরোপ আর উত্তর আমেরিকা ভোগের বাজার হিসেবে পরিপূর্ণতা দিয়েছে পুঁজিবাদকে।
১১। ২য় বিশ্বযুদ্ধোতর আমেরিকান প্রজন্ম, যারা সিভিল রাইট, ভিয়েতনাম যুদ্ধবিরোধী, পরিবেশবাদী আন্দোলনে নতুন পৃথিবী গড়ার স্বপ্ন দেখতো। বিটনিকরা কিছুটা হতাশাবাদী থাকলেও হিপ্পিরা শুরু করেছিল পরিবর্তনের অনুশীলন।
১২।
চাকরিতে তর তর করে উন্নতি করা তরুণদের (Young upwardly mobile professional) সংক্ষিপ্ত নাম। কনজুমারিজমের যুগে হিপ্পিদের প্রভাব কমে গেলে ৮০-৯০ এর দশকে প্রভাবশালী হয়ে উঠে ইয়াপ্পিরা।
১৩। ৯০ দশকে ইন্টারনেট বাজারজাত করার সময় স্পেকুলেটিভ (অগ্রীম) মূল্য ও বাস্তব মূল্যের ফারাকের যে সহ্য সীমা তা পার হওয়ায়, একই দশকের শেষের দিকে প্রযুক্তির বাজারের ধ্বস এ নামে পরিচিত।
১৪।
স্প্যানিশ ভাষীরা। ল্যাটিনজাত স্প্যানিশ ও পর্তুগীজ ভাষীরা ল্যাটিনো নামেও পরিচিত। এরা আমেরিকায় ২য় বৃহত্তর জাতিগোষ্ঠী (~১৬.৩%)। ৩য় কালোরা (~১৩%)।
১৫।
এরকম নানা নামে বিদেশী সস্তা শ্রমিক আনা হয় (Diversified immigrant Visa)।
১৬। বাড়ী বাজারজাত করা নিয়ে ২০০৭-০৮ এর ধ্বস এ নামে পরিচিত।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।