হাই, আমি শারমিন টুম্পা। বাইরের কোনো ঘটনা আপনাকে কতটা বিচলিত করবে, সে ঘটনা যতটা দায়ী তার চেয়ে বহু বেশি দায়ী আপনি ঘটনাটি কীভাবে দেখছেন তার ওপর। যেমন ধরুন আপনি অফিসের নির্বাহী কর্মকর্তা। আপনি আপনার ৩ জন অধীনস্থকে অফিসে দেরি করে আসার জন্য ডেকে তিনজনকেই সতর্ক করলেন। আপনি প্রতিক্রিয়া হিসেবে দেখলেন একজন স্বাভাবিক বা সহজভাবে (বস তো এমনটি বলতেই পারেন) বিষয়টিকে স্বাভাবিকভাবে নিয়ে তিনি অফিসের কাজ দায়িত্বের সাথে করতে মনোনিবেশ করলেন।
দ্বিতীয় জন মন খারাপ করে বসে রইলেন (আমি তো দেরি করি না, হঠাৎ দুই এক দিনের বেশি তো হয় না কিন্তু আমাকে কেন বললেন, আমাকে অপমান করা হয়েছে)। তৃতীয় জন মহিলা জুনিয়র কর্মকর্তা টিস্যু নিয়ে চোখের অশ্রু মুছলেন। না এখানে কাজ করা যাবে না। আমি তো দেরি করি না এক দিনের জন্য এমন কথা। অন্যখানে চাকরি খুঁজতে হবে (মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন)।
ব্যাপারটি কী দাঁড়াল? ঘটনা একই কিন্তু প্রতিক্রিয়া তিন, অর্থাৎ বস একটি বাক্য সবার জন্যই বললেন, কিন্তু তিনজন তিনভাবে নিলেন। একজন স্বাভাবিকভাবে কাজ শুরু করলেন। আর একজন কাজ বন্ধ করে মন খারাপ করে থাকলেন অনেকক্ষণ আর একজন তো চোখের পানি ফেলে চাকরি ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে বসলেন।
ঘটনাটি অতি স্বাভাবিক এবং সাধারণ অথচ এক একজনের এক এক রকম চিন্তা-চেতনা ধারণ করেন এবং ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি না থাকার কারণে দুইজনের প্রতিক্রিয়া নেতিবাচক ছিল। এ কারণেই মনোবিজ্ঞানীরা বলেন-মানুষ কষ্ট পায় না, কষ্ট তৈরি করে, কে কেমন কষ্ট তৈরি করবে সেটা তার বেড়ে ওঠা পরিবেশ, শিক্ষা, কোয়ালিটি অব ইনফরমেশন, বিশ্বাসের ওপর নির্ভর করে।
মানুষের শরীর ত্রিমাত্রিক অর্থাৎ বস্তুগত বা শক্ত জিনিস। মানুষ শরীরে আঘাত পায়, ব্যথা পায়, কষ্ট পায়, জ্বালা যন্ত্রণা হয়, কিন্তু মানুষের মন বস্তুগত বা জড় পদার্থ নয়। এটি জ্যোতি, আলো বা ফ্রিকোয়েন্সি একে স্পর্শ করার, আঘাত করার ক্ষমতা কারও নেই। মানুষ শরীরে আঘাত পেতে পারে কিন্তু মনে কখনোই আঘাত পায় না। আঘাত বা কষ্ট তৈরি করে।
যেমন ধরুন স্বামী-স্ত্রী দাম্পত্য কলহের এক পর্যায়ে স্বামী-স্ত্রীকে (নতুন বিবাহিত) বললেন আমি অফিস থেকে ফিরে যেন তোমাকে না দেখি। এই একটি নেতিবাচক কথাটিকে স্ত্রী মনের ভেতর বিভিন্ন নেতিবাচক চিন্তা সৃষ্টি করে কষ্ট তৈরি করতে থাকে যেমন-এই বাড়ির সবার সামনে আমাকে নিচু করা হয়েছে। ওরা আমাকে আর মূল্য দেবে না। আমার মর্যাদা ক্ষুণ্ন হয়েছে। এখানে থেকে আর লাভ কী? বাবা মায়ের কাছে গেলে তাদের মন খারাপ হবে, এটি আমার অযোগ্যতা।
আত্মীয়-স্বজন জানলে আমার মর্যাদা থাকবে না। সুতরাং বেঁচে থেকে লাভ কী! এসব প্রতিটি চিন্তা তার নিজের তৈরি করা। You are the creator of your own thought. নিজে কষ্ট তৈরি করতে করতে এত কষ্টই তৈরি করে যে গলার দড়ির কষ্টকেও কম কষ্ট মনে হয়। মানুষ কষ্ট পায় না, কষ্ট তৈরি করে। অথচ তাকে শুধু একটি বাক্যই বলা হয়েছে (তাও রাগের মাথায়)।
অথচ বাকি সমস্ত কথাই তার কল্পনাপ্রসূত এবং নিজের বানানো কষ্ট। গবেষকরা বলেন, মানুষ কোনো একটি ঘটনাকে নেতিবাচক চিন্তা করতে করতে পাহাড়সমান কষ্ট তৈরি করে ফেলে যে সকল চিন্তা তৈরি করে তার মধ্যে ৯৫ ভাগ চিন্তাই কিন্তু বাস্তবে ঘটত না। অর্থাৎ মানুষ ভবিষ্যতে কী ঘটবে তা নিয়ে যে নেতিবাচক কষ্টদায়ক চিন্তা করে তা ৯০ ভাগ চিন্তা অর্থহীন বা বাস্তব হয় না, অথচ এসব নেতিবাচক চিন্তা করে সে নিজেকে কষ্ট দিয়ে জীবনকে নষ্ট করে, ধ্বংস করে। পৃথিবীতে যত আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে তা এই কষ্ট তৈরি করে। কষ্টের পাহাড় তৈরি করে।
কষ্টের পাহাড় থেকে লাফ দেয় অথচ ইতিবাচক সিদ্ধান্ত নিয়ে মানুষ তার জীবনকে সফল ও আনন্দময় করতে পারে। কারও জন্য কিছু আটকে থাকে না। হলে ভালো, না হলে অল্টারনেটিভ। এ পৃথিবীটা অনেক বড়। প্রতিটি মানুষ সৎ হয়ে সৎ চিন্তা করে সফলতার শীর্ষে চলে যেতে পারে।
সেই সফলতার পথে সামনে বাধা পেলে ডান পাশ দিয়ে, নতুবা বাঁ পাশ দিয়ে, নতুবা নিচ দিয়ে, কোথাও পথ না পেলে মাড়িয়ে চলুন। নদীর গতিকে যেমন আটকে রাখা যায় না ভেঙে বেরিয়ে যায় মানুষের জীবনের গতিকেও আটকে রাখা যায় না। প্রতিটি মানুষকে সৃষ্টিকর্তা পরিপূর্ণ এবং স্বয়ংসম্পূর্ণভাবে তৈরি করেছেন। You can do what you need to do. আপনি জীবনে সব কিছুই পেতে পারেন, যা কিছু আপনি পেতে চান। আমরা আমাদের অতীতকে বদলাতে পারি না, কিন্তু ভবিষ্যৎকে বদলাতে পারি, জীবনকে বদলাতে পারি।
একমাত্র সৃষ্টিকর্তা মানুষকে পছন্দ করার, বাছাই করার ক্ষমতা দিয়েছেন অন্য কোনো পশু পাখি প্রাণীকে তিনি এ ক্ষমতা দেননি। You have the power to choose and choice is yours. আপনি জীবনটাকে কেমন করে গড়তে চান কেমন করে সাজাতে চান আপনিই তা পছন্দ করবেন, সিদ্ধান্ত নেবেন। আপনি যেমনটি চাইবেন তেমনটিই হবে। মানুষ সৃষ্টির সেরা, শ্রেষ্ঠ। মানুষ শ্রেষ্ঠ জায়গায় থাকবে।
শ্রেষ্ঠ অবস্থানেই অবস্থান করবে সেটাই স্বাভাবিক। মানুষ রাস্তায় থাকবে, অনাহারে থাকবে, ভিক্ষা করবে এটি অস্বাভাবিক।
মানুষ কষ্ট তৈরি করে কেন? মানুষ চায় তার মনের মতো করে সবকিছু হোক, সবাই তার ইচ্ছাকে বুঝুক, গুরুত্ব দিক, মেনে নিক। ধ্রুব সত্য এই যে, আপনি যতই মনে করেন আপনার ইচ্ছাই সঠিক। আপনার ইচ্ছা মতো সবকিছু হওয়া উচিত কিন্তু আপনার কথামতো কেউই চলবে না।
কারণ আপনার নিয়ন্ত্রণে কেউ নেই, আপনার নিয়ন্ত্রণে আছে শুধু একজন আর সেটা আপনি নিজে। মানুষের নিয়ন্ত্রণে যে জিনিসটি সবচেয়ে বেশি থাকে তা হলো আপনি নিজে, আপনি নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন। নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলেই দেখবেন সবকিছু যেন নিয়ন্ত্রিত হয়ে গেছে। আপনার পা দুটিকে ধুলার হাত থেকে বাঁচানোর জন্য আপনি পৃথিবীটাকে চামড়া দিয়ে ঢেকে দিতে পারবেন না। কিন্তু আপনার নিজের ছোট পা দুটিকে চামড়া দিয়ে ঢেকে দিতে পারলেই পৃথিবীটা ঢাকা হয়ে যায়।
সুতরাং নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করুন। দেখবেন সবকিছুই যেন ঠিক মনে হচ্ছে। আপনি যে রঙের চশমা পরবেন আপনি অন্যকে সেই রঙেই দেখবেন। লাল চশমা পরলে সব লাল, সবুজ পরলে সবকিছু সবুজ, হলুদ পরলে হলুদ। সুতরাং আপনার দৃষ্টিভঙ্গি যেমন হবে আপনি তেমনি সব দেখবেন।
মনটি সুন্দর করলে আপনি সবকিছুই সুন্দর দেখবেন। আপনার সুখ, আপনার খুশি, আপনার আনন্দমতো অন্যের ওপর নির্ভর করে না, নির্ভর করে আপনার ওপর। এসব অনুভবগত বিষয়, বস্তুগত নয়। এগুলো বাইরে থাকে না, থাকে ভেতরে অনুভূতিতে। সুখ, আনন্দ, খুশি অনুভব করতে হয় যা আপনার ভেতরে রয়েছে ভরপুর।
বাইরের কোনো ঘটনা বা বিষয় আপনার মনকে প্রভাবিত করতে পারে। কারণ বাইরের কোনো বস্তু, ব্যক্তি ও ঘটনা প্রভাবক। কিন্তু সেটা ইতিবাচকভাবে নাকি নেতিবাচকভাবে চিন্তা করবেন সেটি আপনার দক্ষতার ব্যাপার। কারোর মৃত্যু আপনাকে আবেগময় করতে পারে। তার স্মৃতি আপনাকে অশ্রুময় করতে পারে।
তার স্নেহ মায়া মমতার বিনিময়ে আপনার কিছু দিতে না পারার বেদনা অনুভব করতে পারেন। স্নেহ, মমতা, ভালোবাসা দেয়ার একজন না থাকার শূন্যতা অনুভব করতে পারেন। কিন্তু এটি কোনো নেতিবাচক ঘটনা নয়। এটি মানব জীবন স্বাভাবিক ঘটনা। মেনে নেয়া কঠিন হলে বিষয়টি বাস্তব এবং চিরন্তন সত্য।
ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিতে সামলে নিয়ে জীবনের সঠিক গতিময়তা বজায় রাখা যোগ্য মানুষের কাজ।
পৃথিবীতে যত মানুষ রোগে মারা যায় তার মধ্যে শীর্ষ দশ রোগের মধ্যে হৃদরোগ, ডায়াবেটিস, স্ট্রোক, ক্যান্সার প্রভৃতি। এই সকল রোগের ৭৫ ভাগ কারণ নিরানন্দ, অর্থাৎ আনন্দবোধ না করা। দুশ্চিন্তা, দুর্ভাবনা, মানসিক চাপ, রাগ প্রভৃতি এবং সকল নেগেটিভ সাইকিক ইমপ্রেশন নির্ভর করে আপনার দৃষ্টিভঙ্গির ওপর অর্থাৎ আপনার চিন্তার ওপর।
আপনার দাম্পত্য জীবন, পারিবারিক জীবন, সামাজিক সম্পর্ক, কর্মক্ষেত্রের সফলতা, ব্যবসার উন্নতি, মাল্টিলেভেল মার্কেটিংয়ে সফলতা, সফল নেতৃত্ব এবং জনপ্রিয়তা নির্ভর করে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোকে আপনি কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করছেন তার ওপর।
ঠান্ডা মাথায়, ধৈর্যের সাথে বিবেচনা ও মূল্যবোধের সাথে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারাকেই বলে প্রোঅ্যাক্টিভ বা ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি।
আপনি যদি সৎভাবে নীতি-নৈতিকতার সাথে দায়িত্ব পালন করে এগিয়ে যান তবে কে কী সমালোচনা করল বা বলল তা আপনার সৎভাবে এগিয়ে যাওয়ায় মোটেও বাধাগ্রস্ত হবে না। যেমন ধরুন আপনি সাদা রঙের কাপড় পরেছেন, একজন লাল রঙের চশমা পরে আপনাকে যদি বলে আপনার লাল শার্টটি দারুণ লাগছে, আপনি কি খুশি হবেন? আর একজন কালো চশমা পরিধান করে আপনাকে বলল কালো শার্টটা মানাচ্ছে না আপনি কি কষ্ট পাবেন? আপনি তো জানেন আপনি সাদা শার্টটিই পরেছেন।
অর্থাৎ যার যেমন দৃষ্টিভঙ্গি। যার যেমন চিন্তা-চেতনা সে তেমনই বলবে।
সে আপনাকে তার দৃষ্টিভঙ্গিতে তার বক্তব্য বা সমালোচনা করবে। তাতে আপনার মনে কৌতূক বোধ আসতে পারে। শেখার অনেক কিছুই থাকতে পারে কিন্তু রাগ করা বা মনে কষ্ট তৈরি করা সত্যিই বোকামি; আপনি যদি এক ঘণ্টা মন খারাপ করে থাকেন তবে ওই এক ঘণ্টা আপনার জীবনের জন্য বড় ক্ষতির কারণ। যা কোটি টাকার চেয়ে ক্ষতিকর। Happiness is not Destination, Happiness is Journey.
আপনি যদি সকালে উঠেই মনে করতে পারেন যে আজকের দিনটি আমার জন্য সেরা দিন, সুখের দিন তাহলে কালও হবে আজ, ফলে প্রতিদিনই হবে সুখের, খুশি চাওয়ার বিষয় নয় থাকার বিষয়।
সুতরাং আর মনে কষ্ট তৈরি করা নয়। যে কোনো বিষয়কে আবেগ দিয়ে নয় বিবেক দিয়ে, বিবেচনাবোধ দিয়ে বিশ্লেষণ করা। মানুষ সৃষ্টির সেরা। মানুষ সেরাভাবে সবকিছুকে দেখবে শ্রেষ্ঠ সিদ্ধান্ত নেবে। সেরা এবং সুন্দর আচরণ করবে সেটাই স্বাভাবিক।
সংগ্রহ - লেখক ড. মো. আলমাসুর রহমান
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।