অলৌকিক আনন্দের ভার বিধাতা যাহারে দেন,তাহার বক্ষে বেদনা অপার; বিংশ শতাব্দিতে ব্ল্যাক হোলের ভবিষ্যতবানী স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন তুলল কিভাবে এই ধরনের সুপারডেন্স বস্তু তৈরি হতে পারে। সময়ের সাথে সাথে বিজ্ঞানীরা উপলব্ধি করল এ প্রশ্নের অনেকগুলো উত্তর হতে পারে। এই উত্তর নির্ভর করবে ব্ল্যাক হোলের আকারের উপর। মিচেল,ল্যাপ্লাসের সময় থেকেই জোর্তিবিদ ও পদার্থবিদেরা তীব্র মহাকর্ষীয় ক্ষেত্র সম্পন্ন তারকা আকৃতির বস্তুর দিকে মনযোগী হন। কাজেই ব্ল্যাক হোল কিভাবে তৈরি হয় তা বোঝার জন্য নক্ষত্রের জীবন-চক্র এবং এর ভিতরের ভৌত ক্রিয়া সম্পর্কে জানার ব্যাপারে বিজ্ঞানীরা মনযোগী হন।
অবশ্য আইন্সটাইনের জেনারেল থিওরি অব রিলেটিভিটি খুবই ক্ষুদ্র আকৃতি সহ যে কোন আকৃতির ব্ল্যাক হোল থাকার সম্ভাবনা অনুমোদন করে। ১৯৬৭ সালে জন হুইলারের ব্ল্যাক হোল নামের অবতারনার পর থেকেই অনেক বিজ্ঞানী ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র(মিনিয়েচার) ব্ল্যাক হোলের তত্ত্ব প্রদানের চেস্টা শুরু করল। পরমানু আকৃতির মিনি ব্ল্যাক হোলও থাকতে পারে। কিন্তু এতে পদার্থের ঘনত্ব এতই বেশি হতে পারে যে এ ধরনের একটি মিনি ব্ল্যাক হোলের ভর হতে পারে ১০০ ট্রিলিয়ন টন(~১০^১৭ কেজি)। এমনকি আরো ছোট মানে নিউক্লিয়াস আকৃতির মিনি-ব্ল্যাক হোলও থাকতে পারে।
এই আকৃতির ব্ল্যাক হোলের ভরও ~১০^১২ কেজি স্কেলে হবে।
এই ধরনের ক্ষুদে আকৃতির ব্ল্যাক হোলের নাক্ষত্রিক(স্টেলার বা তারকাকৃতির) ব্ল্যাক হোলের সাথে কোন অত্যাবশ্যক সম্পর্ক না থাকারই কথা। কাজেই মিনি ব্ল্যাক হোলের সৃষ্টির সাথে নক্ষত্রের বা তারকার জীবন মৃত্যুর কোন সম্পর্কও নাই। তাহলে কোন ধরনের প্রক্রিয়ায় বা সক্তির সাহায্য মিনি ব্ল্যাক-হোল সৃষ্টি হয়?সত্তরের দশকের শুরুর দিকে ব্রিটিশ বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং এর একটি গ্রহনযোগ্য ব্যাখ্যা দেন। তার মতে বিগ-ব্যাং বা মহা-বিস্ফোরনের(অধিকাংশ বিজ্ঞানীদের মতে যে বিস্ফোরনের মাধ্যমে মহাবিশ্বের সৃষ্টি হয়েছে) সময় এইসব ক্ষুদ্রাকৃতির সুপারডেন্স বস্তুর সৃষ্টি হয়েছে।
আইজ্যাক আজিমভ মিনি ব্ল্যাক-হোল সৃষ্টির এ ঘটনাটিকে এভাবে ব্যাখ্যা করেন, “অত্যন্ত বিশাল পরিমান পদার্থ মহা-বিস্ফোরনের সময় যখন চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছিল তখন কিছু কিছু যায়গায় এইসব পদার্থের মধ্যে সংঘর্ষ ঘটে থাকতে পারে। এই সংঘর্ষকৃত পদার্থগুলোর কিছু অংশ তখন সবদিক থেকে প্রচন্ড চাপ অনুভব করে থাকতে পারে এবং এই প্রচন্ড চাপে তারা একটিমাত্র বিন্দুতে একীভূত হয় যেখানে মহাকর্ষীয় বলের তীব্রতা এতই বৃদ্ধি পায় যে তা এই পদার্থগুলিকে চিরদিনের মত ওই একটিমাত্র বিন্দুতেই আবদ্ধ করে রাখে। আর এভাবেই তৈরি হয় মিন ব্ল্যাক হোল। ”
স্টিফেন হকিং --তার প্রস্তাবনা অনুসারে যেই বড় বিস্ফোরনের মাধ্যমে মহাবিশ্বের সৃষ্টি হয়েছে ওই একই কারনেই মিনি-ব্ল্যাক হোলের সৃষ্টি
স্টিফেন হকিংসহ অন্যান্য অনেক বিজ্ঞানীর ধারনা এই ধরনের লক্ষ লক্ষ মিনি ব্ল্যাক হোল এখনো মহাবিশ্বে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। যদি তাই হয় তবে একদিন না একদিন কোন গ্রহানুপুঞ্জ,গ্রহ বা বড় আকারের কোন বস্তু এর মহাকর্ষীয় ক্ষেত্র দ্বারা এর দিকে সরে আসবে।
যদিও এই ধরনের মহাজাগতিক সাক্ষাত বিপজ্জনক হবে না বা কোন প্রাকৃতিক বিপর্যয়ও ডেকে আনবে না। অবশ্য আজিমভের মতে,
“যদি একটা মিনি ব্ল্যাক হোল কোন বড় বস্তুর সাথে ধাক্কা খায় তাহলে এটা শুধুমাত্র ওই বড় বস্তুটাকে ভেদ করে এর নিজস্ব পথে চলে যাবে। এটি প্রথমে যে অংশটুকুর সাথে প্রথমে ধাক্কা খাবে সে অংশটুকুকে গ্রাস করে নিবে। এর ফলে যে শক্তি বিমুক্ত হবে তা এর সামনের বস্তুটুকুকে বাষ্পিভূত করে ফেলবে এবং এটি এই গরম বাষ্পের ভিতর দিয়ে যাবার সময় এই বাষ্পকে গ্রাস করবে এবং আবারো শক্তি বিমুক্ত করবে এবং এইভাবে এটি বড় বস্তুটির আরেক প্রান্ত দিয়ে বের হয়ে যাবে। বের হওয়ার সমর এটি আগের চেয়ে তুলনামূলক বড় আকৃতির একটি ব্ল্যাক হোলে পরিনত হবে।
”
একটা মিনি ব্ল্যাক হোল একটা গ্রহের ভিতর দিয়ে গেলে যে গর্ত তৈরি করবে তা একটা বাগানে পিপড়ার তৈরি একটা গর্তের মতই ক্ষুদ্র এবং তাৎপর্যবিহীন হবে। এবং এ কারনেই যদি মিনি ব্ল্যাক হোল থেকেও থাকে তবে বিশালাকার বস্তুর উপর তাদের প্রভাব এতটাই সামান্য হবে যে তা মানুষ ও মাহাবিশ্বের অন্য যে কোন প্রানীর জন্য তা কোন বিবেচ্য বিষয়ই নয়।
অন্যদিকে স্টেলার বা বিশাল ভরের ব্ল্যাক হোলের মহাবিশ্বে এবং মানব জীবনে বিশেষ সম্ভাবনাময় প্রভাব রয়েছে। এজন্যই বিজ্ঞানীরা ব্ল্যাক হোল কিভাবে গঠিত হয়,এদের বৈশিষ্ট্য কি কি এ বিষয়ে বিস্তারিত জানার জন্য বিজ্ঞানীরা এত সময় ধরে নিজেদের নিয়োজিত করে রেখেছেন। তারা এটা উপলব্ধি করতে পেরেছেন যে এমন বিশাল পরিমানের পদার্থ এমন ক্ষুদ্র একটা যায়গায় ঠেসে রাখতে(কমপ্রেস করতে) হলে একটা প্রচন্ড ভায়োলেন্ট প্রক্রিয়া বা ঘটনার প্রয়োজন।
এবং এই ধরনের প্রক্রিয়ায় নির্গত শক্তি ভূমিকম্প,আগ্নেয়গিরির অগ্নুপ্যাত বা কোন গ্রহের সাথে গ্রহানুপূঞ্জের সংঘর্ষের মত প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে নির্গত শক্তি থেকে লক্ষ লক্ষ গুন বেশি হবে। কাজেই বিজ্ঞানীদের কাছে এটা স্পষ্ট হয়ে উঠে যে নক্ষত্রের ভায়োলেন্ট মৃত্যুই স্টেলার ব্ল্যাক হোল সৃষ্টির একমাত্র কারন হতে পারে।
ব্ল্যাক হোল সিরিজের আগের লেখার লিঙ্কঃ
ব্ল্যাক হোল-১( অ্যাস্ট্রোফিজিক্স-অসম্ভব অজানার মুখোমুখি)
ব্ল্যাক হোল-২(ব্ল্যাক হোল সম্পর্কে জানা প্রয়োজন কেন?-এস্ট্রোফিজিক্স
ব্ল্যাক হোল-৩(ব্ল্যাক হোলের প্রাথমিক ধারণাসমূহ)
ব্ল্যাক হোল-৪(মুক্তি বেগ এবং অদৃশ্য তারকারাজি)
ব্ল্যাক হোল-৫(মহাশুন্যের বক্রতা ও মহাকর্ষ কূপ এবং জেনারেল থিওরী অফ রিলেটিভিটি)
ব্ল্যাক হোল-৬(সুপারডেন্স বস্তু থাকা কি সম্ভব???)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।