দিগন্তের উপর মাথা তুলে দাড়াতে চাই সারি সারি তাল গাছ। তারই পাশে শান বাধানো বিশাল পুকুরঘাট। স্বচ্ছ পানিতে গাছের ছায়ার দিন-ভর লুকোচুরি খেলে পানকৌড়ী। এক্কোনে শামীম মামার চায়ের দোকান। সেখানে সকাল থেকেই জ্বলতে থাকে মাটির চুলা, শোনা যায় চায়ের কাপের টুংটাং শব্দ।
এসব দেখতে দেখতেই আড্ডামুখর হয়ে ওঠে শিক্ষার্থীরা। ব্যস্ত হয়ে পড়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অতি পরিচিত ইবলিস চত্বর। বিশাল মাঠ নিয়ে গঠিত এই চত্বর কেবল দিনের জন্য নয়। সন্ধ্যায়ও খোলা আকাশে নরম ঘাসে এখানে বসে থাকতে দেখা যায় বহু শিক্ষক-শিক্ষার্থীকে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের এই ইবলিস চত্বরের নাম নতুন কেউ শুনলেই প্রথমে বেশ অবাক হন।
অনেকে নেতিবাচক ধারনাও করে বসেন। কিন্তু আসলে লোকমুখে প্রচলিত এই নামের ইতিহাস তেমন ভয়ানক কিছুই ইঙ্গিত করেনা। বলা হয় একসময় এটি ছেলে মেয়েদের অবাধ আড্ডার কেন্দ্রবিন্দু হওয়ায় কোন এক ভালোবাসা দিবসে দুষ্টু প্রকৃতির কিছু মানুষ এর নাম দিয়েছিল ইবলিস চত্বর।
তবে যে কারনে হোক আর যে নামেরই হোক, এই চত্বরেই কত শত স্বপ্নের জাল বুনেছেন তরুণ-তরুণীরা। ‘প্রিয়জনকে কাছে পাওয়ার প্রিয় মুহুর্তের সাক্ষী হয়ে আছে এই চত্বর’ বলছিলেন আইন বিভাগের শিক্ষার্থী উৎকলিকা দিসা।
অন্যদিকে সমাজকর্ম বিভাগের এক শিক্ষার্থী বললেন, যাকে তার জীবন সঙ্গী করবেন বলে ভেবেছিলেন তাকে সেদিন এ মাঠে দাড়িয়েই বিদায় দিতে হলো। তাদের পাশে বসে থাকা মোটা ফ্রেমের চশমা খুলে নৃ-বিজ্ঞান বিভাগের ইফফাত চ্যাম্প বললেন, ক্যাম্পাসে তার প্রিয় জায়গা ইবলিস চত্বর। কেননা এখানে খোলা হওয়ায় আড্ডা এবং পড়াশুনা দুই’ই বেশ জমে ওঠে।
শুধু ইবলিস চত্বর নয় সবুজে ঘেরা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে রয়েছে আরো কত চত্বর। প্রতিটি চত্বরেরই রয়েছে মজার মজার নাম ও ঐতিহাসিকতা।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটক দিয়ে ঢুকেই বাঁ-পাশে ঐতিহাসিক ‘সাবাশ বাংলা’ মাঠ। সামনেই ড. শামসুজ্জোহা স্যারের কবর। সেখান থেকে বাঁয়ে গগণচুম্বী সারি সারি বহু পুরাতন গাছ নিয়ে গঠিত রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অপার সৌন্দার্য ‘প্যারিস রোড’। অনেকের মতে দেশের আর কোন বিশ্ববিদ্যালয় বা প্রতিষ্ঠানে এই সুউচ্চ গাছের বিন্যাস নেই।
ক্যাম্পাসের আরেক বহুল আলোচিত জায়গা পশ্চিম পাড়া।
ছাত্রীদের পাঁচটি হলের মধ্যবর্তী এই জায়গাটি বিকাল হতে না হতেই পরিনত হয় তারুণ্যের মেলায়। সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত নামে, তবু শেষ হয়েও শেষ হয়না মেলা। তবে ছাত্রীদের তুলনায় ছাত্রদের সংখ্যা’ই বেশি। এ নিয়েও রয়েছে অনেক হাস্য-রসাত্মক গল্প।
ক্যাম্পাসের সবচেয়ে ব্যস্ততম চত্বর ‘টুকিটাকি চত্বর’।
এখানে রয়েছে সারি সারি চা-নাস্তার দোকান, রাজনৈতিক দলের টেন্ড। গল্পে মেতে কেউ গরম চায়ে গাল পোড়াচ্ছেন আবার কেইবা গিটারে সুর তুলছেন। সবসময়ই চোখে পড়ে বন্ধুরা মিলে আড্ডা দেয়ার চিত্র। ফটোকপির দোকান থেকে শুরু করে বই, খাতা, কলম, সাজ-সরঞ্চাম ও দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহৃত টুকিটাকি সব ধরনের জিনিস এখানে পাওয়া যাওয়ায় এই চত্বরকে বলা হয় টুকিটাকি চত্বর।
গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের মিডিয়া চত্বর, নৃবিজ্ঞান বিভাগের এ্যানথ্রো পয়েন্ট, লালন চর্চা কেন্দ্র, আমতলা চত্বর, লাইব্রেরী চত্বর, বৌ বাজারসহ আরো বেশ কিছু চত্বরই এভাবে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক শিক্ষার্থীদের মনে জায়গা করে নিয়েছে ।
জায়গা করে নিয়েছে বাবু মামার চা, মানিক ভাইয়ের পরোটা, সাজ্জাদের ঝালমুড়ি।
এসব চত্বরে গল্প গান আর আড্ডার সাথে সাথেই ছেলে মেয়েরা নিজেদের ভবিষ্যৎ গড়ে। এই তরুণ প্রজন্মই জাতীর স্বপ্ন হয়ে ওঠে। তারপর এরা’ই একদিন জাতীর হাল ধরে, দেশকে নিয়ে যায় বহুদূর- এমনটিই মনে করেন বিম্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক উপমহাদেশের বিশিষ্ট কথা সাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক।
লাকমিনা জেসমিন সোমা
রাজশাহী, ২১ মার্চ ২০১৩
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।