বাংলার মাটি বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল, পুন্য হউক, পুন্য হউক, পুন্য হউক, হে ভগবান। বাংলার ঘর, বাংলার হাট, বাংলার বন, বাংলার মাঠ, পুর্ন হউক, পূর্ন হউক, পূর্ন হ্উক, হে ভগবান। রবীন্দ্রনাথ বাউল সম্রাট শাহ আবদুল করিম তাঁর স্ত্রী আপ্তাবুন্নেসাকে আদর করে সরলা বলে ডাকতেন। তবুও আমি কি বলিব আর/বিচ্ছেদের আগুনে পুড়ে কলিজা আঙ্গার- বাউল সম্রাটের এই সুরেলা আর্তনাদ সরলা-বিরহে নয়। এ আর্তনাদের মর্ম অতি গূঢ় ও গভীর ।
এই বিচ্ছেদ বাউল সম্রাটের মনের মানুষের সঙ্গে, যিনি সর্বদা মনের মাঝে বিরাজ করেন । তথাপি দেখা দেন না। লালন এই অনুভূতি প্রকাশ করেছেন এভাবে:
কে কথা কয় রে দেখা দেয় না
নড়েচড়ে হাতের কাছে খুঁজলে জনম- ভর মেলে না।
যিনি লালন কিংবা শাহ আবদুল করিমের মনের মানুষ, তিনিই রবীন্দ্রনাথ-এর নাথ । তারই বিচ্ছেদে রবীন্দ্রনাথের আর্তনাদ যেন আরও মর্মান্তিক:
কেন বাণী তব নাহি শুনি নাথ হে
অন্ধজনে নয়ন দিয়ে অন্ধকারে ফেলিলে
বিরহে তব কাটে দিনরাত হে।
রবীন্দ্রবাউল-এর এই প্রকাশ যেন বিবর্তনের ইঙ্গিত দেয়। উন্নত চেতনার অধিকারী মানুষ বিবর্তনের ধারায় দৃষ্টিশক্তি লাভ করল । এর আগে সে দৃষ্টিহীন ছিল- অন্ধ ছিল বলেই । কিন্তু দৃষ্টিশক্তি পেয়ে কী লাভ হল। বিবর্তনের যে কর্তা, তাকেই তো ‘চোখের আলোয়’ দেখা গেল না।
যে কারণে বাউল রবীন্দ্রনাথের আক্ষেপ করছেন: অন্ধজনে নয়ন দিয়ে অন্ধকারে ফেলিলে ! এই আক্ষেপই শাহ আবদুল করিমের গানে ‘অঙ্গার’ রূপে বর্ণিত হয়েছে।
আর শ্রীহট্টের বৈষ্ণব-বাউল রাধারমন দত্তও সে অঙ্গারের অসহনীয় তাপদাহে জীবনভর পুড়েছিলেন কৃষ্ণশূন্য রাধাসম । তাঁর একটি গানে আমরা সে তিলতিল যন্ত্রণা টের পাই যেন:
আমার বন্ধু দয়াময় তোমারে দেখিবার মনে লয়
লালন জানতেন অন্তরের বন্ধুর দর্শন সহজ নয়। যে কারণেই গাইলেন দীর্ঘশ্বাসময় এক গান :
পাবে সামান্যে কি তার দেখা
বেদে নাই যার রূপরেখা ।
(কি অসামান্য বিবৃতি! বেদে নাকি ঈশ্বরের রূপরেখা নেই! কেবল লালনের পক্ষেই এমন ভাবনা সম্ভব।
যিনি (নদীর) মোহনাকে শুকনো কল্পনা করতে পারেন। অমাবশ্যায় পূর্ণিমা দেখেন ... )
শ্রীহট্টের মরমী হাছন রাজাও জীবনভর একটি প্রশ্নে তাড়িত হয়েছেন।
বাউলা কে বানাইল রে
হাছন রাজারে বাউল কে বানাইল রে।
যিনি লালনের মনের মানুষ, তিনিই হাছন রাজার কানাই। কানাই-এর লীলখেলা যেন হাছন বুঝতে পারছেন:
কানাই তুমি খের খেলাও কেনে
রঙ্গে রঙিলা কানাই
কানাই তুমি খের খেলাও কেনে
এই কথাটা হাছন রাজার উঠে মনে মনে।
কিন্তু, কে কানাই? কি তার স্বরূপ? হাছন রাজা বিশ্বাস করতেন যে কানাই স্বর্গে থেকে এ জগতে এসেছেন।
স্বর্গপুরী ছাইড়া কানাই আইলা এই ভূবনে।
হাছন রাজায় জিগ্যাস করুইন
আইলা কোন কারণে?
কানাই-এর সঙ্গে হাছন রাজার নিগূঢ় সর্ম্পকের একটা ব্যাখাও দিয়েছেন হাছন রাজা ।
হাছন জিগ্যাস করুইন কানাই কোন জন?
ভাবনা চিন্তা কইরা দেখি কানাই যে হাছন!
এবার যেন বোঝা গেল কেন হাছন নিজেকে বাউলা বলেন। এই কানাই আবার হাছন রাজার মওলা।
( এবং এটি বৈষ্ণব/মারেফাত সমন্বয়ের উৎকৃষ্ট এক উদাহরণ) হাছন রাজা প্রশ্ন করেছিলেন: বাউলা কে বানাইল রে হাছন রাজারে বাউল কে বানাইল রে। উত্তরটি হাছন রাজা নিজেই দিয়েছেন:
বানাইল বানাইল বাউলা তার নাম হয় যে মওলা।
দেখিয়া তার রূপের চটক হাছন রাজা হইল আউলা।
বাউল দর্শনের গোড়ার কথাটা তো আমাদের জানা আছে। মানুষের মধ্যে মওলা বাস করেন।
যে মওলা- মায়া লাগায়, পিরিতি শিখায় দেওয়ানা বানায় ...এই ভাবনাটি শাহ আবদুল করিম-এর একটি গানে প্রকাশ পেয়েছে এভাবে
(বন্ধে=বন্ধু) মায়া লাগাইছে পিরিতি শিখাইছে দিউয়ানা বানাইছে
কি যাদু করিয়া বন্ধে মায়া লাগাইছে ...
মানবঅন্তরে বাস করে মানবেরে যিনি মায়া লাগান তিনিই তো রবীন্দ্রনাথের প্রাণের মানুষ। জীবনভর এই প্রাণের মানুষের সন্ধান রবীন্দ্রনাথকে বাউল করেছে। সেই প্রাণের মানুষ সম্বন্ধে রবীন্দ্রবাউল একতারা হাতে নেচে নেচে গাইছেন:
আমার প্রাণের মানুষ আছে প্রাণে
তাই হেরি তাই সকল খানে ...
যে রবীন্দ্রনাথের প্রাণের মানুষ সেই আবার মারাফাতপন্থীদের দয়াল-মাওলা। তিনিই আবার ‘আয়নার কারিগর’। সেই আয়নার কারিগর দয়াল-মাওলার উদ্দেশ্যে এক মারফতি বাউলার আর্তনাদ:
দয়াল আমার ভাঙা তরী
অকূলে দিয়েছি পারি ...
বাংলার ভাব জগতে যা মনের মানুষ, প্রাণের মানুষ, কানাই কিংবা দয়াল মাওলা, ইউরোপীয় দর্শনের পরিভাষায় তাই Ultimate Reality. আসলে কি এই Ultimate Reality কে জানা যায়? কিংবা জানা সম্ভব? না, নাকি এ কেবলি অনুভবের বিষয়? যে অনুভূতি অলীক কিংবা ছলনাও তো হতে পারে।
এ সমস্ত ভেবে ভেবে শাহ্ আবদুল করিম- এর অনিবার্য আর্তনাদ কেবল কানে ভাসে-
আমি কি বলিব আর
বিচ্ছেদের আগুনে পুড়ে কলিজা আঙ্গার ...
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।