পৃথিবীর ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ একইনামের তিন বস্তু-
১. বেহেশতের আপেল
২. নিউটনের আপেল
৩. স্টীভ জবসের আপেল
সকলেই আমরা তাকে চিনি, অ্যাপল এর স্রষ্টা হিসেবে। কিন্তু টেক আর করপোরেট এর ভেতরের জগতে কেন তিনি বেশি পরিচিত সে তথ্য আমাদের অনেকেরই অজানা। স্টীভ জবসকে নিয়ে এ বিশ্বে হয়েছে অনেক গবেষনা। তাকে নিয়ে আছে অনেক গবেষনা মূলক প্রবন্ধ (Research Paper) আর বই।
বহুল প্রচলিত এই তথ্য বিশ্ব পরিবর্তনে স্টীভ জবস এর ভূমিকার খুবই সামান্য কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশকেই কেবল তুলে ধরে।
এর বাইরে আছে আরো অনেক কিছু। কম্পিউটার ইন্ডাস্ট্রী কে বদলে দিয়েছেন যে অল্প কয়েকজন ব্যাক্তিত্ব, স্টীভ জবস তাদের মাঝে একজন হয়ে অন্যরকম একজন, কেননা তিনি বদলে দিয়েছেন এর পাশাপাশি মিউজিক, টেলিকমিউনিকেশন, মুভি এবং ইন্টারনেট কেও। কিভাবে তিনি এসব করেছেন তা নিয়ে নানা গবেষনায় বেরিয়ে এসেছে বেশ কযেকটি গুরুত্বপূর্ন তথ্য।
১. “আপনার ভাল লাগার কাজ টিই করুন”- কোন একটা বিষয়ের প্রতি তীব্র আকর্ষন থাকলেই কেবল বিশ্ব বদলে দেয়ার মত আইডিয়া দেয়া যায়। স্টীভ জবস বলতেন, অন্যের স্বপ্ন পূরনের জন্য এক জীবন যথেষ্ট নয়।
আপনি যদি আপনার স্বপ্ন খুঁজে না পান তবে তার খোঁজ চালিয়ে যান, যতক্ষণ না আপনি তা খুঁজে পান। অ্যাপল থেকে তাকে ছাঁটাইয়ের পর বিশ্ববিখ্যাত অ্যানিমেশন মুভি প্রস্তুত কারী প্রতিষ্ঠান “পিক্সার” এর মালিক এবং প্রধান নির্বাহী ছিলেন স্টীভ জবস। কিন্তু তার প্যাসন ছিল প্রযুক্তিগত ব্যবহার উপযোগী পন্য মানুষকে উপহার দেয়া আর তাই ডিজনী’র গভর্নিং বডির এই প্রভাবশালী সদস্য সে সব ছেড়ে দিয়ে একসময় আবার যোগ দেন অ্যাপল এ আর তার পরবর্তী ঘটনা সবার জানা। কিন্তু পিক্সার এর ঘটনা জানেন কতজন? এর মূলে রয়েছে প্রযুক্তি পণ্যের প্রতি তার প্যাসন।
২. কাজ দিয়ে সবার মনে, বিশ্বে ছাপ ফেলা- কম্পিউটার এর শুরুর দিকে এর বিশাল আকার আর জটিল ব্যবহার বিধির কথা হয়ত সকলেই জানেন।
বড় বড় রিসার্চ প্রজেক্ট এবং সরকারী কাজেই কেবল ব্যবহার উপযোগী তখনকার কম্পিউটার এবং তাদের প্রস্তুত কারকদের মতে এত জটিল এবং সূক্ষ একটি যন্ত্র ছোট আকারে সকলের ব্যবহার উপযোগী করে তৈরী করা সম্ভব নয় আর এ ব্যাপারে গবেষণা করতেও তারা ছিলেন নারাজ । কম্পিউটারকে কিভাবে বাসায় বা ছোট আকারে ব্যবহার করা যায় তা নিয়ে তখনকার সময় লোকজন কাজ করতেন কেবল সখের বশে। সৌখিন এসব লোকদের একজন স্টীভ জবস এর স্বপ্ন ছিল সদ্য প্রতিষ্ঠিত কোম্পানী অ্যাপল এর মাধ্যমে সকলের ব্যবহার উপযোগী কম্পিউটার প্রস্তুত করা আর এই স্বপ্নেরই প্রতিরূপে ১০ বছর পর বাজারে আসে ম্যাকিন্টোস, যা সারা বিশ্বে কম্পিউটার ব্যবহারের এক নতুন দিগন্তের সূচনা করেছিল।
৩. সৃজনশীলতার পূর্ণ বিকাশে ব্যবহার করতে হবে পূর্বের সকল অভিজ্ঞতা- স্টীভ জবস কলেজে পড়েছিলেন ক্যালিওগ্রাফী নিয়ে আর তার পূর্ণ ব্যবহার করেছেন তখনকার সময়ের সম্পূর্ণ ভিন্ন এক মাধ্যম কম্পিউটার এ। ম্যাক এ ক্যালিওগ্রাফির অভিজ্ঞতা ব্যবহার করে তৈরী করা ফন্ট এবং এর ডিজাইন ম্যাক এর জনপ্রিয়তার এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে দাড়িয়েছিল।
অনেক অভিজ্ঞতা সম্পন্ন ব্যাক্তি (ধরুন আপনার অফিসের বস) জটিল পরিস্থিতিতে কার্যকরী সিন্ধান্ত নিতে পারেন তখনই যখন তিনি তার পূর্বের সকল অভিজ্ঞতার কার্যকরী সমন্বয় ঘটাতে পারেন আর তাই আপনার শিক্ষাগত যোগ্যতার চেয়ে আপনার অভিজ্ঞতা আর কর্মদক্ষতার মূল্য কর্পোরেট জগতে অনেক বেশিই গুরুত্বপূর্ণ।
৪. না বলতে শিখুন- অ্যাপল এবং তার সকল যুগান্তকারী পণ্যের সাফল্যের পিছনে রয়েছে এই না বলতে পারার ক্ষমতা। স্টীভ জবস এর ভাষায়- “১০০০ জিনিস কে না বলুন”। প্রতিটি পণ্যের ডিজাইন এর মূলে ছিল অপ্রয়োজনীয় সব কিছুকে বাদ দেয়া। যা কিছু একান্ত প্রয়োজনীয় নয় তার সব কিছু বাদ দেয়ায় আজ আমাদের হাতে আছে এক বাটনের আইফোন আর আইপ্যাড।
অপ্রয়োজনীয় ধরে নিয়ে কি-বোর্ড ঝেড়ে ফেলে উন্নত মানের টাচ স্ক্রীন এর মাধ্যমে সহজে সব কাজ সম্পন্ন করার সুযোগ করে দেয়ায় এরা এখন এক একটি আইকন।
৫. ভিন্ন ধর্মী কিছু করুন- গ্রাহক ও ব্যবহার কারীদের সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরণের অভিজ্ঞতা দেয়াটা স্টীভ জবস এর মতে গুরুত্বপূর্ণ আর তার ই ধারাবাহিকতায় তিনি চালু করেন অ্যাপল স্টোর যেখানে গ্রাহকরা সুযোগ পায় সব পন্য কে শেলফে সাজিয়ে রাখা অবস্থায় নয়, পায় একেবারে হাতের নাগালে। তারা সেখানে তা পরিপূর্ণ ভাবে ব্যবহার করে দেখতে পারে এবং শো রুমে প্রযুক্তি পণ্যের এ ধরনের ডিসপ্লে গ্রাহকদের সাথে আত্ত্বিক বন্ধন তৈরীতে সহায়ক হওয়ায় এ দৃষ্টান্ত প্রযুক্তি পণ্যে আজ অনুসরণ করছে অনেকেই।
৬. স্টীভ জবস এক্সিকিউটিভ দের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আলোচিত তার উপস্থাপনার ভঙ্গির কারনে। স্টীভ জবসকে বলা হয় সর্বকালের সেরা কর্পোরেট উপস্থাপক যিনি তার উপস্থাপনায় সবকিছুকে উপস্থাপন করেন ভিজুয়াল দিয়ে, ছবি সাথে প্রয়োজনে একটি বা দুটি শব্দ।
তার উপস্থাপনায় তিনি সবাইকে একাত্ব করে ফেলতে পারতেন এবং নাটকিয়তার মাধ্যমে একই উপস্থাপনায় তিনি নিয়ে আসতেন আনন্দ, উদ্দীপনা এবং পন্যের প্রতি আগ্রহ। তার উপস্হাপনা নিয়েই খুব সম্ভবত বিশ্বে সবচেয়ে বেশি গবেষণা হয়েছে এবং আজ ও হচ্ছে।
অনেকে হয়তো ভাবতে পারেন তার এ ক্ষমতা জন্মগত, আসলে তা নয়। স্টীভ জবস এর প্রেজেন্টেশন এর বেশির ভাগই ইউটিউবে সহজলভ্য। চাইলেই দেখে নিতে পারেন।
খেয়াল করলে দেখবেন ১৯৮০ তে দেয়া স্টীভ জবসের প্রেজেন্টেশন ২০১০ এ দেয়া প্রেজেন্টেশন এর তুলনায় নেয়াহেতই আনাড়ী। আমার ব্যাক্তিগত মত ১৯৮০, ১৯৯০, ২০০০, ২০১০ এ সময়ে তার দেয়া ৪ টি প্রেজেন্টেশন দেখুন, পরিবর্তন আপনিও আলাদা করতে পারবেন। স্টীভ জবস এর কেবলমাত্র এই একটি দিককেই আয়ত্ব করতে পারলে আপনিও হয়ে উঠতে পারবেন আপনার প্রতিষ্ঠানের সম্পূর্ণ আলাদা, অবশ্য প্রয়োজনীয় এবং অবিচ্ছেদ্য একটি অংশ।
৭. স্টীভ জবস বলতেন “Sell dreams, not the product”। স্টীভ জবস এর নের্তৃত্বে অ্যাপল এর লক্ষ্য ছিল তার ভক্তদের মধ্যে নতুন প্রযুক্তির স্বপ্ন জাগানো আর সেই স্বপ্ন তৈরীই ছিল শীর্ষ একটি প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান হিসেবে আ্যাপল এর বেড়ে ওঠার মূল মন্ত্র।
এক নজরে স্টীভ জবস:
নাম: স্টীভ পল জবস
জন্ম: ফেব্রুয়ারী ২৪, ১৯৫৫ সান ফ্রান্সিসকো তে
মৃত্যু: অক্টোবর ৯, ২০১১; ৫৬ বছর বয়সে
শিক্ষাগত যোগ্যতা: স্নাতক, ১৯৭২ সাল
কর্মজীবন: প্রথম কর্মজীবন শুরু করেন বিশ্ব বিখ্যাত গেম নির্মাতা প্রতিষ্ঠান “আটারী” তে গেম নির্মাতা হিসেবে। ১৯৭৬ সালে স্টীভ ওজনিয়াক এর সাথে বাসার গ্যারেজে প্রতিষ্ঠা করেন “অ্যাপল” এর এবং এর বছর পরই তাকে এ প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান পদ থেকে সরিয়ে দেয়া হয়। ১৯৯৬ সালে তিনি আবার ফিরে আসেন এই প্রতিষ্ঠানে। ভারপ্রাপ্ত প্রধান নির্বাহি হিসেবে ৪ বছর কাজ করার পর তিনি পাকাপোক্তভাবে এই প্রতিষ্ঠানের হাল ধরেন ২০০০ সনে এবং তারই তত্ত্বাবধানে পরবর্তী সময় সারা বিশ্ব মেতে উঠে আইপড, আইফোন এবং আইপ্যাড এর উন্মাদনায়।
২০০৪ এ অগ্নাশয় ক্যান্সার এর অপারেশন ও চিকিৎসা এবং ২০০৯ এ লিভার ট্রান্সপ্লান্ট করার পর ২০১১ এর জানুয়ারীতে শারিরিক অসুস্থতার জন্য আবার ছুটিতে যান এবং আগস্ট এ কোম্পানীর প্রধান নির্বাহীর পদ থেকে সরে দাড়ান।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।