মানুষ মরে গেলে পচে যায়, বেঁচে থাকলে বদলায়, কারণে-অকারণে বদলায়
এক
এনাটমি পরীক্ষা ছিলো প্রথম ব্যাচের। এমনিতেই ফার্স্ট ইয়ার বলে উত্তেজনা আর চাপ দুটোই বেশী। অরিন্দম এনাটমির কোরিডোর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। কাল সারা রাত ও না ঘুমিয়ে পড়েছে। এখন আর শরীর চলছে না।
ব্যাগটা নিতে হবে ডিসেকশন থেকে। ডিসেকশন রুমে কিছু ব্যাগ পড়ে আছে, সাথে খোলা কিছু বই। নিঃশব্দে ব্যাগটা নিয়ে অরিন্দম যেই বেরিয়ে যাবে সেই দেখলো রুমের শেষে একটা টেবিলে মৌমিতা বসে আছে।
মৌমিতার পরীক্ষাও শেষ হয়েছে, কেমন হয়েছে একটু শুনে যাওয়া যেতে পারে।
রুমের ওদিকে হাঁটতে গিয়ে একটু শ্লথ হয়ে গেলো অরিন্দম এর গতি।
যাওয়াটা কী ঠিক হবে। কারন মৌমিতার চোখ ভেজা। হয়তো পরীক্ষা ভালো হয়নি। হয়তো কী, আর কোন কারন আপাতত থাকতে পারেনা।
একটু ইতস্তত করে আবার এগিয়ে গেলো, বলল - কি হলো তুই এখানে একা কেন? হোস্টেলে যাবি না?
মৌমিতা কোন কথা বললো না।
অরিন্দম ভেবে পাচ্ছেনা না এর পরে আর কী বলা যায়।
মৌমিতা চোখ মুছে বললো, যাবো পড়ে। তুই যা।
- তুই না গেলে আমি যাবো না।
- আমি এখন যাবো না, তুই যা বলছি।
- পরীক্ষা খারাপের জন্য তো তোর মন খারাপ না, তাহলে কাঁদছিস কেন?
- যা তুই।
- তোর মন এই জন্য খারাপ, কারন যে প্রিপারেশন নিয়ে তোর পরীক্ষা কপাল দোষে খারাপ হয়েছে, সেই একই প্রিপারেশন নিয়ে ডাক্তার বাবার মেয়ে তোর রুমমেট মেঘলার পরীক্ষা ভালো হয়েছে। ঠিক কিনা বল?
মৌমিতা অরিন্দম এর দিকে তাকালো। অরিন্দম বলতে থাকলো - কান্নাকাটি করে কী কিছু হবে বল, সারা রাত জেগে পড়াশোনা সবাই করে কিন্তু সবার লাক কী আর সেইম হয়। বাদ দে, রুমে যা।
কাজ হলো না। এবার মেয়েটা আবারো কাঁদতে শুরু করলো।
- বাসায় ফোন দিয়েছিলি? মামুনির সাথে কথা বল।
মৌমিতা চুপ করে বসে থাকে।
এখনো পরীক্ষা সবার টা শেষ হয়নি, কিছু মেয়ে এখনো বাকি আছে, মৌমিতাকে ওদের সাথে পাঠাতে হবে।
অরিন্দম একটা চেয়ার টেনে নিয়ে মৌমিতা যে টেবিলটাতে বসেছে তার সামনে বসলো। একটা সমবয়সী মেয়ের কান্না দেখছে সে বসে থেকে। হুমায়ুন আহমেদ হলে এই কুমারীর কান্না নিয়ে আরেকটা বাণী শুনিয়ে দিতো। কিন্তু অরিন্দম ক্লান্ত। তারপরও বসে আছে।
রুমে আর কেউ নেই। এভাবে বসে থাকা ঠিক হচ্ছেনা। অরিন্দম ঘড়ি দেখলো।
এসময় মেঘলা এলো ডিসেকশন রুমে। কিরে মৌমি, তুই যাবিনা?
তুই চলে যা।
আমি মার্কেটে যাবো - বোধয় মিথ্যাই বললো মৌমিতা।
অবশেষে আধ ঘন্টা পরে কান্নার যবনিকা হলো। অনেক কথা বলে, এদিক ওদিককার গল্প বলে স্বাভাবিক করতে হলো মেয়েটাকে।
এখন তারা উঠবে। মৌমিতা এপ্রোন খুলে ব্যাগে রাখলো।
বই গুছিয়ে নিয়ে বের হলো ডিপার্টমেন্ট থেকে।
পরীক্ষার স্মৃতি আর কারোরই এখন মনে নেই।
মৌমিতার সাথে অরিন্দম এর পরিচয় হয় নিপার মাধ্যমে। নিপা অরিন্দমের আগের চেনা। ইন্টারে এক সাথে ফিজিক্স পড়তো ওরা।
একদিন নিপা এসে বললো অরিন্দমকে, এই যে ওর নাম হলো মৌমিতা। ওর জন্য একটা মাইগ্রেশন ফরম এনে দে। ও মাইগ্রেশন করবে। ব্যস, এই টুকু হলো পরিচয়।
কয়েকদিন গেলো এভাবে।
লাইব্রেরীতে আর ক্যান্টিনে আড্ড দিতো অরিন্দম ওর ফ্রেন্ড সার্কেল নিয়ে। আস্তে আস্তে মৌমিতাও এ আড্ডায় রেগুলার হয়ে যায়।
অরিন্দম একদিন বললো, এই তোর ফোন নাম্বার তো নেই আমার কাছে। দিস নাই কেন?
মৌমিতা ফোন নাম্বার দিলো। ঐদিন রাতে প্রথমে অনেক্ষণ চললো মিসকল মিসকল খেলা।
তারপর অরিন্দম একবার ফোন দিলো। মৌমিতা ফোন ধরলো। কথা চললো সারা রাত। কোন স্পেসিফিক টপিক ছিলো না। এভাবেই আড্ডা চললো আর নগরের বুকে জায়গা করে নিলো আরো একটা ভালোবাসার গল্প, কাছে আসার গল্প।
এর মাঝে একদিন খুব অসুস্থ হয়ে পড়ে অরিন্দম। ওর অ্যাকিউট অ্যাবডোমেন এর ব্যাথা শুরু হয়। তখন ও বাসায়। হাসপাতালে ভর্তি করতে হয় ওকে। ফোনে খবর পেয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিতে সারা রাত কাঁদে মৌমিতা।
টেলিফোনের ওপ্রান্তে অরিন্দম অবাক হয়ে শোনে সে কান্না। ভালোবাসার কান্না।
এরপর যা কিছু তা সবই ক্ল্যাসিকাল। অরিন্দম খাবার আগে কোনদিন খেতো না মৌমিতা, না দুপুরে, না রাতে। ফোন দিয়ে শুনে নিতো, এই তুমি খেয়েছো? কতোটুকু নষ্ট করেছো?
অরিন্দম একদিন বললো, তুমি দেখি আমার মামুনি হয়ে যাচ্ছো।
আজ থেকে তোমাকে মামুনি বলে ডাকবো।
- আর তুমি হবে আমার টুনটুনি
- আমি টুনটুনি হবো না, বাঘ হবো
- আর আমি?
- তুমি বিড়াল হবে। আমি বলবো, হালুম আর তুমি বলবে মিউ।
এরপর থেকে ওরা মোবাইল ধরে আর হ্যালো বলতো না - সম্বোধন ছিলো মিউ আর হালুম। এমনকি চ্যাট স্ক্রীনে আলাপও শুরু হতো এটা দিয়েই।
অরিন্দম ছিলো আলসে, ক্লাস করতো না নিয়মিত। মেডিকেলে নিয়মিত ক্লাস না করলে পাস করা কঠিন।
অরিন্দমকে ঘুম থেকে ডেকে ক্লাসে নিয়ে যাওয়া ছিলো মেয়েটার আরেকটা নৈমিত্তিক কাজ।
আর রাতে কথা বলে ঘুম পাড়াতে হতো, অবশ্য কতো রাতকে যে ওরা কথা দিয়ে ভোর করে দিয়েছে তার কোন হিসেব কারো কাছে নেই।
একদিন ক্লাসে বসে মৌমিতা অরিন্দম কে বললো, এই শোনো, তোমাকে আমি যেসব নাম দিয়েছি তার একটা লিস্ট বানিয়েছি কাল রাতে।
অরিন্দম বললো, কই দেখি। মৌমিতা একটা চিরকুট বের করে দিলো ব্যাগ থেকে। অরিন্দম দেখলো গোটা গোটা করে এক গাদা নাম লেখা তাতে। সবগুলো নামেই মৌমিতা কোন না কোন দিন অরিন্দমকে ডেকেছে। গুটু, বাবু, টুনটুনি, পুটু - আরো কতো নাম! অরিন্দম মানিব্যাগে রেখে দিলো কাগজটা আর দু’দিন পরে হারিয়েও ফেললো।
অরিন্দম মেয়েদের শাড়ি পড়া পছন্দ করতো। আর তাই মৌমিতা পহেলা বৈশাখ, কালচারাল নাইট ছাড়াও যেদিনই ওদের বড় কোন পরীক্ষা শেষ হতো সেদিনই শাড়ি পড়তো আর ঘুরতে বের হতো অরিন্দম এর সাথে।
অরিন্দম রিকসায় উঠে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকতো।
মৌমিতা বলতো, এভাবে তাকিয়ো না, রাস্তায় লোকজন আছে।
অরিন্দম বলতো, মাঝে মাঝে মনে হয়, আমি প্রেম করছিনা, সংসার করছি তোমার সাথে।
এই ধর এখন আমাদের বাসায় যাচ্ছি। ধরে ঢুকেই তুমি আমার জন্য ঠান্ডা এক গ্লাস শরবত নিয়ে আসবে। আমিও তোমার পিছে পিছে রান্নাঘরে যাবো। এরপর তুমি রান্নার আয়োজন করবে আর আমি তোমাকে জালাবো। কখনো তোমার আঁচল ধরে টানবো, কখনো চুলের খোপা খুলে দিয়ে দৌড় দেবো।
তুমি অনেক বকা দেবে। দুপুরে খাবার পরে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দেবে। পিঠে হাত বুলিয়ে দেবে। আর এরপর আমার দিকে তাকিয়ে ঘুমিয়ে যাবে যেন ঘুম থেকে উঠেই আমি তোমাকে দেখতে পাই।
এক সাথে একই স্বপ্ন দেখতো ওরা দু’জন।
অবশ্য অনেকখানি সংসারের সরলপাঠ ওরা পড়েই ফেলেছিলো। মাঝেই মাঝেই ওরা একসাথে গিয়ে বাজার করে নিয়ে আসতো। এরপর মৌমিতা হোস্টেলে ফিরে রান্না করতো অনেক যত্ন নিয়ে। বাজারে যেতে কখনোই ভালো লাগতো না অরিন্দমের, বোরিং একটা কাজ। তবে মেয়েটার হাতের রান্না খাবার লোভে লোভে এই কষ্টকর কাজটাও করতো ও।
মৌমিতা সামনে বসে থেকে ওকে খাওয়াতো। নিজের হাতে খেলে অরিন্দম এর পেট ভরতো না, তাই রাঁধুনী নিজের হাতেই খাইয়ে দিতো।
অরিন্দম এর বাবা বেঁচে নেই। ওর কাঁধে চাপ তাই অনেক। মৌমিতা বলতো, তোমাকে আমি কোনদিনই চাপ দেবো না।
জোর করে নিজের করে নিতে চাইবো না। তবে যেদিন তোমার দায়িত্বের বোঝা একটু কমবে আর অন্য কিছু নিয়ে ভাবার সময় হবে, আমার কথা একটু ভেবো। আমি অন্য কোন পুরুষের হতে চাইনা।
অরিন্দম বললো, আমি একটা ছোট পৃথিবী বানিয়েছি মনে মনে। ওখানে আমার একটা ঘর আছে।
ঘরে তুমি আছো আর তোমার কোলে আছে হাফ ডজন ছেলেপুলে। বলেই অরিন্দম হো হো করে হাসে। মৌমিতার হাসি পায় না।
(দুই)
আজ মৌমিতার ডেলিভারি। সবাই দাঁড়িয়ে আছে লেবার রুমেই বাইরে।
সবার চোখে মুখে টেনশন। কিছু একটা কম্পলিকেশন ডেভেলপ করেছে। হয়তো যেকোন সময় ওটিতে নিতে হতে পারে। অরিন্দম দৌড়াদোড়ি করছে। আরো দু’ব্যাগ ব্লাড রেডি রাখা প্রয়োজন।
ভেতর থেকে বের হয়ে দুটো ফোন কল করে আবার ভেতরে ডুকে গেলো ও যেখানে মৌমিতা আছে। অনেক বড় একজন গাইনেকোলগিস্ট দায়িত্বে আছেন। তারপর কেউই নিশ্চিন্ত হতে পারছেনা। বাচ্চার ব্রীচ প্রেজেন্টেশন হয়েছে, সাথে মা’রও কিছু সমস্যা তৈরী হয়েছে। ওদের অনেক বন্ধু-বান্ধবও এসেছে।
অরিন্দম এবার বাইরে বেরিয়ে এলো।
আরো ঘন্টা খানেক কাটলো এমনই উতকন্ঠায়। মৌমিতার মা-বাবা রীতিমতো অসুস্থ হয়ে পড়েছেন।
অবশেষে মৌমিতা মা হলো, তারার আলোর মতো গায়ের রঙের একটা বাবুনি হলো ওর। মেয়ের নাম মৌমিতা আর অরিন্দম এর আগেরই ঠিক করা - নন্দিনী।
অরিন্দম ওকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। অরিন্দম এর চোখে জল। জল শুধু চোখেই জমে নেই, চোখের সীমানা পেরিয়ে ধীরে ধীরে নেমেও এসেছে অনেক দূরে। সবাই দেখছে ওরা চোখের জল।
বাবুনি এখনো চোখ খোলে নি।
চোখ খুলে কি আমাকে দেখতে পাবে, অরিন্দম ভাবে মনে মনে।
সুঠামদেহী সুদর্শন একজন ভদ্রলোক এগিয়ে আসে ওর দিকে। অরিন্দম তার কোলে মেয়েটাকে তুলে দিয়ে বলে, তারার আলোর মতো মেয়ে হয়েছে আপনার। মৌমিতাও ভালো আছে।
লোকটি ততোধিক বিনয়ের সাথে বলে, থ্যাঙ্ক ইউ অরিন্দম - তুমি আজ না থাকলে এই সিচুয়েশন টা যে কীভাবে ডিল করতাম জানিনা।
আমি তোমার কাছে আজীবন কৃতজ্ঞ হয়ে রইলাম। থ্যাঙ্ক ইউ বাডি।
অরিন্দম চোখ মুছে একবার হাসলো।
[হয়তো আমার এ গল্প পুরোটাই কাল্পনিক, কিংবা হয়তো না। গল্পটা আপনাদের সবার জন্য, এর পেছনের সত্য টুকু কেবল আমার কাছেই থাকুক]
কৃতজ্ঞতাঃ রাজীব দা
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।