আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আমার কান্না লিখছি আমি,তোমার কান্না তুমি বলো !!

গায়ের ময়লা রঙ্গিলা জামায়, পুঁতি গন্ধ গোলাপ, আর কামে ভরা দেহের মধ্যে- জলের সন্তরণ, শুধুই জলের সন্তরণ !

আমরা মেডিকেলের ছাত্র, একদিন কপালে থাকলে ডাক্তার হব। একসময় ব্যাপারটা ভেবে গর্ব বোধ করতাম,কিন্তু গতকালের পর ব্যপারটা নিয়ে লজ্জা বোধ করতে শুরু করলাম। কেন পড়ি এই মেডিকেল কলেজে? একজন হবু ডাক্তার হয়ে একটা ল্যাব এর সুইপার এর হাতে মার খাওয়ার জন্য? তাদের পায়ের নিচে পিষ্ট হওয়ার জন্য? উপরন্ত সেই ল্যাবে,যা চলে আমাদেরই মত অসংখ্য ডাক্তারের বদান্যতায়? আমাদের স্বনামধন্য বেশকিছু জাতীয় পত্রিকা সমগ্র ব্যাপারটাকে যেভাবে তুলে ধরেছেন, তাতে নিজেদের ডাকাত,সন্ত্রাসী ছাড়া আর কিছু মনে হচ্ছে না। এই নোটটি আমি ২টা অংশে লিখব, প্রথম অংশে একজন প্রত্যক্ষদশী হিসেবে সত্য ঘটনার বিবরণ দেয়ার চেষ্টা করব, ২য় অংশে এই বিষয়ে আমার কিছু কথা। একটু বেশিই হয়ত লম্বা হয়ে যাবে,তবে সবাই যদি একটু কষ্ট করে পড়েন, ভালো লাগবে।

ঘটনার বিবরণঃ রাত ৮.৩০ এর মত বাজে। ৫জন মেডিকেল ছাত্র তাদের একজনের টেস্ট রিপোট আনতে পাঁচলাইশে অবস্থিত শেভরন নামক ক্লিনিক্যাল ল্যাবে যায়। তাদের প্রত্যেকেরই পরদিন সকালে পরীক্ষা ছিল। ১৫মিনিটের মত লাইনে অপেক্ষা করার পর তাদের একজন ৮টা ৪৪ মিনিটে বললো- -ভাইয়া, আমরা মেডিকেলের ছাত্র, কালকে পরীক্ষা আছে,যদি কষ্ট করে আমাদেরকে একটু আগে বিদায় করেন,ভালো হয়। রিসিপশনিস্টঃ মেডিকেল স্টুডেন্ট হইসেন দেখে কি বাল ছিঁড়ে ফেলসেন নাকি? -দেখেন ভাইয়া, আমাদের স্যাররা আপনাদের এখানে চেম্বার করে,তারাও আমাদের সাথে এভাবে কথা বলে না।

ভদ্রভাবে কথা বলেন। মহিলা রিসিপশনিস্টঃ এই, এই মাগীর পুত গুলারে বাঁধ। বাঁইন্ধা মার। সাথে সাথে ১০-১১ জনের মত কর্মচারী তাদের দুইজনকে ঘিরে ফেলে। তাদেরকে হাত পিছমোড়া করে নিয়ে সামনে থেকে একজন ঘুষি মারতে থাকে।

আরেকজনকে মাটিতে শুইয়ে অনবরত পা দিয়ে লাথি মারা হতে থাকে। এরই মাঝে একজন ছাত্রের মোবাইল ও মানিব্যাগ সরিয়ে নেয় তারা। শব্দ শুনে বাইরে অপেক্ষারত অপর ৩জন ছুটে আসে, তারা অবস্থা দেখে হতবাক হয়ে যায়। কোনভাবে তাদেরকে সরিয়ে তারা বাইরে চলে আসে এবং হোস্টেলে ফোন দেয়। এক এক করে প্রায় ৮০-৯০জন ছেলে শেভরন এর সামনে চলে আসে।

পুরো ল্যাব ঘিরে ফেলা হয়। প্রথমে সাধারণ রোগীদের বের করে দেয়া হয়। ছাত্ররা স্লোগান দিতে থাকে-“শুধু যারা গায়ে হাত তুলেছে, তাদেরকে বের করে দেয়া হোক, তাদের আর কোন দাবী নাই, ল্যাবের কোন ক্ষতি হবে না”। ম্যানেজমেন্টের কয়েকজন বের হয়ে আসেন, তারা দাবী করেন,এই ধরনের কোনকিছুই ঘটেনি। তারা CCTV দেখার আমন্ত্রন জানান।

এরই মাঝে প্রায় ৫০জন দাঙ্গা পুলিশ ঘটনাস্থল ঘিরে ফেলে। টিভি দেখার সময় একজন পুলিশ অফিসার,ল্যাব এর ম্যানেজার এবং সাধারন ছাত্ররা উপস্থিত ছিল। ঘটনা যা সত্যি ছিল, তাই ক্যামেরায় ধরা পড়ে। অনেকে এ দৃশ্য সহ্য করতে না পেরে আবেগপ্রবণ হয়ে উঠে। সাথে সাথে ছাত্ররা ফুঁসে উঠে,ল্যাবের ভেতরে সব ভেঙ্গে চুরমাচুর করে দেয়া হয়।

শেভরন এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক বের হয়ে আসেন,তিনি কথা দেন, ১০মিনিটের মাঝে সেই কর্মচারীগুলোকে তাদের হাতে তুলে দেয়া হবে। ছাত্ররা বের হয়ে রাস্তায় অবস্থান নেয়। ২০মিনিট পরেও যখন কিছু হলো না,তখন ছাত্ররা ইট মারা শুরু করে। ক্রমাগত ঢিলের আঘাতে শেভরন এর সামনের বেশ খানিকটা অংশ ধসে পড়ে। আবার বের হয়ে আসেন সেই ভদ্রলোক,তিনি বলেন,সেই লোকগুলি পালিয়ে গেছে।

তিনি আর কিছুক্ষন সময় নেন। আসলে কেউ-ই বুঝেননি, এ ছিল কালক্ষেপণের ষড়যন্ত্র। এই সময়ের মাঝেই আরো প্রায় ১৫০ দাঙ্গা পুলিশ উপস্থিত হয়। তাদের ধাওয়ায় সাধারণ ছাত্ররা পিছু হটতে বাধ্য হয়। তারা মেডিকেলের সামনের রাস্তা বন্ধ করে দেয়, হাসপাতাল এবং কলেজে তালা ঝুলিয়ে রাস্তায় অবস্থান নেয়।

সারারাত অবস্থানের পর সকালেও এই অবস্থা বজায় থাকে। সকালে সকল শিক্ষক,BMA-র নেতা, আ জ ম নাসিরউদ্দিন এবং শেভরনের পরিচালকদের একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। তারা ছাত্রদের দাবী মেনে নেয়ার আশ্বাস দেন। দাবীগুলো ছিল- ১। জড়িতদের শাস্তি প্রদান, ২।

প্রত্যেকটি জাতীয় পত্রিকায় আনুষ্ঠানিকভাবে ল্যাব এর পক্ষ থেকে ক্ষমা প্রাথনা, ৩। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে শেভরন নিষিদ্ধ ঘোষনা। আমার কথাঃ অনেকেই বলবেন,কুত্তা তোমারে কামড়াইলে তুমিও কুত্তারে কামড়াবা নাকি?তোমরা কেন ভাংচুর করলা?দেশে আইন আছে,এই সেই বহু কথা। । দেখেন,আমার সবচে ভাল বন্ধুকে আমার সামনে কয়েকটা রাস্তার মানুষ,যাদের আমাদের সামনে দাঁড়ানোর যোগ্যতা নাই,যখন বিনা কারণে মারে- তখন চুপ করে থাকাটা আমরা কোন স্মাটনেস মনে করি না।

যদি ওইখানে উগ্রতা প্রকাশ আমাদের unsmartness এর পরিচায়ক হয়,তাহলে আমি স্বীকার করে নিচ্ছি আমরা আপনাদের মত smart না, আমরা হতেও চাই না। আমার সেই বন্ধুর কয়েকদিন আগে এবডোমিনাল সাজারি হইসে,তাকে যখন ওই স্থানে একই জায়গায় মারা হয়, তখন অন্তত আমার মাথা ঠিক থাকে না। অনেকে প্রতিবাদ করবেন,মেডিকেল স্টুডেন্ট হয়ে কি মাথা কিনে ফেলসস নাকি যে লাইন এর আগে দিতে হবে? আমি বলি,হ্যাঁ,আমি মাথা কিনে ফেলসি। এই প্রতিটা ল্যাব চলে আমাদের মত অসংখ্য ডাক্তারের বদান্যতায়। প্রতিদিন এক CMC থেকে তারা আমাদের জন্য অন্তত এক লাখ টাকার ব্যবসা করে।

আমাদেরকে কি এটুকু চাহিদা থাকতে পারে না?এই সহজ ব্যাপারটা কেন প্রশ্ন-জর্জরিত হচ্ছে, বুঝলাম না। সর্বস্তরেই দেখুন, একজন বাস কন্ডাক্টর বা ড্রাইভার, অন্য বাসে উঠলে তাকে ভাড়া দিতে হয়না, একজন গ্রামীন ফোনের কর্মচারী বা কর্মকর্তা কল রেটের ক্ষেত্রে বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা ভোগ করেন, এটা সব পেশার সর্বস্তরেই স্বীকৃত সত্য, একই পেশার লোক নিজ পেশাগত ক্ষেত্রে কিছুটা সুবিধা পেতেই পারেন! ওরা তো সুবিধাটা ল্যাবে গিয়ে চেয়েছে, এমন তো নয় যে, ট্রেনের টিকিট কাটতে বা সিনেমার টিকিট কাটতে গিয়ে ওরা এই (তথাকথিত!) এলিটিসমের সুবিধা নিতে চেয়েছে। সব্বাই, সব পেশাজীবিরাই নিজ নিজ পেশাগত ক্ষেত্রে সুযোগ-সুবিধা ভোগ করবেন, আর আমাদের বেলাতেই রাজ্যের তত্ত্বকথার কপচা-কপচি!!! আর কাকে কি বলবো,আমার নিজের আপন বোন আমাকে এই প্রশ্ন নিয়ে খোঁটা দেয়। আমি তাকে বললাম,আমাকে তো অনেক আশা নিয়ে ডাক্তারি পড়াচ্ছো, যদি আজকে আমার বাবাকে আমি কোন একটা ল্যাবে নিয়ে যাই,আর এই ব্যবহার পাই,তখন তোমার কেমন লাগতো? একটা সুইপারের মাইর খাওয়ার জন্য ডাক্তার হব? কয়েকজন বলবেন,সুইপার হইসে দেখে সে কি মানুষ না? তাকে এত অবহেলা করার কি আছে? আমার প্রশ্ন সুইপার নিয়ে না,আমার প্রশ্ন সে কোন প্রেক্ষিতে কার গায়ে হাত দিলো? একটা ৩য় শ্রেণীর কর্মচারী যদি একটা মেডিকেল ছাত্রের সাথে এই ব্যবহার করে,তাহলে সে অন্যদের সাথে কি করে? ওই জায়গায় পুলিশ ছিল,সেই পুলিশও ভিডিও দেখে বলসে,এই অমানুষ গুলাকে মারেন,মারা উচিত,আমরা কিছু বলবো না। ওখানে দায়িত্বপ্রাপ্ত এক পুলিশ কমিশনার আমার বোন ছিলেন।

তিনিও সেই ভিডিও দেখে কেঁদে ফেলেন। এই হচ্ছে সেই মাইরের ভয়াবহতা। এতকিছুই তো হত না,যদি তারা তাদের কথা রাখতেন। প্রথম আলো তে প্রতিবেদন এসেছে,ছাত্রদের তান্ডবে শতাধিক গাড়ি ভাংচুর হয়েছে,শেভরনে লুটপাট হয়েছে। লিঙ্কটি দেখতে পারেন- Click This Link এতগুলা গাড়ি ভাংচুর করলাম আমরা,প্রশ্ন হচ্ছে গাড়ি গুলা গেলো কই?একটা গাড়ি কি কেউ দেখাতে পারবেন? আর যে রাস্তায় একটা গাড়িও ভাঙ্গা হয়,সে রাস্তায় কি আর ৯৯টা গাড়ি আসবে বলে আপনি মনে করেন? এতটা নগ্ন প্রতিবেদন এত জনপ্রিয় একটা পত্রিকার প্রথম প্রষ্ঠায় কিভাবে আসে? আরেক পত্রিকা তো এইটা ছাত্রলীগের তান্ডব বলেও বলে ফেললো।

যদি এই ঘটনা ছাত্রলীগের তান্ডব হয়,তাহলে আমি বলতে বাধ্য হচ্ছি, এই ক্যাম্পাসের প্রতিটা ছেলে-মেয়ে সক্রিয়ভাবে ছাত্রলীগ করে। কারণ,প্রত্যেকেই ওই স্থানে নিজ ইচ্ছায় অংশ নিয়েছে। আসল ঘটনা দেখতে চাইলে এখানে দেখতে পারেন- Click This Link আমি এই হলুদ টাকা খাওয়া সাংবাদিকতার প্রতিবাদ জানাই। আপনারা বলতে পারেন, আমরা যে সত্য বলছি তার কি প্রমাণ? নিচের ভিডিওটি দেখুন,এরপর আর কিছু বলার দরকার আছে বলে মনে হয় না- http://www.youtube.com/watch?v=3l854cIil3I আজ সকালে যখন ক্লাস বন্ধ করতে এক স্যারের কাছে গেলাম, উনি বললেন, ওরা মাইর খাইসে তো আমার কি?আমি কেন ক্লাস ছাড়বো? আশ্চয,এই আমাদের শিক্ষক। তবে মজার ব্যপার হল,ওনার এই কথা বলা সত্ত্বেও সব ছেলে মেয়ে ক্লাস ছেড়ে বের হয়ে আসে।

ওনার যদি সামান্যতম লজ্জাবোধ থেকে থাকে, ওনার আর কোনদিন ক্লাস নিতে আসার কথা না। ধন্য আমার জুনিয়ররা, ধন্য তোরা ! আমাদের প্রাণরসায়ন বিভাগের এক অধ্যাপিকা ওই মারামারির ঘটনার সময় ওখানে উপস্থিত ছিলেন। তার সামনে তার ছাত্রকে মারা হলো,তিনি বাধা দেয়া তো দূরের কথা,তিনি তাকে ডেকে বলেন,”বাবা,তোমরা ভাংচুর কোরো না,আমার গাড়িটা এখানে আছে !”। এখনো আমরা কোন স্যারের চেম্বারে গেলে সিরিয়াল নিতে হয়,মনে হয় আমরা শুধু ওই স্যার নয়,তার attendant এর কাছেও জিম্মি। আত্মীয়-স্বজন নিয়ে গেলে রীতিমত অপমান হতে হয়।

কে করবে আমাদের বিচার? এইসব মানুষরা? যারা ডাক্তার হয়েছেন ঠিকই, কিন্তু এখনো মানুষ হতে পারেননি? আমাদের অসংখ্য শিক্ষক কিন্তু এমন না,তারা এখনো তাদের ছাত্রদের জন্য সবকিছু করেন। বলতে পারি প্রদীপ স্যারের কথা,বলতে পারি আব্দুল্লাহ-আল-মাহমুদ স্যারের কথা। ঠিক এর বিপরীত চরিত্রও আছে, তাদের নাম আর নাই বা করলাম ! আরো একটা জিনিস অবাক হলাম,এতবড় একটা ঘটনা ঘটল,কিন্তু কয়েকজন ছাড়া একটা মেয়েকেও আমরা পাশে পাইনি। যারা ফোন করেছেন,তাদের সবার প্রথম কথা- ১। “মারামারি হবে তো? কলেজ বন্ধ হবে তো?” ২।

“আমরা কি টিকেট করে ফেলব?” ৩। “কালকে আইটেম হবে নাকি হবে না?” কিন্তু একবারো কেউ জিজ্ঞেস করেননি,আসতে হবে কিনা? ওই ছেলেগুলা কেমন আছে? বেঁচে আছে,না মারা গেছে? আমরা মেডিকেলের ছাত্র, আমরা নাকি ডাক্তারও হবো !! জানি এই পুরো ঘটনার কোন বিচার হয়ত হবে না, এইটা বাংলাদেশ। টাকা থাকলে এখানে বিচার বিভাগও কেনা যায়,বাঘের দুধ তো কিছুই না। তবে প্রত্যাশা করবো, এইরকম ঘটনা ভবিষ্যতে আর ঘটবে না। যদি ঘটে তবে তার দাঁত ভাঙ্গা জবাব দেয়ার জন্য যেন আমরা সবাই কে পাশে পাই।

এক শেভরন দিয়ে আমরা নিজেরাও শিক্ষা নিতে চাই,তাদেরকেও শিক্ষা দিতে চাই। আমার কলেজবান্ধবরা, একটা জিনিস শুধু মনে রাখবেন, এই ঘটনা আপনার সাথেও কিন্তু হতে পারে একদিন ! ভাল থাকবেন সবাই,আমরা ভাল নেই!!

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.