এখানে ক্লিক করুন(সমস্যা হলে)
এই মুহূর্তে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে আছেন নন্দিত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ। চিকি ৎসার জন্য নিউইয়র্কের পথে রওনা হওয়ার দুই দিন আগে তিনি মুখোমুখি হয়েছিলেনছুটির দিনের। সাক্ষা ৎকার নিয়েছেন আলীম আজিজ ও ইকবাল হোসাইন চৌধুরী
ধানমন্ডির ‘দখিন হাওয়া’র ফ্ল্যাটবাড়ির দরজাটা হাট করে খোলা। আমরা আসব বলে নয়, গৃহকর্তা ঘরের দরজা সব সময় উন্মুক্ত রাখতে চান বলে। বসার ঘরে বসি।
দেয়ালে ঝোলানো পূর্ণেন্দু পত্রী আর এস এম সুলতানের চিত্রকর্মে চোখ বোলাতে বোলাতেই গৃহকর্তা হুমায়ূন আহমেদ চলে আসেন আমাদের মাঝে। গায়ে সবুজরঙা বাটিকের পাঞ্জাবি আর লুঙ্গি। চোখে সোনালি ফ্রেমের চশমা।
আমরা ঘরের মাঝামাঝি একটা জায়গায় গিয়ে বসি। এক পাশে বুকশেলফ।
সেটা এনসাইক্লোপিডিয়া অব ব্রিটানিকা আর নানাবিধ জার্নালে ঠাসা। অন্য পাশে একটা অ্যাপল কম্পিউটার। একটা স্ট্যান্ডওয়ালা ফ্যান ঘুরছে। মাঝখানে একচিলতে বারান্দা।
হুমায়ূন আহমেদ গদিতে আয়েশ করে বসতে বসতে বলেন, শুরু করো।
এরপর আমাদের কথোপকথন শুরু হয়।
ইকবাল হোসাইন চৌধুরী: প্রথম আলোর ঈদসংখ্যায় আপনার মেঘের ওপর বাড়ি উপন্যাসটি পড়েছি। ভালো লেগেছে। আপনার অন্য উপন্যাসের তুলনায় অন্য রকম।
হুমায়ূন আহমেদ: বইটা আরেকটু বিশদভাবে লেখার দরকার ছিল।
এ ধরনের আরেকটা বই আমি লিখেছিলাম। বইটার নাম যখন গিয়েছে ডুবে পঞ্চমীর চাঁদ। এক লোক তাঁর বউকে খুন করে। মৃত বউয়ের সঙ্গে কথাবার্তা বলে।
মেঘের ওপর বাড়ি বইটা লিখতে গিয়ে প্রধান যে সমস্যা হয়েছে, সেটা ধর্মীয়।
মৃত্যুর পরবর্তী জগ ৎ নিয়ে যদি আমি এমন কিছু লিখি, যেটা ধর্মের সঙ্গে মেলে না, তাহলে ধর্মবিশ্বাসী লোকজন তো রাগ করবে। তবে এই বিষয় নিয়ে আগেও বই লেখা হয়েছে। আমাদের এখানে প্রথম এই বিষয় নিয়ে যিনি লেখেন, তিনি বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়। বইটার নাম দেবযান। এই বইয়ে তিনি মৃত্যুর পরের জগতের অনেক বর্ণনা দিয়েছেন।
মৃত্যু নিয়ে প্রায়ই ভাবি। মৃত্যুর পরের জগ ৎ নিয়েও অনেক ভাবনা-চিন্তা করেছি। সম্ভবত এটা থেকেই মেঘের উপর বাড়ি বইটার ভাবনা মাথায় এসে থাকবে।
ট্রেতে করে চা আসে। তিন কাপ।
এই ফাঁকে সঙ্গী আলীম আজিজ প্রসঙ্গ পাল্টান
আলীম আজিজ: দীর্ঘদিন ধরে আপনি লেখালেখি করছেন, এখন পেছনে তাকালে কী মনে হয়?
হুমায়ূন আহমেদ: মনে হয়, কিছু পরিশ্রম করেছি । কিছু অর্জন হয়তো আমার আছে। আমার স্ত্রী শাওন আমাকে বলে, ‘আমি খুব সৌভাগ্যবান একটা মেয়ে। কারণ, আমি প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠে দেখি, আমার স্বামী লিখছে। এর চেয়ে পবিত্র দৃশ্য আর কী হতে পারে!’ এই কথাটা আমাকে ভীষণ আনন্দিত করে।
আমি ভালো বোধ করি। এটাই লেখক জীবনের বড় পাওয়া মনে হয়।
আলীম আজিজ: অতীতের অনেক তুমুল জনপ্রিয় লেখক কালের গর্ভে হারিয়ে গেছেন।
হুমায়ূন আহমেদ: আমি অত্যন্ত ভাগ্যবান। লেখক হিসেবে আমার আজ প্রায় ৪০ বছর হয়ে গেল।
অথবা আরেকটা ব্যাপার হতে পারে, এত দিনে আসলে আর কোনো লেখক তৈরি হয়নি।
আমি নিজেকে মনে করি নতুন লেখকদের জন্য একটা বিভীষিকা। কথাটা বুঝিয়ে বলি। বিভীষিকা এই অর্থে যে, পাঠক বই কেনে লাইব্রেরি থেকে। বইয়ের বিক্রেতারা যেসব বই বিক্রি হবে, সেগুলো সাজিয়ে রাখে।
যেগুলো বিক্রি হয় না, সেগুলো রাখে না। তারা তো সাহিত্যসেবা করতে আসেনি। তারা চায় বই বিক্রি করতে। আমার নতুন বই বের হবে, আমি জায়গা দখল করব। দখলকৃত জায়গার পরিমাণ বাড়তেই থাকবে।
অন্যদের বই প্রদর্শন করারই সুযোগ নেই। এই অর্থে আমি একটা বিভীষিকা।
আরেকটা ভুল কথা আমার সম্পর্কে বলা হয়ে থাকে। আমি নাকি বইয়ের পাঠক বাড়িয়েছি। আমি কিন্তু পাঠক বাড়াইনি।
পাঠক বাড়ালে তো সবার বই-ই বেশি বেশি বিক্রি হতো। আমি শুধু আমার নিজের পাঠক বাড়িয়েছি। পাঠক যদি বাড়াতাম, তাহলে তো সব বইয়ের বিক্রি বাড়ত।
পড়ার ব্যাপারটা খুবই ব্যক্তিগত একটা বিষয়। যে বইটা তুমি পড়তে চাও না, সেটা তোমাকে বিনা পয়সায় উপহার দিয়ে সঙ্গে ২০০ টাকা দেওয়া হলেও তুমি বইটা পড়বে না।
জোর করে আর যা-ই হোক, কখনো বই পড়া হয় না।
আলীম আজিজ: কলম্বিয়ার বিশ্বখ্যাত সাহিত্যিক গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস একটা বয়সে এসে ঘোষণা দিয়েছিলেন লেখালেখি ছেড়ে দেওয়ার। আপনার কি সে রকম কিছু মনে হয়েছে?
হুমায়ূন আহমেদ: আমারও প্রায়ই মনে হয়, একটা ঘোষণা দিয়ে লেখালেখি ছেড়ে দিই। ছেড়ে দিয়ে বিশ্রাম করি। কিন্তু এটা হবে একটা লোক দেখানো ব্যাপার।
কারণ, আমি জানি, লেখালেখি ছাড়া বেঁচে থাকাটা আমার জন্য অসম্ভব। এই যে শরীরটরীর খারাপ, তাও কাগজ-কলম নিয়ে বসেছি। যেহেতু লেখালেখি ছাড়া থাকতে পারব না, আলতু-ফালতু ঘোষণা দিয়ে তো লাভ নাই। সাধারণত, আমি যে কথা বলি, সেটা রাখার চেষ্টা করি। যেমন, আমি বলতে চাই, ঘেটুপুত্র কমলা আমার পরিচালিত শেষ ছায়াছবি।
ইকবাল হোসাইন চৌধুরী: ছবিটির কাজ কি শেষ?
হুমায়ূন আহমেদ: ছবির সব কাজ শেষ। শুধু প্রিন্টটা করা হয়নি। প্রিন্ট হচ্ছে ব্যাংককে। প্রিন্টিংয়ে প্রচুর টাকা খরচ হচ্ছে। টাকার অঙ্কটা মোটামুটি আঁতকে ওঠার মতো।
ইকবাল হোসাইন চৌধুরী: আপনার সাম্প্রতিক কিছু লেখা পড়ে মনে হয়েছে, অমরত্ব বিষয়ে আপনার আগ্রহ আছে। ২০৪৫ সালের মধ্যে অমরত্বপ্রাপ্তির উপায় আবিষ্কৃত হবে—আপনি লিখেছেন।
হুমায়ূন আহমেদ: এটা আমার কথা না। এটা বিজ্ঞানীদের কথা। আমিও বিশ্বাস করি।
আমরা ক্রমশ সিঙ্গুলারিটির দিকে যাচ্ছি। কলম দাও, বুঝিয়ে বলি।
তাঁর হাতে বলপয়েন্ট কলম তুলে দিই। তিনি দারুণ আগ্রহের সঙ্গে কাগজে গ্রাফ এঁকে বোঝাতে শুরু করেন।
এই দেখো।
ধরো, এই রেখাটা হচ্ছে টাইম। আর এই দিকে আছে বড় আবিষ্কার। সব ক্ষেত্রে আমাদের জ্ঞান বাড়ছে। আমরা এখন কাছাকাছি চলে এসেছি। ২০২১ সাল নাগাদ জ্ঞান-বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে একটা বিস্ফোরণ হবে।
এই বিস্ফোরণটাই হচ্ছে সিঙ্গুলারিটি।
ইকবাল হোসাইন চৌধুরী: অমরত্ব যদি আমাদের নাগালে চলে আসে, ব্যাপারটা কেমন হবে?
হুমায়ূন আহমেদ: ইরিনা নামে একটা উপন্যাস আমি লিখেছি। সেখানে সবাই অমর। যেহেতু মানুষ অমর, তাই মানুষের উ ৎপাদন বন্ধ হয়ে যাবে। আরও অনেক কিছু ঘটবে।
এটার বড় ধরনের একটা সাইড এফেক্ট অবশ্যই থাকবে।
ইকবাল হোসাইন চৌধুরী: অথবা এমন কি হতে পারে যে মানুষ একসময় সবকিছুতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলল? যেহেতু তার আর মৃত্যুঝুঁকি, অনিশ্চয়তা—এসব কিছুই থাকছে না।
হুমায়ূন আহমেদ: এ রকম কিছুও হতে পারে। পুরো বিষয়টাই আসলে খুব বিচিত্র। আজকেই পত্রিকায় পড়লাম।
আমরা আসলে বর্তমানের চেয়ে সব সময় ৪০ মিলিসেকেন্ড পেছনে আছি। ৪০ মিলিসেকেন্ড লাগছে শরীরের সমস্ত বিষয়টা প্রসেস করতে। সব মিলিয়ে এত অদ্ভুত! আরেকটা কথা আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়। স্টিফেন হকিং বলছেন, বাইরের জগতের উন্নত প্রাণীর বিষয়ে চিন্তা না করাটাই ভালো। তারা যেন এখানে না আসে।
আমরা চিন্তা করছি, তারা এখানে এলে ভালো হয়। আসলে সেটা হবে না। ওরা তো অভাবনীয় উন্নত প্রযুক্তি নিয়ে আসবে। আমরা উন্নত প্রাণী। গরু-ছাগল আমরা কেটে খাই, আমাদের প্রয়োজনে।
অন্য বিশ্ব থেকে যারা আসবে, তাদের কাছে আমরা হব গরু-ছাগল। তখন সংঘাত অনিবার্য।
ইকবাল হোসাইন চৌধুরী: আপনি কি মনে করেন, অন্য গ্রহে উন্নত প্রাণী আছে?
হুমায়ূন আহমেদ: অবশ্যই আছে। না থাকার কোনো কারণ নেই। এখন পর্যন্ত ওদের সঙ্গে আমাদের দেখা হচ্ছে না কেন সেটাই আমি বুঝতে পারছি না।
ইকবাল হোসাইন চৌধুরী: SETI (সার্চ ফর এক্সট্রা-টেরিস্ট্রিয়াল ইনটেলিজেন্স) নামের একটা সংগঠন আছে। ওরা ভিনগ্রহের প্রাণীর অস্তিত্ব অনুসন্ধান করে। ওরা কিন্তু এখনো সে রকম কিছু পায়নি।
হুমায়ূন আহমেদ: আমি জানি। কিন্তু ভিনগ্রহের প্রাণীদের যদি অন্য কোনো সিস্টেম থাকে, তাহলে তো আমরা ওদের ধরতে পারব না।
ওদের কার্বন-বেসড লাইফ কেন হবে? ওদের সিলিকন-বেসড লাইফ হতে পারে। ওদের যদি ঠিক চোখ-কান না, অন্য কোনো সিস্টেম থাকে? তাহলে তো আমরা ওদের ধরতে পারব না।
ইকবাল হোসাইন চৌধুরী: ঘেটুপুত্র কমলা ছবির বিষয়টা একটু ভিন্ন ধাঁচের। এই নামে একটি গল্প আপনি লিখেছিলেন। ছবিটি কি কোনো বিতর্ক তৈরি করতে পারে?
হুমায়ূন আহমেদ: মূলত, গল্পটা থেকেই এই ছবি।
এখন তো এই কালচার নেই। গল্পে বিষয়টা আন্ডার কারেন্ট ছিল। ছবিতেও তা-ই। ছেলেটাকে নিয়ে দরজা বন্ধ করেছে, ওই পর্যন্তই। তবে পুরো বিষয়টা পরিষ্কারভাবে উঠে আসবে।
আমার শুধু একটা অনুরোধ, বাচ্চারা যেন এই ছবিটা না দেখে। আমার ছেলে আমাকে প্রশ্ন করেছে, ঘেটুপুত্র ছেলে, না মেয়ে? আমি চাইছি না বাচ্চারা এই ছবিটা দেখুক। ছবিটা নিয়ে বিতর্ক হতে পারে।
ইকবাল হোসাইন চৌধুরী: কোনো ঘেটুপুত্রের সঙ্গে কি আপনার দেখা হয়েছে?
হুমায়ূন আহমেদ: হ্যাঁ, দেখা হয়েছে। ২০-২৫ বছর আগে তো হবেই।
গল্পটা লিখেছি তারও পরে। জিনিসটা মাথায় ছিল। ঘেটুগান ছিল মূলত হাওরভিত্তিক। ওখানকার লোকদের তিন মাস কিছুই করার থাকে না। কর্ম ছাড়া একদল লোক কীভাবে বাঁচবে।
তারা গানবাজনা করে। গানগুলোর সুর ক্লাসিক্যাল। একদম ক্লাসিক্যাল সুর। দাঁড়াও, তোমাদের শোনাই।
প্রধান সহকারী পরিচালক জুয়েল রানা এসে অ্যাপল কম্পিউটারের পর্দায় ঘেটুপুত্র কমলার গান বাজিয়ে দেন—‘পাখি উড়ি লো...উড়ি লো’।
আমরা শুনি।
গান শেষে আবার আলাপে ফিরি।
ইকবাল হোসাইন চৌধুরী: আমি দেশের অনেক নামি জাদুশিল্পীর সঙ্গে কথা বলেছি। তাঁরা আপনাকে দেশের শীর্ষস্থানীয় একজন পামিং (হাত সাফাই) শিল্পী হিসেবে স্বীকার করেছেন।
হুমায়ূন আহমেদ: পামিং।
এটা শেখার জন্য বছরের পর বছর সাধনা করতে হয়। এখন আর কেউ সেটা করতে চায় না। আমার শুরুই হয়েছে পামিং দিয়ে। বছরের পর বছর আমি এর পেছনে সময় দিয়েছি। হাতের তালুতে পয়সা লুকানোর চেষ্টা করেছি।
ইকবাল হোসাইন চৌধুরী: আপনার প্রিয় জাদুশিল্পী কে?
হুমায়ূন আহমেদ: অবশ্যই জুয়েল আইচ। ম্যাজিকের প্রতি তাঁর যে আগ্রহ, ডেডিকেশন, সেটার কোনো তুলনা হয় না। আচ্ছা, বলে রাখি, আমার জাপানি ভাষায় একটা বই প্রকাশিত হচ্ছে।
ইকবাল হোসাইন চৌধুরী: এর আগে জাপানি টেলিভিশনে আপনার ওপর একটা তথ্যচিত্র প্রচারিত হয়েছে।
হুমায়ূন আহমেদ: হ্যাঁ।
সেটা বহুদিন আগে। এই বইটার নাম বনের রাজা। বাচ্চাদের বই। আমাদের এখানে অলংকরণ করেছিল ধ্রুব এষ। যেসব প্রাণীর কথা বলা হয়েছে, ওরা সেগুলো তৈরি করেছে।
তারপর সেগুলোর ছবি তুলেছে। খুব যত্ন নিয়ে করেছে বইটা।
ইকবাল হোসাইন চৌধুরী: হিমু প্রসঙ্গে আসি। হিমুর এবারের বইয়ে দেখা যাচ্ছে, মাজারের হুজুরের কাছে হার্ভার্ড পিএইচডি বল্টু ভাই, মানে একজন বড় বিজ্ঞানী, গিয়ে আশ্রয় নিচ্ছেন। মাজারে আসার পর তাঁর মাথার জট খুলে যাচ্ছে।
আপনার অবচেতন মনে, এটা ছিল যে বিজ্ঞান সবকিছুর উত্তর দিতে পারে না?
হুমায়ূন আহমেদ: হ্যাঁ, পারে না। বল্টু ভাইয়ের মতো বই পড়েই আমরা সবকিছু জানতে পারব না। যেমন, ওই হুজুর বলেছেন, যে চিনি খায়নি সে কি বই পড়ে বুঝতে পারবে চিনির কী স্বাদ?
ধর্ম এবং বিজ্ঞান দুটোই রহস্যময়।
ইকবাল হোসাইন চৌধুরী: আপনার লেখার মধ্যে এমনিতে মোটা দাগে কোনো ফর্মুলা খুঁজে পাওয়া কঠিন। কিন্তু অনেক সময় আপনাকে পাঠক ধরে রাখার কিছু সহজ কৌশল অবলম্বন করতে দেখি।
ধরা যাক, সাধারণ একটা লোকজ ধাঁধা আপনি বইয়ের শুরুতে ব্যবহার করছেন। যার উত্তর মেলে বইয়ের শেষের দিকে। এটা কি সচেতনভাবে করেন?
হুমায়ূন আহমেদ: এটা আসলে পাঠকের আগ্রহ ধরে রাখার জন্য করি। একটা পৃষ্ঠা পড়ার পর পাঠক যাতে পরের পৃষ্ঠাটা পড়ে। কৌশলটা যে খুব ভালো, তা বলব না।
তলস্তয়ের ওয়ার অ্যান্ড পিস। প্রথম দেড় শ পৃষ্ঠা আমার কাছে খুবই একঘেয়ে মনে হয়েছে। পাতার পর পাতা শুধুই একটা পার্টির বর্ণনা। কিন্তু যখন তুমি গল্পটার মধ্যে ঢুকে যাচ্ছো, তখন তুমি বারুদের গন্ধ পাবে। যুদ্ধটাকে অনুভব করতে পারবে।
আমি প্রথম পৃষ্ঠায় আটকে ফেলতে পেরেছি, তার মানে আমি বিরাট লেখক এটা ভাবার কোনো কারণ নেই। জাপানি লেখক হারুকি মুরাকামির একটা বই পড়ছি। পড়ে মুগ্ধ হলাম। তার গল্প বলার ধরন অসাধারণ। খুব সহজ কথা বলছে, কিন্তু একই সঙ্গে এত গভীর কথা বলে যাচ্ছে।
আলীম আজিজ: আপনি ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাস করেন?
হুমায়ূন আহমেদ: , ঈশ্বরবিশ্বাস আমার আছে। ধরা যাক, তুমি একটা গ্রহে গেছ। গ্রহটা দেখে তোমার মনে হতে পারে, চিরকাল ধরে গ্রহটা একই রকম আছে। কিন্তু সেখানে গিয়ে তুমি যদি একটা নাইকন ক্যামেরা দেখ, তোমাকে সেটা হাতে নিয়ে বলতেই হবে, এটার একজন কারিগর বা মেকার আছে।
সামান্য একটা প্লাস্টিকের ক্যামেরা দেখে তুমি বলছো এর একটা মেকার আছে।
ক্যামেরার কিন্তু অনেক সীমাবদ্ধতা আছে। তোমার পেছনে একটা মানুষ আছে। ক্যামেরায় পেছনের মানুষটাকে ফোকাস করার সঙ্গে সঙ্গে তুমি হয়ে যাবে আউট অব ফোকাস। আবার তোমাকে ফোকাস করার সঙ্গে সঙ্গে পেছনের জন হবে আউট অব ফোকাস।
মানুষের চোখের কিন্তু এই অসুবিধে নেই।
চোখ ক্যামেরার চেয়ে বহুগুণ শক্তিশালী। আমাদের শরীরে একটা যন্ত্র আছে, যার কাজ শরীরের সুগার-লেভেল ঠিক রাখা। মানুষের পুরো শরীর এমন বিচিত্র আর জটিল যন্ত্রপাতিতে ভরপুর। এসব জটিল ব্যাপার এক দিনে এমনি এমনি হয়ে গেছে, এটা আমার মনে হয় না। ‘ডারউইন থিওরি’ কী বলে? বলে, সারভাইভাল অব দ্য ফিটেস্ট।
বলে, পৃথিবীতে টিকে থাকতে হলে মানুষের সামনে নানা রকম বিপত্তি আসবে, সেগুলো জয় করতে গিয়ে আমরা এ রকম হয়ে গেছি। পশুর চোখ কিন্তু হলুদ। আর আমাদের চোখ সাদা। এটা হয়েছে, যাতে মানুষ অন্ধকারের মধ্যে নিজেরা নিজেদের চিনতে পারে। আমাদের টিকে থাকার জন্য এইটুকু জ্ঞানই তো যথেষ্ট ছিল।
কিন্তু মানুষের মাথায় এই জ্ঞান কীভাবে এল যে সে রীতিমতো ‘বিগ ব্যাং থিওরি’ আবিষ্কার করে ফেলল? এই এক্সট্রা-অর্ডিনারি জ্ঞানটা মানুষকে কে দিল? খেয়াল করলে দেখা যাবে, মানুষ সবার আগে যে বাড়িটা বানায়, সেটা একটা প্রার্থনাকক্ষ। সব জাতির মানুষের ক্ষেত্রেই তা-ই। তার মানে, সেই একদম শুরু থেকেই মানুষ আসলে একটা ব্যাপার নিয়ে চিন্তিত—হু ইজ গাইডিং মি?
ইকবাল হোসাইন চৌধুরী: মৃত্যুর পরবর্তী জগ ৎ নিয়ে আপনার নিজের চিন্তাভাবনা কী?
হুমায়ূন আহমেদ: এই বিষয়ে আমার প্রবল একটা আগ্রহ সব সময় ছিল। একবার আমি চেষ্টা করলাম প্রার্থনা করব। প্রতিদিন একটা সময়ে বসি।
পৃথিবী থেকে বিদায়মুহূর্তটা কেমন হবে, এটা জানা যায় কি না চেষ্টা করি। দিনের পর দিন এটা চলল। তখন আমি একটা স্বপ্ন দেখলাম। স্বপ্ন আমাকে দেখানো হলো। অথবা আরেকটা ব্যাপার হতে পারে, দিনের পর দিন একটা ব্যাপার চিন্তা করার ফলে আমার মস্তিষ্ক সেটা তৈরি করল।
অনেক বড় বিজ্ঞানীর বেলায়ও এটা হয়েছে।
আমি কী স্বপ্নে দেখেছি সেটা বলি—
বিশাল একটা হাওর। হাওরের মধ্যে পানি, পানি আর পানি। কলাগাছের মতো একটা জিনিস ধরে আমি ভাসছি। পানি অল্প ঠান্ডা।
কলাগাছের মতো জিনিসটা মনে হচ্ছে একটা যান। সেটা আমাকে নিয়ে যাচ্ছে। কিছুদূর গিয়ে মনে হলো—মাই গড! এ তো আনন্দের পৃথিবী ছেড়ে আমি চলে যাচ্ছি! সঙ্গে সঙ্গে যাত্রা বন্ধ হলো। আবার ফিরে এলাম। আমার এই বাড়িঘর—সব আগের মতো।
আমি দেখলাম। তখন আমার মনে হলো—আর কী? এবার যাই। আমার যাত্রা আবার শুরু হলো। অনেক দূর গিয়ে আবার মনে হলো—ও মাই গড! সব ফেলে আমি কোথায় যাচ্ছি! আবার ফিরে এলাম। তারপর আবার মনে হলো—এই তো সব।
আর কী? এরপর যানটা একটা অকল্পনীয় গতিতে ছুটতে শুরু করল। কোন দিকে যাচ্ছি, কিছুই বুঝতে পারছি না। দূরে ছোট্ট একটা আলো।
এটাই হচ্ছে আমার অভিজ্ঞতা। হতে পারে, আমার মস্তিষ্ক এটা তৈরি করেছে।
আবার না-ও হতে পারে।
ইকবাল হোসাইন চৌধুরী: মেঘের ওপর বাড়ি বইয়ের কেন্দ্রীয় চরিত্রকে আমরা দেখি, নিয়ন্ত্রণ করছে অন্য একজন।
হুমায়ূন আহমেদ: আমরা তো সাধারণ মানুষ। রবীন্দ্রনাথ কী বলে গেছেন? বলে গেছেন, আমি তো লিখি না, জীবনদেবতা আমাকে দিয়ে লেখান। আবার, এমনও হতে পারে, আমরা খুব অসহায় বোধ করি বলেই একজন বড় পথনির্দেশকের কথা চিন্তা করি।
ইকবাল হোসাইন চৌধুরী: আপনি দীর্ঘদিন যুক্তরাষ্ট্রে ছিলেন।
দেশটা আপনার কেমন লাগে?
হুমায়ূন আহমেদ: ওখানে যাওয়াটা আমার জন্য ভয়ের ব্যাপার। দীর্ঘ বিমান ভ্রমণ খুবই ক্লান্তিকর। আর বিমান ভ্রমণ আমার জন্য এমনিতেই আতঙ্কজনক। কারণ আমার উচ্চতাভীতি আছে।
সারাক্ষণ মনে হতে থাকে—এই বুঝি সব ভেঙেচুরে নিচে পড়ে যাব।
দুপুর দুইটা মতো বাজে। আমরা আলাপ শেষে ‘দখিন হাওয়া’ থেকে বেরিয়ে আসি।
ঘণ্টা চল্লিশেক পরে তিনি উড়াল দেবেন যুক্তরাষ্ট্রেরএখানে ক্লিক করুন(সমস্যা হলে)
এই মুহূর্তে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে আছেন নন্দিত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ। চিকি ৎসার জন্য নিউইয়র্কের পথে রওনা হওয়ার দুই দিন আগে তিনি মুখোমুখি হয়েছিলেনছুটির দিনের।
সাক্ষা ৎকার নিয়েছেন আলীম আজিজ ও ইকবাল হোসাইন চৌধুরী
ধানমন্ডির ‘দখিন হাওয়া’র ফ্ল্যাটবাড়ির দরজাটা হাট করে খোলা। আমরা আসব বলে নয়, গৃহকর্তা ঘরের দরজা সব সময় উন্মুক্ত রাখতে চান বলে। বসার ঘরে বসি। দেয়ালে ঝোলানো পূর্ণেন্দু পত্রী আর এস এম সুলতানের চিত্রকর্মে চোখ বোলাতে বোলাতেই গৃহকর্তা হুমায়ূন আহমেদ চলে আসেন আমাদের মাঝে। গায়ে সবুজরঙা বাটিকের পাঞ্জাবি আর লুঙ্গি।
চোখে সোনালি ফ্রেমের চশমা।
আমরা ঘরের মাঝামাঝি একটা জায়গায় গিয়ে বসি। এক পাশে বুকশেলফ। সেটা এনসাইক্লোপিডিয়া অব ব্রিটানিকা আর নানাবিধ জার্নালে ঠাসা। অন্য পাশে একটা অ্যাপল কম্পিউটার।
একটা স্ট্যান্ডওয়ালা ফ্যান ঘুরছে। মাঝখানে একচিলতে বারান্দা।
হুমায়ূন আহমেদ গদিতে আয়েশ করে বসতে বসতে বলেন, শুরু করো। এরপর আমাদের কথোপকথন শুরু হয়।
ইকবাল হোসাইন চৌধুরী: প্রথম আলোর ঈদসংখ্যায় আপনার মেঘের ওপর বাড়ি উপন্যাসটি পড়েছি।
ভালো লেগেছে। আপনার অন্য উপন্যাসের তুলনায় অন্য রকম।
হুমায়ূন আহমেদ: বইটা আরেকটু বিশদভাবে লেখার দরকার ছিল।
এ ধরনের আরেকটা বই আমি লিখেছিলাম। বইটার নাম যখন গিয়েছে ডুবে পঞ্চমীর চাঁদ।
এক লোক তাঁর বউকে খুন করে। মৃত বউয়ের সঙ্গে কথাবার্তা বলে।
মেঘের ওপর বাড়ি বইটা লিখতে গিয়ে প্রধান যে সমস্যা হয়েছে, সেটা ধর্মীয়। মৃত্যুর পরবর্তী জগ ৎ নিয়ে যদি আমি এমন কিছু লিখি, যেটা ধর্মের সঙ্গে মেলে না, তাহলে ধর্মবিশ্বাসী লোকজন তো রাগ করবে। তবে এই বিষয় নিয়ে আগেও বই লেখা হয়েছে।
আমাদের এখানে প্রথম এই বিষয় নিয়ে যিনি লেখেন, তিনি বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়। বইটার নাম দেবযান। এই বইয়ে তিনি মৃত্যুর পরের জগতের অনেক বর্ণনা দিয়েছেন। মৃত্যু নিয়ে প্রায়ই ভাবি। মৃত্যুর পরের জগ ৎ নিয়েও অনেক ভাবনা-চিন্তা করেছি।
সম্ভবত এটা থেকেই মেঘের উপর বাড়ি বইটার ভাবনা মাথায় এসে থাকবে।
ট্রেতে করে চা আসে। তিন কাপ। এই ফাঁকে সঙ্গী আলীম আজিজ প্রসঙ্গ পাল্টান
আলীম আজিজ: দীর্ঘদিন ধরে আপনি লেখালেখি করছেন, এখন পেছনে তাকালে কী মনে হয়?
হুমায়ূন আহমেদ: মনে হয়, কিছু পরিশ্রম করেছি । কিছু অর্জন হয়তো আমার আছে।
আমার স্ত্রী শাওন আমাকে বলে, ‘আমি খুব সৌভাগ্যবান একটা মেয়ে। কারণ, আমি প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠে দেখি, আমার স্বামী লিখছে। এর চেয়ে পবিত্র দৃশ্য আর কী হতে পারে!’ এই কথাটা আমাকে ভীষণ আনন্দিত করে। আমি ভালো বোধ করি। এটাই লেখক জীবনের বড় পাওয়া মনে হয়।
আলীম আজিজ: অতীতের অনেক তুমুল জনপ্রিয় লেখক কালের গর্ভে হারিয়ে গেছেন।
হুমায়ূন আহমেদ: আমি অত্যন্ত ভাগ্যবান। লেখক হিসেবে আমার আজ প্রায় ৪০ বছর হয়ে গেল। অথবা আরেকটা ব্যাপার হতে পারে, এত দিনে আসলে আর কোনো লেখক তৈরি হয়নি।
আমি নিজেকে মনে করি নতুন লেখকদের জন্য একটা বিভীষিকা।
কথাটা বুঝিয়ে বলি। বিভীষিকা এই অর্থে যে, পাঠক বই কেনে লাইব্রেরি থেকে। বইয়ের বিক্রেতারা যেসব বই বিক্রি হবে, সেগুলো সাজিয়ে রাখে। যেগুলো বিক্রি হয় না, সেগুলো রাখে না। তারা তো সাহিত্যসেবা করতে আসেনি।
তারা চায় বই বিক্রি করতে। আমার নতুন বই বের হবে, আমি জায়গা দখল করব। দখলকৃত জায়গার পরিমাণ বাড়তেই থাকবে। অন্যদের বই প্রদর্শন করারই সুযোগ নেই। এই অর্থে আমি একটা বিভীষিকা।
আরেকটা ভুল কথা আমার সম্পর্কে বলা হয়ে থাকে। আমি নাকি বইয়ের পাঠক বাড়িয়েছি। আমি কিন্তু পাঠক বাড়াইনি। পাঠক বাড়ালে তো সবার বই-ই বেশি বেশি বিক্রি হতো। আমি শুধু আমার নিজের পাঠক বাড়িয়েছি।
পাঠক যদি বাড়াতাম, তাহলে তো সব বইয়ের বিক্রি বাড়ত।
পড়ার ব্যাপারটা খুবই ব্যক্তিগত একটা বিষয়। যে বইটা তুমি পড়তে চাও না, সেটা তোমাকে বিনা পয়সায় উপহার দিয়ে সঙ্গে ২০০ টাকা দেওয়া হলেও তুমি বইটা পড়বে না। জোর করে আর যা-ই হোক, কখনো বই পড়া হয় না।
আলীম আজিজ: কলম্বিয়ার বিশ্বখ্যাত সাহিত্যিক গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস একটা বয়সে এসে ঘোষণা দিয়েছিলেন লেখালেখি ছেড়ে দেওয়ার।
আপনার কি সে রকম কিছু মনে হয়েছে?
হুমায়ূন আহমেদ: আমারও প্রায়ই মনে হয়, একটা ঘোষণা দিয়ে লেখালেখি ছেড়ে দিই। ছেড়ে দিয়ে বিশ্রাম করি। কিন্তু এটা হবে একটা লোক দেখানো ব্যাপার। কারণ, আমি জানি, লেখালেখি ছাড়া বেঁচে থাকাটা আমার জন্য অসম্ভব। এই যে শরীরটরীর খারাপ, তাও কাগজ-কলম নিয়ে বসেছি।
যেহেতু লেখালেখি ছাড়া থাকতে পারব না, আলতু-ফালতু ঘোষণা দিয়ে তো লাভ নাই। সাধারণত, আমি যে কথা বলি, সেটা রাখার চেষ্টা করি। যেমন, আমি বলতে চাই, ঘেটুপুত্র কমলা আমার পরিচালিত শেষ ছায়াছবি।
ইকবাল হোসাইন চৌধুরী: ছবিটির কাজ কি শেষ?
হুমায়ূন আহমেদ: ছবির সব কাজ শেষ। শুধু প্রিন্টটা করা হয়নি।
প্রিন্ট হচ্ছে ব্যাংককে। প্রিন্টিংয়ে প্রচুর টাকা খরচ হচ্ছে। টাকার অঙ্কটা মোটামুটি আঁতকে ওঠার মতো।
ইকবাল হোসাইন চৌধুরী: আপনার সাম্প্রতিক কিছু লেখা পড়ে মনে হয়েছে, অমরত্ব বিষয়ে আপনার আগ্রহ আছে। ২০৪৫ সালের মধ্যে অমরত্বপ্রাপ্তির উপায় আবিষ্কৃত হবে—আপনি লিখেছেন।
হুমায়ূন আহমেদ: এটা আমার কথা না। এটা বিজ্ঞানীদের কথা। আমিও বিশ্বাস করি। আমরা ক্রমশ সিঙ্গুলারিটির দিকে যাচ্ছি। কলম দাও, বুঝিয়ে বলি।
তাঁর হাতে বলপয়েন্ট কলম তুলে দিই। তিনি দারুণ আগ্রহের সঙ্গে কাগজে গ্রাফ এঁকে বোঝাতে শুরু করেন।
এই দেখো। ধরো, এই রেখাটা হচ্ছে টাইম। আর এই দিকে আছে বড় আবিষ্কার।
সব ক্ষেত্রে আমাদের জ্ঞান বাড়ছে। আমরা এখন কাছাকাছি চলে এসেছি। ২০২১ সাল নাগাদ জ্ঞান-বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে একটা বিস্ফোরণ হবে। এই বিস্ফোরণটাই হচ্ছে সিঙ্গুলারিটি।
ইকবাল হোসাইন চৌধুরী: অমরত্ব যদি আমাদের নাগালে চলে আসে, ব্যাপারটা কেমন হবে?
হুমায়ূন আহমেদ: ইরিনা নামে একটা উপন্যাস আমি লিখেছি।
সেখানে সবাই অমর। যেহেতু মানুষ অমর, তাই মানুষের উ ৎপাদন বন্ধ হয়ে যাবে। আরও অনেক কিছু ঘটবে। এটার বড় ধরনের একটা সাইড এফেক্ট অবশ্যই থাকবে।
ইকবাল হোসাইন চৌধুরী: অথবা এমন কি হতে পারে যে মানুষ একসময় সবকিছুতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলল? যেহেতু তার আর মৃত্যুঝুঁকি, অনিশ্চয়তা—এসব কিছুই থাকছে না।
হুমায়ূন আহমেদ: এ রকম কিছুও হতে পারে। পুরো বিষয়টাই আসলে খুব বিচিত্র। আজকেই পত্রিকায় পড়লাম। আমরা আসলে বর্তমানের চেয়ে সব সময় ৪০ মিলিসেকেন্ড পেছনে আছি। ৪০ মিলিসেকেন্ড লাগছে শরীরের সমস্ত বিষয়টা প্রসেস করতে।
সব মিলিয়ে এত অদ্ভুত! আরেকটা কথা আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়। স্টিফেন হকিং বলছেন, বাইরের জগতের উন্নত প্রাণীর বিষয়ে চিন্তা না করাটাই ভালো। তারা যেন এখানে না আসে। আমরা চিন্তা করছি, তারা এখানে এলে ভালো হয়। আসলে সেটা হবে না।
ওরা তো অভাবনীয় উন্নত প্রযুক্তি নিয়ে আসবে। আমরা উন্নত প্রাণী। গরু-ছাগল আমরা কেটে খাই, আমাদের প্রয়োজনে। অন্য বিশ্ব থেকে যারা আসবে, তাদের কাছে আমরা হব গরু-ছাগল। তখন সংঘাত অনিবার্য।
ইকবাল হোসাইন চৌধুরী: আপনি কি মনে করেন, অন্য গ্রহে উন্নত প্রাণী আছে?
হুমায়ূন আহমেদ: অবশ্যই আছে। না থাকার কোনো কারণ নেই। এখন পর্যন্ত ওদের সঙ্গে আমাদের দেখা হচ্ছে না কেন সেটাই আমি বুঝতে পারছি না।
ইকবাল হোসাইন চৌধুরী: SETI (সার্চ ফর এক্সট্রা-টেরিস্ট্রিয়াল ইনটেলিজেন্স) নামের একটা সংগঠন আছে। ওরা ভিনগ্রহের প্রাণীর অস্তিত্ব অনুসন্ধান করে।
ওরা কিন্তু এখনো সে রকম কিছু পায়নি।
হুমায়ূন আহমেদ: আমি জানি। কিন্তু ভিনগ্রহের প্রাণীদের যদি অন্য কোনো সিস্টেম থাকে, তাহলে তো আমরা ওদের ধরতে পারব না। ওদের কার্বন-বেসড লাইফ কেন হবে? ওদের সিলিকন-বেসড লাইফ হতে পারে। ওদের যদি ঠিক চোখ-কান না, অন্য কোনো সিস্টেম থাকে? তাহলে তো আমরা ওদের ধরতে পারব না।
ইকবাল হোসাইন চৌধুরী: ঘেটুপুত্র কমলা ছবির বিষয়টা একটু ভিন্ন ধাঁচের। এই নামে একটি গল্প আপনি লিখেছিলেন। ছবিটি কি কোনো বিতর্ক তৈরি করতে পারে?
হুমায়ূন আহমেদ: মূলত, গল্পটা থেকেই এই ছবি। এখন তো এই কালচার নেই। গল্পে বিষয়টা আন্ডার কারেন্ট ছিল।
ছবিতেও তা-ই। ছেলেটাকে নিয়ে দরজা বন্ধ করেছে, ওই পর্যন্তই। তবে পুরো বিষয়টা পরিষ্কারভাবে উঠে আসবে। আমার শুধু একটা অনুরোধ, বাচ্চারা যেন এই ছবিটা না দেখে। আমার ছেলে আমাকে প্রশ্ন করেছে, ঘেটুপুত্র ছেলে, না মেয়ে? আমি চাইছি না বাচ্চারা এই ছবিটা দেখুক।
ছবিটা নিয়ে বিতর্ক হতে পারে।
ইকবাল হোসাইন চৌধুরী: কোনো ঘেটুপুত্রের সঙ্গে কি আপনার দেখা হয়েছে?
হুমায়ূন আহমেদ: হ্যাঁ, দেখা হয়েছে। ২০-২৫ বছর আগে তো হবেই। গল্পটা লিখেছি তারও পরে। জিনিসটা মাথায় ছিল।
ঘেটুগান ছিল মূলত হাওরভিত্তিক। ওখানকার লোকদের তিন মাস কিছুই করার থাকে না। কর্ম ছাড়া একদল লোক কীভাবে বাঁচবে। তারা গানবাজনা করে। গানগুলোর সুর ক্লাসিক্যাল।
একদম ক্লাসিক্যাল সুর। দাঁড়াও, তোমাদের শোনাই।
প্রধান সহকারী পরিচালক জুয়েল রানা এসে অ্যাপল কম্পিউটারের পর্দায় ঘেটুপুত্র কমলার গান বাজিয়ে দেন—‘পাখি উড়ি লো...উড়ি লো’।
আমরা শুনি।
গান শেষে আবার আলাপে ফিরি।
ইকবাল হোসাইন চৌধুরী: আমি দেশের অনেক নামি জাদুশিল্পীর সঙ্গে কথা বলেছি। তাঁরা আপনাকে দেশের শীর্ষস্থানীয় একজন পামিং (হাত সাফাই) শিল্পী হিসেবে স্বীকার করেছেন।
হুমায়ূন আহমেদ: পামিং। এটা শেখার জন্য বছরের পর বছর সাধনা করতে হয়। এখন আর কেউ সেটা করতে চায় না।
আমার শুরুই হয়েছে পামিং দিয়ে। বছরের পর বছর আমি এর পেছনে সময় দিয়েছি। হাতের তালুতে পয়সা লুকানোর চেষ্টা করেছি।
ইকবাল হোসাইন চৌধুরী: আপনার প্রিয় জাদুশিল্পী কে?
হুমায়ূন আহমেদ: অবশ্যই জুয়েল আইচ। ম্যাজিকের প্রতি তাঁর যে আগ্রহ, ডেডিকেশন, সেটার কোনো তুলনা হয় না।
আচ্ছা, বলে রাখি, আমার জাপানি ভাষায় একটা বই প্রকাশিত হচ্ছে।
ইকবাল হোসাইন চৌধুরী: এর আগে জাপানি টেলিভিশনে আপনার ওপর একটা তথ্যচিত্র প্রচারিত হয়েছে।
হুমায়ূন আহমেদ: হ্যাঁ। সেটা বহুদিন আগে। এই বইটার নাম বনের রাজা।
বাচ্চাদের বই। আমাদের এখানে অলংকরণ করেছিল ধ্রুব এষ। যেসব প্রাণীর কথা বলা হয়েছে, ওরা সেগুলো তৈরি করেছে। তারপর সেগুলোর ছবি তুলেছে। খুব যত্ন নিয়ে করেছে বইটা।
ইকবাল হোসাইন চৌধুরী: হিমু প্রসঙ্গে আসি। হিমুর এবারের বইয়ে দেখা যাচ্ছে, মাজারের হুজুরের কাছে হার্ভার্ড পিএইচডি বল্টু ভাই, মানে একজন বড় বিজ্ঞানী, গিয়ে আশ্রয় নিচ্ছেন। মাজারে আসার পর তাঁর মাথার জট খুলে যাচ্ছে। আপনার অবচেতন মনে, এটা ছিল যে বিজ্ঞান সবকিছুর উত্তর দিতে পারে না?
হুমায়ূন আহমেদ: হ্যাঁ, পারে না। বল্টু ভাইয়ের মতো বই পড়েই আমরা সবকিছু জানতে পারব না।
যেমন, ওই হুজুর বলেছেন, যে চিনি খায়নি সে কি বই পড়ে বুঝতে পারবে চিনির কী স্বাদ?
ধর্ম এবং বিজ্ঞান দুটোই রহস্যময়।
ইকবাল হোসাইন চৌধুরী: আপনার লেখার মধ্যে এমনিতে মোটা দাগে কোনো ফর্মুলা খুঁজে পাওয়া কঠিন। কিন্তু অনেক সময় আপনাকে পাঠক ধরে রাখার কিছু সহজ কৌশল অবলম্বন করতে দেখি। ধরা যাক, সাধারণ একটা লোকজ ধাঁধা আপনি বইয়ের শুরুতে ব্যবহার করছেন। যার উত্তর মেলে বইয়ের শেষের দিকে।
এটা কি সচেতনভাবে করেন?
হুমায়ূন আহমেদ: এটা আসলে পাঠকের আগ্রহ ধরে রাখার জন্য করি। একটা পৃষ্ঠা পড়ার পর পাঠক যাতে পরের পৃষ্ঠাটা পড়ে। কৌশলটা যে খুব ভালো, তা বলব না। তলস্তয়ের ওয়ার অ্যান্ড পিস। প্রথম দেড় শ পৃষ্ঠা আমার কাছে খুবই একঘেয়ে মনে হয়েছে।
পাতার পর পাতা শুধুই একটা পার্টির বর্ণনা। কিন্তু যখন তুমি গল্পটার মধ্যে ঢুকে যাচ্ছো, তখন তুমি বারুদের গন্ধ পাবে। যুদ্ধটাকে অনুভব করতে পারবে। আমি প্রথম পৃষ্ঠায় আটকে ফেলতে পেরেছি, তার মানে আমি বিরাট লেখক এটা ভাবার কোনো কারণ নেই। জাপানি লেখক হারুকি মুরাকামির একটা বই পড়ছি।
পড়ে মুগ্ধ হলাম। তার গল্প বলার ধরন অসাধারণ। খুব সহজ কথা বলছে, কিন্তু একই সঙ্গে এত গভীর কথা বলে যাচ্ছে।
আলীম আজিজ: আপনি ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাস করেন?
হুমায়ূন আহমেদ: , ঈশ্বরবিশ্বাস আমার আছে। ধরা যাক, তুমি একটা গ্রহে গেছ।
গ্রহটা দেখে তোমার মনে হতে পারে, চিরকাল ধরে গ্রহটা একই রকম আছে। কিন্তু সেখানে গিয়ে তুমি যদি একটা নাইকন ক্যামেরা দেখ, তোমাকে সেটা হাতে নিয়ে বলতেই হবে, এটার একজন কারিগর বা মেকার আছে।
সামান্য একটা প্লাস্টিকের ক্যামেরা দেখে তুমি বলছো এর একটা মেকার আছে। ক্যামেরার কিন্তু অনেক সীমাবদ্ধতা আছে। তোমার পেছনে একটা মানুষ আছে।
ক্যামেরায় পেছনের মানুষটাকে ফোকাস করার সঙ্গে সঙ্গে তুমি হয়ে যাবে আউট অব ফোকাস। আবার তোমাকে ফোকাস করার সঙ্গে সঙ্গে পেছনের জন হবে আউট অব ফোকাস।
মানুষের চোখের কিন্তু এই অসুবিধে নেই। চোখ ক্যামেরার চেয়ে বহুগুণ শক্তিশালী। আমাদের শরীরে একটা যন্ত্র আছে, যার কাজ শরীরের সুগার-লেভেল ঠিক রাখা।
মানুষের পুরো শরীর এমন বিচিত্র আর জটিল যন্ত্রপাতিতে ভরপুর। এসব জটিল ব্যাপার এক দিনে এমনি এমনি হয়ে গেছে, এটা আমার মনে হয় না। ‘ডারউইন থিওরি’ কী বলে? বলে, সারভাইভাল অব দ্য ফিটেস্ট। বলে, পৃথিবীতে টিকে থাকতে হলে মানুষের সামনে নানা রকম বিপত্তি আসবে, সেগুলো জয় করতে গিয়ে আমরা এ রকম হয়ে গেছি। পশুর চোখ কিন্তু হলুদ।
আর আমাদের চোখ সাদা। এটা হয়েছে, যাতে মানুষ অন্ধকারের মধ্যে নিজেরা নিজেদের চিনতে পারে। আমাদের টিকে থাকার জন্য এইটুকু জ্ঞানই তো যথেষ্ট ছিল। কিন্তু মানুষের মাথায় এই জ্ঞান কীভাবে এল যে সে রীতিমতো ‘বিগ ব্যাং থিওরি’ আবিষ্কার করে ফেলল? এই এক্সট্রা-অর্ডিনারি জ্ঞানটা মানুষকে কে দিল? খেয়াল করলে দেখা যাবে, মানুষ সবার আগে যে বাড়িটা বানায়, সেটা একটা প্রার্থনাকক্ষ। সব জাতির মানুষের ক্ষেত্রেই তা-ই।
তার মানে, সেই একদম শুরু থেকেই মানুষ আসলে একটা ব্যাপার নিয়ে চিন্তিত—হু ইজ গাইডিং মি?
ইকবাল হোসাইন চৌধুরী: মৃত্যুর পরবর্তী জগ ৎ নিয়ে আপনার নিজের চিন্তাভাবনা কী?
হুমায়ূন আহমেদ: এই বিষয়ে আমার প্রবল একটা আগ্রহ সব সময় ছিল। একবার আমি চেষ্টা করলাম প্রার্থনা করব। প্রতিদিন একটা সময়ে বসি। পৃথিবী থেকে বিদায়মুহূর্তটা কেমন হবে, এটা জানা যায় কি না চেষ্টা করি। দিনের পর দিন এটা চলল।
তখন আমি একটা স্বপ্ন দেখলাম। স্বপ্ন আমাকে দেখানো হলো। অথবা আরেকটা ব্যাপার হতে পারে, দিনের পর দিন একটা ব্যাপার চিন্তা করার ফলে আমার মস্তিষ্ক সেটা তৈরি করল। অনেক বড় বিজ্ঞানীর বেলায়ও এটা হয়েছে।
আমি কী স্বপ্নে দেখেছি সেটা বলি—
বিশাল একটা হাওর।
হাওরের মধ্যে পানি, পানি আর পানি। কলাগাছের মতো একটা জিনিস ধরে আমি ভাসছি। পানি অল্প ঠান্ডা। কলাগাছের মতো জিনিসটা মনে হচ্ছে একটা যান। সেটা আমাকে নিয়ে যাচ্ছে।
কিছুদূর গিয়ে মনে হলো—মাই গড! এ তো আনন্দের পৃথিবী ছেড়ে আমি চলে যাচ্ছি! সঙ্গে সঙ্গে যাত্রা বন্ধ হলো। আবার ফিরে এলাম। আমার এই বাড়িঘর—সব আগের মতো। আমি দেখলাম। তখন আমার মনে হলো—আর কী? এবার যাই।
আমার যাত্রা আবার শুরু হলো। অনেক দূর গিয়ে আবার মনে হলো—ও মাই গড! সব ফেলে আমি কোথায় যাচ্ছি! আবার ফিরে এলাম। তারপর আবার মনে হলো—এই তো সব। আর কী? এরপর যানটা একটা অকল্পনীয় গতিতে ছুটতে শুরু ক।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।