নাজমুল ইসলাম মকবুল
বুটের তলায় পিষ্ট মানবাধিকার
নাজমুল ইসলাম মকবুল
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল বলেছেন, মানবাধিকার পরিস্থিতি উদ্বেগজনক, দেশে এখন স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি নেই। গত ২১ সেপ্টেম্বর ঢাকা রিপোটার্স ইউনিটিতে আইন ও সালিশ কেন্দ্রের ২৫ বছর পুর্তি উপলে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি একথা বলেন। সংগঠনটি মনে করে, বাংলাদেশ মানবাধিকার পরিস্থিতি এখনও উদ্বেগজনক পর্যায়ে রয়ে গেছে। প্রতিদিনই মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটছে।
সুলতানা কামাল বলেন, বর্তমানে এমন একটি সময় চলছে যে মানুষ রাতে ঘুমাতে গেলে সকালে কী হবে তা জানে না।
ঘর থেকে বের হলে নিরাপদে আবার ফিরতে পারবে কি না, বিষয়টি অনিশ্চিত। মানুষের জীবনের স্বাভাবিক মৃত্যুর কোনো গ্যারান্টি নেই। র্যাবের সমালোচনা করে তিনি বলেন, এ মুহুর্তে র্যাবের বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ড বন্ধ করতে হবে। বিশ্বের প্রতিটি দেশের এলিট ফোর্সের নির্দিষ্ট কিছু নিয়মবিধি থাকে, কিন্তু র্যাব কোনো ধরনের নিয়ম নীতি না মেনে বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ড চালিয়ে যাচ্ছে। তিনি বলেন, দেশে এখনও নারীর সম অধিকার অর্জিত হয়নি, বন্ধ হয়নি শিশুশ্রম।
এসব অনিয়ম বন্ধে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ সন্তোষজনক নয়।
অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল বর্তমান মতাসীন সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অত্যন্ত ঘনিষ্ট ও কাছের মানুষ হিসেবে জানা যায়। আর এই কাছের মানুষের বক্তব্য থেকে সহজেই অনুধাবন করা যায় আমরা কোন জগতে বসবাস করছি।
বর্তমানে গণতান্ত্রিক এই বাংলাদেশে মানুষের অধিকার নিয়ে প্রতিনিয়তই হচ্ছে ছিনিমিনি খেলা। দেশে সত্যিকার অর্থে গণতন্ত্র নেই।
লেখক সাংবাদিকদের ইচ্ছেমতো গ্রেফতার ও হয়রানি চলছে। সত্য কথা বলা ও লিখার জন্য বিনা দুষে বিনা ওয়ারেন্টে যখন তখন লেখক সাংবাদিকদের গ্রেফতার করে কারাগারে নিয়ে অমানুষিক নির্যাতন করা এখন যেন ডালভাত। যারাই গণতন্ত্রকে মজবুত ভিত্তির উপর দাড় করানোর দৃঢ প্রত্যয় নিয়ে সরকারের ত্র“টি বিচ্যুতিগুলো তাদের লেখনির মাধ্যমে তুলে ধরে তা থেকে সংশোধনের পথ বাতলে দেন তারাই সরকারের দুশমন হিসেবে পরিগণিত হচ্ছেন এবং টার্গেটে পরিণত হয়ে বিনা দুষে গ্রেফতার হয়ে অমানুষিক নির্যাতন ভোগ করছেন। যারাই দুঃশাসনের প্রতিবাদে শক্ত হাতে কলম ধরছেন তাদের কলম যেন কেড়ে নেয়া হচ্ছে। যারা মানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে টু শব্দ করছেন তাদেরকেই নির্মম কায়দায় গ্রেফতার নির্যাতন ও মিথ্যা মামলায় হয়রানি করা হচ্ছে।
গত ২২ সেপ্টেম্বরের হরতালের দিন বিরোধী দল কোন ধরনের উস্কানিমুলক কর্মকান্ড না করলেও বিরোধী দলীয় নেতা কর্মী ও সাধারন নিরীহ পথচারিকে যেভাবে গ্রেফতার নির্যাতন নীপিড়ন করা হয়েছে এমনকি বুটের তলায় পিস্ট করা হয়েছে তাতে সাধারন মানুষকে পশুর সমান মর্যাদাও দেয়া হয়নি। বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় ও টিভি চ্যানেলে এমন মর্মন্তুদ ছবি দেখে তাই মনে হয়েছে। একজন নীরিহ দরিদ্র হাসপাতালকর্মী ইউসুফ আলীকে মাটিতে ফেলে চিত করে শুইয়ে বুকের উপর পুলিশ বুট জোতা দিয়ে সজোরে চেপে ধরে বুক মাড়ানোর যে দৃশ্য পত্র পত্রিকায় ছাপা হয়েছে তা সত্যিই মর্মন্তুদ। ছবিতে ঢাকা মহানগর পুলিশের পেট্রল ইন্সপেক্টর সাজ্জাদ হোসেন এর পায়ের নিচে যন্ত্রনায় কাতরাতে থাকা অবস্থায় ইউসুফ আলী দুই হাতে ওই পুলিশের পায়ে ধরে এমন নিষ্টুর নির্যাতন থেকে বাচার জন্য করুন রুদন ও কাকুতি মিনতি করার দৃশ্য স্পষ্টতই বুঝা যাচ্ছে। সবচেয়ে নিকৃষ্ট পশুর সাথেও কোন মানুষ এ ধরনের নির্মম নিষ্টুর অমানবিক আচরন করতে পারেনা।
কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, আমাদের বাংলাদেশে এ ধরনের জগন্য কর্মকান্ড রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রকাশ্যে মিডিয়ার সামনে চলছে। দৃশ্যটি আমার চোখকে যেন বিশ্বাস করাতে পারছিনা। মানুষকে যে দেশে এতোই অপমানিত দলিত অপদস্থ করা হয় সেদেশে গণতন্ত্র আছে একথা বলা কতটুকু যুক্তিসংগত তা দেশবাসীর উপরই ছেড়ে দিলাম। বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে, এই ইউসুফ আলীকে যে পুলিশ এভাবে প্রকাশ্য দিবালোকে মিডিয়ার সামনে নির্মমভাবে নির্যাতন করলো তার কোন বিচার না করে উল্টো দরিদ্র পরিবারের একমাত্র অবলম্বন ইউসুফ আলীকে ভ্রাম্যমান আদালত নামক ক্যাঙ্গারু কোর্ট এক বছরের সাজা দিয়ে জেলে চালান দিয়ে মানবাধিকারের জ্বলন্ত নজীর সৃষ্টি করলো। বিশ্বের অন্য কোথাও এ ধরনের আদালত ব্যবস্থা দেখা যায়না।
যদি প্রকাশ্য দিবালোকে মিডিয়ার সামনে ইউসুফ আলীকে এভাবে নির্মম অমানুষিক কায়দায় নির্যাতন করা হয় তাহলে বিভিন্ন ধরনের সাজানো মামলায় প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার সাংবাদিক বুদ্ধিজীবি পেশাজীবি ও বিরোধী দলীয় রাজনৈতিক নেতা কর্মীদেরকে বিনা অপরাধে রিমান্ডের পর রিমান্ডে নিয়ে কোন ধরনের অত্যাচার নির্যাতন চালানো হচ্ছে তা সহজেই অনুমেয়। মিডিয়াতে বিভিন্ন সময়ে আরও অনেকগুলি ছবিতে দেখলাম পুলিশ মহিলাদের স্পর্শকাতর স্থানগুলোতে বুট জোতা দিয়ে সজোরে লাথি মারছে। এগুলো কিসের আলামত। সাবেক প্রধান উপদেষ্টা বিচারপতি হাবিবুর রহমান আপে করে বলেছিলেন, দেশটা এখন বাজিকরদের হাতে।
যে দেশে গণতন্ত্র আছে সেদেশে বিরোধী দল থাকবে।
সরকারের বিতর্কিত কাজের সমালোচনা করবে। সরকারের বিভিন্ন অগণতান্ত্রিক কার্যকলাপের বিরুদ্ধে নিয়মতান্ত্রিকভাবে আন্দোলন সংগ্রাম করবে। এটাইতো গণতন্ত্রের নিয়ম। গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার নিয়ম। কিন্তু বর্তমান সরকার মতায় আসার পর থেকেই বিরোধী দলকে মিটিং মিছিল সভা সমাবেশ এমনকি মানববন্ধনও করতে দিচ্ছেনা।
রাস্তায় দাড়াতে দিচ্ছেনা। এটার নাম কি গণতন্ত্র। এটাই কি গণতান্ত্রিক সরকার। এটাই কি মানবাধিকার। এেেত্র আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোর আরও দায়িত্বশীল ভুমিকা নেয়ার এখনই প্রয়োজন নয় কী।
পত্র পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী গত মাত্র এক বছরে রাজনৈতিক হত্যাকান্ড ঘটেছে ২২০ টির বেশি। ক্রসফায়ারে ১০১টিসহ বিচারবহির্ভূত হত্যার সংখ্যা ১৩০ ছাড়িয়ে গেছে। যেগুলোর মধ্যে র্যাব জড়িত ছিল ৬৮ টিতে। কিন্তু হত্যাকান্ডগুলোর তদন্তে সরকার কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। সরকার বরং রাজনৈতিক হয়রানি ও নিপীড়ন তীব্রতর করে চলেছে।
সরকার বিচার বিভাগের ওপরও প্রত্য প্রভাব বজায় রেখেছে বলে অভিযোগ উঠেছে। জিজ্ঞাসাবাদের নামে রিমান্ডে নিয়ে অমানবিক নির্যাতন চালানো হচ্ছে। এক বছরে পুলিশ কাস্টডিতে মারা গেছে ১০৯ জন। কারাগারে মৃত্যু হয়েছে ৪৬ জনের। ফলে বিচারের আগেই কারাগারে মৃত্যুঝুকির পরিবেশ তৈরি হয়েছে।
নারী ধর্ষণ এবং ধর্ষণের পর হত্যাসহ নারী নির্যাতন বাড়লেও সরকার এসব দমনে আইনশৃঙ্খলা বাহিণীকে কাজে না লাগিয়ে তাদেরকে বিরোধী দল ও মতের মানুষকে দমন নীপিড়নের কাজেই ব্যবহারে ব্যস্ত সময় অতিবাহিত করতে দেখা যাচ্ছে। বিগত সরকারগুলোর আমলেও দেশে যে মানবাধিকার লংঘনের ঘটনা ঘটেনি তা আমি বলছিনা। তবে বর্তমান সরকারের আমলে মানবাধিকার পরিস্থিতির যে অবনতি ঘটেছে তা সর্বকালের রেকর্ডকেও হার মানিয়েছে। তাই অনতিবিলম্বে দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নয়নকল্পে সরকারকে কড়া নজর দিতে হবে।
লেখকঃ সভাপতি, সিলেট লেখক ফোরাম।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।