গনজাগরনের মাধ্যেমে পরিবর্তন সম্ভব....মানুষের চিন্তার পরিবর্তন করাটা জরুরি ....বুদ্ধিবৃত্তিক পুনরজাগরনে বিশ্বাসী ১৯৭১ সালে জীবন বাজি রেখে এই শিক্ষক মুক্তিযুদ্ধ করেছিলেন, স্বাধীন দেশে মানুষ গড়ার ব্রত নিয়েছিলেন এমন একজন শিক্ষককে স্বাধীন দেশের পুলিশ তাঁকে তার প্রতিদান কড়ায়-গণ্ডায় বুঝিয়ে দিল। যৌবনে যুদ্ধে যাবেন আর সেই স্বাধীন দেশে জীবন সায়াহ্নে শুধু বেঁচে থাকার দাবি জানাতে এসে বুটের তলায় জীবন দেবেন এই ছিল আজিজুর রহমানের নিয়তি। আহতদের মধ্যে জামালপুরের চর বাটিয়ানি রেজিস্টার্ড বেসামরিক প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আজিজুর রহমানও ছিলেন। তাঁকে প্রথমে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়, রাতে বাড়ি নেওয়ার পথে তিনি মারা যান। গতকাল পত্রিকার পাতায় পুলিশের বুটের তলায় পদদলিত যেসব শীর্ণকায় মানুষকে আর্তনাদ করতে দেখা গেছে, তাঁরা শিক্ষক।
বাংলাদেশের ২০,০৬১টি বেসরকারি রেজিস্টার্ড প্রাথমিক বিদ্যালয়ের হতদরিদ্র ৯০ হাজার শিক্ষকদের কয়েকজন। জীবনের সব লড়াইয়ে হারতে হারতে শেষপর্যন্ত বেঁচে থাকার প্রয়োজনে চাকরি জাতীয়করণের দাবি নিয়ে ঢাকায় এসেছিলেন, কারণ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ২০১১-র ৫ মে ঘোষণা দিয়েছিলেন আগামী বাজেটের আগেই বেসরকারি প্রাথমিক শিক্ষকদের চাকরি সরকারিকরণ করা হবে। শিক্ষকদের আন্দোলনও ছিল ধারাবাহিক। গত জানুয়ারি থেকে স্কুলে তালা দেয়া, সংবাদ সম্মেলন, মানববন্ধন, আত্মাহুতির ঘোষণা থেকে শুরু করে শেষপর্যন্ত ঢাকায় আগমন। দুদিন কর্মসূচি পালন করার পরেও যখন কেউ কোনও খোঁজ করেনি বা আশ্বাসবাণী শোনায়নি তখন তাঁরা মিছিল নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে যাচ্ছিলেন।
সেই মিছিলে গ্রীষ্মের এই দাবদাহকে লজ্জা দিয়ে গনগনে গরম পানি ছুড়ে, গরমে গলা পিচের রাস্তায় ফেলে কুকুরের মতো পিটিয়ে পুলিশ অসংখ্য শিক্ষককে আহত করে।
শহরের বস্তিবাসী যেমন উচ্ছিষ্ট তেমন শিক্ষাব্যবস্থার এই ‘বেসামরিক প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক’ নামের প্রান্তিক গোষ্ঠীকেও বোধ হয় উচ্ছিষ্ট। তাই তাঁদের বিরুদ্ধে এই নির্মম আচরণের কোনো প্রতিবাদ নেই, ক্ষমা প্রার্থনা নেই, মিডিয়ায় শোরগোল নেই, সামান্য খবরও নেই, আছে এক নিদারুণ উপেক্ষা আর অবহেলা। এদের দুর্নীতির কোনো সুযোগ নেই, সুযোগ নেই এনজিওর কনসালটেন্সির। এই শিক্ষকরা যে বেতন পান সেটাতে একটা সম্মানের জীবন তো দূরের কথা প্রাণ ধারণ করাও অসম্ভব।
তাই শুধু প্রাণ ধারণের জন্য শিক্ষক একজন শ্রমিক হয়ে কাজ করেন ইট ভাটায়। কী লজ্জা। সরকারি রেজিস্ট্রেশনপ্রাপ্ত বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একজন প্রধান শিক্ষক বেতন পান সর্বসাকুল্যে ৪,৯০০ টাকা। আজকের দিনে এই আয় দিয়ে কী হয়? এই আয়ে একটা পরিবারের ক্ষুধার জ্বালাও কি মেটানো সম্ভব? ওই বেসরকারি শিক্ষকরাই দেশের প্রথম শিক্ষার হাল ধরে আছেন আর সরকারি বেতন-ভাতার আশায় পরিবারকে অনাহারে বসিয়ে রেখে অবশেষে চোখের জল আটকে দিন পার করেছেন। এই প্রাথমিক শিক্ষাই দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের একমাত্র শিক্ষা।
এই শিক্ষকদের চাকরি জাতীয়করণের জন্য নাকি প্রয়োজন ৪৬০ কোটি টাকার একটি অতিরিক্ত বরাদ্দ। এই অতিরিক্ত বরাদ্দের চাপ রাষ্ট্র গ্রহণ করতে পারবে নাÑ এটা ভাবতে কষ্ট হয়। এই বরাদ্দকে কি বাহুল্য মনে করা হচ্ছে? রাষ্ট্র তো ক্যাশ রেজিস্টার নয় অথবা কর্পোরেটের প্রফিট অ্যান্ড লস আকাউন্ট নয়, রাষ্ট্রের রয়েছে মানবিক, নৈতিক এবং প্রগতিশীল বিবর্তনের এক গুরু দায়িত্ব। সামর্থ্য সীমিত হলে প্রায়োরিটি ঠিক করতে হয়। ক্রিকেট বিশ্বকাপের ঝলমলে আয়োজন আর প্রাথমিক শিক্ষকদের চাকরি জাতীয়করণÑ এই দুটোর মধ্যে প্রায়োরিটি ঠিক করার রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নিতে হবে সরকারকেই।
এ ধরনের অনেক খাতের উদাহরণ দেয়া যায়, যেখানে মানবিক দীর্ঘমেয়াদী প্রগতিশীল রূপান্তরের জরুরি প্রয়োজন ক্রমাগত উপেক্ষিত হয় আর আমাদের প্রিয় স্বদেশ আমাদের স্বপ্ন থেকে শুধু দূরেই সরে যায়।
ক্ষুধা, অবহেলা আর অপমানকে নিত্যসঙ্গী করেই প্রতিবাদ জানাতে গিয়েছিলেন আজিজুর রহমান। স্বাধীন দেশের পুলিশের সেই সংবেদনশীলতাও নেই যে তারা বুঝবে, জাতির প্রথম শিক্ষাগুরুর গায়ে হাত তুলতে নেই। তবুও হাত তোলা হয়েছে, নির্মমভাবে। নির্দয় বুটের নিচে রাস্তায় শুয়ে থাকা আহত সংজ্ঞাহীন প্রবীণ শিক্ষক আর তার পাশে অসহায়ভাবে আর্তনাদ করতে থাকা মানুষগুলোর ছবি দেখলেই দলা পাকিয়ে বুক থেকে কান্না উঠে আসে।
আন্দোলনরত শিক্ষকেরা ফিরে গেছেন, না গিয়ে উপায়ও নেই। আমরা এমন এক নিষ্ঠুর সমাজ গড়ে তুলছি সেখানে এই বঞ্চিতদের দীর্ঘশ্বাস আর পৌঁছবে না। বছরের পর বছর জুড়ে চলতে থাকবে আশ্বাস আর বঞ্চনার পৌনঃপুনিক মঞ্চায়ন। আজিজুর রহমান যেন এক ট্র্যাজিক নায়ক যার মৃত্যুর দায় এবং লজ্জা আমাদের এই অক্ষম সবার। পুলিশের নির্যাতনে শহীদ শিক্ষক হয়ে উঠেছেন আমাদের পরাজিত স্বপ্নের প্রতীক।
আজিজুর রহমানদের মুক্তিযুদ্ধ কবে শেষ হবে? কালের সমুদ্র পাড়ি দিয়ে আমাদের মানবিক স্বদেশের স্বপ্নগুলো যে কবে পাখা মেলবে কে জানে? ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।