আমাদের দেশ আমাদের সম্পদ পুরান ঢাকার কষ্টগাথাধ্বংসের পথে মোগল স্থাপনা, পুনরুদ্ধারে ব্যর্থ সরকার
নওশাদ জামিল
৫০ কোটি টাকার মহাপরিকল্পনা, সংসদীয় কমিটির বৈঠকের পর বৈঠক, প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের চিঠি চালাচালি_এত কিছুর পরও উদ্ধার হয়নি রাজধানীর ঐতিহাসিক মোগল স্থাপনা ছোট ও বড় কাটরা। স্থাপনা দুটি দীর্ঘদিন ধরে দখল করে রেখেছেন ইসলামী আইন বাস্তবায়ন কমিটির আমির মুফতি ফজলুল হক আমিনী ও স্থানীয় প্রভাবশালী লোকজন। কাটরার জায়গায় নতুন নতুন স্থাপনা নির্মাণ, এর দেয়াল ঘেঁষে বসতবাড়ি এবং অভ্যন্তরে দোকানপাট ও মাঝারি আকারের শিল্প-কারখানা স্থাপনের ফলে ওই দুটি কাটরার মূল কারুকাজের সৌন্দর্যহানি হয়েছে অনেক আগেই। এ অবস্থায় শিগগির স্থাপনা দুটির যথাযথ সংস্কার ও দখলমুক্ত না করা গেলে তা পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যাবে বলে প্রত্নতাত্তি্বক ও ইতিহাসবিদরা আশঙ্কা করছেন।
জানা যায়, সরকারি গেজেটে সংরক্ষিত ও ঐতিহাসিক স্থাপনা হিসেবে স্বীকৃত এ দুটি স্থাপনা সংরক্ষণে সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি প্রায় ৫০ কোটি টাকার একটি মহাপরিকল্পনা নেয়।
এ নিয়ে সংসদ ভবনে কমিটি কয়েক দফা বৈঠকও করে। কমিটি এ বিষয়ে বিস্তারিত জানতে চেয়ে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরকে চিঠি দেয়। অধিদপ্তর ঢাকার জেলা প্রশাসকের কাছে বড় কাটরা সংরক্ষণে কত টাকা প্রয়োজন, তা জানতে চেয়ে চিঠি দেয়। জেলা প্রশাসন জমির মূল্য অনুসন্ধান করে গত বছরের ২৫ মার্চ শুধু বড় কাটরার ১ দশমিক ৮০২ একর জমি অধিগ্রহণ করার জন্য ৪১ কোটি পাঁচ লাখ ৬৭ হাজার ২১৭ টাকা প্রয়োজন বলে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরকে জানায়। এরপর সংসদীয় কমিটির বৈঠকে বড় কাটরা ও ছোট কাটরার সংরক্ষণ ও দখলমুক্ত করার বিষয়ে আবার আলোচনা হয় এবং এ বিষয়ে বিস্তারিত জানতে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরকে আবারও চিঠি দেওয়া হয়।
তবে কাজের কাজ কিছুই হয়নি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ড. শফিকুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, 'ছোট কাটরা ও বড় কাটরা নিয়ে আমাদের প্রতিবেদন ও চিঠি প্রস্তুত করে তা সংসদীয় কমিটিতে পাঠিয়েছি। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় ও প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর এ বিষয় নিয়ে দুই বছর ধরে কাজ করে যাচ্ছে। অবৈধ মালিকদের উচ্ছেদ, বৈধ মালিকদের ক্ষতিপূরণ দিয়ে আমরা চাই মূল স্থাপনার ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে। এর জন্য ইতিহাসবিদ, প্রত্নতাত্তি্বকদের প্রতিবেদন, মতামত আমরা গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করছি।
তাঁদের সঙ্গে বিভিন্ন সময়ে আলোচনা করেছি। আমরা ছোট কাটরার সংস্কার ও দখলমুক্ত করার বিষয়ে শিগগির উদ্যোগ নেব। '
প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, ১৯১২ সালে এ স্থাপনাগুলো মোগল সম্পত্তি হিসেবে তালিকাভুক্ত হয়। এরপর ১৯৫৪ সালে এগুলো প্রত্নসম্পদ হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয়। সর্বশেষ ঢাকা সিটি করপোরেশন (ডিসিসি) নগরের ঐতিহাসিক, নান্দনিক, বৈজ্ঞানিক, সামাজিক ও ধর্মীয় গুরুত্ব বিবেচনা করে ৯৩টি ভবনকে ঐতিহ্যবাহী বিশেষ ভবন, স্থাপনা ও গুরুত্বপূর্ণ এলাকা হিসেবে সংরক্ষণের জন্য তালিকা করে।
তালিকায় প্রথমে রয়েছে ঢাকার প্রথম মসজিদ নারিন্দার বিনত বিবির মসজিদ। এর পরই রয়েছে বড় কাটরা ও ছোট কাটরা। তালিকাভুক্ত ভবন ও স্থাপনা নগর উন্নয়ন কমিটির অনুমোদন ছাড়া আংশিক বা সম্পূর্ণ অপসারণ, পুনর্নির্মাণ, পরিবর্তন, পরিমার্জন ও সংযোজন সম্পূর্ণ নিষেধ। তারপর কিভাবে ছোট কাটরায় দেউড়ি ঘেঁষে বহুতল ভবন নির্মাণ হচ্ছে_এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের কাছে কোনো সদুত্তর মেলেনি।
আমিনীর দখলে বড় কাটরা : উগ্র ইসলামপন্থী নেতা মাওলানা ফজলুল হক আমিনীর দখলে দীর্ঘদিন ধরেই আছে ঐতিহাসিক বড় কাটরার ৮৭ কাঠা জমি।
সরেজমিনে গিয়ে দখলের সত্যতা মেলে। জানা যায়, ২০০৩ সালের ৯ জুন বিএনপির তৎকালীন সংসদ সদস্য নাসির উদ্দিন আহমেদ পিন্টুর সহযোগিতায় আমিনী সন্ত্রাসী বাহিনী দিয়ে বড় কাটরার ৮৭ কাঠা জমি দখল করে নেন। এ জমির মধ্যে আছে বসতবাড়ি, হোসাইনিয়া আশরাফুল উলুম মাদ্রাসাসহ আরো অনেক সম্পত্তি। বড় কাটরার স্থানীয় অধিবাসীরা জানান, 'গনিমতের মাল' ঘোষণা দিয়ে আমিনীর লোকজন সেদিন লুটতরাজ করে। আমিনীর বিরুদ্ধে আরো অভিযোগ হচ্ছে, তিনি হোসাইনিয়া আশরাফুল উলুম মাদ্রাসাটি দখল করে সেটিকে জঙ্গি আস্তানায় পরিণত করেছেন।
অভিযোগকারীরা নাম প্রকাশ না করার শর্তে কালের কণ্ঠকে জানান, আমিনীর ওই মাদ্রাসায় প্রায় ৮০০ শিক্ষার্থী রয়েছে। তাদের জঙ্গি প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। সরকারবিরোধী মিছিল-সমাবেশে তাদের পিকেটিংয়ে নামতে বাধ্য করা হয়।
প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর মুফতির দখলদারির কথা স্বীকার করে জানায়, বড় কাটরা সংরক্ষণে সবচেয়ে বড় বাধা হচ্ছেন আমিনী। বড় কাটরার একটি বিশাল অংশ দখল করে তিনি মাদ্রাসা করেছেন।
প্রাচীন ইমারতটির বিভিন্ন অংশ তিনি ভেঙে নতুন স্থাপনা করেছেন।
এ ব্যাপারে মুফতি ফজলুল হক আমিনীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, 'মাদ্রাসা নিতে বললেই হবে না। আমিই এর প্রকৃত মালিক। আমি সরব না। মাদ্রাসার নিজস্ব সম্পত্তি নিয়ে কিছু করতে হলে পরিচালনা কমিটির সঙ্গে আলোচনা করতে হবে।
' তিনি আরো বলেন, 'আমরা মোগল স্থাপনা সংরক্ষণের বিরোধী নই। এ জন্য সরকারি বিধি ভঙ্গ করেও আমরা কিছু করব না। সরকার যা করবে, তা আমাদের সঙ্গে আলোচনা করেই করতে হবে। তবে আমরা কোনোভাবেই উচ্ছেদ মেনে নেব না। আল্লাহ ছাড়া এখান থেকে কেউ আমাদের সরাতে পারবে না।
'
ছোট কাটরার দাবিদার অনেকে : অনুসন্ধানে জানা যায়, ছোট কাটরার মালিক এখন ৩৪ জন। ১৯৯৩ সালে অধিদপ্তরের নিজস্ব জরিপে এই মালিকদের পরিচয় পাওয়া গেছে। তবে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর জানায়, তাঁদের বেশির ভাগই জরিপের সময় মালিকানার কাগজ দেখাতে পারেননি বা দেখাতে চাননি। যাঁরা কাগজ দেখিয়েছেন, সেসব নথিপত্র প্রকৃত দলিল নয় বলেও অধিদপ্তর জানিয়েছে।
ছোট কাটরার কিছু অংশের মালিকানা দাবি করে শামসুল ভূঁইয়া নামের একজন বলেন, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের কাছ থেকে তাঁর পূর্বপুরুষরা জায়গাটি কিনেছিলেন।
তারপর হাতবদল হতে হতে তাঁর কাছে এসেছে। তাঁর মতে, এখানে মালিকের সংখ্যা প্রায় ৫০ জন। ছোট কাটরা এলাকায় দোকান আছে তিন শতাধিক। পাঁচতলা একটি সুপারমার্কেটও উঠে গেছে ভেতরে। তবে তাঁরা অনেকেই ভাড়া নিয়ে ব্যবসা করেন বলে জানা গেছে।
ছোট কাটরার জায়গার পরিমাণ দুই একর ১০ শতাংশ। বড় কাটরার মতোই এটিও ১৯০৪ সালের 'অ্যানশিয়েন্ট মনুমেন্ট প্রিজার্ভেশন অ্যাক্ট' অনুসারে ১৯০৯ সালে প্রথমে সংরক্ষিত ভবন ঘোষণা করা হয়েছিল।
জানা যায়, বড় ও ছোট কাটরা সংরক্ষণের জন্য সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের কাছে স্বরাষ্ট্র ও অর্থ মন্ত্রণালয়, রাজউক ও সিটি করপোরেশনসহ বিভিন্ন সংস্থার সমন্বয়ে একটি বৈঠক করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছিল প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর থেকে। কিন্তু সে বিষয়ে কোনো অগ্রগতি হয়নি।
জরাজীর্ণ দশা : চুন-সুরকি দিয়ে মজবুত করে তৈরি সম্পূর্ণ রাজকীয় মোগল স্থাপত্যশৈলীর ইমারত বড় কাটরা ১৬৪৩ থেকে ১৬৪৬ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে নির্মিত হয়েছে বলে অনুমান করা হয়।
তবে রাজসিক শৈলী হারিয়ে বড় কাটরা এখন জরাজীর্ণ। সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, এর বিশাল ফটকের ওপরে বাঁধানো আছে আমিনীর মাদ্রাসার সাইনবোর্ড। ফটকের ওপরে নতুন স্থাপনা, দেয়াল ঘেঁষেও নির্মাণ করা হয়েছে নতুন স্থাপনা। এগুলো মাদ্রাসার ছাত্রাবাস বলে জানা যায়। কাটরার বিভিন্ন অংশের কাঠামো ভেঙে সেখানে নতুন ইমারত নির্মাণ করায় মোগল স্থাপত্যশিল্পের সুনিপুণ কারুকার্যখচিত বড় কাটরার মূল অংশই এখন ধ্বংসের পথে।
কাটরার ভেতরে দোকানপাট, সেলুন, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন নতুন স্থাপনার সাইনবোর্ড চোখে পড়বে। কাটরার বেশির ভাগ বড় কক্ষ ভেঙে ছোট কক্ষ করা হয়েছে। প্রবেশপথে আবর্জনা, ডাস্টবিন ও মাদ্রাসার ছাত্রদের গোসলখানা থাকায় গোটা রাস্তা চলতে হয় নাকে রুমাল চেপে।
শায়েস্তা খাঁ কর্তৃক ১৬৬৪ সালের দিকে নির্মিত ইমারত ছোট কাটরাও এখন প্রায় বিলুুপ্তির পথে। বড় কাটরা থেকে ২০০ গজ পূর্বে এখনকার হাকিম হাবিবুর রহমান লেনের ওপরে ছোট কাটরা।
চকবাজার থেকে সরু গলি পেরিয়ে কিছুদূর এগোলেই চোখে ভাসবে ছোট কাটরার মূল ফটক। একটি বুড়িগঙ্গার দিকে, অন্যটি চকবাজারের দিকে। মূল দুটি ফটকের মাঝখানে, ওপরে ও চারপাশে অসংখ্য দোকান, বহুতল মার্কেট। দোতলা থেকে সরু লোহার সিঁড়ি জুড়ে দেওয়া হয়েছে তৃতীয় তলার ছাদে ওঠার জন্য। ছাদে উঠে দেখা গেল, পূর্ব দিকের মিনারের ওপরে এবং দোতলার একটি অংশজুড়ে ইট গেঁথে ছোট ছোট ঘর তোলা হয়েছে।
পূর্ব দিকে এর কোনোটি গুদাম, কোনোটি কারখানা ইত্যাদি। পশ্চিম দিকে বাসাবাড়ি। দোতলার কাঠের পাটাতন ও সিঁড়ির ধাপ এখনো মজবুত। কক্ষগুলো জরাজীর্ণ।
ইতিহাসবিদ ড. মুনতাসীর মামুন কালের কণ্ঠকে বলেন, মুফতি আমিনীর দখল থেকে যত দ্রুত সম্ভব বড় কাটরা রক্ষা করতে হবে।
এটি শুধু জাতির সম্পদ নয়, ঐতিহ্যের অংশ। তিনি আরো বলেন, 'স্থাপনা রক্ষায় বিদ্যমান আইনের কঠোর প্রয়োগ, প্রত্নতাত্তি্বক বিভাগের সংকট নিরসন ও প্রতিষ্ঠানটির দুর্নীতি বন্ধ না হলে ঢাকার প্রত্নতাত্তি্বক স্থাপনার কোনো নজির আগামী ১০ বছর পর আর থাকবে না। '
প্রত্নতাত্তি্বক ড. শাহ সুফি মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, কাটরা দুটির সংস্কার না হলে যে বিলুপ্ত হবে, তা জানা কথা। তবে আসল বিষয় হলো, এর জন্য সরকারকেই এগিয়ে আসতে হবে সবার আগে।
সূত্র : Click This Link ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।