আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

পাইরেট'স অব বেঙ্গল..সেবাস্টিয়ান গঞ্জালেস টিবাও

তখন দিল্লীতে সম্রাট আকবরের শাষন আমলের শেষ সময়..বিভিন্ন ইউরোপিয় দেশ থেকে দলে দলে ভাগ্যন্মেষী নাবিকরা ভারতবর্ষে আসছে..। বাংলার পুকুর ভরা মাছা ,গোয়াল ভরা গরু,ক্ষেত ভরা সোনার ফসল..মসলিনের আভিজাত্যার কথা দিকে দিকে ছড়িয়ে পরছে। কিন্তু মানুষের মনে শান্তি নেই..মোঘল সম্রাজ্যের একেবারে পুর্ব সীমান্তে হওয়ায় বাংলায় মুঘলদের শাষন শিথিল.. সমগ্র বাংলা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সামন্ত রাজাদের হাতে শাষিত যারা দিনে রাজা রাতে ডাকাত। এরা ইতিহাসে বার ভুইয়া হিসাবে পরিচিত। আরো আছে মগ আর ফিরিঙ্গী জলদস্যু।

এই ফিরিঙ্গী শব্দ এসেছে ফ্রাংক শব্দ থেকে । ইউরোপের জাতিগুলির মধ্যে ইংরেজ,ওলন্দাজ,ফরাসী,স্প্যানিশ ,পুর্তগীজরা ভারতে এসেছে ব্যবসা করতে এদের মধ্যে একদল পেশা হিসাবে বেছে নিয়েছে ডাকাতি। এদের মিশ্রনে জাতিগোস্টিই ফিরিঙ্গী। এসময় বোম্বের কাছ থেকে একদল ডাকাত পালিয়ে চলে আসে বাংলায় এদের নাম হয় বোম্বেটে। এরা ব্যপক ভাবে বাংলার মানুষের কাছে হার্মাদ নামে পরিচিত।

এই হার্মাদ কথাটা স্প্যানিশ শব্দ আর্মাডার (রনপোত)বিকৃত রুপ। এই জলদস্যুরা একসাথে অনেক নৌ যানে একত্রে চলাফেরা করতো বলেই হয়তো এই নাম। তাদের অত্যাচারে বঙ্গের উপকুলের মানুষ অতিস্ট। যতটুক জানা যায় সেবাস্টিয়ান গঞ্জালেস টিবাও ১৬০৫ সালের দিকে পুর্তগাল থেকে ভারতের গোয়া হয়ে বাংলায় আসেন একজন ভাগ্যন্মেষী ক্ষুদ্র অভিযাত্রি হিসাবে। প্রথমে তিনি বাংলা থেকে আরাকানের দিয়াঙ্গা বন্দরে লবন বেচাকেনার ব্যবসা করতেন।

সে সময় আরকানের রাজ্যে ওনেক পুর্তগীজরা ব্যবসা করতো...কিন্তু আরাকানের আভ্যন্তরীন রাজনীতিতে নাক গলানোর কারনে আরাকানের রাজা ৬০০ পুর্তগীজকে হত্যা করে.. স্ত্রী পুত্র ফেলে অল্প কিছু নাবিকের সাথে ১০-১২ টি ছোট জাহাজে জীবন নিয়ে সেখান থেকে পালিয়ে সেবাস্টিয়ান গঞ্জালেস বাকালায়(বর্ত্মান বরিশাল)আসতে সক্ষম হয়। বাকালার রাজা তাদের আশ্রয় দেন। ও সন্দীপে থাকতে দেন। এর কিছু দিন পর পুর্তগীজদের ঘাটি সন্দীপে হামলা করে ফতে খান দখল করে নিলে পুর্তগীজদের সাথে সঙ্ঘর্ষ বাধে। কোনঠাসা পুর্তগীজদের মধ্য থেকে নৌ যুদ্ধে পারদর্শী দুর্ধর্ষ নাবিক সেবাস্টিয়ান গঞ্জালেস ফতে খানের ৪০ টি ক্ষুদ্র যুদ্ধ জাহাজ ধংস করে সন্দীপে আবার পুর্তগীজদের দখলে আনে।

এই সাফল্যের পরে সন্দীপের পুর্তগীজ নাবিকরা তাকে একচ্ছাত্র নেতা হিসাবে মেনে নেয়। বাকালার রাজার সাথে সন্ধি করে বার্ষিক করের ভিত্তিতে সেবাস্টিয়ান গঞ্জালেস সন্দীপের মালিকানা নিয়ে গঙ্গা মোহনার অববাহিকা থেকে ৭০ ক্রোশ ভিতরে পর্যন্ত লুটপাট অব্যাহত রাখে। এর মধ্যে ফতে খানের ভাইয়ের সাথে যুদ্ধে গ্যাস্পার ডি পিনা নেতৃত্বে স্প্যানিয়ার্ডদের সহায়তায় ফতে খানের ভাইকে পরাজিত করে। ১৬০৯ এর শেষের দিকে ১০০০ পুর্তগীজ নাবিক,২০০০ স্থানীয় নাবিক ২০০ অশ্বরহী সৈন্যসহ ৪০ টি কামান সজ্জিত যুদ্ধজাহাজের সেবাস্টিয়ান গঞ্জালেসের অধিনে আসে। এদের অবিসম্বসাদিত নেতায় পরিনত হয়ে নৌ যুদ্ধে পারদর্শী সেবাস্টিয়ান ও তার জলদস্যু বাহিনী সমগ্র বাংলাদেশের নদী পথে ত্রাসে পরিনত হয়।

নরনারী ধনী গরীব নির্বিষেশে নদী তীরের কোন জনপদ হার্মাদের হাত থেকে রেহাই পায় নি। লুটপাটের বাইরে তার অন্যতম প্রধান ব্যাবসা ছিলো এইসব বাঙ্গালী নরনারীদের দাস হিসাবে আরাকান,শ্রীলংকা,ব্যাভারিয়ায় চালান দেয়া। আজকের নোয়াখলী লক্ষীপুর,সন্দীপের বড় বড় বাজারে এদের দাস হিসাবে বেচাকেনা হত। এইভাবে জোর যার মুল্লুক তার এই নীতির মধ্যে গড়ে ওঠে ছোট খাটো একটি রাজ্য। গঞ্জালেস শাসন পরিচালনা করত চাতুর্য ও বিচক্ষণতার সঙ্গে।

ব্যবসাবাণিজ্যের সমৃদ্ধি ঘটে। বিশাল ধন সম্পদের মালিক বনে যায় দরিদ্র পুর্তগীজ জলদস্যুরা। প্রতিবেশী রাজ্যের রাজাদের আতঙ্ক ও হিংসা উদ্রেক করে গঞ্জালেস। তার নিস্টুরতা থেকে তার এক্সময়ের আশ্রয়দাতা বাকালার রাজাও রক্ষা পায় নি। এমন সময় আরাকানে গৃহযুদ্ধ বাধলে আরকান রাজের ভাই আনাপরাম চট্টগ্রাম থেকে পালিয়ে সন্দীপ চলে আসে এবং সেয়াবস্টিয়ানের সাহায্য প্রার্থনা করে।

আনাপারামের বোন কে বিয়ে করে সেবাস্টিয়ান এবং তার সাথে আরাকান রাজের বিরুদ্ধে যুদ্ধে যোগ দেয় কিন্তু চট্টগ্রাম দখল করতে ব্যার্থ হইয়ে সন্দীপে ফিরে আসে ও সেখানে আনাপরাম কে বিষ প্রয়োগ করে হত্যা করে তার নৌ বহর ও ধনরত্ন সব লুট করে নেয় সেবাস্টিয়ান। বঙ্গোপসাগরে এমন কেউ ছিলো না যে সেবাস্টিয়ান গঞ্জালেস কে বাধা দিতে পারে। তারা এতোটাই দুর্ধর্ষ ছিলো যে তার ছোট ভাই অ্যান্টনিও মাত্র ৫ টি জাহাজের সাহাজ্যে ১০০ আরাকানী জাহাজ লূট করে। সেবাস্টিয়ান গঞ্জালেস এমনকি সুরাট উপকুলে মক্কা ফেরত মোঘলদের একটি নৌ বহর লুট করে এর আরোহীদের হত্য করে..যার মধ্যে সম্রাট জাহাঙ্গীরের নিকট আত্মীয়রাও ছিলো। এরি মধ্যে মোঘল অভিযান ঘনিয়ে আসে।

পূর্ব সীমান্তের বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি ও বদ্বীপ এলাকায় পর্তুগীজদের উপর্যুপরি হামলায় বিরক্ত বোধ করছিলেন বাদশাহ জাহাঙ্গীর। শেষে তিনি সুবা বাংলার রাজধানী স্থানান্তরিত করলেন রাজমহল থেকে ঢাকায়। (১৬১০ সালে) বাদশাহের প্রতিনিধি সুবাদার ইসলাম খান রাজধানী স্থাপন করলেন ঢাকায়। সুবা বাংলার শাসনভার গ্রহণ করেই পর্তুগীজ হার্ম্মাদদের নির্মূল করে প্রদেশে শান্তি শৃঙ্খলার প্রতিষ্ঠার কাজে নিয়োজিত হলেন। ঢাকা জেলায় মোটামুটি তখন শান্তি বিরাজিত।

মোঘল অগ্রাভিযানের মুখে সহসাই পট পরিবর্তন হয়...দুই প্রতিদন্দী ফ্রী ল্যান্সার সেবাস্টিয়া গঞ্জালেস ও আরকান রাজ মুঘোলদের প্রতিরোধে চুক্তিবদ্ধ হন। চুক্তি অনুযায়ী সম্মিলিত নৌবহরের নেতৃত্ব দেবেন গঞ্জালেস, আর উপকূল বরাবর আরাকানী স্থলসৈন্য বাহিনী যখন এগিয়ে আসবে নৌপথে গঞ্জালেসের বহর তখন তাদের সাথে সমন্বয় করে অগ্রসর হবে। যুদ্ধে বিজয় লাভের পর বিজিত অঞ্চলের অধিপতি হবেন দুই অংশীদার। আরাকান রাজের ৮০,০০০ সৈন্য ৭০০ হাতি আর ২০০ যুদ্ধ জাহাজ সেবাস্টিয়ান গঞ্জালেসের অধিনে মোঘল সুরেদার কাসিম খাঁ (ইসলাম খানের ভাই) বাহিনীর বিরুদ্ধে অগ্রসর হয়। প্রথম দিকে এদের সম্মিলিত বাহিনী বেশ সাফল্য পায় এবং তারা বড় ফেনী নদী,ছোট ফেনী নদী হয়ে ভুলুয়া দখল করে আরো উত্তর দিকে অগ্রসর হয় এবং ব্যাপক লুটতরাজ করে।

কিন্তু হঠাৎ যুদ্ধের গতি বদলে যায় .... চুক্তি অনুযায়ী কথা ছিলো ভুলুয়া থেকে মোঘল দের হটিয়ে দিয়ে আরকান রাজ সামনে আগালে পুর্তগীজরা ভুলুয়া ধরে রাখবে। সেবাস্টিয়ান গঞ্জালেস যথারীতি জলদস্যুর সুলভ সুযোগ বুঝে টাকার বিনিময়ে কাশিম খার বাহিনীকে স্থান ছেড়ে দিয়ে চলে আসে... যার ফলে আরকান রাজা তার বাহিনী মোগলদের হাতে ঘেরাও হয়ে আত্মসমর্পন করে। এদিকে সেবাস্টিয়ান সন্দীপের দিকে পিছিয়ে এসে তার বাহিনীতে থাকা আরকানী যুদ্ধ জাহাজের প্রধান দের সবাইকে একসাথে জবাই করে সমস্ত জাহাজ দখলে নেয় এবং চিটাগাঙ্গের অরক্ষিত আরকানী দুর্গগুলি ধংস করে চট্টগ্রাম লুট করে। এ এবধি গোয়ার পর্তুগীজ ভাইসরয়ের কর্তৃত্ব মানতে অস্বীকার করেছেন গঞ্জালেস। মগদের সাথে বেইমানি আর মোঘলদের কাছে অবিশ্বস্ত হিসাবে পরিচিত হয়ে যাওয়ায় তার দুইপাশ থেকেই বেশ চাপ অনুভব করছিলেন।

বাধ্য হয়ে ১৬১৫ খ্রী. আরাকান আক্রমণের জন্য আবেদন করেন গোয়ার পুর্তগীজ ভাইসরয়ের কাছে । সেই অনুযায়ী একটি নৌবহর পাঠানো হয় ডি. ফ্রান্সিস দ্য মেঞ্জেস রোক্স-এর নেতৃত্বে। পর্তুগীজ নৌবহরটি আরাকান নদীতে এসে পৌঁছে ৩রা অক্টোবর। পুর্তগীজরা যুদ্ধ শুরু করলে ওলন্দাজ নৌবহরের সহায়তায় মগরা সে আক্রমণ প্রতিহত করে। এখানেও গঞ্জালেস সময়মত উপস্থিত থাকেনি।

গঞ্জালেস এসে পৌঁছায় নভেম্বরে। সঙ্গে পঞ্চাশটি যুদ্ধজাহাজ। সম্মিলিতভাবে তারা মগ বাহিনীকে আক্রমণ করে। যুদ্ধে ডি.মেঞ্জেস নিহত হন। এতে দিশাহারা হয়ে পুর্তগীজ আক্রমণকারীরা পালায়।

সন্দ্বীপে ফিরে আসেন গঞ্জালেস। তখন তার আগেকার জনপ্রিয়তা ও ক্ষমতা বিলুপ্ত হয়। ভগ্নপ্রায় অনুচররা তখন কলহে লিপ্ত। নয়বছর শাসনের পর ভাগ্যাহত গঞ্জালেস ক্ষমতা হারান। তখন তার সার্বভৌমত্ব বিলুপ্ত, দর্প চূর্ণ।

শয়তানি শেষ। পরে আরকানের সৈন্যরা সন্দীপ দখল করলে তাদের হাতে বঙ্গোপসাগরের তার সময়ে শ্রেস্ট জলদস্যু সেবাস্টিয়ান গঞ্জালেস টিবাও নিহত হন। ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.