পেশায় নাবিক নেশায় যাযাবর
মুক্তিপণের টাকা ফেলা হচ্ছে
জাহজ ছিনতাই ও মুক্তিপণের টাকা বিতরণঃ
একটি জাহাজ সফল ভাবে আটকের পর প্রথমেই ওরা জাহাজের যোগাযোগ ব্যাবস্তা নষ্ট করে ফেলে । শুধু স্যাটেলাইট ফোন সচল রাখে । সকল নাবিকদের এক জায়গায় বন্দি করে । যখন বুঝতে পারে ওদের জন্য আর কোন হুমকি নেই , তখন ওরা সোমালিয়ার সমুদ্র সীমানায় জাহাজটিকে নিয়ে যায় । এখানে জাহাজটি হাত বদল হয় ।
অন্য একটি গ্রুপ এর নিরাপত্তায় নিয়োজিত হয় । মুলতঃ পাহাড়া দেয়া,নাবিকদের দেখাশুনা করাই এদের কাজ। একাজের জন্য মাঝে মাঝে ওদের নিজেদের মধ্যেও যুধ্ব হয় ।
জাহাজটি নিরাপদ জায়গায় পৌঁছানর পর জাহাজের মালিকের সাথে যোগাযোগ করে তৃতীয় একটি পক্ষ ।
মুক্তিপণের টাকা সাধারণত চার ভাগে ভাগ হয় ।
প্রথম ভাগ যারা জাহাজটি ছিনতাই করেছে , ২য় ভাগ যারা পাহারা দিয়েছে , ৩য় ভাগ সোমালিয়ান সরকার এবং ৪রথ ভাগ যারা জাহজের মালিকের সাথে যোগাযোগ করে , টাকা পৌঁছানোর ব্যাবস্থা করে(অভিযোগ রয়েছে সোমালিয়ার সেনাবাহিনী, কোয়ালিশন সরকারের মন্ত্রি ও নেতারা এমন কি ইউরোপ আমেরিকার অনেক বড় বড় ব্যাবসায়ি এই লুটের টাকার ভাগ পেয় থাকে। এছাড়াও যুদ্ধবাজ গোষ্ঠি নেতারা ও জঙ্গি সংগঠনগুলোও টাকার ভাগ পায়। ) যতটুকু জানা গেছে দুবাই এবং লন্ডন ভিত্তিক বেশ কিছু কোম্পানি এ কাজে জড়িত । টাকা একটি বিশেষ পানিরধক ব্যাগে ভড়ে হেলিকপ্টার দিয়ে জাহাজের কাছে পানিতে ফেলা হয়। পাইরেটদের বোট টাকা নিয়ে নিরাপদে সরে গেলে জাহাজটি ছেড়ে দেয় ।
(সোমালিয়া উপকূলে রাখা ছিনতাই করা জাহজ)
জাহাজে অবস্থানকারী নাবকদের করুন অবস্থাঃ
ছিনতাই করা জাহাজে যে সব নাবিকরা থাকেন তাদের অবস্থা খুবই করুণ । জিম্মিদশা সিনেমা / নাটকে দেখা আর বাস্তব অনেক তফাঁৎ । আমার সৌভাগ্য আমাকে এরকম পরিস্থিতির মধ্যে পড়তে হয়নি । কিন্তু যারা পড়েছিল তাদের দুজনের অভিজ্ঞতা তুলে ধরছি। সাধারণত পাইরেটদের দলনেতার উপর নির্ভর করে অনেক কিছু ।
একটি জাহাজে সবাইকে ব্রিজে আটকে রেখেছিল । প্রথম দিকে দিনে দুবার খাবার দিত । শেষের দিকে যখন জাহাজে রক্ষিত খাবার পরিমাণ কমে গিয়েছিল এক বেলা করে খেতে দিত । সবাইকে দিনে ১ মিনিট বাসায় কথা বলতে দিত । এটা কোন মানবিক কারনে নয় ।
এটাও ওদের একটা ট্রিক্স । নাবিকদের পরিবার দিয়ে জাহাজের মালিক পক্ষকে চাপে রাখা যেন তারাতারি টাকা দিতে রাজি হয় । টয়লেটে যেতে হল ওরা স্কট করে নিয়ে যেত । খুব অল্প পরিমাণে পানি বরাদ্দ ছিল সবার জন্য । অন্য জাহাজটিতে সবাইকে হাত পা বাঁধা অবস্থায় রাখত ।
টয়লেটে যেতে দিতে চাইত না । সবাইকে একটি করে বোতল ধরিয়ে দিত ছোট কাজ সাড়ার জন্য । জাহাজের ক্যাপ্টেনকে আলাদা জায়গায় বন্দি করে রেখেছিল । তাছাড়া দিনের পর দিন একটি রুমে বন্দি , কবে ছাড়া পাবে তার কোন ঠিক নাই , অসুস্থ হলে ডাক্তার মিলবে না , পরিবারের সাথে যোগাযোগ নাই । বুঝতেই পারছেন কি হতে পারে মানসিক অবস্থা ।
নাবিকদের বাসার পরিস্থিতি তোঁ আরও খারাপ । জাহান মনি আটকের পর মিডিয়াতে দেখেছেন সবাই ।
জলদস্যু দমন অভিযান
জলদস্যুদের অত্যাচারে এক রকম অতিষ্ঠ হয়েই জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে সর্বসম্মতিক্রমে আন্তর্জাতিক নৌবাহিনীর জলদস্যুদের সোমালিয়ান নৌ সীমানায় ধাওয়া করা এবং জলদস্যুদের জাহাজগুলোকে ডুবিয়ে দেয়ার আইন পাস করা হয়। তবে জলদস্যুরা শুধু সোমালিয়া থেকেই তাদের কার্যক্রম চালায় না। ইয়েমেনেও তাদের ঘাঁটি রয়েছে।
সাম্প্রতিককালে সোমালিয়া উপকূলে জলদস্যুদের উৎপাত ব্যাপকভাবে বেড়ে যাওয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে আফ্রিকার সাগর এলাকায় নিবিড় টহল কার্যক্রম শুরু হয়েছে। অত্যাধুনিক অস্ত্র ও সরঞ্জাম সজ্জিত জলদস্যু মোকাবিলায় হেলিকপ্টারসজ্জিত আন্তর্জাতিক জাহাজ এখন টহল দিচ্ছে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাগুলোতে। তবে এখন পর্যন্ত বিদেশি নৌবাহিনীর সাফল্য হাতেগোনা। গত বছর জলদস্যুরা দখল করে নিয়েছিল ফ্রেঞ্চ ইয়ট লা পোনান্ট, ৩০ জন ক্রুসহ। দুই মিলিয়ন ডলার মুক্তিপণ দেওয়া হয়।
জলদস্যুরা ইয়টকে মুক্ত করে দিলে ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। এর একটা গ্রুপ সোমালিয়ান ডেজার্ট দিয়ে পালাচ্ছিল জিপে করে। ফরাসি সামরিক হেলিকপ্টার সেটাকে আক্রমণ করে এবং জলদস্যুদেরকে আটকে ফ্রান্সে পাঠায় বিচারের জন্য। গত বছর নবেম্বরে গালফ অব এডেনে ভারতীয় যুদ্ধজাহাজ আক্রমণ করে ধ্বংস করে দেয় জলদস্যুদের একটি মাদারশিপকে। এপ্রিল মাসে যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনীর জাহাজ ইউএসএস-এ হামলা চালানোর জন্য পাঁচ সোমালীয় জলদস্যুকে অভিযুক্ত করা হয়েছে।
২০০৮ সালে ইউরোপীয় ইউনিয়নের নৌবাহিনী এসব জলদস্যুদের মোকাবিলায় ‘অপারেশন আটলান্টা’ শুরু করে, তা এখনো চলছে। পরবর্তীতে জার্মান ও ফ্রান্সের যুদ্ধজাহাজও এই অপারেশনে যোগ দেয়। কয়েকদিন আগে তারা বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির ৯০টি ত্রাণবাহী জাহাজ গন্তব্যস্থলে নিরাপদে পৌঁছে দেয়। রাশিয়া, চীন ও ভারত জলদস্যুদের দমনের জন্য ‘সম্মিলিত যৌথবাহিনী’ গঠন করে এবং এখন চলছে। এডেন সাগরে এই যৌথবাহিনী পণ্যবাহী জাহাজগুলোকে পাহারা দিয়ে নিরাপদ আশ্রয়ে পৌঁছে দেয়া ও জলদস্যুদের জাহাজে আক্রমণের কাজ করছে।
২০০৮ সালে চীনের একটি পণ্যবাহী জাহাজ ছিনতাই হলে, সেটি উদ্ধারের জন্য তাদের দুইটি যুদ্ধজাহাজ এডেন সাগরে পৌছায়। তারা জলদস্যুদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করে এবং জলদস্যুদের বেশ কয়েকটি বোট ডুবিয়ে দেয়।
২০০৯ সালে নরওয়ের নৌবাহিনীও জলদস্যুদের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করে। তাদের আক্রমণেও বেশ কয়েকটি বোট ডুবে যায়।
মার্চ ২০১০ সালে জলদস্যুরা একটি মার্কিন জাহাজ ছিনতাই করে ২৭ জন নাবিককে জিম্মি করে।
তাদের উদ্ধারের জন্য মার্কিন নৌবাহিনী অভিযান চালায় এবং দুইটি বোট ডুবিয়ে দেয়। এছাড়া ২০০৯ সাল থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত ব্রিটেন, সুইডেন, স্পেন, থায়ল্যান্ড, কোরিয়া, জাপান, ইতালি, বুলগেরিয়া, কানাডাসহ প্রায় অর্ধশতটি দেশ অসংখ্য অভিযান পরিচালনা করে।
ন্যাটো ও সমুদ্রোপকূলীয় বাহিনীর সমন্বয়ে গঠিত ইউরোপীয় ইউনিয়নের নৌবাহিনী চলতি বছর জলদস্যুদের ১২০টি হামলা ঠেকিয়েছে। ইউরোপীয় বাহিনীর হাতে চলতি বছর ৪০০ জলদস্যু আটক হয়েছে। ভারত মহাসাগরে বেশ কয়েকটি বাণিজ্য রুট জলদস্যুদের হুমকির মুখে রয়েছে।
জলদস্যুরাও বেপরোয়া
গত তিন বছরে জলদস্যুদের বিরুদ্ধে এতগুলো অভিযান এবং বিভিন্ন দেশের নৌবাহিনীগুলোর টহলদারির কারণে যে সাফল্য জমা হয়েছিল সাম্প্রতিক ঘটনাসমূহে তা ম্লান হয়ে যাওয়ার পথে। কোনঠাসা জলদস্যুরা এবার নতুন কৌশল অবলম্বন করছে। যুদ্ধজাহাজগুলোকে এড়িয়ে যাওয়ার পাশাপাশি তাদের অপারেশনের ক্ষেত্রকে সরিয়ে নিয়ে গেছে আরো দক্ষিণে। তারা হয়ে উঠেছে আগের চেয়েও অনেক বেশি আক্রমণাত্মক এবং মরিয়া। ইন্টারন্যাশনাল শিপিং এসোসিয়েশন বিমকো বলছে যে, এই আক্রমণ এখন আর শুধু গালফ অব এডেনেই সীমাবদ্ধ নেই।
ভারত মহাসাগরের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে এখন ছড়িয়ে পড়েছে জলদস্যুতা। যেখানে নাবিকরা জানত যে আটকা পড়লেও জানে বেঁচে যাবে তারা মুক্তিপণ আসলেই। এখন আর সেই নিশ্চয়তা নেই। যেহেতু জলদস্যুরা এখন প্রতিনিয়ত যুদ্ধজাহাজের মুখোমুখি হচ্ছে, কখনো বন্দী হচ্ছে, কখনো বা নিহত হচ্ছে, সেহেতু তারাও এখন আগের চেয়ে জোর খাটাচ্ছে বেশি, বেশি ভায়োলেন্ট হচ্ছে। ফলে, তাদের জিম্মিদেরকে আরো বিপন্ন করে তুলছে তারা।
‘সোমালিয়ার জলদস্যুদের তৎপরতা প্রসার ও প্রভাব উভয় দিক থেকেই পুষ্ট হয়েছে। দস্যুরা তাদের সামর্থ্য বাড়িয়েছে। বিশাল এলাকাজুড়ে তাদের প্রভাব রয়েছে। ’ সাম্প্রতিক দিনগুলোতে জলদস্যুরা তানজানিয়া ও মাদাগাস্কারেও হামলা চালিয়েছে। সেখানে আরও বড় জাহাজ ছিনতাই করে, বিশাল অঙ্কের মুক্তিপণ আদায় করে।
ভারত মহাসাগর ও আফ্রিকার বিস্তীর্ণ উপকূলজুড়ে এখন তারা ছড়িয়ে পড়েছে। সোমালিয়ার অববাহিকা ও এডেন উপসাগরে বিদেশি সামরিক বাহিনীর উপস্থিতি জলদস্যুদের আরও বেপরোয়া করে তুলছে ।
এর শেষ কোথায়
জাতিসংঘের রিপোর্ট অনুযায়ী গত বছর গালফ অব এডেনের করিডোরে ১১১ আক্রমণ হয়েছে, যা আগের বছরের তুলনায় ২০০ গুণ বেশি। ইন্টারন্যাশনাল ম্যারিটাইম ব্যুরো জানাচ্ছে যে, বিশটারও বেশি দেশের নৌবাহিনীর যুদ্ধজাহাজের উপস্থিতি সত্ত্বেও গালফ অব এডেনে গত বছরে আক্রমণের সংখ্যা বেড়েছে ।
জলদস্যুদের এড়িয়ে বাণিজ্য জাহাজগুলি পরিচালনা করা এক কথায় অসম্ভব।
কারন এশিয়ার দেশগুলো ইউরোপের সঙ্গে বাণিজ্য করতে চাইলে ভারত ও আরব উপসাগর দিয়ে সুয়েজ খাল অতিক্রম করেই কেবল ভূমধ্য সাগরে পৌঁছানো সম্ভব। আর এই পথে জাহাজগুলিকে সোমালিয়ার উপকূল অতিক্রম করতেই হবে। আর একটি পথ আছে ইউরোপ থেকে পূর্ব ও দক্ষিণ এশিয়ায় পৌঁছানোর উত্তামাশা অন্তরীপ। কিন্তু এত পথ ঘুরে বাণিজ্য করতে গেলে ব্যবসায়ে লালবাতি জ্বলার সম্ভাবনাই বেশি।
আর এ কারণেই জলদস্যুদের এড়ানোটা বেশ রকমের ব্যয়বহুল হয়ে পড়েছে শিপিং কোম্পানিগুলোর জন্য।
জলদস্যুদের এড়ানোর জন্য গালফ অব এডেন থেকে মোম্বাসা যাওয়ার জন্য সব জাহাজকেই অতিরিক্ত দুই দিন সময় নিতে হচ্ছে ঘুরপথে আসার জন্য। এছাড়া এই এলাকায় চলাচলকারী জাহাজের ইন্স্যুরেন্সের প্রিমিয়ামও হয়ে উঠেছে অনেক উচ্চ। কাজেই জাতিসংঘের সশস্ত্র পাহারা ছাড়া কোনো শিপিং কর্পোরেশনকে ঝুঁকির মধ্যে পড়ে তাদের বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানকে জাহাজ ভাড়া দেওয়ার জন্য রাজি করানো কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।