~~~কেমন যেন একটা উৎকন্ঠায় আছি....... বিপ্লব, নেপালের মাওবাদী পার্টির একজন নেতৃস্থানীয় সদস্য, উনার এই সাক্ষাৎকারটি বাবুরাম ভট্টরাই'এর নির্বাচিত হওয়ার এক সপ্তাহ আগে নেওয়া হয়েছে। সে সময়ে দলে প্রচন্ড'র ক্ষমতা কমানোর লক্ষ্যে দলের ভট্টরাই এবং কিরণ অংশের মধ্যে কৌশলগত মিত্রতা ছিল (এই মিত্রতার পিছনে যৌক্তিক কারণও ছিল)। ভট্টরাই'এর পিপলস লিবারেশন আর্মি'কে (গণবাহিনী) নিরস্ত্র ও বিলুপ্ত করার সিদ্ধান্তের পূর্ব পর্যন্ত এই কৌশলী মৈত্রী টিকে ছিল। যদিও এই সাক্ষাৎকার নেওয়ার সময় থেকে এখন পর্যন্ত নতুন কিছু ঘটনা সংযুক্ত হয়েছে, তথাপি এই সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে আমরা নেপালের সংগ্রাম ও মাওবাদী পার্টির ভেতরে আগামীদিনের বিপ্লব সম্পর্কে একটা পরিষ্কার ধারণা পেতে পারি।
(সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন “উইন্টার হ্যাস ইটস ইন্ডস”এর প্রতিনিধি, আমরা এখানে সংক্ষেপে “উইন্টার ইন্ডস” ব্যবহার করব।
)
উইন্টার ইন্ডস: খুব সূক্ষ কিছু পার্থক্য উঠে এসেছে আপনার পার্টি থেকে সেনা একীকরণের প্রশ্নে, আমাদের কাছে কী তা ব্যাখ্যা করতে পারবেন?
বিপ্লব: পিপলস লিবারেশন আর্মি (PLA) একীকরণ নিয়ে এখন আমাদের পার্টিতে দুই লাইনের সংগ্রাম বিদ্যমান। এই সংগ্রাম প্রধানত বাবুরাম ভট্টরাইকে লক্ষ্য করে হলেও এই মুহূর্তে এটা প্রচণ্ড'র উপর নিবদ্ধ হয়েছে। প্রচণ্ড দাবী করছেন যে, আমরা নেপালের প্রতিক্রিয়াশীল বাহিনীর একীকরণ প্রস্তাব গ্রহণ করে এগোতে পারি। যে পিপলস লিবারেশন আর্মি ১২ বছর যাবৎ নেপাল আর্মির বিরুদ্ধে লড়াই করে এসেছে, তারা তাকে একীকরণ নয়, বরং বিলুপ্ত করতে চায়।
ভাবতে অবাক লাগে যে, নেপাল আর্মি একীকরণের প্রস্তাব দিয়েছে! যে প্রস্তাবে নেতৃত্ব থাকে তাদের হাতে, পিপলস লিবারেশন আর্মি থাকে অধীনস্ত হয়ে আবার পিএলএ'কে ভেঙ্গেও ফেলা হয়।
পিএলএ সদস্যরা নেপালে সৈনিক হিসাবে গণ্য হবেন না, বরং প্রস্তাব অনুযায়ী, পিএলএ'কে স্থানীয় ব্যুরো থেকে সরিয়ে নিরস্ত্র বন রক্ষিবাহিনী বানানো হবে। প্রচণ্ড তাদের প্রস্তাব গ্রহণ করেছেন।
এই মূহুর্তে, পিএলএ'এর অস্ত্র কন্টেনারগুলোতেই সীমাবদ্ধ রাখা হয়েছে। নেপালি কংগ্রেস এবং ইউএমএল দলগুলোর (প্রো-ভারতীয় এবং ধনিক শ্রেণীর দল) দাবী হলো এই অস্ত্রগুলো ধ্বংস করতে হবে আর প্রচণ্ড তাদের এই অনৈতিক দাবীর সাথে সহমর্মী।
তারা পিএলএ'কে দুই দলে বিভক্ত করতে চায়, যার মাঝে বড় অংশটিকে বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়া হবে আর অপর ছোট অংশটিকে একীভুত করা হবে।
আমরা এমন একটি কূট-পরিকল্পনা গ্রহণ করতে পারি না।
আমরা মনে করি প্রচণ্ড যে লাইন ধরে এগুচ্ছেন, তা সংশোধনবাদের লাইন। আর তা আমাদের গণবাহিনী ও বিপ্লবকে নিঃশেষ করে দিবে। আমরা তা কখনোই হতে দিতে পারি না।
পিএলএ'কে একীভুত করতে হলে দু'টি বিষয়ে নির্দিষ্ট করা আবশ্যক:
১. পিএলএ'এর সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ একীভুত করতে হবে।
২. পিএলএ'কে অবশ্যই তার ইউনিটের নেতৃত্ব দিতে হবে এবং সেনাবাহিনীতে পিএলএ'কে নেতৃস্থানীয় অবস্থান দিতে হবে।
আমরা স্বতন্ত্র ইউনিট এবং সমষ্টিগত একীকরণ চাই। তারা এই বিষয়গুলো প্রত্যাখ্যান করছে, আর এই বিষয়গুলোতেই সংগ্রাম অব্যাহত আছে।
উইন্টার ইন্ডস: পূর্বে আপনি ২০১০ সালের অক্টোবরে অনুষ্ঠিত পালুংটার মিটিং-এর কথা বলেছিলেন। আপনি আমাদের বলতে পারেন কী ছিল এই পালুংটার মিটিং এবং তা আপনি কিভাবে দেখেন? পালুংটার মিটিং-এর পর থেকে পার্টিতে পরিস্থিতির কি কি উন্নয়ন লক্ষ্য করছেন?
বিপ্লব: পালুংটার'এ পার্টির বেশ বড় এক মিটিং অনুষ্ঠিত হয়।
ওই মিটিং-এ তিনটি পক্ষ উপস্থিত ছিল, কিন্তু প্রকৃত অর্থে সেখানে মাত্র দুইটি লাইন উপস্থিত ছিল (এখানে প্রচণ্ড ও বাবুরাম'কে সংশোধনবাদী বুঝানো হয়েছে)।
আমরা যুক্তি দেখিয়েছিলাম, “গণ-বিদ্রোহ ছাড়া আমাদের আর কোন পথ খোলা নাই। ” প্রচণ্ড'র যুক্তি ছিল, “গণ-বিদ্রোহ অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু আমরা শান্তি প্রক্রিয়া শেষ করে দিতে পারি না। ” বাবুরামের যুক্তি ছিল, “আমাদের অবশ্যই অন্যান্য পার্টিগুলোর সাথে আপোষ করতে হবে এবং বিদ্রোহ কখনোই সম্ভব নয়। অতএব, আমরা ভবিষ্যতে আইনি সংশোধনী দ্বারা আমাদের লক্ষ্য অর্জন করতে পারব।
”
আলোচনার ছয় দিন পর আমরা একটি তিন পয়েন্টের উপসংহারে পৌঁছাই:
১. গণ-বিদ্রোহের কোন বিকল্প নেই।
২. পার্টিকে ঐক্যবদ্ধ করা ছাড়া কোন বিকল্প নেই।
৩. পার্টিকে রূপান্তর করার কোনো বিকল্প নেই। পার্টি ভঙ্গুর অবস্থায় আছে এবং আমাদেরই না ঠিক করতে হবে। বিপ্লবী আদর্শ এবং বিপ্লবীরাই এই পার্টিকে নেতৃত্ব দিবে।
দুর্ভাগ্যবশত, প্রচণ্ড তার লাইন নিয়ে কেন্দ্র থেকে বেরিয়ে আসেন এবং তার লাইন এই সিদ্ধান্ত সমূহ গ্রহণ করেনি।
প্রচণ্ড তার সাম্প্রতিকতম ডক্যুমেন্টে “বিদ্রোহ” শব্দটিও ছিল না। এমনকি বাবুরাম ভট্টরাই পর্যন্ত এই ডক্যুমেন্টকে সংশোধনবাদী মনে করেন (একথা বলার সময় কমরেড বিপ্লব হেসে উঠেন)। প্রচণ্ড ভট্টরাইয়ের কাছে ক্ষমাও চেয়েছেন ভট্টরাইয়ের প্রতি খুব উত্তেজক আচরণের জন্য। কিন্তু ভট্টোরাই (কমরেড বিপ্লব আবারো হেসে উঠেন) আমাদের দলের নেতৃত্ব প্রচণ্ডের কাছে রাখাতেই সন্তুষ্ট ছিলেন, এটা খুবই আশ্চর্যজনক!
২৩ বছর যাবৎ আমাদের নেতৃত্ব দেওয়ার পর প্রচণ্ড প্রথম বারের মতো আমাদের মাঝে নেতৃত্ব হারান।
ডান সংশোধনবাদীতা আমাদের আমাদের পার্টিতে ছড়িয়ে পড়েছে। অদূর ভবিষ্যতেই আমরা আমাদের দলের বড় রকমের সংস্কার করতে চাই।
এই বিচ্যুতিকে প্রতিক্রিয়াশীল নেপালি কংগ্রেস এবং ইউএমএল দলগুলো ব্যবহার ব্যবহার করছে। বেশিরভাগ প্রতিক্রিয়াশীলেরাই প্রচণ্ড'র প্রশংসা করছে এবং সাধারণ মানুষকে তার লাইনকে গ্রহণ করতে উৎসাহিত করছে। তারা তাদের এই স্বপ্ন সফল করতে পারবে না।
দলের ভেতরে লাইনগুলোর এই সংগ্রাম বিপ্লব চলাকানীন সময়ে চলতেই থাকবে, কিন্তু দিন-দিন এই বিপ্লবে প্রচণ্ড'র নেতৃত্ব ক্ষীণ হয়ে আসছে। যদি পার্টি পুনর্গঠিত হয়, তাহলে আমরা একসাথে এগোতে পারব। এক সাথে না এগোতে পারলেও আগামীর বিপ্লবকে কেউ ঠেকাতে পারবে না।
উইন্টার ইন্ডস: বাবুরাম ভট্টরাইয়ের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার প্রচেষ্টাকে আপনি কিভাবে মূল্যায়ন করেন?
বিপ্লব: আমরা এখন অনন্য-সাধারণ এক সংগ্রাম করছি। ভট্টরাই সরকারের নেতৃত্ব দিতে চান, কিন্তু বিপ্লব চান না।
আমরা বিপ্লব চাই, তাই আমরা প্রচণ্ড এবং ভট্টরাইয়ের বাধাগুলো অতিক্রমের চেষ্টা করছি। আমরা আলোচনা করছি, তাদের মধ্যে কে প্রধানমন্ত্রি হলে ভাল হয়। চূড়ান্ত বিশ্লেষণে দেখা যায়, দলের নিয়ন্ত্রণ আমাদের হাতেই থাকে এবং যদি আমরা না ঠিক করি, তাহলে কেউই প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন না।
প্রকৃতপক্ষে, দু'টি লাইন প্রায় অনুরূপ। আমরা মনে করি প্রচণ্ড'র বিরুদ্ধে সংগ্রাম করাটা ভট্টরাইয়ের বিরুদ্ধে সংগ্রামের চেয়ে কঠিনতর হবে।
এজন্যই আমরা ভট্টরাইকে প্রধানমন্ত্রী হতে সমর্থন দিয়েছি।
আমরা দেখলাম যে, আমরা সমর্থন দিলে প্রতিক্রিয়াশীলেরাও বাবুরাম ভট্টরাইকে সমর্থন দেওয়ার কথা বলেছে। কিন্তু আমরা ভট্টরাইকে সমর্থন দেওয়ার পর হঠাৎ করেই তারা প্রচণ্ড'র সমর্থনে এগিয়ে আসলেন। এটি বেশ মজার, কিন্তু তাদের হস্তক্ষেপ কখনোই গ্রহণযোগ্য নয়।
প্রচণ্ড বা ভট্টরাই, যেই প্রধানমন্ত্রি হোন না কেন, এতে পার্থক্য খুবই সামান্য।
সাধারণ মানুষকেই নেপালি সমাজকে নেতৃত্ব দিতে এগিয়ে আসতে হবে।
আমরা মনে করি, সত্য হলো সংবিধান (সিএ) বিলুপ্ত হচ্ছে না। রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা নৈরাজ্যকে উজ্জীবিত রাখে এবং এভাবেই সংবিধান বিলুপ্ত হয়... এটা সত্য নয়।
বিদেশী এবং প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিগুলো বরং একটি আপসকামী সংবিধানের জন্য তিন মাস অপেক্ষা করবে (বিপ্লব এবং কিরণ দ্বারা সমর্থিত একটি বৈপ্লবিক নয়া গণতান্ত্রিক সংবিধানের পরিবর্তে) এবং এই মধ্যবর্তী সময়ে মানুষের বিপ্লবী চেতনাকে বিভক্ত করার কাজে ব্যবহার করবে। চূড়ান্ত বিশ্লেষণে দেখা যায় যে, তাদের কূটচাল ফলে যায়, যা একটি পরিস্থিতিকে খারাপের দিকেই নিয়ে যায়।
আমরা একটা আপসকামী সংবিধান কখনোই গ্রহণ করব না। হয় আমরা একটি গণ-মানুষের সংবিধান চাই, অথবা আমরা আরো একটা বিপ্লব চাই।
এক দিকে, আমাদের মধ্যে লাইনে সংগ্রামই প্রধান বিষয়বস্তু, এবং অপরদিকে আছেন ভট্টরাই এবং প্রচণ্ড, যারা মনে করেন উপরি-কাঠামো বিপ্লব করা যায়। এই লাইনের সংগ্রাম উপসংহারে উপনীত হবে। সুপার-স্ট্রাকচার, বা উপরি-কাঠামো থেকে বিপ্লব করা আমাদের দৃষ্টিতে অসম্ভব।
বিপ্লব করতে হলে বুর্জোয়া অবস্থান, বা কারণগুলোর উপর নির্ভর না করে আমাদের অবশ্যই বিপ্লবী কারণগুলোকে সচল করতে হবে। ।
অনুবাদ: শাহেরীন আরাফাত
মুল লেখা
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।